মহৎ সাহিত্য আমাদেরকে যা হতে সাহায্য করে তার মধ্যেই তার সার্থকতা নিহিত। নিছক সাহিত্যের খাতিরে, শুধু লেখকদের কলাকুশলের প্রমাণপত্র হিসেবে, তারা এত মূল্যবান হতো না, আর সেক্ষেত্রে তারা আমাদের হাতে এসে না পৌঁছালেও সত্য বা মহত্ত্বের বড়ো কোনো ক্ষতি হতো না। তাদের অতীত মূল্য বা মর্যাদায় আমরা কিছুই যোগ করতে পারি না। বরং শুধু তারাই আমাদের মনের বর্তমান মূল্য ও মর্যাদায় কিছু জিনিস যোগ করতে পারে, অবশ্যই যদি তারা আমাদের জন্য বিষ না হয়ে পুষ্টিকর খাদ্য আদৌ হতে পারে। বিদেশী ধ্রুপদী সাহিত্যকে তাদের পুরনো স্বাভাবিক স্বভাবে বুঝতে হলে, তাদের চিরসবুজ মানবতাকে আসলেই সজীব রাখতে হলে, প্রত্যেক প্রজন্মকেই সেগুলো পুনরানুবাদ ও পুনর্ব্যাখ্যা করতে হয়। এমনকি দেশী ধ্রুপদী সাহিত্যও প্রত্যেক পাঠককে আবার নতুন করে বুঝতে হয়। অতীতের দেয়া সারবস্তুর এই অবিরাম পরিপাকই শুধুমাত্র, বর্তমান আর ভবিষ্যতের জন্য অতীতকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পারে। মানুষের মেধার সঞ্চয়ী একাউন্ট থেকে লভ্যাংশ পেতে চাইলে, প্রয়োজন সজীব সমালোচনা আর খাঁটি সমঝদারি।
হজমের উপযোগী খাদ্য হিসেবে দেখলে, লুক্রেতিউস, দান্তে, আর গ্যোটে’র (যার শুধু ‘ফাউস্ট’ নিয়ে কথা বলব) কাব্যসম্ভারকে একটা রকমারি পদের ভোজ বলতে হয়। মতাদর্শ ও মেধার চরিত্রের দিক দিয়ে তাদেরকে এতই আলাদা মনে হয় যে, তাদের প্রজ্ঞাকে অভিসারী বা সমন্বিত করার চেষ্টাকে পণ্ডশ্রম মনে হতে পারে। যারা এদের যে-কোনো এক জনের ভক্ত, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত বাকি দু-জনের কাছ থেকে কিছু শেখার আছে বলে মনে করেন না। কিন্তু আমি এই তিন জনেরই ছাত্র, আশাকরি স্নেহভাজন ছাত্র, এবং আমি বলতে চাই, যে-দিকটা তাদেরকে মহৎ করেছে সেই দিক দিয়ে তারা খুবই সংগতিপূর্ণ। নিজের রুচিতে কোনো অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থতা না রেখেও এই তিন জনের কবিতা সমানভাবে উপভোগ করা যায়, প্রশংসা করা যায়। এবং নিজের বিশ্বদর্শনে সংজ্ঞা বা সুষ্ঠুতার অভাব না রেখেও এই তিন জনেরই মৌলিক দর্শন আর ইতিবাচক স্বজ্ঞাটি গ্রহণ করা যায়।
হেগেলীয় উপভাষায় বলতে গেলে, এই তিন কবির বৈচিত্র্য শেষ পর্যন্ত একটি মহত্তর একত্বে মিলিত হয়। তিন জনই যার যার যুগের প্রতিনিধি। তিন জনকে একসাথে নিলে গোটা ইউরোপীয় দর্শনের সারমর্ম শোনা হয়ে যায়। লুক্রেতিউস গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন গ্রিকদের তৈরি সবচেয়ে প্রাগ্রসর ও সঠিক বিশ্বদর্শনটি। তার কাছে মহাবিশ্ব এক বিরাট অট্টালিকা, বিশাল