এই লেখার মূল উদ্দেশ্য 'ঈশ্বর' নামক ধারণাটির ইতিহাস বর্ণনা। ঈশ্বর বাস্তবে থাকুক বা না-ই থাকুক মানুষের ধারণায় আছে—এই ধারণার ইতিহাসই বলব। বাস্তবে ঈশ্বর আছেন কি-না সেই আলোচনাও ধারণার ইতিহাসের মধ্যেই প্রোথিত, কারণ ঈশ্বর এসে কাউকে বলে যাননি যে তিনি আছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে সবাই নিজেদের স্মৃতি, যুক্তি বা কল্পনা দিয়ে ঈশ্বর আছেন কি-না তা বুঝার চেষ্টা করেছে। অবতীর্ণ বাণীও আক্ষরিক অর্থে অবতীর্ণ নয়, বরং উৎসারিত। স্মৃতি, যুক্তি, ও কল্পনার মধ্যে প্রথমে যুক্তি নিয়ে কথা বলব। বিজ্ঞান যুক্তির (রিজন) অন্তর্ভুক্ত, আর দর্শন মানবিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। দার্শনিকরা কিভাবে যুগে যুগে ঈশ্বরের ধারণাটি সূত্রায়িত ও পুনঃসূত্রায়িত করেছেন তা-ই প্রথমে আলোচনা করব। ফোকাস থাকবে মূলত পাশ্চাত্য দর্শনের উপর, তবে ভবিষ্যতে ভারতীয়, চৈনিক, ও ইসলামি বিশ্বে দর্শনের কিছু জিনিসও যুক্ত হবে।
অ্যান্টনি কেনি'র A New History of Western Philosophy বইটি আমার পথপ্রদর্শক। আসলে এই লেখাটা ~৯০% কেনি'র কথা আর ~১০% আমার কথার জগাখিচুরি; তবে কেনি'র ~৯০ শতাংশের মধ্যে আবার ~৬০% ই বিভিন্ন দার্শনিকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতির শেষের তথ্যসূত্রগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা এখান থেকে জেনে নিতে পারেন; আর সূত্র অনুযায়ী বই খুঁজে পেতে এই ওয়েবসাইটটি বিশেষ কাজে লাগতে পারে।
হোমারের ইলিয়াড আর অডিসিতে দেবতা আর মানুষে প্রভেদ খুব কম—আসলে একমাত্র পার্থক্য মানুষ মরণশীল আর দেবতারা অমর। মানুষের মতোই গ্রিক দেবতাদের হিংসা, বিদ্বেষ, রেষারেষি, ক্রোধ, কামার্ততা ইত্যাদি আছে। প্রায় সব বহুদেববাদী ধর্মের দেবতাদের মধ্যেই এ ধরনের দোষ দেখা যায়, এবং একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর ঈশ্বরের মাঝেও মানবীয় বৈশিষ্ট্যের অভাব নেই। এ ধরনের মানবীয় দোষ- বা গুণাবলিতে পরিপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণাকে আক্রমণের মধ্য দিয়েই প্রাচীন গ্রিসে 'প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের' জন্ম হয়েছিল, যা ছিল ঈশ্বরকে বুঝার প্রথম দার্শনিক প্রচেষ্টা। এবং কাজটা শুরু করেছিলেন Xenophanes।
জেনোফানিস (৫৭০–৪৭৫ খ্রি-পূ) হোমার দিয়ে শুরু করেছিলেন। তার অভিযোগ হচ্ছে, হোমার (খ্রি-পূ ৮/৯ম শতক) দেবতাদের উপর চুরি, প্রতারণা, ব্যভিচারের মতো মানবীয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছেন যার সবগুলোই ঘৃণ্য। এর পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কৃতির দেবতাদের সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করার পর তিনি ভেবেছিলেন: মানুষ নিজের আদলে ঈশ্বর তৈরি করে, ইথিওপিয়ানদের ঈশ্বর কালো ও নাক-বোচা, আর থ্রেসিয়ানদের (বর্তমান বালকানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ) ঈশ্বর লাল চুল ও নীল চোখওয়ালা, ঠিক সে জায়গার মানুষের মতো। তার একটা বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে:
"যদি গরু ঘোড়া বা সিংহের হাত থাকত এবং তারা আঁকতে পারত, তাহলে ঘোড়ারা ঘোড়ার মতো ঈশ্বর আঁকত, গরুরা আঁকত গরুর মতো, তাদের ঈশ্বরের রূপ হতো তাদেরই মতো" [KRS 169]।
মানুষের রূপে দেবতাদের কল্পনা করার এই ব্যাপারটিকে বর্তমানে anthropomorphism বলা হয়। এর বিপরীতে জেনোফানিস "এক" ঈশ্বরের কথা বলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন:
এক ঈশ্বর, সব দেবতা ও মানুষের প্রভু,
দেহ, মন কোনোকিছুতেই নশ্বরদের মতো নয়। [DK 24 B23]
জেনোফানিসের ঈশ্বর কেবল একটিই থাকতে পারে। কারণ ঈশ্বর সবচেয়ে শক্তিমান, কিন্তু একাধিক ঈশ্বর থাকলে কেউই সবার চেয়ে শক্তিমান হতে পারবে না, কেউই যাচ্ছেতাই করতে পারবে না, প্রত্যেকের ক্ষমতাকে আটকানোর জন্য অন্য ঈশ্বর থাকবে। এরিস্টটল মেলিসোস, জেনোফানিস, ও গোর্গিয়াসকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে বলেছিলেন: জেনোফানিসের ঈশ্বরের জন্ম হওয়া সম্ভব না, বরং তাকে হতে হবে চিরন্তন, কারণ জন্মাতে হলে তাকে হয় তার মতো কিছু থেকে জন্ম নিতে হবে যা অসম্ভব (যেহেতু তার মতো কিছু নেই), বা তার চেয়ে ভিন্ন কিছু থেকে জন্ম নিতে হবে যা-ও অসম্ভব (যেহেতু তার চেয়ে ভিন্ন কিছু তার চেয়ে কম শক্তিমান এবং ছোট কিছু থেকে বড় কিছুর জন্ম হতে পারে না) [976b14–36]। ঈশ্বর জীবন্ত, কিন্তু মানুষ বা প্রাণীদের মতো জৈব সত্তা নয়। ঈশ্বরের কোনো অংশ নেই; দৃষ্টি, শ্রবণ, চিন্তা সব ক্ষমতাই তার মধ্যে অবিচ্ছেদ্যভাবে প্রোথিত। বিশ্বের কোনোকিছুর সাথে ঈশ্বরের বস্তুগত সংযোগ নেই, তিনি "বহুদূরে থেকে কেবলমাত্র তার মনের মাধ্যমে অনায়সে সবকিছু চালনা করেন" [DK 21 B25]।
