• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

হাফিজ

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: রবি, ০৩/০৭/২০১৬ - ৫:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইরানের বাইরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইরানি কবি রুমি হলেও ইরানের ভিতরে হাফিজের তুল্য জনপ্রিয় আর কোনো কবি নেই। দূরপাশ্চাত্য থেকে শুরু করে এই প্রাচ্য পর্যন্ত সবখানে তার প্রভাব প্রকট। বাংলায় নজরুল হাফিজ অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ পারস্য ভ্রমণকালে হাফিজের সমাধিতে গিয়ে ভেবেছেন "কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।" ইউরোপের মহাকবি গ্যোটে হাফিজপ্রেমে পাগল হয়ে নিজেকে হাফিজের যমজ ভাই জ্ঞান করেছেন, তার প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দিওয়ান কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, "হাফিজ তার কাব্যে অকাট্য সত্য অনপনেয়রূপে প্রকাশ করেছেন… এই পাগলামো আমার চেনা—হাফিজ অদ্বিতীয়।" মার্কিন তুর্যবাদের পয়গম্বর রালফ ওয়াল্ডো এমারসন গ্যোটের দিওয়ান পড়েই হাফিজ সম্পর্কে জেনেছিলেন, এবং এক পর্যায়ে হাফিজকে বলেছিলেন "কবিদের কবি"। এ তো গেল কেবল কবিদের কবিভক্তির কথা, সাধারণের ভক্তির নানা রূপ বর্ণনার অতীত, কেবল এটুকু বলাই বোধহয় যথেষ্ট যে ইরানে কুরানের চেয়ে হাফিজের দিওয়ান বেশি বিক্রি হয়। হাফিজের সাথে মোল্লাতন্ত্রের বিরোধ তার জীবদ্দশায় যতটুকু ছিল এখন নিশ্চয় তার চেয়ে বেশি। "আচারনিষ্ঠ ধার্মিকের কুটিল ভ্রূকুটি" হাফিজকে অনেক বিদ্ধ করেছিল, কারণ তিনি আচারসর্বস্ব-ধর্মের আল্লাহকে মেনে নিতে পারেন নি, তার মতে আল্লাহ মৌলবি-দের বর্ণনার মতো হতে পারে না, আল্লাহ শাস্তির ভয় দেখিয়ে কাউকে পথে আসতে বলতে পারে না, আল্লাহ যদি কিছুর লোভ সত্যিই দেখিয়ে থাকে তবে সেটা প্রেমের আনন্দের।

প্রথম জীবন

সব লেখা আছে মনের অন্তরে
দরবেশের শিক্ষা ও সাহায্যার্থে
নৃত্যে প্রেমে ও প্রার্থনাতে।

হাফিজের নাম সবাই জানলেও জন্মতারিখ কেউ জানে না। অনুমান করা হয় তিনি ১৩২৫/২৬ (বা ১৩২০) সালে জন্ম নিয়ে ১৩৮৯/৯০ সালে মারা গিয়েছিলেন। ইরানের শিরাজ নগরে তার জন্ম, এবং সারা জীবন এখানেই ছিলেন। সংস্কৃতিমুখরিত, বাগানশোভিত শিরাজ তার সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত; মোঙ্গল ও তাতারদের বর্বর আক্রমণের হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে যাওয়ায় সে সৌন্দর্য হাফিজের সময়ও অক্ষত ছিল। হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দিন মুহাম্মদ, কুরআন মুখস্ত করেছিলেন বলেই লোকে তাকে 'হাফিজ' ডাকত এবং কবিতা লিখতে শুরু করার পর তিনি এই নামটিই ব্যবহার করতে থাকেন।

হাফিজের পরিবার সচ্ছল ছিল না, তিনি ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোটো। কয়লার ব্যবসায়ী বাবা তার কৈশোরকালেই মারা গিয়েছিলেন। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য হাফিজ দিনের বেলায় এক রুটির দোকানে কাজ করতেন, এবং সেই কাজের বেতনের একাংশ দিয়েই তার রাত্রিকালীন বিদ্যাপিঠের খরচ নির্বাহ করতেন। তখনকার ইসলামি বিশ্বে পড়াশোনা বলতে প্রধানত কুরআন, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা বুঝানো হতো, স্বভাবত হাফিজ এই বিষয়গুলোতেই দীক্ষা পেয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি ক্যালিগ্রাফি ও মুদ্রণশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। জীবন্ত জিনিসের ছবি আঁকা যেত না বলে ইসলামি বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি দিয়েই মানুষ তার শৈল্পিক চাহিদা মেটাত, আর ধর্মজীবীরাও এতে সন্তুষ্ট হতেন কারণ ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অধিকাংশ সময় কুরআনের বাণীকেই মহিমান্বিত করা হতো। হাফিজ অনেক সময় পেশাদার প্রতিলিপিকার হিসেবেও কাজ করেছেন।

ধর্মীয় জিনিসের পাশাপাশি হাফিজ নিশ্চিত পারস্যের বড় বড় কবির কাব্য অধ্যয়ন করেছেন। সাদি, ফরিদুদ্দিন আতর, জালালুদ্দিন রুমি নিশ্চিত তার পাঠ্যসূচীতে ছিল। ইরানে কবিতা জাতীয় শিল্পের মতো, অনেকটা যেমন ইতালিতে অপেরা। এখনো ইরানের প্রায় সবাই মহাকবিদের আপনজনের মতো চেনে। মধ্যযুগে রাজা-রাজরারা কবিদের অনেক সম্মান করতেন। অনেকে নিজস্ব রাজকবি, সভাকবি রাখতেন, তাদের দিয়ে নিজেদের বংশগৌরবের কথা লেখাতেন। কবি খুব ভাল লিখলে অনেক রাজা তাকে দাঁড়িপাল্লায় উঠিয়ে তার ওজনের সমান স্বর্ণ উপহার দিতেন।