মেশিন, যার প্রত্যেক অংশ প্রত্যেক অংশের সাথে মিথস্ক্রিয়া করছে, এবং একটি সর্বজনীন সূত্র বা প্রাণের বিধান অনুসারে একের মধ্য থেকে আরেকের সৃষ্টিস্থিতিলয় ঘটছে অনাদি থেকে অনন্তে। তার কবিতার বিষয় প্রকৃতি, অর্থাৎ সবকিছুর, হ্যাঁ একেবারে সবকিছুর, জন্ম আর গঠন। তিনি দেখান, কীভাবে সবকিছু মৌলিক পদার্থ অর্থাৎ সদাগতিশীল পরমাণু দিয়ে গঠিত, যারা সব সময় পুনর্বণ্টিত পুনর্মিশ্রিত হচ্ছে, যাতে পুরনো জিনিসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন জিনিসের জন্ম হতে পারে। বিশ্বের এই ক্যানভাসে তিনি এরপর মানুষের একটি ছবি আঁকেন; বলেন, বিশ্বটা এমন হলে মানুষের জীবন কেমন হওয়া উচিত। তার বস্তুবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তি আর চিত্তের শান্তি। বিশ্বের এই বিস্ময়কর সার্কাস আদ্যন্তহীন, কিন্তু আমাদেরকে তা শুধু একবারই দেখতে দেয়া হয়, তাই দু-চোখ ভরে দেখে নিতে হবে এখনই, কারণ কালকেই মৃত্যু। আমাদের উচিত খাওয়া, পান করা, সুখে থাকা, কিন্তু সবকিছু পরিমিতভাবে, শৈল্পিকভাবে, কারণ না হলে কালকের বদলে দুর্বিষহ মৃত্যু ঘটবে আজকেই—বিশ্বটা আর দেখা হবে না, আসল কাজটাই আর করা হবে না।
এটা এক সামগ্রিক বিশ্বদর্শন—প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বস্তুবাদ আর নৈতিকতায় মানবতাবাদ। সক্রেটিসপূর্ব সব গ্রিক দর্শনেরও সারকথা ছিল এটাই, এবং শুধুমাত্র এই ভাবধারাটিকেই বিশুদ্ধ ‘হেলেনিক’ বলা যায়। এর নাড়ির বন্ধন গ্রিকদের আচার-আচরণ, সরকারব্যবস্থা, শিল্প, সবকিছুর চলার ছন্দের সাথে—যে-চলা সরলতার দিকে, স্বায়ত্তশাসনের দিকে, পোশাক থেকে ধর্ম পর্যন্ত সবকিছুতে যুক্তিনির্ভরতার দিকে। এবং ইউরোপের রেনেসাঁসের দর্শনের সারমর্মও এটাই, যখন আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান ও মুক্তির বার্তা আবার প্রচার করেন বেকন আর স্পিনোজা-রা। আর বর্তমান যুগেও যে আমরা তথ্যের জন্য বিজ্ঞানের দিকে আর সামাজিক আদর্শের জন্য মানুষের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাই সেটাও এরই দান। এই বিশ্বদর্শনের নাম প্রকৃতিবাদ, আর তার একমেবাদ্বিতীয়ম কবি লুক্রেতিউস।
এক হাজার বছর এগিয়ে আসলে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। ইউরোপের সব মন, সব প্রতিষ্ঠান এমন এক ধর্মের অধীনস্থ, যা আত্মাকে পৃথিবীতে তীর্থযাত্রী হিসেবে দ্যাখে; বিশ্ব দুর্বিপাকগ্রস্ত, শয়তানের শিকার; কষ্ট আর দারিদ্র্যই স্বাভাবিক; সুখ ইহকালে অসম্ভব; কেবল পরকালেই সুখের আশা করা যায়, তাও যদি এই জীবনের ফাঁদ ভোগ সুখ আমাদেরকে জড়িয়ে না ফেলে। আর ততদিন একমাত্র সান্ত্বনা হচ্ছে, পদব্রাজক মানুষ ক্লান্ত হয়ে যে-পাথরের গায়ে মাথা রাখে, সে-পাথর থেকে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গ পর্যন্ত পাতা জেকবের সিঁড়ির মতো একটি মই, এবং এই মই বেয়ে যেসব দেবদূত ফেরেশতা উঠানামা করে তাদের অনিন্দ্য সুন্দর গল্প, বিস্ময়কর তত্ত্ব, স্বস্তিদায়ক কৃত্যানুষ্ঠান। এসবের মাধ্যমে মানুষ তার ভবিষ্যৎ পরজীবনের একটু ছোঁয়া পায়। সে তার অদৃষ্ট কিছুটা বোঝে; তার ইতিহাস, এবং বিশ্বের ইতিহাস, তার সামনে মহৎ রূপে মূর্তমান হয়, দুঃখকে চিরসাথী করেও হয়ে উঠে সুন্দর। ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পন এবং তাঁর সাথে পুরোপুরি একাত্ম হওয়ার পরমানন্দ মানুষকে অভিভূত করে প্রার্থনার সময়। এর নাম অতিপ্রাকৃতবাদ; খ্রিস্টান জগতে এর সবচেয়ে বড়ো প্রতিনিধি ক্যাথলিক চার্চ, তবে খ্রিস্ট-পরবর্তী যুগের পৌত্তলিকরাও এটা গ্রহণ করেছিল, এবং এশিয়াতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এই এখন পর্যন্তও এর প্রভাব বহুবিস্তৃত। ইউরোপ-আমেরিকার সমসাময়িক মেজাজের সাথে এর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু যে-কোনো মানুষ বা জাতি যে-কোনো সময় আবার এই ভাবধারায় ফিরে যেতে পারে। এর উৎস নিহিত আছে চিত্তের একাকিত্ম বোধের মধ্যে, এবং চিত্ত নিজেকে যে-বিশাল কিছু করতে সক্ষম মনে করে, তার সাথে এই বাস্তব জগতে সে যেসব তুচ্ছ কাজ করতে বাধ্য হয়, তার পার্থক্য বা বিরোধের মধ্যে। এই অতিপ্রাকৃতবাদের অদ্বিতীয় কবি হচ্ছেন দান্তে।
আরো পাঁচশ’ বছর এগিয়ে আসলে, আবারও চিত্র পাল্টায়। যে-টিউটনিক জাতিরা আগে ইউরোপ দখল করেছিল, তারা এবার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, এবং নিজেদেরকে বুঝতে শুরু করে। তারা নিজেদেরকে ডাকে প্রটেস্ট্যান্ট, কারণ রোমান জগৎকে প্রটেস্ট করার মধ্যে দিয়ে তাদের নবযাত্রা শুরু হয়েছে। তাদের বুকে যেন জীবনের এক অনন্ত ঝর্ণাধারা অবারিত হয়। নতুন প্রেমের সন্ধানে, নতুন নতুন জগৎ জয়ের উদ্দেশ্যে, তারা একে একে মনোনিবেশ করে বাইবেলে, শিক্ষায়, দেশাত্মবোধে, শ্রমশিল্পে। এক কর্মদানব যেন তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়; আপাত স্বেচ্ছাচারিতায় ঐশ্বরিক ও অমর এই কর্মদানবই তাদের অন্তরতম আত্ম। এটা তাদের চির-অতৃপ্ত ইচ্ছাশক্তি, আমূল-পরিবর্তন প্রয়াসী সাহস। অনভিজ্ঞের জন্য কথাটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, আমি বলতে চাই, তাদের ইচ্ছাশক্তিই সেই সবকিছু সৃষ্টি করেছে, যা