এই ধারণাগুলোর পক্ষে যুক্তি দিলেও জেনোফানিসের ঈশ্বরধারণা সার্বিকভাবে না-বোধক ছিল। ঈশ্বরের প্রতিটি গুণের পক্ষে বা বিপক্ষেই তিনি যুক্তি ভাবতে পেরেছিলেন, এবং কোনটি সত্যি তা জানা অসম্ভব মনে করেছিলেন। ঈশ্বর সসীম না-কি অসীম, পরিবর্তনশীল না-কি অপরিবর্তনীয় তা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব নয়। তার ঈশ্বর একেবারে অতীন্দ্রিয় না-কি তার মহাবিশ্ব সম্পর্কিত ধারণার মধ্যেই ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। অবশ্য তিনিই বলেছিলেন, "দেবদেবী সম্পর্কিত স্পষ্ট সত্য কোনো মানুষ কোনোদিন দেখেনি এবং কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না" [DK 21 B34]।
জেনোফানিস অবশ্যই প্রথম একেশ্বরবাদী ছিলেন না। তার অনেক আগে মিশরের ফারাও আখেনাতেন সূর্যদেবতাকে একেশ্বর বলেছিলেন, আর তার কিছুকাল আগের ইসরায়েলি হিব্রু নবিরাও একেশ্বরবাদী ছিলেন। কিন্তু তাদের সাথে জেনোফানিসের বড় পার্থক্য হচ্ছে তারা তাদের সত্য অবতীর্ণ বাণীর মাধ্যমে পেয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন, যেখানে জেনোফানিস তার সত্য কেবল যুক্তির মাধ্যমে উদ্ঘাটন করেছেন। সুতরাং জেনোফানিসের মাধ্যমেই ধর্মতত্ত্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে: অবতীর্ণ ধর্মতত্ত্ব আর প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব। জেনোফানিস ছিলেন প্রথম প্রাকৃতিক ধর্মতাত্ত্বিক।
প্লেটো তার 'রিপাবলিক' বইয়ে জেনোফানিসের সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, হোমার ও হেসিয়ড (~৭০০ খ্রি-পূ) ঈশ্বরের উপর জঘন্য সব অসদ্গুণ আরোপ করেছে, এবং স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে এসব বাদ দেয়া উচিত, কারণ এগুলো মানুষকে অসততার দিকে ঠেলে দেয়। তার মতে, শিক্ষার্থীদেরকে দেবতায় দেবতায় যুদ্ধ বা দেবতাদের মানবরূপ বা জন্তুরূপ ধারণের কাহিনী শোনানো উচিত না [377e–381d]। প্লেটোর ঈশ্বর পরমশুভ। জীবনের শুধু ভালো জিনিসগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে এবং ঈশ্বর যদি কাউকে শাস্তি দেয় সেটা তার ভালোর জন্যই [379c–380b]। ঈশ্বর অপরিবর্তনীয়, এবং মিথ্যাচার বা ছদ্মবেশ ধারণের মাধ্যমে কাউকে বিভ্রান্ত করেন না [382e]।
হোমারের মতো একজন কবির উপর প্লেটোর সাঁড়াশি আক্রমণ আমাদের কাছে বড্ড বাড়াবাড়ি মনে হয়। কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রাখলে ব্যাপারটা এত অতিরঞ্জিত মনে হবে না। গ্রিকরা 'আহলে কিতাব' ছিল না, তাদের কোনো অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ ছিল না। সুতরাং তোরাহ, বাইবেল, বা কুরআনের যে কর্তৃত্ব আছে সেটা হোমারকাব্যের অবশ্যই ছিল না। কিন্তু তাই বলে 'ইলিয়াড', 'অডিসি', বা 'থিওগনি' গ্রিকদের কাছে আমাদের রূপকথার গল্পের মতো বিষয়ও ছিল না। মুসা, যিশু, বা মুহাম্মাদের মতো না হলেও হোমারের একটা প্রভাব তৎকালীন গ্রিক সমাজে ছিল এবং বিশেষ করে গ্রিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে হোমারের উপস্থিতি ছিল প্রকট। সমাজের ধর্মাচরণে যেহেতু এসব পুরাণের একটা প্রভাব ছিল সেহেতু প্লেটোর আক্রমণের কারণটা বুঝা যায়। এবং এটা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ ছিল, যেখানে তার গুরু সক্রেটিসকে কিছুদিন আগেই তরুণদেরকে প্রতিষ্ঠিত দেবতায় বিশ্বাস না করতে বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল [Apology. 26b]।