কবিখ্যাতি

কবি
পেয়ালায় আলো ঢেলে
তুলে ধরে পুষ্ট করতে
তোমার সুন্দর রৌদ্রশুষ্ক, পবিত্র মুখ।

হাফিজের কাব্যপ্রতিভার কথা খুব কম বয়সেই ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশের কোঠার শুরুর দিকেই তার প্রেমের কবিতা বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। শিরাজের অনেক রাজা, রাজকুমার তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। একজন একটা মাদ্রাসা খুলে তাতে হাফিজকে চাকরি দিয়েছিলেন। তাই মধ্যবয়সে তিনি ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। বিয়ে করেছিলেন এবং তার অন্তত একটি সন্তান হয়েছিল। জীবিকার জন্য তাকে পুরোপুরিই নির্ভর করতে হতো পৃষ্ঠপোষকের সুনজরের উপর। কিন্তু সেই সুনজর সবসময় তার ভাগ্যে জোটেনি, কারণ ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা তাকে পছন্দ করত না এবং তাদের পক্ষের লোক ক্ষমতায় এলেই হাফিজকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। একবার তাকে শিরাজ ছেড়ে নির্বাসনেও যেতে হয়েছিল। পরে আবার ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সব মিলিয়ে তার জীবনের মধ্যভাগটা বেশ অনিশ্চিত ছিল। এ সময় তার স্ত্রী ও ছেলেও মারা গিয়েছিল। তার সবচেয়ে কষ্টের ও নৈরাশ্যের কবিতাগুলোর সাথে এসব ঘটনার নিশ্চয়ই কিছু সম্পর্ক আছে।

বয়স যখন ষাটের মতো তখন হাফিজ সুপ্রতিষ্ঠিত মহাকবি, তার প্রচুর ভক্ত, মুরিদ ও শুভানুধ্যায়ী। সত্তর বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষের পরমবন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, ও বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসেবে কাব্যপ্রচার করে গেছেন। শিরাজের একটি বাগানে তার নিজের লাগানো সাইপ্রেস গাছের তলায় তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুর পর প্রায় পাঁচশ' বছর পর্যন্ত হাফিজের মাজার ও তৎসংলগ্ন গোলাপবাগানটি তীর্থযাত্রীদের পদচারণায় মুখর ছিল, কিন্তু এরপর তার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মাজারটির দৈন্যদশা কাতর করেছিল ভারতীয় পারসী আধ্যাত্মিক গুরু, অবতার দাবিদার মেহের বাবাকে। পারস্য সরকারের ব্যবস্থাপনায় ও মেহের বাবার আংশিক অর্থানুকূল্যে ১৯২৫ সালে হাফিজের সমাধিসৌধের পুনর্নির্মাণ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ সালে ইরানে গিয়ে এই পুনর্নির্মিত রূপ দেখেই বোধহয় বলেছিলেন, "নূতন রাজার আমলে এই সমাধির সংস্কার চলছে। পুরোনো কবরের উপর আধুনিক কারখানায় ঢালাই-করা জালির কাজের একটা মণ্ডপ তুলে দেওয়া হয়েছে। হাফেজের কাব্যের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না। লোহার বেড়ায় ঘেরা কবি-আত্মাকে মনে হল যেন আমাদের পুলিস-রাজত্বের অর্ডিনান্সের কয়েদী।"

অধ্যাত্মবিদ্যার্থি

ঈশ্বরের প্রেমে পড়ে আছি
কত, কত যুগ ধরে।

মেহের বাবা তার ধর্মপ্রচারণায় হাফিজের কবিতা অনেক ব্যবহার করতেন। তার মতে হাফিজের প্রেমকাব্যে আধ্যাত্মিক পথের সব নিগূঢ় নির্দেশনা রয়েছে, কারণ আধ্যাত্মিকতার আসল বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রেম। হাফিজ ব্যক্তিজীবনেও আসলে অধ্যাত্মবিদ্যার্থি ছিলেন। বয়স হওয়ার পরই তিনি এক সুফি সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘকাল তার সান্নিধ্যে থেকে অধ্যাত্মবিদ্যা সাধনা করেন। পরে তিনি নিজেও সুফিগুরু হয়েছিলেন। হাফিজের দিওয়ান সুফিবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিরায়তগ্রন্থের একটি। সুফিবাদের মূল বিষয় আল্লাহ'র প্রতি একপাক্ষিক, সুতীব্র উন্মাদনাপূর্ণ প্রেম, হাফিজের কাব্য যে-প্রেমে পরিপূর্ণ।