তাদেরকে বিনোদিত করে বিহ্বলিত করে, কিন্তু কখনো পোষ মানাতে পারে না। এই ইচ্ছাশক্তি একেবারে শূন্য থেকে অভিনব সব সুযোগ আর দুর্যোগ সৃষ্টি করে তাদের কর্মক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করে; এবং এই আদর্শিক কাজের মধ্যেই নিহিত তাদের একমাত্র বাস্তবতা। যে-কোনো জিনিস একবার অর্জন করে ফেলার পর, তারা সেটা অতিক্রম করে যায়। যেন একটা যাপিত স্বপ্নের মতো—নতুন কিছু দেখে একবার হাসতে হবে, তারপর সেটা ভুলে যেতে হবে। আর যে-চিত্ত উদ্ভাবন আর বিস্মরণের কাজটা করে, সে থেকে যায় বরাবরের মতোই শক্তিশালী নিষ্কলুষ; চিত্তের হৃদয়টা সব সময় নতুন নতুন কল্পলোক জয়ের জন্য কাঁদতে থাকে। এরই নাম রোমান্টিকতা। এই মনোভঙ্গি পাওয়া যায় অনেক ইংরেজি কবিতায়, তবে সবচেয়ে বেশি জার্মান দর্শনে। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন এটা গ্রহণ করেছিলেন; আমেরিকানদের জন্য এই দর্শন আকর্ষণীয়ই হওয়ার কথা, কারণ এতে আছে বিশ্বনির্মাতা যৌবনের উপর প্রবল আস্থা, আর ইচ্ছা ও কর্মের শক্তির উপর এক অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস। এই রোমান্টিকতার সবচেয়ে উঁচু কীর্তিস্তম্ভ গ্যোটে’র ‘ফাউস্ট’।
এটা কি কাকতালীয় হতে পারে যে, এই তিন দর্শনধারার সবচেয়ে সন্তোষজনক এবং সম্ভবত সবচেয়ে টেকসই ভূমিকাগ্রন্থ রচিত হলো কবিদের হাতে? মহৎ কবি-রা কি আসলে মনে মনে একটা দর্শনের সন্ধানে থাকেন? না-কি দর্শন শেষ পর্যন্ত কবিতা ছাড়া আর কিছুই না? একটু ভেবে দেখা যাক ব্যাপারটা।
দর্শনকে যদি সত্যের অনুসন্ধান হিসেবে দেখি, বা সত্য আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তির সমষ্টি হিসেবে দেখি, তাহলে তাতে কবিতার মতো কিছুই নেই। এপিকুরোস, সন্ত একুইনাস, বা কান্টের লেখায় কাব্যিক কিছু নেই; সেগুলো পাতাবিহীন বন। স্বয়ং লুক্রেতিউস আর দান্তের কবিতায়ও এমন অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়, যেগুলোতে একমাত্র ছন্দোবদ্ধতা বা কিছু ছিন্ন অলংকার ছাড়া কাব্যিক আর কিছু নেই। এসব অনুচ্ছেদে গদ্যের সামগ্রীর উপর পদ্যের রূপ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কেবল। লুক্রেতিউস নিজেই এক জায়গায় দায় স্বীকার করে বলেন:
“যেমন, ছোটো শিশুকে ডাক্তাররা যখন কোনো বিস্বাদ
ওষুধ গেলাতে চান, তখন বাটির ধার একটু মিষ্টি
সোনালি মধু মাখিয়ে ভেজা ভেজা করে দেন, যাতে বাচ্চাটি
শৈশবের বেভুল অসতর্ক মনে, তার ঠোঁটটিকে,
ভুলে, বাটির প্রান্তে নিয়ে আসে, আর কষা সোমরস
ঢক করে গিলে নেয়, প্রলুব্ধ হয়ে, তবে প্রতারিত হয়ে
