পুরো উনিশ শতক এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার শিক্ষিতমহলে যা ঘটেছে তাকে "রেনেসাঁস" বলা যায় কি-না, এবং তার সাথে চতুর্দশ শতকের "ইতালীয় রেনেসাঁসের" তুলনা করা যায় কি-না সে নিয়ে বিতর্ক আছে। আর সব বিতর্কের মতো এই বিতর্কেরও দুটো চরম-পক্ষ রয়েছে: এক পক্ষ একে রেনেসাঁস বলে মানেনই না, আর অন্য পক্ষ একে একেবারে ইতালীয় রেনেসাঁসের কাতারে ফেলেন। শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় এ নিয়ে একটা থিসিস লিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০০০ সালের অক্টোবরে "ইতালীয় রেনেসাঁসের আলোকে বাংলার রেনেসাঁস" নামে এটি বই আকারে প্রকাশ করে কলকাতার প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স। বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় উল্লেখ করেন, ইতালীয় রেনেসাঁস একশো বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি, কারণ তার বিপরীতে চার্চ কাউন্টার-রেনেসাঁ শুরু করে। তবে রেনেসাঁসের মাধ্যমে যে "হিউম্যানিজম"-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল তার প্রভাব এ-যাবৎ কেবল বেড়েছেই। ইতালীয় রেনেসাঁস ম্যাজেলানের জাহাজের মতো পুরো পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব একেক জাতি একেক-ভাবে নিয়েছে। রেনেসাঁস ইংল্যান্ডে এসে ভিঞ্চি বা মিকেলাঞ্জেলোর মতো চিত্রকরের জন্ম দেয়নি, দিয়েছে মার্লো, মিল্টন, শেক্সপিয়রের মতো কবির। অন্নদা আক্ষেপ করে বলেন, "রেনেসাঁসকে ইতালীয় মডেল গ্রহণ করতে হবে এরকম দাবি জার্মানিতেও ওঠেনি, রাশিয়াতেও ওঠেনি, উঠেছে কি-না বাংলা দেশে।" দেখতে, শুনতে হুবহু ইতালীয় রেনেসাঁসের মতো না হলেও বাংলার রেনেসাঁসকে দ্বিধাহীনভাবে "একটি রেনেসাঁস" বলতে আপত্তি কোথায়? যারা বলেন রেনেসাঁস হয়নি তারা "কী করে বোঝাবেন বাংলা কাব্য থেকে দেবদেবীর কল্পনা উঠে গেল কেন।"
আর এই-বা যদি শেষ হতো! রেনেসাঁস হলেও সেটা কবে, কিভাবে, কী রূপে হয়েছে সে নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। বিতর্ক ভালো জিনিস। যেখানে বিতর্ক নেই, যেখানে দুটো চরম-পক্ষ নেই, দ্বন্দ্ব নেই, সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি হয় না। বাংলার রেনেসাঁস নিয়ে একটা বড় বিতর্ক হলো, তাতে মুসলমানদের অবদান ও অবস্থান কী ছিল। এটাই শক্তিসাধনের বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ের বিষয়। মুসলমানরা যে বাংলার রেনেসাঁসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও ভাগীদার সে নিয়ে তার সন্দেহ এতই কম যে ১৮৬০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া বাঙালি মুসলমানদের জাগরণকে তিনি "বাংলার ইতিহাসে দ্বিতীয় রেনেসাঁস" বলেছেন। এই অধ্যায়ের সার-বক্তব্যই আমি এখানে স্বমতসহ স্বভাষায় তুলে ধরব। ঠিক কোন্ বাক্য বা বাক্যাংশগুলো একবারে আমার নিজের তা আলাদা করে বলা কঠিন, কিন্তু অন্তত এটুকু বলতে পারি, তারা সংখ্যায় বেশ কম। নিছক তথ্য-সংযোজনের বাইরে আমি যদি নিজের বড় কোনো মত উল্লেখ করি তাহলে আগে বলে নেব যে সেটা আমার কথা।
অন্ধকার ছাড়া আলো হয় না, ঘুম ছাড়া জাগরণ হয় না। রেনেসাঁস বানাতে তাই অন্ধকার যুগ লাগে। ইউরোপে মধ্যযুগকে অন্ধকার বলা হয়েছে। বাংলায় অন্ধকার যুগ কোনটা সে নিয়ে দ্বিধা নেই, কিন্তু অন্ধকারের কারণ বর্ণনা করতে গিয়েই অনেকে বাংলার হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের শিকার বা ঘটক হয়েছেন। যদুনাথ সরকার ১৭৫৭ সালকে রেনেসাঁসের সূচনা ধরেছেন, সেহেতু সে বছর পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার "বিদেশী" মুসলমান শাসনকে হিন্দুদের অবক্ষয়ের কারণ বলেছেন, যা থেকে ইংরেজ শাসনামলে তাদের মুক্তি ঘটেছে। যারা রেনেসাঁস ঘটেছে বলেন তাদের অনেকে মুসলমান-শাসন ও মুসলমান-সমাজকে ঘুমের কারণ বলেছেন, আর যারা "বাংলার" রেনেসাঁস ঘটেনি বলেন তাদের অনেকে কারণ হিসেবে বলেছেন, এটা ছিল শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুদের জাগরণ। শক্তিসাধন এসব সরল সমীকরণের বিরোধিতা করেছেন। প্রথমত, এটা রেনেসাঁস ছিল, এবং দ্বিতীয়ত, এটা হিন্দু-মুসলমান উভয়ের রেনেসাঁস ছিল।
তবে মুসলমানরা রেনেসাঁসে শরিক হয়েছে দেরিতে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এতে কেবল হিন্দুরাই অংশ নিয়েছিল। মুসলমানদের ঘুম ভেঙেছে দ্বিতীয়ার্ধে। এর কারণ কী? অনেকে কারণ হিসেবে বলেন, রেনেসাঁস-পুরুষরা না-কি মুসলমান-বিদ্বেষী ও হিন্দু-প্রেমী ছিলেন, যার কোনোটাই ঠিক নয়। তাদেরকে কেবল মানবপ্রেমীই বলতে হবে। প্রমাণ হিসেবে শক্তিসাধন কয়েকজন রেনেসাঁস-পুরুষের "সেকুলারিজম" ও "হিউম্যানিজমের" উদাহরণ দেন। রামমোহন রায় বাল্যকালে ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন, এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার খোঁজ পাওয়ার আগেই তার "চরিত্র, চিন্তা-চেতনা পরিণত রূপ পেয়েছিল।" তার প্রথম বইটি ফার্সি ভাষায় লেখা, নাম 'তুহ্ফাতুল মুওয়াহ্হিদিন' ('একেশ্বরবাদীর উপহার', ১৮০৩)। এতে তিনি দাবি করেছেন, ঈশ্বর কেবল একজন, এবং সব ধর্মই এই একেশ্বরের ধ্যান করেছে। অনেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে রামমোহনকে 'মাজমা-উল-বাহরাইন'-এর (দুই সমুদ্রের মহামিলন) প্রবক্তা দারাশিকো'র উত্তরসূরি বলেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন "সেকুলার হিউম্যানিজমের পরাকাষ্ঠা," ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতেই তিনি রাজি ছিলেন না। ডিরোজিওর বিরুদ্ধে হিন্দু পরিবারের ছেলেদের নাস্তিক বানানোর অভিযোগ উঠেছিল। অক্ষয়কুমার দত্ত মনে করতেন, 'বিশ্বরূপ মূলগ্রন্থ' পাঠের মাধ্যমেই কেবল সত্য জানা সম্ভব। (এরা ধর্ম বা নির্ধর্মের মোড়কে বিশ্বকে দেখতেন না, দেখতেন কেবলই 'মানবিক' দৃষ্টিকোণ থেকে।) মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'-তে বাচস্পতি ও হানিফ চরিত্রকে জোটবদ্ধ করেছেন। দীনবন্ধু মিত্র 'নীলদর্পণ'-এ নবীনমাধব ও তোরাপকে সংগ্রামের সাথী করেছেন। "বঙ্গসংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র" ঠাকুরবাড়িতে "ইসলামি সংস্কৃতির হাওয়া বইত।" দেবেন্দ্রনাথ পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় "উচ্চৈস্বরে হাফিজের কবিতা আবৃত্তি করতেন।" অনেক রেনেসাঁস-পুরুষ ফার্সি জানতেন। সাধারণ হিন্দুদের মধ্যেও ফার্সি শেখার চল ছিল: বাংলার পাঁচটি জেলায় ফার্সি-জানা হিন্দুর সংখ্যা ফার্সি-জানা মুসলমানের চেয়ে বেশি ছিল।