পাশ্চাত্যে বা দূরপ্রাচ্যে মনে করা হয় সুফিবাদ মানেই ইসলামি অধ্যাত্মবাদ, সুফিবাদ ইসলামেরই একটি রূপ বা সংস্করণ। কিন্তু সুফিদের মধ্যে প্রচলিত একটা ধারণা হচ্ছে, সব ধর্মে, সব স্থানে, সব কালেই তাদের পথ অনুসৃত ও চর্চিত হয়েছে, সব অধ্যাত্মতন্ত্রের মাঝেই সুফিতন্ত্র রয়েছে। যেমন প্রাচীন গ্রিসে পিথাগোরাস ও প্লেটোর মতো 'সোফিয়া' (প্রজ্ঞা) চর্চাকারীদেরকে তারা তাদেরই লোক মনে করে। সে অর্থে হাফিজ সক্রেটিসের সহযাত্রী। প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে সোফিয়া'র প্রতি প্রেমকে ('ফিলোসোফিয়া') প্রেমের সর্বোর্ধ্ব ও সর্বোৎকৃষ্ট রূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে—সুফিরা সেই রূপেরই কাঙাল। যিশুর সময় এই রূপের দর্শনপ্রার্থী ছিল Essene ও Gnostic-রা। সুফিদের মতে মুহাম্মাদের পর এই পথের লোকেরা ইসলাম থেকেও অনেক কিছু নিয়েছে এবং ইসলামি বিশ্বে ও সেই সূত্রে অন্য সবখানে 'সুফি' নামে পরিচিত হয়েছে। ৮০০ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যে 'ইসলামি' সুফিবাদ রূপ পেয়েছে, এবং এর শীর্ষ প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইবনে আরাবি (মৃ. ১২৪০) ও রুমি (মৃ. ১২৭৩)। একেক সুফিধারা একেক জিনিসকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে: কেউ চেয়েছে কঠোর ধ্যান, কেউ নিবিড় মানবসেবা, আর কেউ মরমি সুকুমার শিল্প। হাফিজের কবিতা এই সুকুমারশিল্পপন্থী সুফিবাদের চূড়া। হাফিজকাব্যকে সুফিরা ঐশ্বরিক প্রেমের অভিজ্ঞতার শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ বিবেচনা করে। হাফিজ কিভাবে সুফি হয়েছেন সে নিয়ে বেশ জনপ্রিয় একটা গল্প আছে যা এখানে তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

বলা হয় একুশ বছর বয়সে হাফিজ যখন এক রুটিওয়ালার সহকারী ছিলেন তখন এক বাড়িতে রুটি দিতে গিয়ে বারান্দায় এক পরমা সুন্দরীকে এক পলক দেখতে পান। সেই এক নিমিখ তার হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল, সে পাগলের মতো মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, অথচ মেয়েটি তাকে লক্ষ্যই করেনি। মেয়েটি ধনী বণিক ঘরের, আর হাফিজ নিতান্ত গরিব এক রুটিওয়ালার সহকারী। মেয়েটি সুন্দর, হাফিজ বেটে ও অসুন্দর—কোনো আশা নেই: "কোঈ উম্মীদ বার নাহী আ'তি।"

এরপর মাসের পর মাস যায়, আর হাফিজ মেয়েটির রূপ আর মেয়েটির জন্য তার আকুলতা উদযাপন করে কবিতার পর কবিতা লিখে যায়। মানুষ হাফিজের কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়, মুখে মুখে তার কবিতা সব শিরাজব্যাপী ছড়িয়ে যায়। হাফিজ এই খ্যাতির কিছুই জানে না, তার মনে শুধু তার অধরা প্রেমিকা। মেয়েটিকে জয় করার জন্য সে এক কঠিন আধ্যাত্মিক কর্ম সাধনের সিদ্ধান্ত নেয়: এক পীরের মাজারে চল্লিশ বিনিদ্র রাত কাটানো। কথিত ছিল, যে এই অসাধ্য সাধন করবে তার মনের বাসনা পূর্ণ হবে। প্রতি দিন হাফিজ রুটির দোকানে কাজে যেত, আর প্রতি রাতে মাজারে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করত মেয়েটির মুখ ভেবে ভেবে। এমনই প্রেম যে হাফিজ শেষ পর্যন্ত টানা-বিনিদ্র-রজনীর সংখ্যা চল্লিশ করতে সক্ষম হয়।

চল্লিশার পরের দিন স্বয়ং জিবরাইল হাফিজের সামনে উদিত হয়ে তার মনের বাসনা জানতে চায়। হাফিজ জীবনে এত উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত কোনো সত্তা দেখেনি। সে ভেবে চলে, "ঈশ্বরের দূতই যদি এত সুন্দর হয়, তবে না জানি ঈশ্বর নিজে কত সুন্দর!" অপলক নয়নে জিবরাইলের অকল্পনীয় জৌলুস দেখতে দেখতে হাফিজ মেয়েটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। আসল উদ্দেশ্যের কথা ভুলে সে বলে, "আমি ঈশ্বরকে চাই!" এই শুনে জিবরাইল তাকে নিকটবর্তী শহরের এক আধ্যাত্মিক গুরুর হদিশ দেয়। বলে, সব উপায়ে এই গুরুর সেবা করলেই তার ইচ্ছা পূরণ হবে। হাফিজ দ্রুত সেই শিক্ষকের দ্বারে উপস্থিত হয় এবং দু'জনে সেদিনই সাধনা শুরু করে।"

লোকগল্প হলেও এর মূল ধারণার সাথে প্লেটোর ইরটিক রচনাবলির মিলটা সহজেই বুঝা যায়। সিম্পোজিয়ামের আলোচনা-উৎসব শুরু হয়েছিল প্রেমের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি নির্ধারণের চেষ্টা দিয়ে। Έρως নিয়ে সবাই সুমধুর, সুচতুর, বা সকৌতুক বক্তৃতা দেয়। সবার শেষে সক্রেটিস এসে প্রেমের আসল রূপ উন্মোচন করেন। প্রেম তখন মর্ত্য থেকে স্বর্গে আরোহণ করে, প্রেমের বস্তু নিয়ে পড়ে থাকার পরিবর্তে সক্রেটিস প্রেমের 'স্বরূপ' খুঁজতে যান। সক্রেটিসের মুখেও যেন আমরা শুনতে পাই, প্রেমের দূতই যদি এত সুন্দর হয়, তবে না জানি প্রেম নিজে কত সুন্দর!