নয়, কারণ তারই লাভ হবে এতে, সেরে উঠবে সে দ্রুত;
আমার উদ্দেশ্য অনেকটা সেরকমই—যেহেতু আমার
এই দর্শন অনভিজ্ঞের কাছে বেশ তিক্ত ঠেকে,
আর অনেকে যেহেতু এর কবলে সহজে পড়তে চায় না,
সেহেতু আমি এখানে পিয়েরীয় সঙ্গীত যোগে, বলা যায়,
দর্শনের আধারে কলালক্ষ্মীর মধু মাখিয়ে দিচ্ছি।” [১. ৯৩৬–৪৭]
কিন্তু কবিতা কোনোকিছুর উপর বাটারের মতো মাখানো যেতে পারে না; বরং তাকে আলোচ্য বিষয়ের উপর আলো হিসেবে ফেলতে হয়, যে-আলোর মাধ্যমেই বিষয়টা দেখা যায়। লুক্রেতিউস এখানে নিজের কবিতার প্রতি অবিচার করেছেন। তার দর্শন যদি তার কাছে বিস্বাদ ওষুধের মতো হতো, তাহলে তিনি বলতে পারতেন না:
“জানি, বিষয়টা ঘন অন্ধকারে ছাওয়া, কিন্তু আজকে
বাক্খোস-বর্শার মতো, খ্যাতির তীব্র বাসনা আমার
হৃদয়ে তুলেছে মৃদু কাঁপন, বুক ভরেছে কলালক্ষ্মীর
কোমল প্রেমে, চলেছি তাই কুসুমিত এক স্বজ্ঞার তেজে,
পিয়েরিয়া’র ভূতুড়ে পথহীন-দেশে, কোনো মানুষের পা যা
স্পর্শ করেনি আগে। সু-কুমারী ঝর্ণার জলের কী স্বাদ!
সদ্য ফোটা পুষ্প কুড়িয়ে অতুল মালা বানিয়ে, মুকুট
হিসেবে নিজ মাথায় পরার কী আনন্দ! এরকম ফুল
দিয়ে কোনো মানুষকে আগে বরণ করেনি কলালক্ষ্মীরা—
কেননা, আমি এখানে মহত্তম সত্য নিয়ে কথা বলছি
যাতে আত্মা মুক্ত হয় ধর্মান্ধতার ফাঁস-দড়ি থেকে,
আর এত তামসিক একটা বিষয় তুলে ধরছি এমন
স্বচ্ছ গানের সুরে, কাব্য-সৌন্দর্যে আপ্লুত করে। . . .
আমার আশা হচ্ছে, হয়ত তোমার মন এভাবে আমার
পদ্যে ধরে রাখতে পারব, যতক্ষণ না তুমি বিশ্বের
প্রকৃতি আর তার সুন্দর ধ্রুব রূপ বুঝতে পারবে।” [১. ৯২২–৩৪, ৯৪৮–৫০]
আমার মনে হয় এখানেই আমাদের সন্দেহের সমাধান আছে। দর্শনের যুক্তি আর অনুসন্ধানের পদ্ধতিটা একদমই কাব্যিক না, এবং সেটাকে কবিতার মতো করতে গেলে ফলাফলটা স্বাভাবিক বা সাবলীল কোনটাই হয় না। কিন্তু দর্শনের চূড়ান্ত অন্তর্দৃষ্টিটা ভীষণ সুন্দর ও মহীয়ান। দর্শন বিশ্বের যে সুশৃঙ্খল বিন্যাস উন্মোচন করে তা সুন্দর, বিয়োগান্তক, মর্মস্পর্শী, এবং ঠিক সেই জিনিসটার সন্ধানই কম বেশি সব কবি করেন।
দর্শনের মধ্যেও অনুসন্ধান ও যুক্তির পদ্ধতিটা উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য নয়। চূড়ান্ত লক্ষ্য অন্তর্দৃষ্টি, যাকে ‘তত্ত্ব’ (θεωρία) শব্দটির সবচেয়ে মহৎ অর্থটা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। এই অর্থে তত্ত্ব হচ্ছে বাস্তবতার সবকিছুর বিন্যাস ও মূল্য নিয়ে অনুধ্যান। এ ধরনের অনুধ্যান কল্পনামূলক। হৃদয়কে পোষ না মানিয়ে, মনকে যথাসম্ভব বিস্তৃত না করে, এই স্তরে পৌঁছানো যায় না। একজন দার্শনিক যখন সে-স্তরে পৌঁছান, সেই মুহূর্তে তিনি কবি; আর একজন কবি যখন তার বহুল-চর্চিত আবেগ আর কল্পনাকে বাস্তবতার বিন্যাস নিয়ে ধ্যান, বা যে-কোনো জিনিসকে সামগ্রিক বাস্তবতার সাপেক্ষে বিবেচনা করার কাজে লাগান, সেই মুহূর্তে তিনি দার্শনিক।