তাহলে "সূয্যিমামা জাগার আগে" মুসলমানরা জাগতে পারেনি কেন? বাংলার রেনেসাঁসের কারণগত উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি। মেকলে লিখেছেন, ভারতে "প্রাচীন সাহিত্যের চেয়ে এখন ইংল্যান্ডের সাহিত্য বেশি মূল্যবান।" (এতে হীনমন্যতার কিছু নেই, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ঘুমই অন্য কারো ডাকে ভেঙেছে: মিশরের ডাকে গ্রিসের, গ্রিসের ডাকে আরব-ইরান-ইতালির, ইতালির ডাকে ইংল্যান্ডের, ইংল্যান্ডের ডাকে আমেরিকার, আমেরিকার ডাকে ফ্রান্সের, ফ্রান্সের ডাকে ব্রিটেনের, ব্রিটেনের ডাকে বাংলার।) মুসলমানরা শুরুতে এই পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকেই দূরে ছিল, যার কারণ অনেক। ব্রিটিশরা যেহেতু মুসলমানদেরকে "রাজার জাতি" হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে সেহেতু প্রথমদিকে ব্রিটিশদের প্রতি মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল বেশি। তার উপর, আরবের ওয়াহাবিরা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতকে "দারুল হারাব" অর্থাৎ বিধর্মী-শাসকের দেশ বা শত্রুর দেশ আখ্যায়িত করে, যা অনেক ভারতীয় মুসলমানকে প্রভাবিত করেছিল। উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ আহমদ বেরলভি'র শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ওয়াহাবি-ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার কথা বলা যায়। আরেকটা কারণ হলো অর্থনৈতিক: বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী দেরিতে তৈরি হয়েছে। উনিশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মুসলমানরা 'আশরাফ' (অভিজাত) ও 'আতরাফ' (নিম্নবিত্ত) এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। হিন্দুদের মধ্যে বর্ণপ্রথা থাকলেও অনেক বর্ণের হিন্দুদের একাংশ মিলে একটা মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি করেছিল, যা মুসলমানদের মধ্যে দেরিতে হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ছাড়া রেনেসাঁস হয় না। ইতিহাসবিদ A. F. Pollard বলেন, "যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নেই, সেখানে রেনেসাঁস ও রিফর্মেশন নেই।" বিনয় ঘোষ বলেছেন, "ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসও প্রধানতঃ মধ্যবিত্তের হাতে গড়া।" এছাড়া রেনেসাঁসের কেন্দ্র ছিল কলকাতা, আর কলকাতার আশপাশের অঞ্চলগুলো ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ববঙ্গের অনেক মুসলমানের পক্ষে এতদূর এসে আলোর মিছিলে শামিল হওয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু, অধিকাংশ মুসলমান কৃষিজীবী হওয়ার কারণে গ্রামের মায়া কাটিয়ে শহরে যেতে চায়নি। সবশেষে আহমদ ছফা'র বলা মনস্তাত্ত্বিক কারণটিও উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। ছফা'র ভাষায়:
"দিনের পর দিন গিয়েছে, নতুন ভাবাদর্শ এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসন পদ্ধতি চালু করেছেন, কিন্তু তাঁরা (বাঙালি মুসলমান) মনের দিক থেকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতোই বারবার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছেন।" ['বাঙালি মুসলমানের মন']
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমানরা ধীরলয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। এর অন্যতম কারণ, মুসলমান ও ব্রিটিশ দু-পক্ষই ঘটনাচক্রে পরস্পরের দিকে আসতে শুরু করেছিল। W. W. Hunter-এর 'The Indian Mussalmans' এই পরিবর্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যদিও বইটা পুরোপুরি ইংরেজ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। হান্টারের বই থেকে জানা যায়, মুসলমান ধর্মনেতারা রীতিমতো লিখিত বয়ানের মাধ্যমে ওয়াহাবি-দের "জিহাদ তত্ত্বের" ব্যাখ্যা পাল্টে দিয়েছিলেন। এর কারণ, ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশরা ভারতের কয়েক ডজন ওয়াহাবির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কলকাতার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আমির খানের বিরুদ্ধে মামলাটি। ইতিহাসে এগুলো "Great Wahabi Trial" নামে পরিচিত। কাজী আবদুল ওদুদ এ-কারণে ১৮৬৮ সালকে ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয় মুসলমানদের সম্পর্ক উন্নয়নের দিক দিয়ে একটি যুগান্তকারী বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলমানদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার আরেকটি কারণ সম্ভবত ছিল রাজভাষার পরিবর্তন। আগে আরবি-ফারসি জানলেই সরকারি চাকরি পাওয়া যেত, ইংরেজি রাজভাষা হওয়ার পর মুসলমানদের সেই সুযোগ আর থাকেনি। অন্যদিকে ব্রিটিশদের মুসলমানদের দিকে ঝোঁকার কারণ ছিল হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উত্থান। ইউরোপে যেমন হিউম্যানিস্ট রেনেসাঁসের পর ধর্মীয় রিফর্মেশন এসেছে, তেমনি বাংলায়ও সেকুলার রেনেসাঁসের পর বঙ্কিমদের হাত ধরে ধর্মীয় রিভাইভালিজম শুরু হয়। হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রভাব কমাতে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'-এ বিশ্বাসী ব্রিটিশরা মুসলমানদের ব্যবহার করে। এই ডামাডোলের মধ্যেই মুসলমান-সমাজের প্রথম রেনেসাঁস-পুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। ইংরেজি-শিক্ষিত নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক প্রবন্ধ আহ্বান করেন, এবং তার বাড়িতেই ১৮৬৩ সালে 'মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক কারণটাও বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পাট-শিল্পের বিকাশ ঘটার কারণে কৃষিজীবী মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে, এবং মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হতে শুরু করে। পুঁজিবাদের অমোঘ চক্র মেনে বাণিজ্যিক কারণে যাতায়াত ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে, এবং পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পক্ষে কলকাতায় আসা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
এটুকু পড়ে আমার মনে হলো, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরই মুসলমানরা প্রথম নিজধর্মকে বলতে সমর্থ হয়েছিল:
"আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!"