গুরু-শিষ্য

আমাদের সঙ্গীকে অনুসরণ করা বড্ড কঠিন,
এমনকি তার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতও সহজ নয়
শোনা।

হাফিজের দীক্ষাগুরুর নাম মুহাম্মদ আতর। ধারণা করা হয় আতরের আসলেই একটা আতরের দোকান ছিল এবং তার নিকটবন্ধুদের বাইরে কেউ তাকে ঠিক সুফিগুরু হিসেবে চিনত না। অনেক বছর ধরে হাফিজ প্রায় প্রতিদিন আতরের কাছে যেতো, তারা একসাথে কথা বলত, গাইত, খেতো, আর মাঝে মাঝে শিরাজের পুষ্পকাননগুলোতে নীরবে পায়চারি করত। জীবনের ঐকতান ও সৌন্দর্য আর প্রেমের সব রূপ আতরই হাফিজকে শিখিয়েছিলেন। আতর নিজেও কবি ছিলেন, এবং হয়ত তিনিই হাফিজকে তাদের আধ্যাত্মিক আবিষ্কারগুলো কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। হাফিজ গুরুর জন্য প্রতিদিন একটা করে কবিতা লিখতেন, আর আতর তাকে প্রতিটি কবিতা নিয়ে আরো গবেষণা করতে বলতেন।

কিন্তু আতরের সেবা করা সবসময় সোজা ছিল না। মেহের বাবাদের মতো আধুনিক দীক্ষাগুরুরা প্রকৃত গুরুর সাহচর্য কত কঠিন হতে পারে তা বুঝানোর জন্য অনেক সময় আতর ও হাফিজের সম্পর্ক ব্যবহার করেন। মেহের বাবা জোর দিয়ে বলেন, গুরুর আসল কাজ শিষ্যের অন্তরের উত্তরোত্তর উৎকর্ষ সাধনে সাহায্য করা যাতে তার প্রেমবোধ দিন দিন উন্নত হয়। এটা করতে গিয়ে শিষ্যের অহং "ধূলায় পড়ে ধূলিসাৎ" হয়ে যায়। মেহের বাবা বলেছেন, অহং চূর্ণ করার জন্য হাফিজ চল্লিশ বছর ধরে দিনের পর দিন "গুরুর পায়ে মাথা কুটেছেন।"

হাফিজকে নিয়ে প্রচলিত কিছু গল্পে এর সত্যতা পাওয়া যায়। একটা গল্প উল্লেখ না করলেই নয়:

ষাটোর্ধ্ব হাফিজ একদিন গুরুকে বলল, "দেখুন আমাকে! আমি বৃদ্ধ, বহু আগেই আমার স্ত্রী ও ছেলে মারা গেছে। এত বছর ধরে আপনার বাধ্য ছাত্র থেকে আমার কী লাভ হয়েছে?" আতর ধীর কণ্ঠে উত্তর করেন, "ধৈর্য ধরো, একদিন বুঝতে পারবে।" হাফিজ চিৎকার করে বলে, "জানতাম আপনি এই উত্তর দিবেন।" আধ্যাত্মিক হতাশায় পাগল হয়ে হাফিজ চল্লিশ দিন ধরে আরো কঠোর এক তপস্যার চিন্তা করে। এবার সে মাটিতে একটা বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে চল্লিশ দিনের জন্য নিজেকে বন্দি করে, এর মধ্যে পানাহার বা মলমূত্র-ত্যাগ কোনো কারণেই বৃত্ত থেকে বের হয় না। চল্লিশতম দিনে আবারো জিবরাইল এসে তার বাসনা জানতে চায়। তখন হাফিজ উপলব্ধি করে যে তার সব কামনা, বাসনা চলে গেছে, এবং উত্তরে বলে, তার একমাত্র ইচ্ছা গুরুর সেবা করা। ঊষালগ্নে হাফিজ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গুরুর বাড়িতে আসে। আতর দোরগোড়াতেই অপেক্ষা করছিলেন। দু'জনে আলিঙ্গন করে এবং আতর হাফিজকে এক পেয়ালা পুরনো মদ দেয়। মদিরার উন্মত্ত আনন্দে হাফিজের সব বিচ্ছিন্নতাবোধ কেটে যায়। তীব্র আনন্দের হাসি দিয়ে হাফিজ ঈশ্বরের প্রেমে ডুবে যায়, তার সাথে চিরতরে একত্রিত হয়ে যায়।