সক্রেটিসকে নতুন দেবতা উদ্ভাবনের অপরাধেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এর কারণ বোধহয় সক্রেটিসের 'দাইমন' (যেখান থেকে ইংরেজি demon শব্দটা এসেছে)। সক্রেটিস বলতেন যখন তিনি কোনো বড় ব্যাপারে ভুল পথে চলে যেতে থাকেন তখন তার দাইমন, তথা অন্তর্দেবতা এসে তাকে সতর্ক করে দিয়ে যান [Apology. 40b], দাইমনের কারণেই সক্রেটিস বড় কোনো ভুল করেন না। সক্রেটিস প্রচলিত ধর্মকে অশ্রদ্ধা করেছেন বলা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন তিনি সবকিছুকেই করেছেন—অন্য আট দশটা গুণের অর্থ না জানার দাবি তিনি যেভাবে করেছেন, ঠিক সেভাবেই ধার্মিকতার অর্থও জানেন না বলে দাবি করেছেন। প্লেটোর 'ইউথিফ্রো' সংলাপে সক্রেটিসকে ধার্মিকতার সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়।
সক্রেটিস ধার্মিকতা কী জানতে চাইলে ধর্মজীবী ইউথিফ্রো বলেন "যা দেবতারা ভালবাসে" তা-ই ধার্মিকতা বা পুণ্যতা। সক্রেটিস প্রশ্ন করেন: দেবতারা ভালবাসে বলে কোনোকিছু পুণ্য হয়, না কি কোনোকিছু পুণ্য বলেই দেবতারা তা ভালবাসে? ইউথিফ্রো দ্বিতীয়টার পক্ষে সায় দেয়: পুণ্য বলেই কোনো জিনিস দেবতাদের ভালবাসার পাত্র হয়, উল্টোটা নয়। এই প্রেক্ষিতে সক্রেটিস 'দেবতারা যা ভালবাসে' তার প্রতিশব্দ হিসেবে 'দৈব' শব্দটি ব্যবহার করেন। ইউথিফ্রোর দ্বিতীয় উত্তরে 'পুণ্যের' বদলে 'দৈব' ব্যবহার করলে পাওয়া যায়:
(ক) দেবতারা দৈব জিনিস ভালবাসে কারণ তা দৈব।
অন্যদিকে প্রথম উত্তরে এই কাজটি করলে পাওয়া যায়:
(খ) দৈব জিনিস দৈব কারণ দেবতারা তা ভালবাসে।
সক্রেটিসের মতে এই কথা দুটো পরস্পরবিরোধী এবং এ কারণে তিনি ইউথিফ্রোকে তার পুণ্যের সংজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে বলেন [10a–11b]।
কিন্তু আসলে কথা দুটো পরস্পরবিরোধী নয়। দুটো বাক্যে 'কারণ' শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ধরে নেয়া যায়। (ক)-তে দেবতাদের অভিপ্রায় বলা হচ্ছে, আর (খ)-তে সংজ্ঞার শর্তটি বলা হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে।
(গ) বিচারক বিচার করেন কারণ তিনি বিচারক
(অর্থাৎ তিনি এটা করেন কারণ এটাই তার চাকরি) কথাটা সত্য, এবং একইসাথে
(ঘ) বিচারক একজন বিচারক কারণ তিনি বিচার করেন
কথাটাও সত্য; এখানে তাকে কেন বিচারক বলা হয় সেটা জানানো হচ্ছে। ইউথিফ্রো অবশ্য স্ববিরোধিতা মেনে নিয়ে তার সংজ্ঞা থেকে সরে এসে আরেকটা সংজ্ঞা দেন: পুণ্যতা হচ্ছে দেবতাদের সেবায় সুবিচার। সক্রেটিস এটাও সাথে সাথে উড়িয়ে দেন: দেবতাদেরকে আমরা কী সেবা দিতে পারি? যেখানে দেবতাদেরকে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছুই আমাদের নেই সেখানে তাদের সাথে লেনদেনের চেষ্টা করাটা কত হাস্যকর সক্রেটিস তা-ই বুঝানোর চেষ্টা করেন [14e–15a]। প্লেটো সক্রেটিসকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন তা যদি আসলেই বাস্তবানুগ হয় তাহলে এথেন্সের ধার্মিকরা কেন সক্রেটিসের উপর ক্ষেপেছিল তা বুঝাই যায়। পাশাপাশি এই বইগুলো লেখার জন্য প্লেটোর সাহসেরও তারিফ করতে হয়।
আরেকটি সক্রেটিক সংলাপে সক্রেটিসকে প্রার্থনা নিয়ে কটাক্ষ করতে দেখা যায়। ইংরেজিতে 'সেকেন্ড অ্যালসিবায়াডিস' নামে পরিচিত এই সংলাপটি প্লেটোর লেখা কি-না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এতে সক্রেটিস বলেন, আমরা প্রার্থনার মাধ্যমে যা চাই তা আমাদের জন্য আসলেই ভালো হবে কি না তা আমরা জানি না, সুতরাং প্রার্থনাটা মঞ্জুর হলে হয়ত আমাদের জন্য বিশাল বিপর্যয়ের কারণ হবে। যেহেতু আমাদের জন্য কী ভালো তা আমরা জানি না সেহেতু প্রার্থনা না করাই উত্তম, বা স্পার্টানদের মতো ভালো কি সেটা বলে না দিয়ে 'যাহা ভালো তাহার' জন্যই প্রার্থনা করা উচিত, অর্থাৎ ভালো-খারাপ নির্ধারণের ভার দেবতার উপরই ছেড়ে দেয়া উচিত [148c]। প্রার্থনা ও কোরবানির দিক দিয়ে এথেনীয়রা স্পার্টানদের চেয়ে অনেক বেশি ধার্মিক, তারপরও সব যুদ্ধে কেবল স্পার্টানরা জিতে কেন? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? সক্রেটিস বলেন, "দেবতারা যদি আমাদের আত্মা এবং তার মধ্যে বিরাজমান পুণ্যতা ও ন্যায়পরায়ণতার চেয়ে আমাদের কোরবানি ও উপঢৌকনকে বেশি প্রাধান্য দেয় তাহলে ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত ও দুঃখজনক হবে" [150a]।