তবে তারা "ঊষা দিদির ওঠার আগে" উঠতে পারেনি। হিন্দু ও মুসলমান সমাজের জাগরণের প্রাথমিক ঘটনাগুলোর সময়কাল খতিয়ে দেখলেই বুঝা যায়, মুসলমানরা হিন্দুদের অন্তত ৫০ বছর পরে জেগেছে। যেমন, ১৮১০-এর দশকে রামমোহন 'আত্মীয় সভা' প্রতিষ্ঠা করেন, 'হিন্দু কলেজ' স্থাপিত হয়, এবং গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্য 'বাঙ্গাল গেজেটি' প্রকাশ করেন। হিন্দুদের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৪৮ সালে। আর হিন্দুদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক বিকাশ ঘটে ১৮৫০-এর দশকে। এর বিপরীতে মুসলমানদের প্রথম সাহিত্যসভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৩ সালে। এরপর ১৮৭০-এর দশকে 'আলিগড় মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ' স্থাপিত হয়, আবদুর রহিম 'বালারঞ্জিকা' প্রকাশ করেন, এবং মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথম 'মুসলিম বালিকা মাদ্রাসা' স্থাপিত হয় ১৮৯৭ সালে। আনিসুজ্জামান বাঙালি মুসলমানদের জাগরণ, বা বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁসের সূচনাবর্ষ ধরতে চেয়েছেন ১৮৭০কে।
রেনেসাঁস প্রমাণিত করার জন্য গুটিকয়েক ঘটনা দেখানো যথেষ্ট নয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মুসলমানদের কর্মযজ্ঞ যে আসলেই বিশাল ছিল তা ওয়াকিল আহমদের 'উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা' এবং আনিসুজ্জামানের 'মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য' বইয়ে ফুটে উঠেছে। শক্তিসাধন এর মধ্যে বেশ কিছু সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকা, ও সাহিত্যকীর্তি উল্লেখ করেছেন। তার মতে হিন্দু-সমাজের জাগরণের প্রাথমিক পর্বে সভা-সমিতির যে জোয়ার বয়েছিল, তা পঞ্চাশ বছর পর মুসলমান-সমাজেও এসেছে। পত্র-পত্রিকার মধ্যে আবদুর রহিম একাই নয়টি সম্পাদনা করেছিলেন। আর প্রথম আধুনিক বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। "নবজাগরণের প্রধান ভাষা-মাধ্যম" যে গদ্য মীর মশাররফ তাকেই সহায় করেছিলেন। কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, মাইকেল অনুসারী হামিদ আলি, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, এবং বেগম রোকেয়া সবাই এ-সময়কার। ইসলামি ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণামূলক বই লেখাও তখন থেকেই শুরু হয়। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী লিখেন 'ভারতে মুসলমান সভ্যতা'। মোহম্মদ নইমুদ্দিন কুরআন বাংলায় অনুবাদ করেন। আর পুঁথি-বিশেষজ্ঞ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তো আছেনই।
হেগেল বলেছিলেন, ইতিহাস দ্বান্দ্বিক (ডায়ালেক্টিক্যাল) প্রক্রিয়ায় চলে। পরস্পরকে ঘৃণা করে এমন দুইজন মানুষের মধ্যে অসচেতন সাংঘর্ষিক সম্মিলনকে দ্বান্দ্বিকতার উপমা হিসেবে ব্যবহার করা যায়; এটা এমন অসম্ভাব্য কিছুও না, অনেক সংসারে এই প্রক্রিয়াতেই বাচ্চা উৎপাদিত হয়। সমাজে দুটো পরস্পরবিরোধী ভাবধারা পরস্পরের সাথে সংঘাত করতে করতে একসময় সম্মিলিত হয়ে একটি নতুন ভাবধারার জন্ম দেয়, তবে সেই নতুন ভাবধারারও একটি বিপরীত-পক্ষ তৈরি হয়, তাই দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং রিফর্মেশনকে দুটো বিপরীতধর্মী ভাবধারা বলা যায়। রেনেসাঁস এক ধরনের "নবজাগরণ"; অতীত থেকে শিখে নতুন কিছু তৈরির মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া, অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। অন্যদিকে রিফর্মেশন ছিল এক ধরনের "রিভাইভালিজম" বা "পুনর্জাগরণ"; অর্থাৎ স্বয়ং অতীতটাকেই পুনরায় জাগ্রত করা, অতীতের কিছু জিনিসেই ফিরে যাওয়া। বাংলার ইতিহাসে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের হিন্দু-জাগরণের মতো দ্বিতীয়ার্ধের মুসলমান-জাগরণেও নবজাগরণ ও পুনর্জাগরণ এই দুটো উপাদান ছিল। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে যেখানে নবজাগরণের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেখানে দুই পক্ষ একইসাথে জাগতে শুরু করেছে। এর একটা কারণ হয়ত হিন্দু-পুনর্জাগরণ নিজেই। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের হিন্দু-নবজাগরণকে যে প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হতে হয়নি, দ্বিতীয়ার্ধের মুসলমানদেরকে তার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মৌলবাদ অনেক সময় একটা শক্ত প্রতিপক্ষের ডাকে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, তা ডাকটা বাস্তবই হোক আর ঘুমন্তের স্বপ্নপ্রসূতই হোক। উনিশ শতকের ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে সেই প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু মৌলবাদ। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর মতো শক্তিশালী লেখকও এই বিতণ্ডায় জড়িয়ে নিজের সাহিত্যমান খাটো করেছেন। তার চারটি উপন্যাস এই প্রতিক্রিয়াজাত। শক্তিসাধন লিখেছেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মুসলমানদের লেখালেখি "যতখানি জাগরণের ক্রিয়াজাত, ঠিক ততখানিই হিন্দু-পুনর্জাগরণের প্রতিক্রিয়াজাত।" সবচেয়ে প্রকট উদাহরণ সৈয়দ আবুল হোসেন, যার দু'টি বইয়ের নাম করাই এখানে যথেষ্ট—'দুর্গেশনন্দিনী বা ত্রিজারজা' এবং 'কপালকুণ্ডলা বা সখের সতীন'।
শক্ত প্রতিপক্ষের ডাকে ঘুম ভাঙলেও মনে রাখতে হবে মৌলবাদকে শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হয়, এবং এই উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটা তার নিজের সংস্কৃতি থেকেই আসে, বিরোধী-সংস্কৃতি থেকে না। মুসলমানদের মৌলবাদী পুনর্জাগরণের বীজ তাদের সমাজেই প্রোথিত ছিল। শক্তিসাধন মনে হয়েছে এই বীজকে আহমদ ছফা'র মতোই পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক বলেছেন, যা অবশ্যই একটি সরলীকরণ, কিন্তু অচিন্তিত সরলীকরণ নয়। তাই "বাঙালি মুসলমানের মন" আসলেই মনোযোগ ও সহানুভূতির সাথে বুঝার চেষ্টা করা উচিত। বাঙালি মুসলমানরা তখনো নাবালক ছিল, আর নাবালকদেরকে কারো না কারো কোলে আশ্রয় নিতে হয়। পুনর্জাগরণবাদীরা আশ্রয় নিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগৌরবে। খোন্দকার ফজলে রাব্বি 'The Origin of Musalmans of Bengal' (১৮৯৫) বইয়ে দাবি করেছেন বাঙালি মুসলমানদের "অধিকাংশই খাস আরব, পারস্য, তুরস্ক থেকে আগত।" এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই। আশরাফ শ্রেণীর কারো কারো মধ্যে হয়ত মধ্যপ্রাচ্য-রক্ত ছিল, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মোট সংখ্যার তুলনায় সেটা অতি নগণ্য। (এই কোলে-ওঠা'র চল এখনো বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আছে—এখনো অনেক পরিবার তাদের বংশলতিকার প্রথম পুরুষ ধরে কোনো আরব, ইরানি, আফগান, বা তুর্কীকে; আমার নিজের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়: খান জাহান আলী থেকে শুরু করে একেবারে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত একটা সম্পূর্ণ বংশতালিকা আমাদের পরিবারে আছে, যা খুব সম্ভবত কয়েক প্রজন্মের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফল।)
[দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য]
মন্তব্য
বাঙ্গালী মুসলিমের মৌলবাদের কিছু উপাদান কি সেই দ্বিতীয় রেনেসাঁসের সময়েই জন্ম হয়েছিল?
লেখাটা ভালো লাগছে। দ্বিতীয় পর্ব পড়বার জন্য এখনই অস্থির।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
হ্যাঁ, এই ব্যাপারে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নেই যে উনিশ শতক থেকেই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে "আধুনিক অর্থে মৌলবাদ" শুরু হয়েছে। "আন্তর্জাতিক ইসলামি মৌলবাদ" বুঝতে হলে যেমন গত ১০০০ বছরের বিশ্ব-ইতিহাস মাথায় নিয়ে তারপর এগুনো উচিত, তেমনি "বাংলার ইসলামি মৌলবাদ" বুঝতে হলে আমার মনে হয় বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন থেকে শুরু করে সবকিছু বিবেচনায় আনা উচিত। এই উদ্দেশ্যেই আসলে ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। আমি ইসলাম ধর্মকে মূলগতভাবে মৌলবাদীদের ব্যাখ্যার মতো মনে করি না। প্রাচীন সুন্নি ইসলামের সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্ডিতরা আধুনিক অর্থে মৌলবাদী ছিলেন না। আধুনিক মৌলবাদের শুরু হয়েছে সৌদি আরবের ইবনে আব্দুল ওয়াহাব, মিশরের হাসানুল বান্না, পাকিস্তানের মওদুদি, ইরানের আয়াতুল্লাহ এদের মাধ্যমে। এরা (শিয়ারা ছাড়া) অনুপ্রেরণা নিয়েছে প্রাচীন পণ্ডিত আহমাদ ইবনে হানবাল এবং ইবনে তাইমিয়া'র কাছ থেকে, যারা কিন্তু তাদের যুগে অবহেলিত ছিলেন। ঐতিহাসিক ইসলামের একটা অবহেলিত ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আধুনিক মৌলবাদীরা আধুনিকতার সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ইতিহাসটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আকর্ষণীয়।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
মিশরের সৈয়দ কুতুবের নাম বাদ দিলে এই তালিকাটা মনে হয় গুরুতরভাবে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কুতুবকে কি আধুনিক মৌলবাদের অন্যতম প্রাণপুরুষ বা তাত্বিক গুরু বলা যায় না?
****************************************
সরি মন্তব্যটা আগে দেখিনি। একদম ঠিক বলেছেন। আসলে কুতুবই বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইসলামের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক। কুতুবের 'ফি যিলালিল কুরআন' বাংলাদেশে জামাত-শিবিরের কাছে মওদুদির 'তাফহিমুল কুরআন'-এর পরই সবচেয়ে বড় পাঠ্য।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
জামায়াত-শিবিরের অবশ্যপাঠ্য বইয়ের মধ্যে সাইয়্যেদ কুতুবের 'ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম' অন্যতম।
আল-গাজ্জালি সম্পর্কে আপনার কি মূল্যায়ন?
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
গাজ্জালির ভাল দিক এবং খারাপ দিক দুটাই আছে। প্রথমে খারাপটা বলি:
- গাজ্জালি প্রধানত একজন ধর্মতাত্ত্বিক। ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দর্শনকে আক্রমণ করেছেন, আর তার কাছে দর্শন বলতে ছিল প্রধানত প্লেটো, এরিস্টটল, আল-ফারাবি, ও ইবনে সিনা। তিনি "দার্শনিকদের অসঙ্গতি" বইয়ে দার্শনিকদের ২০টি মতবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন, এবং এর মধ্যে বিশেষ করে ৩টি মতবাদে যারা বিশ্বাস করবে তাদেরকে "যান্দাক্বা" (গুপ্ত ধর্মত্যাগী) ও কতলযোগ্য বলেছেন। এটা খুবই ক্ষতিকর একটা কাজ ছিল। ইবনে সিনা, আল-ফারাবি সবাই পুরোপুরি বিশ্বাসী ধার্মিক ছিলেন, এবং এরিস্টটলের সাথে তারা ইসলামের অসঙ্গতি দেখতে পেতেন না, আর তাদেরকেই কি-না গাজ্জালি কতলযোগ্য বললেন। গাজ্জালির এই ফতোয়ার দুঃস্বপ্ন থেকে মুসলমানরা আরো অনেক দিনেও জাগতে পারবে না। তবে আশার কথা যে ইবনে রুশদ এই বইয়ের প্রতিবাদে "অসঙ্গতির অসঙ্গতি" নামে আরেকটা বইয়ে গাজ্জালিকে খণ্ডন করেছিলেন।
- অনেকে মনে করত গাজ্জালির কারণেই ইসলামি বিশ্বে সেকুলার শিক্ষার প্রভাব কমতে শুরু করে। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণাকে অনেকে ভুল বলছেন। কারণ ধর্মতাত্ত্বিক হলেও গাজ্জালি আসলে দর্শন ও বিজ্ঞান থেকে অনেক কিছু নিয়েছিলেন। এবং তার প্রভাবেই ইসলামি ধর্মতত্ত্বে এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার প্রসার ঘটেছিল।
এবার ভাল দিক:
- গাজ্জালি প্রথানুগত ইসলাম ধর্মের সাথে সুফিবাদের সামগ্রিক সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, এবং সুফি পন্থাকেই সর্বোত্তম পন্থা বলেছিলেন। গাজ্জালি ছিলেন বলেই সুফিবাদকে কোন মুসলমান সহজে অনৈসলামিক আখ্যা দিতে পারে না। একজন সুফি হয়ে তিনি কিভাবে ইবনে সিনা-কে কতলযোগ্য বলতে পারলেন সেটা নিয়েও আমি এখনো ভেবেই যাচ্ছি, কোনো সমাধান পাইনি (পেলে জানাব)।
- আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি গাজ্জালি রীতিমত বিজ্ঞানবাদী ছিলেন। ধর্মগ্রন্থ এবং সুপ্রমাণিত বিজ্ঞানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তার মতে বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়া উচিত, এবং ধর্মগ্রন্থের বিকল্প ব্যাখ্যা খোঁজা উচিত। কারণ তার মতে ধর্মীয় বাণী বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যার অনেক সুযোগ আছে, এবং নানান মানুষের হাত ধরে ধর্মের অনেক কথা যেভাবে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তা ত্রুটিমুক্ত না; এর তুলনায় বিজ্ঞান অনেক ত্রুটিমুক্ত। গাজ্জালি সরাসরি বলেছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যা বলে সব মেনে নিতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী ধর্মগ্রন্থকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই কথা সে গালিলেও আসার ছয়শ' বছর আগে বলছিল।
গাজ্জালি নিয়ে এখানে সামান্য লিখেছিলাম। তবে অনেকদিন ধরেই গাজ্জালিকে নিয়ে পড়ছি। খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র। এই পডকাস্ট সিরিজের ১৪৩ থেকে ১৪৫ এই তিন পর্বে বেশ ইন্টারেস্টিং আলোচনা পাবেন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