কথিত আছে হাফিজ নিজের অজ্ঞাতেই এই চল্লিশ দিনের তপস্যা তার শিষ্যত্বের চল্লিশ বছর পূর্তির ঠিক চল্লিশ দিন আগে শুরু করেছিলেন। সুতরাং ঈশ্বরের সাথে তার মহামিলন ঘটেছিল তার শিষ্যত্ব গ্রহণের ঠিক চল্লিশ বছর পূর্তির ক্ষণটিতে। চল্লিশ এখানে অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে নেয়ার কোনো কারণ নেই। চল্লিশ দিয়ে পূর্ণতা উপলব্ধি, বুদ্ধি, বা প্রজ্ঞার পূর্ণতা বুঝানোর কাহিনী অনেক পাওয়া যায়—মুহাম্মাদ 'ওহী'ও পেয়েছিলেন চল্লিশ বছর বয়সেই।

প্রেমের অনেক স্তর

আমি জানি কেবল প্রেম,
এবং দেখেছি আমার হৃদয় অসীম
ও সর্বত্র বিরাজমান।

মুহাম্মদের চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়্যত-প্রাপ্তিরও অনেক আগে থেকে মানুষ 'চল্লিশ' সংখ্যাটিকে ব্যবহার করে আসছে। মোল্লারা অনেক সময় এসব সংখ্যাকে আক্ষরিক অর্থে প্রচার করে সংখ্যার মাহাত্ম্য দিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, বুঝেন না যে ধর্মকে যদি সংখ্যা দিয়ে মহৎ হতে হয় তবে তার মহৎ না হওয়াই উত্তম। সুফিরা অবশ্যই সংখ্যার রূপকার্থ নিয়ে পূর্ণ সচেতন, এবং আমাদেরও সচেতন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। চল্লিশের ব্যবহার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব জায়গাতেই প্রচুর: নূহের প্লাবন 'চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত' স্থায়ী হয়েছিল, মিশর থেকে বের হয়ে চল্লিশ বছর যাযাবর জীবন যাপনের পর ইসরায়েলিরা প্রতিশ্রুত ভূমির সন্ধান পায়, যিশু প্রাচীন নবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চল্লিশ দিন মরুভূমিতে নিভৃতে থেকেছিলেন, সিদ্ধার্থ গৌতম চল্লিশ (কেউ অবশ্য ৪৯ বলে) দিন ধরে টানা ধ্যান করার পরই বুদ্ধ হয়েছিলেন। মোটকথা চল্লিশের সাথে অনেক সংস্কৃতিতেই আলোকপ্রাপ্তি, শিক্ষার পূর্ণতা, বা পূতপবিত্র হওয়ার সম্পর্ক আছে।

হাফিজের চল্লিশকেন্দ্রিক যে গল্পগুলো আলোচনা করলাম সেগুলোর একটা সার্বিক রূপকার্থ তৈরি করা যায়। এবং এতে অনেক সুফি প্রতীকও আছে। যেমন, বৃত্ত দিয়ে পূর্ণতা ও পরম-বিশুদ্ধতা বুঝানো হয়েছে। প্লেটোও বৃত্তকে বিশুদ্ধতার স্কেলে সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন, যে বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে এওদক্সোস ও এরিস্টটলকে আকাশে অজস্র নিরেট গোলকের কল্পনা করতে হয়েছিল। মদের পেয়ালাও একটা বড় রূপক—পেয়ালা যেমন মদের আধার, তেমনি মানুষ হতে পারে প্রেমের আধার, আর মদ হতে পারে প্রেমের সমার্থক। স্ট্যানলি কুবরিকের '২০০১: আ স্পেস অডিসি' (১৯৬৮) সিনেমার একটি দৃশ্যে টেবিল থেকে পানির গ্লাস পড়ে ভেঙে যাওয়া দিয়ে মানুষের দেহের খাঁচা থেকে চিরমুক্তি বুঝানো হয়েছিল। তবে হাফিজের সুরাপত্র ভেঙে যায়নি, পাত্রের পুরনো মদ পান করে তিনি নিজের দেহকে ঈশ্বরপ্রেমের জন্য প্রস্তুত করেছেন। এই গল্পের বিভিন্ন অংশ সুফিবাদে প্রেমের বিভিন্ন স্তর নির্দেশ করতে পারে; এক স্তর পেরোলেই কেবল আরেকটির জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়:—

সবার অধ্যাত্মপথে যাত্রা যেভাবে শুরু হয় হাফিজেরও সেভাবেই শুরু হয়েছিল—কোনো মানুষের প্রেমে পড়ার মাধ্যমে। নারীদেহের সৌন্দর্যই তাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল। এই আদর্শনারীকে পাওয়ার জন্য সে মানবপ্রেমের সব স্তর ঘুরে দেখে—কবিতায় সে নারীর সৌন্দর্য ও নারীর প্রতি তার আকুলতাকে উদযাপন করে। এক পর্যায়ে সে সব শক্তি দিয়ে প্রেমিকাকে জয়ের সংকল্প করে—মাজারে চল্লিশ বিনিদ্র রাত কাটায়।

যখন তার প্রেমের প্রতি আকুলতা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় (শেষদিনের ঊষালগ্ন) তখন প্রেমের একটি উচ্চতর স্তর (জিবরাইল) তার সামনে প্রকাশিত হয়। সে এই উচ্চতর প্রেমের মর্যাদা বুঝে এবং সে অনুযায়ী সাড়া দিতেও ("আমি ঈশ্বরকে চাই") সক্ষম হয়। এর ফলে সে প্রজ্ঞা বা প্রেমের নতুন এক জগতে প্রবেশ করে যেখানে তার একটি নতুন প্রেমের সম্পর্ক (গুরুর সাথে) হয়। সক্রেটিসের সাথে তার ভক্ত যুবকদের প্রেমকেও এর সাথে তুলনা করা যায়।