অবশ্য কেউ বলতে পারেন, দার্শনিক তার সবচেয়ে ভালো মুহূর্তে কবি সেটা ঠিক, কিন্তু কবি যখন দার্শনিক হতে চান বা হতে সফল হন, সেটা তার সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত। দর্শন যুক্তিনির্ভর ভারী জিনিস, আর কবিতা পাখাওয়ালা, চপল চঞ্চল, অনুপ্রেরণা-নির্ভর। যে-কোনো বড়ো কবিতা নিয়ে বসলেই দেখা যায়, পুরোটার চেয়ে অংশগুলো বেশি ভালো। কবি শুধু ছোটো ছোটো কিছু শব্দ আর চিত্রকল্প জোড়া লাগিয়ে একটি একক অনুভূতি প্রকাশ করতে জানেন। এভাবে তিনি কেবল ক্ষণিকের গভীর প্রবল উত্তেজক একটা অনুভূতি আমাদের জানাতে পারেন, কিন্তু মুহূর্তটা যেই চলে যায়, অনুভূতিটা সেই মিইয়ে যায়, এবং তার পরেও যদি তিনি কবিতা লেখা চালিয়ে যান তবে সেটা আর অত সঙ্গতিপূর্ণ বা ভালো থাকে না। যেখান থেকে চিন্তাটা শুরু হয়েছিল সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, ভেলায় ভেসে অন্য দিকে চলে যায়, পদ্যায়নের বালুতে হারিয়ে যায়। মানুষ এভাবেই তৈরি; অনুপ্রেরণার প্রধান শর্তই যেন সংক্ষিপ্ততা।
তাহলে কি বলব, কবিতা আবশ্যকভাবেই ক্ষণচারী, কবিদের লেখায় কেবল এলোপাতাড়ি ও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় কাব্যিকতা পাওয়া যায়, শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত পর্ব বা মেজাজই প্রবলভাবে অনুভব করা যায়, বা প্রকাশ করা যায়, আর সামগ্রিক জীবন ইতিহাস চরিত্র বা নিয়তির জগতে কল্পনা বিচরণ করতে পারে না, কাব্য প্রবেশ করতে পারে না? আমি সেটা ভাবতে পারি না। যদি এটা আসলেই সত্য হয়ে থাকে যে, আমরা শুধু ছোটো ছোটো জিনিসে সুখ পাই, এবং বড়ো মহৎ জিনিস আমাদের কাছে রূপহীন শুষ্ক লাগে, এবং আমরা যদি আসলেই মহাকাব্যের চেয়ে এক লাইনের গণ্ডিতে বেশি ভালো কবি হয়ে থাকি, তবে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আমাদের বোধ কল্পনা স্মৃতি শক্তির অভাব, এবং সবচেয়ে বেশি আসলে শৃঙ্খলার অভাব।