গাজ্জালীর এমন মনোভাবের কথা জানতাম না। সম্ভবত 'স্থানীয়' টেক্সট সচেতনভাবে এই কথাগুলো সেন্সর করে গেছে। দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে আমি সবসময় গাজ্জালীর 'দর্শনবিরোধী এবং প্রশ্নবিরোধী' রূপটুকুই পেয়েছি।
মুক্তমনার লেখাটা আগে পড়া হয়নি, ভাল লাগল। এই কথাগুলোই আমারও বলার ছিল।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বেশ খাটাখাটুনি করে লেখা এই পোস্টটার জন্য ধন্যবাদ।
বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এতো আলোচনা হয়েছে, এতো লেখালেখি হয়েছে যে এটা নিয়ে কথা বলতেও ক্লান্ত লাগে। বাংলার রেনেসাঁর দাবীদাররা যে বিষয়টা বুঝতে চান না সেটা হচ্ছে রেনেসাঁ হয়েছে কি হয়নি এটা যুক্তি দিয়ে বোঝার বিষয় নয়। মাস লেভেলে জনগণের মানস, আচরণ, সংস্কৃতি, শিল্পচর্চ্চা, দর্শন ইত্যাদি থেকে একজন বিদেশীও বুঝতে পারবে সে অঞ্চলে রেনেসাঁ হয়েছে কি হয়নি। কলকাতা থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরের কোন গাঁয়ে গেলে ব্রিটিশ ভারত দূরে থাক এখনো এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলা তো পৃথিবী বিচ্ছিন্ন কোন জায়গা না যে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সারা দুনিয়ায় যে পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে সেটা হবে না। প্রযুক্তিগত উন্নয়ণ, বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তন, সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি ও কৌশলে পরিবর্তন শিক্ষিত সমাজে তো বটেই মাস লেভেলেও ব্যাপক পরিবর্তন আনে। বাংলাতেও সেটা হয়েছে। কিন্তু রেনেসাঁ একটা বড় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, দর্শন, জীবনাচরণ, শিল্পসংস্কৃতিতে পরিবর্তনের যে উল্লম্ফন ঘটায় সেটা বাংলাতে কিছুই হয়নি। কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুমশায় আর মিঁঞাসাহেবরা গ্রামবাংলাকে চোখেই দেখেননি, সুতরাং সেখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে কি হয়নি সেটা তারা কী করে বলবেন? ইউরোপের রেনেসাঁর খবর সারা দুনিয়া জানে, সেটা তাদের ঢাকঢোল পেটানোর জন্য না। ইউরোপের কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করেছে সেখানে রেনেসাঁ হয়েছিল। বাংলা কি তার সমতুল কোন কিছু দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করতে পেরেছে?
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সামন্ততন্ত্রের বিদায় ঘন্টা বাজা, সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিবর্তন, বুর্জোয়াঁ বিকাশ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব প্রাচীন ধ্যানধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দেয়। ফলে দুটো ভিন্ন শ্রেণী দুটো ভিন্ন উপায়ে আদাজল খেয়ে নামে। একটা দল নৈরাজ্যবাদীদের মতো (স্মর্তব্য একই সময়ে সারা দুনিয়ায় নিহিলিস্টদের জয়জয়কার চলছে) প্রচলিত সবকিছুকে নেগেট করে গেছে। এই অতি স্বার্থপরের দল ধ্বংসের পর কী নির্মাণ করতে হবে, কীভাবে নির্মাণ করতে হবে সেটা বলার বা করার কোন চেষ্টা করেনি। এদেরকে যারা মডেল বিবেচনা করেছে তারা তাদের জীবদ্দশাতেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জাতীয়জীবনে ধনাত্মক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এদের কোন অবদান নেই। ঔপনিবেশিক প্রভুদের খুদকুঁড়ো খুঁটে খাওয়া এদের নাম সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃতির আড়ালে গেছে, সেটাকে আর খুঁড়ে আনার দরকার নেই।
দ্বিতীয় দলটা প্রগতিশীলতার ভেকধারী চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের দল। এই গ্রুপটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় এরাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ভোগ করে গেছে। এরাও জাতীয় বিপ্লব সংগঠনের সকল সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে ঔপনিবেশিকতাকে জিইয়ে রেখেছে। এরা সংস্কারের নামে পুরনো মদকে নতুন বোতলে ভরে এনে হাজির করেছে। এদের সংস্কারের নমুনা বোঝার জন্য ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস পাঠ যথেষ্ট। স্বাভাবিকভাবে বাংলার জনগণের কাছে এদের তথাকথিত সংস্কার ঠাঁই পায়নি। জনমানসের পরিবর্তন কী কারণে ও কীভাবে হচ্ছে সেটা তাদের বোধের বাইরে ছিল।
বাংলার শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা অথবা সেক্যুলার ভাব প্রকাশের যে প্রবণতা দেখা যায় সেটা গড় হিসেবে আরেকটা ভণ্ডামী। বাংলার শিক্ষিত মুসলমানরা এই ক্ষেত্রে হিন্দুদেরই মিরর ইমেজ। উভয় গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িকতার সপক্ষে যেসব উদাহরণ দেয়া হয় একটু খতিয়ে দেখলে সেগুলোর বেশিরভাগের অসারতা বোঝা যায়। এই দুই ভণ্ডের দল বাংলাকে দুইবার ভাগ করিয়েছে, কলকাতা থেকে রাজধানী সরানো বা তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ কোনটাই ঠেকানোর কোন চেষ্টা করেনি। এই দুই ভণ্ডের দল সারা জীবন আত্মপরিচয় সংকটে ভুগে গেছে, জাতিকেও ভুগিয়েছে।
কথা হচ্ছে, এর কি কোন ব্যতিক্রম নেই? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এর ব্যতিক্রম বিদ্যমান। এবং সেই ব্যতিক্রম মূলস্রোত চালানো বাকি কুলাঙ্গারদের উপস্থিতি আরও স্পষ্ট করে।
বুঝলাম আপনি রেনেসাঁস-হয়নি দলের। এই যুক্তির একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আপনি রেনেসাঁস বলতে বিশাল কিছু বুঝাচ্ছেন। আসলে রেনেসাঁস সেরকম আহামরি কিছু না। ইতালীয় রেনেসাঁস প্রথম দুই-তিনশ' বছর সামান্য কিছু মানুষের মধ্যেই সীমিত ছিল, সেটার প্রভাব সমাজে তখন পড়েনি বললেই চলে। এখন সেটাকে যদি রেনেসাঁস বলা যায়, তাহলে বাংলার রেনেসাঁস অস্বীকারেরও কোনো কারণ নেই। ইতালীয় রেনেসাঁসের লোকেরাও গ্রামের খবর রাখতেন না। গ্রামের লোকেরা ভিঞ্চি মহাশয়ের নামটা ছাড়া আর কিছুই জানতেন না, নামটাও জানতেন কি-না সন্দেহ। ইংল্যান্ডে রেনেসাঁসের প্রভাব পড়েছে সেই ষোড়শ শতকে, কিন্তু কেবলই অভিজাত মহলে; ইংল্যান্ডের খেটে-খাওয়া গরিব শ্রেণীর মধ্যে বিংশ শতকের শুরুতেও (৪০০ বছর পরও) ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কোনো প্রভাব পড়েনি (এটা আমার অনুমান, নিশ্চয়তা দিতে পারছি না)।