প্রেমের এই নতুন স্তরে আগের স্তরের চেয়ে অনেক বেশি দিন থাকতে হবে—দীর্ঘ চল্লিশ বছর। আতর হাফিজকে হাঁটি হাঁটি পা পা (প্রতিদিন একটি করে কবিতা) করে প্রেমের আরো বিস্তৃত ও পরিব্যাপ্ত একটি বোধের দিকে নিয়ে যান। ঈশ্বরপ্রেম যত বাড়ে হাফিজ ততই আরো অস্থির হতে থাকে। আতর বারবার তাকে "ধৈর্যের" কথা বলে, বুঝাতে চায় প্রেমের প্রতিটি স্তর যথেষ্ট সময় নিয়ে নিরীক্ষা করতে হবে, প্রতি স্তরে 'বাস' করতে হবে।

প্রশিক্ষণকালের শেষের দিকে হাফিজ আরো বেপরোয়া ও আকুল হয়ে উঠে। আবার তার সব শক্তি প্রেমের পথে ঢেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবার সে চল্লিশ দিন নিজের তৈরি বৃত্তের (পূর্ণতা ও ত্রুটিহীনতার প্রতীক) ভিতরে আবদ্ধ থাকে, তার সব চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রবিন্দু করে ঈশ্বরকে। ঈশ্বরের প্রতি প্রেমকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাতে তার জীবনে ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই না থাকে।

এই সত্যিকারের পূর্ণতা অর্জনে যখন (আবারো শেষদিনের ঊষালগ্নে) সফল হয়, তখন সে লক্ষ্য করে প্রেম তার সীমাবদ্ধ ব্যক্তিত্ব ও তার সব কামনাকে নিঃশেষ করে ফেলেছে, এমনকি ঈশ্বরকামনাও আর অবশিষ্ট নেই। হাফিজ অবশেষে বুঝতে পেরেছে, প্রেমের "প্রভু" হওয়া সম্ভব না, প্রেমের আধার (মদের পেয়ালা) হিসেবে তার সেবা করাই কেবল সম্ভব।

হাফিজ এখন জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে প্রেমের অসীম প্রজ্ঞার সাহায্যে আলিঙ্গন (গুরুর সাথে আলিঙ্গন) করতে সক্ষম। হাফিজ ও আতর একই নিখুঁত জ্ঞান (অনেকদিনের পুরনো পরিপক্ক মদ) একসাথে উপভোগ করে। এখন হাফিজ নিখুঁত প্রেমের মূর্তরূপ, প্রকৃত প্রজ্ঞা বা প্রেমের যোগ্য আধার, পুরনো মদের উপযুক্ত পেয়ালা।

পরমোৎকর্ষ

শুনি
প্রত্যেক প্রাণী ও উদ্ভিদকে,
প্রত্যেক বিশ্ব সূর্য ও ছায়াপথকে
প্রেয়সীর নাম জপতে!

মানুষের পক্ষে 'পরম জ্ঞান' বা 'পরম প্রেম' অর্জন করা সম্ভব শুনলে অনেক ধরনের অনুভূতি মনে আসে। দার্শনিক প্রথমেই 'পরমের' সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিধায় পড়বেন, সক্রেটিক জিজ্ঞাসাবাদের শেষে পরমের অপ্রকাশ্যতাই কেবল প্রকাশিত হবে। কেউ বলবেন যা অধরা তাই পরম। হাফিজ সেই পরমের সংজ্ঞা জানার দাবি, এবং সেই পরমকে অধিকার করার দাবি একসাথে করেছেন। দুটো দাবি অবশ্য কেবল একসাথেই করা যায়—যে পরম কি জানে না সে পরমকে পায়নি। এ ধরনের দাবি সব আধ্যাত্মিক সিস্টেমেই করা হয়, যেমন হিন্দুধর্মের 'নির্বিকল্প সমাধি' বা ইসলামধর্মের 'কুতুবিয়্যাৎ'। গোঁড়া ধার্মিকরা এই দাবির আক্ষরিক অর্থ করেন, আর গোঁড়া নির্ধর্মীরা সেই আক্ষরিক অর্থ দিয়ে ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করে তাকে খণ্ডন করার জন্য বহু সময় ব্যয় করেন। কিন্তু মূল সমস্যা সবার জন্যই পরমজ্ঞানের দাবির নিহিতার্থ (বা অন্তত 'ব্যবহারিক' ও 'সামাজিক' অর্থ) খুঁজে বের করা। নিহিতার্থ আদৌ পাওয়া সম্ভব কি না বলা যায় না, কিন্তু বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো যুক্তিবিদও যখন সব কালে, সব সমাজে, সব অধ্যাত্মতন্ত্রে দৃশ্যমান মরমিবাদ দিয়ে সাময়িকভাবে আপ্লুত হন তখন পরমজ্ঞানী বা পরমপ্রেমীর পরমত্ব অর্জনের নিহিতার্থ নিয়ে না ভেবে পারা যায় না।