প্লেটোর ধর্ম ও অধিবিদ্যা বিষয়ক ধারণা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। 'রিপাবলিক' সংলাপের আলোচ্য বিষয় 'গড' নয়, 'গুড' তথা 'শুভ'। আমাদের এই 'আবির্ভবনের' (becoming) বিশ্বে সূর্য যে ভূমিকা পালন করে, পরম 'বিরাজনের' (Being) বিশ্বে শুভ সেই ভূমিকা পালন করে [508c–e]। সব সত্তা (being) তাদের অস্তিত্বের জন্য এই পরমশুভের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু পরমশুভ নিজে সব সত্তার ঊর্ধ্বে [509b]। একইভাবে 'সিম্পোজিয়াম' সংলাপে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে 'সুন্দর'-কে। এতে যাজিকা দিওতিমা একেবারে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে সক্রেটিসকে আত্মার সুন্দরাভিমুখী মহাযাত্রার কথা বলেন। মানুষ অমরত্ব চায়, অমরত্বের জন্যই বংশবৃদ্ধি করে, বাচ্চা লালন-পালন করে, ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো কাজ করতে চায়, মরার আগে চিরস্থায়ী মূল্য আছে এমন কিছু করে যেতে চায়। এই সবকিছুকেই 'প্রেমের' (Eros) পশ্চাদ্ধাবন বলা যায়, কিন্তু এগুলো আসলে নিম্নতর প্রেম। প্রেমের মহত্তর রহস্যের সন্ধান পেতে হলে মানুষকে সুন্দর দেহ, সুন্দর আত্মা, বিজ্ঞান ও প্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্য, ইত্যাদি সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে চিরন্তন ও চির-অপরিবর্তনীয় পরমসুন্দরের পানে ধাবিত হতে হবে। দৈব, ঐশ্বরিক, পরম, নির্ভেজাল সুন্দরের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানই কেবল মহত্তম জীবন তৈরি করতে পারে। মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অমরত্ব লাভ হতে পারে কেবল এই প্রেমযজ্ঞের মাধ্যমেই [206b–212a]।
ধর্মীয় ভাবধারায় লেখা হলেও 'সিম্পোজিয়ামে' কোনো ব্যক্তিক ঈশ্বরের আইডিয়া আছে বলা যাবে না; সুন্দরের আইডিয়াটি শেষ পর্যন্ত 'রিপাবলিকের' শুভর আইডিয়ার মতোই নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু 'সোফিস্ট' সংলাপে আইডিয়ার নৈর্ব্যক্তিকতাই 'আইডিয়া তত্ত্ব' পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছিল। প্লেটোর আইডিয়া তত্ত্বের মূলকথা হচ্ছে, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ত্রুটিপূর্ণ এবং এর বাইরে একটি ত্রুটিহীন, চিরন্তন, চির-অপরিবর্তনীয় স্বরূপ (Form) বা আইডিয়ার (ἰδέα) জগৎ আছে, এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ তার অস্তিত্বের জন্য আইডিয়া-জগতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আইডিয়া বলতে আমরা যেমন কেবলমাত্র মানসিক ধারণা বুঝি, প্লেটোরা তেমন বুঝতেন না; আইডিয়ার বাস্তব উপস্থিতিও তাদের কাছে অসম্ভাব্য ছিল না। 'সোফিস্ট' সংলাপে এলেয়াবাসী অজ্ঞাত চরিত্রটি বাস্তব আইডিয়ার জড়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে: "আমরা কি এত সহজেই মেনে নিব যে সবচেয়ে নিখুঁত সত্তাটির মধ্যে পরিবর্তন ও জীবন, আত্মা ও প্রজ্ঞা নেই, এবং সে জীবন্তও নয়, চিন্তাও করে না, বরং গতিহীন, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, ও পবিত্র, অথচ তার কোনো মন নেই?" [248e]।
প্লেটো যখন 'টিমেয়াস' সংলাপটি লিখছেন ততদিনে প্রায় একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর ঈশ্বরের মতো একটি ব্যক্তিক ঈশ্বরের আইডিয়াতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই সংলাপের বিষয় আমাদের বিশ্বের উৎপত্তি: এটি কি চিরকাল ছিল, না কি আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্বটা যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সেহেতু তার আবির্ভবন ঘটতেই হবে, কিন্তু "এই মহাবিশ্বের নির্মাতা ও পিতাকে খোঁজা" [28c] কোনো সহজ কাজ নয়। আর সেরকম সত্তা কেনই বা মহাবিশ্বের আবির্ভাব ঘটাবে? "স্রষ্টা শুভ, এবং যে শুভ তার কোনো ঈর্ষা থাকতে পারে না, আর যার ঈর্ষা নেই সে সবকিছু তার মতো হোক তা-ই চাইবে" [29e]। তাহলে ঈশ্বর কেন তার চেয়ে নিকৃষ্ট হাজারটা জিনিস তৈরি করলেন? কিন্তু এখানেই প্লেটোর ঈশ্বরের অভিনবত্ব। তার ঈশ্বর নিকৃষ্ট কিছু তৈরি করেননি, বরং ইতিমধ্যে বিরাজমান নিকৃষ্টতার মধ্যে যথাসাধ্য উৎকৃষ্টতার বীজ রোপণ করেছেন।