মন্তব্যের বাকি অংশে আপনি বিভিন্ন দল তৈরি করে তাদেরকে ইচ্ছামত গালিগালাজ করলেন। আমি আসলে আপনার তৈরি এসব দলের সাথে একেবারেই পরিচিত না। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করা ধৃষ্টতা।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
না, রেনেসাঁ বলতে আমি বিশাল কিছু বোঝাচ্ছি না। প্রথমত, ইতালির রেনেসাঁ মানে যেমন কেবল ফ্লোরেন্স বা রোমের রেনেসাঁ না তেমন বাংলায় রেনেসাঁ প্রমাণ করতে গেলে তার সীমা কলকাতা শহরে আবদ্ধ করলে চলবে না। পঞ্চদশ শতকে কোন ধ্যানধারণার ডিসপারশন যে গতিতে এবং যে বিস্তৃতিতে হবে বিংশ শতকে তার বহুগুণ দ্রুত গতিতে এবং আরও বড় ব্যপ্তিতে হবে। তাছাড়া পর পর দুইটি মহাযুদ্ধের প্রভাব ও কিছু কিছু প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক অগ্রগতি এই পরিবর্তনের গতি তার আগেক শতকের চেয়ে বাড়িয়ে দেবার কথা। সুতরাং সময় লাগার ক্ষেত্রে আপনি বাংলার রেনেসাঁর সাথে ইতালির রেনেসাঁর যে তুলনা করেছেন সেটা প্রযোজ্য হবার কথা না। দ্বিতীয়ত, রেনেসাঁর ক্ষেত্রে বিশ্বাস, দর্শন, জীবনাচরণ, শিল্পসংস্কৃতিতে পরিবর্তনের যে উল্লম্ফনের কথা আমি বলেছিলাম তার সূচনাও কিন্তু আমরা এতগুলো দশকে (নাকি এক শতক বলবো) দেখতে পাইনি। বড় আকারে না হোক, ছোট আকারেও কি এই উল্লম্ফনটা প্রতিভাত হয়?
রেনেসাঁর প্রভাব পড়া মানে শুধু ভিঞ্চিদের নাম বা কাজের সাথে পরিচিত হওয়া নয়। অচল ধ্যানধারণাগুলোকে পরিত্যাগ করতে পারাটা এর প্রাথমিক অর্জন। জনমানসে ইহজাগতিকতা প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা তার পরবর্তী অর্জন। ফলে রেনেসাঁ পর্ব হতে শুরু করে এর পরবর্তী সময়ে ঐ অঞ্চলের মানুষেরা শুধু শিল্পসাহিত্যে নয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, অভিযাত্রা প্রতিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। রেনেসাঁ না হলে এই অর্জনগুলো সম্ভব হতো না। এবং এগুলোর কোনটাই ছোট সীমাবদ্ধ গ্রুপের কাজ না।
আমার বক্তব্য বাংলায় রেনেসাঁ আনার দাবিদারদের নিয়ে। এদেরকে আমি দলে ভাগ করিনি, এরা এমনসব দলে ভাগ হয়েই ছিল। এদের দলাদলির ইতিহাসও আমাদের জানা। এবং আমি এদেরকে গালাগালি করিনি, এরা আসলে যা আমি শুধু সেটুকু বলতে চেয়েছি। বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে লিখছেন সুতরাং এর নিশানবরদারদের আপনার না চেনার কথা না। তাদেরকে নিয়ে আপনি মন্তব্য করতে না চাইতেই পারেন।
শক্তিসাধন রেনেসাঁসকে একেবারেই কলকাতা শহরে আবদ্ধ করেননি। এই লেখায় যদি সেরকম কোন ইঙ্গিত চলে আসে তাহলে সেটা আমার লেখার সীমাবদ্ধতা। শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে সবকিছুকে রেনেসাঁসের অবদান বলায় ভুল আছে। রেনেসাঁস না হলে অবশ্যই এগুলো হতো না, রেনেসাঁস এক্ষেত্রে একটা নেসেসারি শর্ত, কিন্তু রেনেসাঁস কোন সাফিসিয়েন্ট শর্ত না। রেনেসাঁসের পরও ইউরোপে আরো বহু কিছু ঘটেছে যার কোনটাই বাংলায় ঘটেনি। কিন্তু রেনেসাঁস একটা হয়েছে বাংলায়। এই রেনেসাঁসকে আমি খুব সীমাবদ্ধ কিছু বুঝাচ্ছি। আসলে আমি রেনেসাঁস ব্যাপারটাকে এতই সীমাবদ্ধ মনে করি যে বাংলার রেনেসাঁসের একমাত্র অর্জন আমার কাছে মনে হয় "বাংলা সাহিত্য"। বাংলা সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই যদি রেনেসাঁস না করে থাকে তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। সেক্ষেত্রে এটা বহুলাংশে ব্যর্থ রেনেসাঁস। কিন্তু রেনেসাঁস বটে। আর আসল কথা আমি রেনেসাঁস নামটা নিয়েও অত চিন্তিত নই, আপনি যা ইচ্ছা ডাকতে পারেন, কিন্তু এটা বোধহয় অস্বীকার করবেন না যে তখন একটা কিছু ঘটছিল যেটা বর্তমানে ঘটছে না। আমি ঐ যুগের একটা ব্যতিক্রমী অর্জন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এবং ইতালীয় রেনেসাঁসের সাথে তুলনা করলে এটাকে আমি রেনেসাঁস নামেই ডাকব। সেটার ভবিষ্যৎ অবদান শূন্য হলেও কিছু যায় আসে না। শূন্য যদি হয়েই থাকে তাহলে অবদানটাকে অশূন্য করাই আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। সে-যুগের সব মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা ছিল, ঠিক যেমন ইতালীয় রেনেসাঁসের অধিকাংশ মানুষও প্রচণ্ড রকমের সীমাবদ্ধ এবং ক্ষেত্রেবিশেষে বদ্ধমনাও ছিল। কিন্তু বদ্ধমনা পেত্রার্কা বা দান্তে'র কাছ থেকেও যেমন অনেক কিছু শেখার আছে, তেমনি বাংলার রেনেসাঁস মানুষদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার কাছে। ইতিহাসকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেয়ার মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। তবে ইতিহাসকে ভুল ব্যাখ্যা করলে অবশ্যই খুব খারাপ হবে। রেনেসাঁস মানুষদের শুধু প্রশংসা করলে, এবং তাদের সীমাবদ্ধতা আলোচনা না করলেও খুব খারাপ হবে। সেটা যদি করে থাকি তাহলে খুবই দুঃখিত। ভবিষ্যতে সমালোচনাসহ প্রশংসা করার চেষ্টা করব।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
শক্তিসাধন কী বলেছেন বা তার কথা আপনি কীভাবে উপস্থাপন করেছেন আমার মন্তব্যে আমি সেটা বিবেচনা করিনি। সুতরাং এটা নিয়ে আপনার দুঃখিত হবার কিছু নেই। বুঝতেই পারছেন আমি তাদের দাবিকৃত রেনেসাঁর ধারণাটিকেই গ্রহন করছি না।
এটা ঠিক বলেছেন যে শিল্প বিপ্লব ও অন্যান্য বিষয়গুলোর জন্য রেনেসাঁ নেসেসারি কন্ডিশন, কিন্তু সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন নয়। আমিও আসলে রেনেসাঁকে একমাত্র শর্ত বোঝাতে চাইনি। আমার টোন অমনটা বোঝালে সেটা আমার প্রকাশের দুর্বলতা। ভূমির তো আনুভূমিক বিস্তারণ হয় না তাই কৃষি তার উৎপাদনসক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাচ্ছিল। ফলে পুঁজি বা উদ্ধৃত পুঁজি শিল্পে বা অভিযাত্রায় (বাণিজ্যে) খাটানো ছাড়া উপায় ছিল না।