পরমজ্ঞানী ও পরমগুরুর প্রধান বৈশিষ্ট্য, তিনি মহাবিশ্বের সৌন্দর্য ও ঐকতান উপলব্ধি করতে পারেন, যদিও সে উপলব্ধি অন্য কারো মধ্যে সহজে প্রবাহিত করা সম্ভব না। তিনি যে উপায়ে সে উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন সেই উপায়েই অন্যকেও তা উপলব্ধি করতে হবে। পরমগুরু ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক বস্তু, স্মৃতি, ও কল্পনার মধ্যে স্বর্গীয় প্রেমের প্রবাহ টের পান। এদিক দিয়ে তিনি পিথাগোরাসদের উত্তরসূরি। পরমগুরু পরমজ্ঞান, পরমপ্রেম ও পরমানন্দের মূর্তরূপ, তার জীবনের প্রতিটি কর্মে এগুলো প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্যে এরকম পরমগুরুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসিসি'র ফ্রান্সিস। আর প্রাচ্যে সংখ্যাটা অনেক বেশি: ভারতে বুদ্ধ, কবির, বা রামকৃষ্ণ; ইরানে রুমি; তিব্বতে মিলারাসপা; চীনে লাউজি; এবং নাম জানা, না-জানা আরো অনেকে। অনেক ধর্মের প্রবর্তকের মধ্যে এই মরমি দিকটাও ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত অনেকে ব্যক্তিমর্মের চেয়ে সমাজবর্ম তৈরিতে মনোযোগী হয়েছেন বেশি।

হাফিজ ও তার শিক্ষকও এই পরমগুরু দলভুক্ত। হাফিজের একেকটি কবিতা আসলে মানুষের পরমপ্রজ্ঞা, পরমজ্ঞান, পরমপ্রেম, ও পরমানন্দের পথে যাত্রার একেকটি মাইলফলক। কিন্তু এই পরমজ্ঞান মানুষের অন্য সব জ্ঞানকে একটুও খাটো করে না, বরং অন্য সব জ্ঞানকে তার আত্মোপলব্ধির স্বার্থে ব্যবহার করে। স্মৃতি, যুক্তি, কল্পনা সবই পরমজ্ঞানে পৌঁছাতে মানুষকে সাহায্য করতে পারে। সে জ্ঞানে পৌঁছানোর বহু পথ, তারপরও বলার লোভ সামলাতে পারছি না যে, হয়ত এই অভিযাত্রায় প্রধান বাহন হতে হবে কল্পনাকে—অতীতের স্মৃতিপুঞ্জে যুক্তিযন্ত্র চালিয়ে একটি ভবিষ্যৎগামী প্রজ্ঞাকল্পযান বানাতে হবে।

অদৃশ্যের জিহ্বা

হাজারটা দেদীপ্যমান গূঢ়কথা লিখো
অস্তিত্বের দেয়াল জুড়ে
যাতে অন্ধও, দেখে
আমাদের নিশান,
মিলিত হতে পারে এই প্রেমে।

হাফিজ তার কবিতাগুলো লিখেছেন তার গুরু মুহাম্মদ আতরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। তারা প্রতিটি কবিতা পর্যালোচনা করতেন, দলের অন্যদের সাথে আলোচনা করতেন, এবং অনেক কবিতা থেকে গান তৈরি হতো। তৎকালীন সুফি স্কুলে এটাই স্বাভাবিক ছিল যার উদাহরণ তুরস্কে রুমির তৈরি দরবেশ নৃত্যের সংস্কৃতি। কবিতা ও গান মুখস্থ করতে সুবিধা বলেই তারা আধ্যাত্মিক শিক্ষা এই ভাষায় তুলে ধরতেন। আতরের উৎসাহে হাফিজ সুফি শিক্ষার জন‍্য গজলের মতো একটি জনপ্রিয় প্রেমসঙ্গীত ব‍্যবহার শুরু করেছিলেন। তিনি শত শত গজল লিখেছেন, প্রেমের গানের আবহটা বজায় রেখেও তার কথায় নতুন নতুন অর্থ এবং গভীরতার নতুন নতুন স্তর যুক্ত করেছেন।

প্রেমের পরিপূর্ণ বোধে পৌঁছানোর পথের প্রতিটি ধাপ নিয়ে হাফিজ কবিতা লিখেছেন। প্রেমের খেলা, প্রিয়তম'র সৌন্দর্য, আকুলতার মিষ্টি বেদনা, অপেক্ষার তীব্র যাতনা, মিলনের পরমানন্দ সবই এসেছে তাতে। লিখেছেন প্রেমের বিভিন্ন রূপ ও স্তর নিয়ে, যেমন, প্রকৃতির সৌন্দর্য, আদর্শ অলভ্য নারীর প্রতি প্রেমাসক্তি, স্ত্রীর প্রতি মধুর অনুরাগ, সন্তানের প্রতি তীব্র মায়া; লিখেছেন স্ত্রী-সন্তান মারা যাওয়ার পরের তীব্র কষ্ট নিয়ে। গুরুর সাথে সম্পর্ক ও ঈশ্বরের কীর্তণও রয়েছে অনেক।

মানুষের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা হলো সে অন‍্যের কথা বা এমনকি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ‍্যেও নিজের মনের প্রতিধ্বনি আবিষ্কার করতে পারে। কবিরা এই ক্ষমতাটিই ব‍্যবহার করেন, এবং হাফিজ তা সর্বোচ্চ যতটা করা যায় ততটাই করেছিলেন। তার কবিতা ধনী-গরিব, ছোট-বড়, পণ্ডিত-মূর্খ নির্বিশেষে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি বাচ্চাদের মুখেও তার কবিতা শুনতে পাওয়া যায়।