সন্ত টমাস একুইনাস Summa contra gentiles বইয়ে ঈশ্বরকে শূন্য থেকে বিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু প্লেটোর ঈশ্বর বিশ্ব শূন্য থেকে তৈরি করেননি, করেছেন ইতিমধ্যে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। "ঈশ্বর চেয়েছিলেন সব শুভ হোক, এবং কোনোকিছুর মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো ত্রুটি না থাকুক, তাই তিনি যখন দেখলেন দৃশ্যমান মহাবিশ্ব অস্থির, এবং বেসুরো ও বিশৃঙ্খলভাবে গতিশীল, তখন তাকে বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসেন, যে অবস্থা তার কাছে সব দিক দিয়ে উৎকৃষ্টতর মনে হয়েছিল" [30a]। 'টিমেয়াসে' এরপর এই শৃঙ্খলায়নের পুরো প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হয়: প্রথমে আত্মা ও তার পরে পদার্থ সৃষ্ট হয়, এবং স্বর্গের দৃশ্যমান পদার্থের মাঝে আত্মার আবির্ভাব ঘটে [34e, 36e]। মহাবিশ্বে চার ধরনের জীবন্ত জিনিস আছে: দেবতা, পাখি, মাছ, ও প্রাণী [40a]। বলা হয়, দেবতা দুই ধরনের: দৃশ্যমান ও অদৃশ্য। দৃশ্যমান দেবতা হচ্ছে আকাশের স্থির, চিরন্তন নক্ষত্রেরা। আর অদৃশ্য দেবতা কেবল মাঝে মাঝে মানুষকে দেখা দেয় এবং কাকে দেখা দেবে তা দেবতাই ঠিক করে [40b, 41a]। মহাবিশ্বের পিতা এই দেবতাদের উপর নিকৃষ্টতর জীব নির্মাণের ভার দেন। মানুষের উৎকৃষ্ট আত্মা মহাপিতাই তৈরি করেছিলেন, কিন্তু সেই আত্মাকে একটি খুলির ভিতরে স্থাপন এবং তার নিচে একটি নিকৃষ্ট দেহ সংযোজনের দায়িত্ব ছিল দেবতাদের উপর [69c–d]।
সংলাপটির শেষে গোটা মহাবিশ্বকেই একটি একক জীব ও দৃশ্যমান দেবতা বলা হয়, যে জীব তার পিতার প্রতিচ্ছবি, যে পিতাকে কেবল মনের মাধ্যমেই বুঝা সম্ভব [92c]। প্লেটোর গল্পে 'টিমেয়াসের' আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয় 'রিপাবলিকের' আলোচনার পরের দিন। আগের দিন সক্রেটিসের সমাজ কাঠামো বিষয়ক আলোচনা যারা শুনেছে, আজকে তারা বিনিময় হিসেবে গোটা মহাবিশ্বের একটা কাঠামো সক্রেটিসের সামনে তুলে ধরতে চায়, চূড়ান্ত উদ্দেশ্য সমাজ ও মহাবিশ্বের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ। সুতরাং টিমেয়াসের কথা কতটুকু প্লেটোর দার্শনিক অভিব্যক্তি আর কতটুকু পৌরাণিক সাহিত্য তা-ও মাথায় রাখতে হবে। প্লেটো গল্পের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেই আবার অনিন্দ্য সুন্দর সব গল্প ফেঁদেছেন, তাই তার কোন্ কথা আক্ষরিক আর কোন্ কথা রূপক তা নির্ধারণ একটু জটিলই বটে। তবে 'টিমেয়াসের' পৌরাণিক মালমশলা বাদ দিলে তার যে কঙ্কালটি থাকে তাকে প্লেটোর নিজস্ব ভাবনাই মনে করা উচিত। এবং মহাবিশ্বের পুরো কাঠামো বলে দেয়া আছে বলেই বোধহয় এই ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্তও প্লেটোর সবচেয়ে জনপ্রিয় সংলাপ ছিল 'টিমেয়াস'। 'রিপাবলিকের' অতি-জনপ্রিয়তা খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা।
প্লেটোর শেষ সংলাপ Laws-এ ধর্মের উপস্থিতি প্রকট, দশম খণ্ড পুরোটাই ধর্ম নিয়ে। এখানে তিনি 'Magnesia' নামে একটি আদর্শ নগররাষ্ট্রের কল্পনা করেন। ম্যাগনেসিয়াতে অধার্মিকের কোনো স্থানই যেন নেই; ভাব দেখে মনে হয় প্লেটোকে শেষ বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছিল। ম্যাগনেসিয়াতে নাস্তিকদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান থাকে। নগরটির ৫৮ নম্বর আইনে বলা হয়, কোথাও কোনো অধার্মিকতা দেখলে সাথে সাথে নগর কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে হবে। অধার্মিকতার শাস্তি ৫ বছর নিঃসঙ্গ কারাবাস, এবং কারামুক্তির পর যদি সে তার আগের অবস্থানে ফিরে যায় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। নাস্তিকরা যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দাবি করে তাহলে তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে হবে [907e–909c]।
তবে ম্যাগনেসিয়ার আইন প্রণেতারা মনে করেন আইন মানানোর জন্য শাস্তির চেয়ে যুক্তি প্রদর্শন ও বুঝানো বেশি কার্যকরি। তাই এই ভয়ানক শাস্তিগুলোর কথা বলার আগে তারা বলে নেন:
"যে ব্যক্তি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত দেবতাদের উপর বিশ্বাস রাখে সে কখনো অধার্মিক কাজ করতে পারে না, বা বেআইনি কথা বলতে পারে না। যদি কেউ এগুলো করে তাহলে বুঝতে হবে তার তিনটি ত্রুটির কোনো না কোনোটি আছে। হয় সে দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না; নয় অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও মনে করে মানবজাতির ব্যাপারে দেবতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই; আর নয়ত মনে করে দেবতাদেরকে প্রার্থনা ও কোরবানির মাধ্যমে জয় করে নেয়া সম্ভব।" [885b]