বাংলার রেনেসাঁকে আপনি যদি কেবল সাহিত্যে সীমাবদ্ধ করতে চান তাহলে সেটাকে হয়তো মানা যেতে পারে। তবে আমার অবজারভেশন হচ্ছে সাহিত্যে কূপমন্ডুকতা ধরে রাখা, অচলায়তনে আটকে থাকা ইত্যাদি দোষগুলো মূলত শহুরে এবং স্পনসরড সাহিত্যকর্মে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশাল বাংলার সাহিত্যে ও লোকসাহিত্যে সেই চর্যাপদের আমল থেকে এইসব বিষয়কে অস্বীকার করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আশা-আকাঙ্খা, দুঃখ-দুর্দশা, স্বপ্ন-হতাশা, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরার কিছু ধারা বিদ্যমান ছিল। কৌশলগত কারণে কখনো রূপকের আশ্রয় নেয়া (যেমন, কানু বিনা গীত নাই) অথবা ছদ্মপরিচয়ের আশ্রয় নেয়া (যেমন, চর্যাপদ) ধরনের ঘটনা ঘটলেও এই ধারাগুলো সব সময়েই বাস্তব, জীবনমুখী ও ইহজাগতিক ছিল। উন্নাসিক শহুরে বাবুরা এর খোঁজ রাখার চেষ্টা করেনি। সোনাভানের পুঁথির কাহিনী আজকে আপনি নিজের নামে লিখে বই প্রকাশ করলে আগামী কাল আপনাকে চাপাতির কোপ খেতে হবে।
আপনার চিন্তাটা কি আরোহী না অবরোহী? যদি সেটা অবরোহী হয় তাহলে এমন ভাবনার কারণটা কী? আপনি এই দায়ই বা কেন নিতে যাবেন? আর আরোহী হলে আপনার গবেষণা শেষ পর্যন্ত কী ফল দেবে সেটা তো এখনই অনুমান করতে পারবেন না।
দুটো বাক্যের সাথেই প্রবলভাবে সহমত। আমি নিজে ইতিহাস চর্চ্চা ও ইতিহাস নিয়ে নিয়মিত আলোচনার পক্ষপাতী। তবে তার আগে ঠিক ইতিহাসটা বের করাটা জরুরী। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ইতিহাস সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রেক্ষিত থেকে লিখিত নয়। একটা নির্দিষ্ট সময়কালে তাদের প্রকৃত অবস্থা, তাদের ভাবনা, তাদের কর্মকাণ্ড না জানলে সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্পনসরড ইতিহাস থেকে কখনোই সত্যে পৌঁছানো যাবে না। আর অসত্য ইতিহাস ভবিষ্যত প্রজন্মের কোন কাজে আসবে না।
না, আপনি রেনেসাঁর দাবিদারদের কেবল প্রশংসা করেননি। কিন্তু আপনি নিজে যেহেতু এই ব্যাপারে একটা অবস্থান গ্রহন করেছেন সুতরাং আপনার বক্তব্য সেই অবস্থানের অভিসারী হয়েছে। আপনার অবস্থান কতটুকু ঠিক/বেঠিক সেটা তো সিরিজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়।
১
রেনেসাঁসের সংজ্ঞার ব্যাপারে যদি আমাদের মত একেবারে ভিন্ন হয় তাহলে বিতর্ক প্রায় বৃথা। কারণ সেক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ২টা বিষয় নিয়ে কথা বলছি।
২
আপনি যেভাবে শহুরে বাবুদেরকে গেঁয়োদের থেকে আলাদা করে মেরুকরণ করলেন সেটাতে আমি বিশ্বাসী নই। আমি গেঁয়োদের পক্ষের লোক নই, এবং বাবুদের পক্ষের লোকও নই। শহুরে বাবুদের মাঝে যেমন উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট আছে, গেঁয়োদের মাঝেও তেমনি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট আছে। বাবুদের শুধু নিকৃষ্ট জিনিস আর গেঁয়োদের শুধু উৎকৃষ্ট জিনিস জড়ো করে অনেক কল্পিত সত্যেই "আরোহণ" করা সম্ভব, কিন্তু সেই সত্য কল্পিতই থেকে যাবে। ইহজাগতিকতা ভাল সাহিত্যের কোন আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য নয়। তাছাড়া মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ইহজাগতিকতা যতটুকু ছিল পরজাগতিকতা ছিল তারচেয়েও বেশি (আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বলে)। আপনি যদি পরকে অবজ্ঞা করে শুধু ইহকে আদর করেন তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হবে না। আর চাপাতির কোপ খাওয়ার সম্ভাব্যতাও ভাল-খারাপ বা উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট সাহিত্যের কোন মাপকাঠি নয়। আমি বলছি না মধ্যযুগে ভাল সাহিত্য ছিল না। মধ্যযুগের অনেক সাহিত্য অবশ্যই কালোত্তীর্ণ। কিন্তু সেই কালোত্তীর্ণতার কারণ ইহজাগতিকতাও নয়, গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলাও নয়, এবং কোপযোগ্য লেখা লেখাও নয়। গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে যতটা ভাল সাহিত্য লেখা সম্ভব, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনকুবেরের সুখ-দুঃখ নিয়েও ততটাই ভাল সাহিত্য লেখা সম্ভব (দ্রষ্টব্য শেক্সপিয়ার)। একইভাবে ইহজাগতিক সাহিত্য (লুক্রেতিউসের 'On the Nature of Things') যত বড় হতে পারে, পরজাগতিক সাহিত্যও (দান্তের 'Divine Comedy') ততই বড় হতে পারে।
৩
ইতিহাস কি কখনো অবরোহী হতে পারে? আমার মনে হয় না। এটা একদম ঠিক বলেছেন যে পাহাড়ে আরোহণ শেষ না করেই চূড়া থেকে পৃথিবীকে দেখতে কেমন লাগে বলে ফেলে ভুল করেছি। এটা মেনে নিলাম। কিন্তু বুঝেনই তো, মানুষ মাত্রই ত্রুটিপূর্ণ। মানুষ ইনস্টিংক্ট দিয়েও অনেক কিছু বলে ফেলে। তাছাড়া পাহাড়টাতে যতটুকু উঠেছি তাতে মনে হচ্ছে বাংলার রেনেসাঁসের ভাল দিকগুলো আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের জন্য সবার সামনে নিয়ে আসাটা খুবই উচিত কাজ হবে।
৪
আবারো রেনেসাঁসের সংজ্ঞা নিয়ে কথা বলতে হয়। আমি যদি রেনেসাঁসকে সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করি, এবং তারপরও মনে করি এই সামান্য কিছু মানুষের "শুধু সঠিক" চিন্তাগুলো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, তাহলে এতে নিশ্চয়ই আপনার কোন সমস্যা থাকার কথা না। হাইডেগার নাৎসি পার্টি সমর্থন করতেন। তারপরও তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় দার্শনিকদের অনেক। হাইডেগারের দর্শনের কিছু জিনিস আমি নিজের মতো করে পছন্দ করতেই পারি, এবং সেটা আমাকে কোনভাবেই হাইডেগারের রাজনৈতিক আদর্শের অনুগামী করে না। হাইডেগারের রাজনীতি যতই খারাপ হোক, আমি মনে করি হাইডেগার ছাড়া বিংশ শতাব্দীর দর্শনের প্রাণ থাকে না। আমি সাধারণত মানুষের অর্জনকে কিভাবে দেখি বুঝাতে উদাহরণটা দিলাম।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
১.