তার কবিতা যারা ভালবাসত তাদের অধিকাংশই আসলে জানত না যে তিনি সুফি। আর তার শিক্ষক আতর যে সুফি তা তো কেউই জানত না। তখনকার সব সুফির মতো আতরও খুব গোপনে তার শিষ‍্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আতর মারা যাওয়ার পরই কেবল হাফিজ তার সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা মুখ ফুটে বলেছিলেন। তৎকালীন ইরানে এই গোপনীয়তার কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের মতো তখনও মাঝে মাঝে পুরো দেশ জুড়ে মৌলবাদের বন‍্যা বয়ে যেত। সরাসরি আল্লাহ'র সাথে সম্বন্ধ স্থাপন, এবং পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব এটা বলা মৌলবাদীদের কাছে ধর্মদ্রোহিতার সামিল। সুফি ধারার অনেককেই বিচারের পর হত‍্যা করা হয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তারা গোপনে আড্ডা দিত, এবং তাদের কথাবার্তা খুব নিগূঢ় ও প্রতীকী ভাষার আড়ালে লুকিয়ে উপস্থাপন করত। সুতরাং সুফি কাব‍্যের প্রতীকী ও রূপক মহিমার জননী আসলে বাধ‍্যবাধকতা। মদ ও পানশালা বলতে তারা বুঝাত যথাক্রমে প্রেম ও সুফি বিদ‍্যালয়; পাপিয়া ও গোলাপ ছিল প্রেমিক ও প্রেয়সী। আর অধ‍্যাত্মবিদ‍্যার্থীদেরকে ভাঁড়, ফকির, যাযাবর, বারবনিতা, বা মাদকাসক্ত ভবঘুরে হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।

কয়েকশ' বছর ধরে এই প্রতীকী ভাষা অনেক পরিবর্তনের মধ‍্য দিয়ে গেছে, এবং হাফিজের হাতে সবচেয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। এখনো আমরা হাফিজের কাব‍্যের আসল অর্থ নিয়ে দ্বিধায় থাকি। যেমন, তিনি যখন বাগানে হাঁটার কথা বলছেন তখন কি কেবলই বাগানে হাঁটার আনন্দ বর্ননা করছেন, না-কি নিজের সৃষ্টির মাঝে বিচরণ করতে আল্লাহর যে আনন্দ লাগে সেটা বর্ণনা করছেন? হয়ত দুটোই। কারণ হাফিজ আল্লাহকে বিশ্ব থেকে আলাদা করে দেখেন না, যেখানেই প্রেম, সেখানেই প্রেয়সী আছে। ভারতীয় সুফি গুরু ইনায়াত খান বলেছিলেন, "হাফিজের মিশন ছিল একটা ধর্মোন্মাদ বিশ্বকে বুঝানো যে ঈশ্বরকে কেবল স্বর্গেই নয়, বরং মর্ত‍্যেও পাওয়া যায়।"

ফার্সিতে অনেক সময় হাফিজকে অদৃশ‍্যের জিহ্বা বলা হয়, কারণ তার কবিতা শুনলে মনে হয় এ যেন প্রেয়সী বিশ্বের কাছে প্রেমিক ঈশ্বরের পাঠানো পরমানন্দপূর্ণ চিঠি। আমাদের চতুর্দিকে এবং আমাদের ভিতরে ঐশ্বরিক প্রাণের যে জাদুকরি সুন্দর ধারা বইছে তাতেই কিছুটা ভাগ বসাতে চেয়েছিলেন হাফিজ। তিনি আমাদেরকে প্রেমের পাখায় ভর করে উড়তে বলেছেন। আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব বিরাজ করতে বলেছেন। জীবনের সবচেয়ে নগণ‍্য জিনিসগুলোকেও ঈশ্বরের উপহার হিসেবে গ্রহণ করে উদযাপন করতে বলেছেন। তিনি চেয়েছেন আমরা এক নিমিখের জন‍্য হলেও ঘুম থেকে জেগে কান পেতে ঈশ্বরের আনন্দের হাসিটা শুনি।

হৃদয় ছাপিয়ে প্রস্ফূটিত এই
মহামূল‍্যবান প্রেম আর হাসিটা কী?
এ হচ্ছে একটি আত্মার
ঘুম থেকে উঠার শব্দ।

তথ্যসূত্র

  1. Henry S. Mindlin, "The Life and Work of Hafiz", Daniel Ladinsky, 1996, I Heard God Laughing: Renderings of Hafiz.
  2. Daniel Ladinsky, 1999, "Preface", The Gift, London: Penguin Compass.
  3. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, "পারস‍্যে"

লেখাটির ৬০%-ই হেনরি মাইন্ডলিনের প্রবন্ধের (১নং তথ‍্যসূত্র) তরজমা।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বহুত দিন পর কবিতা নিয়া একটা ভালো লেখা পড়লাম

সোহেল ইমাম এর ছবি

সুন্দর লিখেছেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তায়ীদ এর ছবি

সুন্দর লেখা। আমি নিজে কবিতা পাঠক নই, এবং কবিতা বিষয়ক লেখাগুলো সাধারণত এত কঠিন ভাষায় লেখা হয় যার অর্থ করা দুঃসাধ্য। ধন্যবাদ আপনার লেখার জন্য। সামনে আরও লেখা পড়তে পারব আশা করি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

(Y)

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চমৎকার। বুকমার্ক করলাম।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাহ! চমৎকার!!
(Y)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।