যারা এই তিন ত্রুটির কোনোটাতে পতিত তাদেরকে বিপরীত যুক্তি দিয়ে পথে আনার দায়িত্ব আইন প্রণেতাদেরই। দেবতাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য মহাবিশ্বের অপার সৌন্দর্য বা ঋতুর অমোঘ চক্রের কথা বলা মোটেই যথেষ্ট নয়। কারণ নাস্তিকরা বলবে সূর্য, চাঁদ, বা নক্ষত্রগুলো নিরেট মাটি ও পাথর দিয়েই তৈরি, এবং সব মৌলিক পদার্থ ও তাদের যৌগিক সন্নিবেশের জন্য প্রকৃতি ও ঘটনাচক্রই দায়ী [886d, 889a]। গ্রিক ও বর্বর নির্বিশেষে সবাই দেবতায় বিশ্বাস করে বলাও যথেষ্ট নয়, কারণ নাস্তিকরা মনে করে এসব বিশ্বাস শৈশব থেকে মাথায় ঢুকাতে থাকা মন্ত্রণার ফলাফল, আর তাছাড়া দেবতাদের প্রকৃতি নিয়ে কোনো ঐকমত্যও নেই [887c, 889e]।
প্লেটো বলেন, নাস্তিকদের যুক্তি খণ্ডানোর জন্য আরো ঘোরা পথে আসতে হবে। যারা মনে করে এলোপাতাড়ি বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের বিশ্বের আসবাবপত্র গঠিত হয়েছে তাদের প্রধান ভুল হচ্ছে তারা দেহের উপর আত্মার পূর্ববর্তিতা বুঝতে পারেনি। দেহের অনেক আগে আত্মা সৃষ্ট হয়েছে, এবং সব ভৌত বস্তুর উন্নয়ন ও রূপান্তর আত্মার কারণেই ঘটে [892a]। বিভিন্ন ধরনের গতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সংলাপে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন প্লেটো। তার মতে দশ ধরনের গতি আছে, কিন্তু প্রধান ধরন দুটি: (ক) যা অন্যের মধ্যে গতি সঞ্চার করে, কিন্তু নিজে আবার অন্যের দ্বারাই গতিশীল হয়, এবং (খ) যা নিজের এবং অন্যের সবার মধ্যেই গতি সঞ্চার করতে পারে। নিশ্চয়ই (ক) ধরনের গতি মহাবিশ্বের সব গতির আদিসঞ্চারক হতে পারে না, বরং মহাবিশ্বে গতি শুরু হতে হবে কোনো আত্মঘটিত গতির মাধ্যমে। কিন্তু আত্মঘটিত গতি আত্মারই নামান্তর: কেননা 'জীবিত জিনিসের' সংজ্ঞাই হচ্ছে 'যা নিজেকে নড়ায়' [894c–896a]।
সুতরাং প্লেটোর মতে আত্মা দেহের পূর্ববর্তী, এবং আত্মা বা আত্মারাই স্বর্গ নিয়ন্ত্রণ করে। যদি প্রশ্ন করা হয় আত্মা কিভাবে সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে Laws থেকে তিনটি সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায়: হয় সূর্যের নিজেরই একটি আত্মা আছে যা তার গোলকের মধ্যে থাকে, ঠিক যেমন আমাদের আত্মা আমাদের দেহের ভিতরে থাকে; বা অন্য কোথাও একটি আত্মা আছে, যার নিজের একটি দেহও আছে, এবং যে সূর্যের সাথে সংযুক্ত থেকে তাকে তার কক্ষপথে ঘোরায়; কিংবা আত্মা একেবারেই অশরীরী এবং কোনো না কোনো আধ্যাত্মিক বলের মাধ্যমে সূর্যকে তার পথে পরিচালনা করে। যেভাবেই কাজটা করুক না কেন, আত্মাটি নিঃসন্দেহে এক ধরনের দেবতা, এবং থেলিস বিশ্বটা দেবতায় পরিপূর্ণ বলে ঠিকই করেছিলেন [898e–899b]।
এরপর যারা মনে করে দেবতারা মানুষ নিয়ে মাথা ঘামায় না, বা দেবতাদেরকে প্রার্থনা ও কোরবানি দিয়ে প্ররোচিত করা সম্ভব তাদের যুক্তি খণ্ডাতে হবে। দেবতারা মানুষ নিয়ে চিন্তিত না ভাবার পিছনে প্রধান কারণ: পৃথিবীতে খারাপ মানুষেরাও অনেক উন্নতি করতে পারে। প্লেটোর দেবতা মহাপ্রাজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরমশুভ; অশুভের কুকর্ম দেখে কিছু না করে চুপ করে বসে থাকার মতো আলস্য তাদের ভর করতে পারে না। দেবতারা যদি আসলেই আমাদের প্রয়োজন পূরণ না করে তাহলে হয় তারা এ সম্পর্কে জানে না, কিংবা অন্য কিছুর প্রলোভনে তাদেরকে এই জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করছে। কিন্তু এটা হতেই পারে না: হাজার হোক গোটা মহাবিশ্ব সৃষ্টির তুলনায় আমাদের টুকটাক প্রয়োজন মেটানো তো দেবতাদের কাছে নিতান্ত তুচ্ছ কাজ [899d–903a]।
তাহলে অশুভের আস্ফালনের কারণ কী? প্লেটোর মতে অশুভের হম্বিতম্বি সাময়িক। মহান ঐশ্বরিক পরিকল্পনায় একটু আধটু অশুভেরও স্থান আছে: কিন্তু অসৎ কাজ করে কেউ আজীবন পার পেয়ে যেতে পারবে না, তা সে স্বর্গেই উড়াল দিক আর নরকেই আত্মগোপন করুক [905a]। আর যারা মনে করে উপঢৌকন ও প্রার্থনা দিয়ে শাস্তি থেকে বাঁচা সম্ভব তাদের ভাবখানা এমন যেন দেবতারা ভেড়াপালকের সহকারী কুকুর যাকে নেকড়েরা ঘুষ দিয়ে হাত করে নিতে পারে [906b]।