রেনেসাঁর সংজ্ঞায়ন নিয়ে আপনি-আমি দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও আলোচনাটা এখানে চলতে পারে। সেক্ষেত্রে এই সিরিজের পাঠক উভয় মত সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি ভিন্ন মত নিয়ে আলাদা পোস্ট দিলে পাঠকের খাটুনি বাড়তো, আলোচনাগুলোও একপেশে হতো। এরচেয়ে একটা পোস্টে উভয় মত বা এর বাইরে কোন মত থাকলে সেটার আলোচনাও চলুক।
২ (ক).
পাঠক হিসেবে আমরা বাবু বা গেঁয়ো কারও পক্ষে যাবো না। আমাদের কাজ পাঠ করা, পাঠের আনন্দ নেয়া, লেখা নিয়ে আলোচনা করা, ভালো লেখাকে প্রমোট করা, ভালো লেখা থেকে শিক্ষা নেয়া। কোন শ্রেণী/গোষ্ঠীই এক প্রকার মানুষ দিয়ে গঠিত নয়, এবং তাদের আউটপুটও সব সময় এক প্রকার নয়। বাবুদের ভালো জিনিস আর গেঁয়োদের মন্দ জিনিসের উপস্থিতি তাই অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। তবে গেঁয়োদের কৃতকর্মকে আলোচনার বাইরে রাখা বা ইতিহাস থেকে সরিয়ে রাখার ক্ষমতাটা বাবুদের আছে। সেটা তারা হরহামেশা করে থাকে। তাদের অবদানকে অস্বীকার করার, বিশেষত যখন গেঁয়োরা প্রাগ্রসর চিন্তার প্রকাশ দেখায় সেটা উপেক্ষা করার চেষ্টা বাবুদের মধ্যে প্রবল। উন্নাসিকতা গেঁয়োদের মধ্যেও আছে। এই জন্য দেখবেন তাদের কাজের মধ্যে ফর্মের পরিবর্তনের গতি খুবই মন্থর অথবা স্থবির।
২ (খ).
সাহিত্যের উৎকৃষ্টতা বিচারের মাপকাঠিতে ফর্ম, কনটেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ইমপ্যাক্ট এমনসব টেকনিক্যাল বিষয় থাকে। ইহজাগতিকতা, কোপযোগ্যতা সেখানে বিবেচ্য নয়, অমন কিছু আমি দাবিও করিনি। সোনাভানের পুঁথির কালোত্তীর্ণতা তার কোপযোগ্যতার জন্য নয়। তবে একালে সেটা কোপযোগ্য হয়ে গেছে সেটুকু কেবল জানিয়েছি। সৃষ্টিকর্মে ইহজাগতিকতার উপস্থিতি ও প্রাবল্য জনমানসের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সহায়ক। সাহিত্যকে জনবিচ্ছিন্ন কিছু বা ক্ষুদ্র অডিয়েন্সের জন্য কিছু না ভাবলে সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা টেকার কথা না।
৩.
কোন বৈজ্ঞানিক চিন্তা অবরোহী হবার কথা না। তবে সম্ভাব্য আউটকামের ব্যাপারে একটা অনুমিতি তো থাকতেই পারে। বাংলার তথাকথিত রেনেসাঁতে ভালো জিনিসের পরিমাণ অনেক। সেটা কেউ অস্বীকার করবে না, তা সে ওটাকে রেনেসাঁ হিসেবে মানুক আর নাই মানুক। ভালো জিনিস নিয়ে আলোচনা সবসময়ই উপকারী।
৪.
এই পয়েন্টে রেনেসাঁ নিয়ে যা বলেছেন সেটাতে আপনার সাথে সহমত।
হাইডেগারের উদাহরণ দিয়ে যে চেরি পিকিং-এর কথা বলেছেন সেটা যথেষ্ট বিপদজনক কাজ। এই ধরনের চেরি পিকিং-এ ভুল করার, ভুল বোঝার, পা হড়কানোর প্রচুর স্কোপ খোলা থাকে। যথেষ্ট সচেতন, সাবধান ও প্রজ্ঞাবান না হলে এখানে প্রায়ই ভুল হয়ে যেতে পারে। অনেকে আলোচ্য ব্যক্তির দুষ্কর্মকে জাস্টিফাই করার জন্য তার সুকর্মকে ব্যবহার করে। চেরি পিকিং একটা অনিঃশেষ বিতর্কের বিষয়। আমি এটাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সহ্য করতে রাজী আছি যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা দুরাচারকে মহৎ ব্যক্তি বানানোর বা তার দুষ্কর্মকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা না হয়।
সবগুলো পয়েন্টের সাথেই একমত। এবং ২খ পয়েন্টটা আসলে আমিই ভুল বুঝেছিলাম। আপনি এটাকে জঙ্গিদের কাছে কোপযোগ্য বলেছেন তার মানে অবশ্যই এই নয় যে সেই কারণেই এটা উৎকৃষ্ট। সবশেষে ৪নং পয়েন্টে আরেকটা কথা যোগ করার আছে: একজন মানুষের ভাল কাজ দিয়ে তার খারাপ কাজকে যেমন জাস্টিফাই করা যায় না, তেমনি একজন মানুষের খারাপ কাজ দিয়েও তার ভাল কাজকে নালিফাই করা যায় না। এবং অবশ্যই এটা কোন সাধারণ তত্ত্ব না; প্রত্যেক ব্যক্তিকে এখানে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করতে হবে, এবং কারো কারো ক্ষেত্রে হয়ত আসলেই খারাপ কাজ দিয়ে ভালটা পুরো নালিফাই হয়ে যায়, তবে হতেই হবে এমন কোন কথা নেই সেটাই বলতে চাচ্ছি। আর বিপদজনক কাজ করতেই হবে, নইলে এগোনো যাবে না। সুতরাং বিপদকে আলিঙ্গন করাটা সমস্যা না, এড়িয়ে যাওয়াটাই সমস্যা।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
নতুন মন্তব্য করুন