প্লেটোর ম্যাগনেসিয়া আসলে একটা রক্ষণশীল, টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্র, এবং ধর্ম সেখানে পুরোপুরি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, প্লেটো তার সময়কার গ্রিক লোকধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন। গ্রিক লোকধর্ম তার গুরু সক্রেটিসের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, কিন্তু সে ধর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে প্লেটো ম্যাগনেসিয়া রাষ্ট্রে যে নতুন ধর্ম তৈরি করেছেন তাতেও সক্রেটিসের মতো অনেকের মৃত্যু হতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে ধর্মীয় দিক দিয়ে ম্যাগনেসিয়ার মতো রাষ্ট্র যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি সক্রেটিসের মতো মৃত্যুও পাওয়া যাবে। প্লেটো পারলেন না গুরুর মৃত্যুর বদলা নিতে।
মন্তব্য
শিরোনাম ও প্রথম প্যারা বলছে ঈশ্বর ধারণার সূচনার কথা। কিন্তু টেক্সটে সেরকম আলোচনা আসেনি। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর ধারণাটা জানা ইতিহাস থেকে অনেক অনেক পুরনো। আলোচনায় গ্রেকো রোমানদের সময়কালের আগের সভ্যতাগুলোর আলোচনাও থাকবে আশা করি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ভূমিকাটা আরেকটু পরিষ্কার করা উচিত ছিল বুঝতে পারছি। এক বাক্যে অবশ্য বলেছি যে আমার উদ্দেশ্য ঈশ্বর ধারণাটা "দর্শনে" কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা বর্ণনা। ঈশ্বর বিষয়ক "বোধগম্য ধারণা" পাকাপোক্ত রূপ পেয়েছে কেবল দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক অংশটাতে। দর্শন বা ইতিহাস শুরু হওয়ার অনেক আগে ঈশ্বরের ধারণা শুরু হলেও সেটার কোনো বিধিবদ্ধ, সুচিন্তিত, বা যৌক্তিক রূপ ইউরোপে জেনোফানিস এবং ভারতে উপনিষদের আগে দেখা যায় না; হয়ত ছিল, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য রেকর্ড নেই। হিব্রু বাইবেল আছে, কিন্তু সেটাকেও দর্শন বলা যায় না। এর আগে সহায় বোধহয় প্রধানত মিথ বা প্রত্নতত্ত্ব, কিন্তু আমার আপাতত সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছা নাই; সে কারণেই কিন্তু এমনকি হোমারের ইলিয়াড বা হেসিয়ডের থিওগনি নিয়েও কোনো আলোচনা করিনি, শুরু করেছি দার্শনিকদের কথাবার্তা দিয়ে। আপাতত শুধুমাত্র দর্শনে ঈশ্বর নিয়ে কী ভাবা হয়েছে সেটাই লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছা। অবশ্য দর্শনে সীমাবদ্ধ থাকার আরেকটা কারণ, আমি অ্যান্টনি কেনি'র বই অনুসরণ করছি, এবং এটা শুধুমাত্র দর্শনের ইতিহাস। ভবিষ্যতে আরো বই থেকে সাহায্য নেয়া; মিথ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান থেকে ঈশ্বরের ধারণা উদ্ধার; এবং এমনকি ঈশ্বরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক ইউটিলিটি ও ব্যবহার নিয়েও ভাবার ও লেখার ইচ্ছা আছে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
[সেমেটিক প্রচারকেরা কি 'বাই এনি চান্স' জেনোফানিসের ধারণার সংস্পর্শে এসেছিলেন?
অথবা উল্টোটা? বর্ননায় কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ণ মিল পাচ্ছি। কাকতালীয় ব্যাপার কি?]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা কম। তবে জেনোফানিস কবি ছিলেন এবং অনেক জায়গা ঘুরেছেন, সুতরাং কি জানতেন তিনি কে জানে! কিন্তু আমার মতে জেনোফানিস যা ভেবেছেন সেটা একজন মানুষ কেবল যৌক্তিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই অনুমান করতে পারে, তার জন্য হিব্রু নবিদের কোনই দরকার নেই। গ্রিসের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে প্রথম ঈশ্বর নিয়ে ঐশ্বরিকের বদলে মানবিক আলোচনা হয়েছে; অর্থাৎ অবতীর্ণ বাণী পাওয়ার দাবি করার বদলে মানুষ বসে বসে নিজের মাথা দিয়ে ভেবেছে। তাই এখান থেকেই আমার আলোচনা শুরু।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
জেনোফানিসের চিন্তাভাবনা, অবতীর্ণ বাণী প্রাপ্তির দাবীদারেরা কোথাও কোনওভাবে কি শুনে থাকতে পারেন না? যেটা সজ্ঞানে অথবা অবচেতনভাবে তাদের প্রচারণাকে প্রভাবিত করেছে?
আপাতত নিয়ে বসি, সিরিজ আগাক।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এসবের জন্য এত শোনাশুনির আসলে খুব একটা দরকার নেই। যেকোন বুদ্ধিমান মানুষ একটু চিন্তাভাবনা করলেই এবিষয়ে অনেক বেসিক ধারণায় পৌঁছুতে পারে। শিক্ষানবিস যেমন বলছেন - "আমার মতে জেনোফানিস যা ভেবেছেন সেটা একজন মানুষ কেবল যৌক্তিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই অনুমান করতে পারে" । অন্য লাইনের লোকেরাও সেই কাজটাই করেছেন এবং সেইসাথে আরও অনেককিছু যোগ করেছেন তাতে, পরিবর্তন-পরিবর্ধণ, পরিমার্জন করেছেন নিজেদের সুবিধামত - এই আরকি।
এই অনেককিছু কি হতে পারে? ২টা ইন্টারেস্টিং ভিডিও ক্লিপ দেখেন মনোযোগ দিয়ে --
https://www.youtube.com/watch?v=e1CWBKRWIg0
https://www.youtube.com/watch?v=ljRKhZ81aqY
****************************************
শিরোনামটা নিয়ে একটু খটকা আছে। এটা মনে হয় ইউরোপিয় ঈশ্বরের ইতিহাস কিংবা ইউরোপে সার্বভৌম ঈশ্বর সংযোজনের ইতিহাস হলে বেশি মানায়
০২
আমার পড়াশোনায় 'সার্বভৌম ঈশ্বর' কনসেপ্টটা কোনো না কোনোভাবে সেমেটিক ঈশ্বর দ্বারা প্রভাবিত (সম্ভবত)। অন্য সংস্কৃতিগুলা বহু দেবতা নির্ভর; একক ঈশ্বর নির্ভর না
হিব্রু বাইবেল লেখা হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে
সেমেটিক মোয়াবদের একক ঈশ্বর চেমোশের ধারণা কমপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের — এই ব্যাপারে লিখিত প্রমাণ আছে
মেসোপটেমিয়ান ঈশ্বরের ধারণা কমপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের
এদের তুলনায় সক্রেটিস-প্লাতো-জেনোফানেস’রা নিতান্তই সেদিনের মানুষ
আচ্ছা, হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়া হোমো গণভূক্ত বাকিদের মধ্যে কি ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হয়েছিল?
ভূমিকাতেই কিন্তু আছে: আমার লক্ষ্য দর্শনে ঈশ্বরের ধারণার ইতিহাস বর্ণনা। দার্শনিকদের মধ্যেই ঈশ্বর নিয়ে একটা সর্বজনীন, যৌক্তিক ধারণা নির্মাণের চেষ্টা দেখা যায়। কোনো ধর্মপ্রবর্তক সেরকম চেষ্টা করতে পারেনি, তাই সে নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা নাই। হিব্রু বাইবেলের ১ম লিখিত দলিল খ্রি-পূ ৭ম শতকের। আর সেই দলিলেও ঈশ্বরের কোনো সফিস্টিকেটেড ধারণা নাই। আর তারা সবাই অবতীর্ণ বাণী পাওয়ার দাবি করেছেন। যারা ঈশ্বরের কাছ থেকে বাণী পেয়েছে বলে দাবি করেছে তাদের নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। জেনোফানিস, প্লেটো, এরিস্টটলদের বিশেষত্ব হচ্ছে এরা কেউ ঈশ্বরের সাথে কথা বলেছেন বলে দাবি করেননি। তাই এরাই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
ঠিক ইউরোপীয় ঈশ্বরের ইতিহাস লেখা উদ্দেশ্য না। পাশ্চাত্য, ইসলামি, ভারতীয়, চৈনিক এই ৪টা দর্শনে ঈশ্বর সম্পর্কে যেসব সর্বজনীন ধারণা পাওয়া যায় কেবল সেগুলো নিয়েই পড়ার ও লেখার ইচ্ছা। ধর্মপ্রচারকদের ঈশ্বরে ঠিক আগ্রহ নাই আমার। এটাকে "দার্শনিকদের ঈশ্বরের ইতিহাস" বললে ভাল হতো, তাহলে উপনিষদ, ইবনে সিনা, প্লেটো, অগাস্টিন ইত্যাদি এক কাতারে পড়ে যেতো। কিন্তু ভেবে দেখলাম দার্শনিকদের ঈশ্বর সবচেয়ে সুচিন্তিত ঈশ্বর। ধর্মপ্রচারক বা লোকধর্মের ঈশ্বরের দিকে তাই যাব না। সংগঠিত ধর্মের মধ্যেও কেবল অনেক সুচিন্তিত, কোহেরেন্ট ঈশ্বরের ধারণাগুলো নিয়েই আলোচনা করব। বহু দেবতা'র কোনো কোহেরেন্ট দার্শনিক ধারণা যদি কেউ দিয়ে থাকে তাহলে সেটাও আসবে ভবিষ্যতে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে –
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে –
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে।
****************************************
গ্রীক সভ্যতা ও সেই অঞ্চলের ঈশ্বর-ধারণার পাশাপাশি এই অঞ্চলের অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের ঈশ্বর-ধারণার (বিশেষ করে বহুঈশ্বরবাদ) অনেক মিল, এই মিলের ক্ষেত্রে যে জিনিসটা চিন্তিত করে তা হলো ভৌগলিক দূরত্ব ও অমিলের ফলে-ও দুটো অঞ্চলেই কীভাবে প্রায় একই ধরণের ঈশ্বর-ধারণার সৃষ্টি হলো, মনে হয় যেহেতু ঈশ্বর মানুষের মস্তিষ্কজাত, সেই মস্তিষ্ক একই ফসল ফলায় দুই অঞ্চলেই।
ভারতীয়দের ঈশ্বর-ধারণার ব্যাপারে-ও বিস্তারিত আলোচনা করলে ভালো লাগবে।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
নতুন মন্তব্য করুন