আমার মনে হয়, একটা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এটা দেখানো সম্ভব, যদি আমরা আসলেই মনোবিজ্ঞানের মতো বিতর্কিত ও বিমূর্ত একটা জিনিসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে রাজি হই। সাধারণ কল্পনাবিমুখ মানুষ, যারা সাধারণ কথা বলে, সাধারণ দৃশ্য দেখে, তাদের তুলনায় একজন ক্ষণচারী কবি কোন দিক দিয়ে বেশি দক্ষ? তিনি কি তুলনামূলক আরো কম চিন্তা করেন? না, আমার মনে হয় তিনি বেশি অনুভব করেন, তার স্বজ্ঞার মুহূর্তগুলো ক্ষণিকের হলেও, তাদের একটা ব্যাপ্তি আছে, দূরদৃষ্টি আছে, প্রতীকী এমন কিছু একটা আছে যা অনুভূতিকে সুগভীর ও প্রকাশযোগ্য করে তোলে। তীব্র অনুভূতি, তা সে যত ক্ষণিকেরই হোক, যদি আসলেই প্রকাশযোগ্য হয়, তাহলে সেই সুতীব্র ক্ষণকালের মধ্যেই ঘনীভূত আকারে এক ধরনের পূর্ণতা স্থান করে নেয়। আসলে, আমাদের কাছে যা-ই আসে, তাকেই তো কোনো না কোনো নির্দিষ্ট সময়েই আসতে হবে। আমরা সব সময় ক্ষণকালের মধ্যেই বাস করি। দার্শনিকই হন, কবিই হন, সবাই এই ক্ষণকালে আবদ্ধ। একটি ক্ষণ কেবল তখনই কোনো পর্যবেক্ষকের চোখে প্রকাশযোগ্য হিসেবে ধরা দেয়, যখন তিনি ঐ ক্ষণটিকে তার নিজস্ব অন্তহীন কেন্দ্রীভূত সুবিস্তীর্ণ দৃশ্যপথ দিয়ে সমৃদ্ধ করেন। আট দশটা সাধারণ মুহূর্তের সাথে কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টির মুহূর্তের পার্থক্য হচ্ছে, কাব্যিক মুহূর্তের অনুভূতিতে পরিপ্রেক্ষিত বেশি। এমনকি ক্ষণচারী কবিও এমন ভারের শব্দ নির্বাচন করেন যা, কীভাবে যেন, আমাদেরকে ক্ষণ থেকে ক্ষণান্তরে, স্বজ্ঞার পাহাড়-চূড়ায় নিয়ে যেতে পারে। একটা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে যে বিভ্রান্তিকর অস্থিরতা তৈরি করে তাকে ঘনীভূত করে এক ধরনের মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা যখন একটি শব্দ বা বাক্যাংশের মধ্যে তৈরি হয়, তখনই কি তাকে কাব্যিক বলে না? নৈখুঁত্যের প্রবাহ আর স্পষ্টতার গভীরতা অনুভব করাকেই কি কাব্যিক শিহরণ বলে না, অনেকটা একটি মুক্তার পানির ফোঁটায় গোটা সমুদ্রের আলো দেখার মতো? আর ঠিক এটাই কি দার্শনিক চিন্তারও সারমর্ম না?
একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদকে যদি কাব্যিক বলা হয়, কারণ তা গুটিকয়েক জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে আমাদেরকে মনোযোগী মগ্ন ঐকান্তিক করে তুলতে পেরেছে, তাহলে যে-ভিশন আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক সবকিছুর আভাস দিতে পারে, তার আরো কত বেশি কাব্যিক হওয়ার কথা? নিজের অভিজ্ঞতাগুলো একটু কেন্দ্রীভূত করলে, নিজের অনুভূতিকে একটু ব্যাপ্তি আর গভীরতা দিলে, তা কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠে; যদি ব্যাপ্তি গভীরতা আরো বাড়ানো হয়, যদি সব অভিজ্ঞতা এক কেন্দ্রে জড়ো করা হয়, আর যদি তাকে একজন দার্শনিকের বিশ্বদর্শনে পরিণত করা হয়, তাহলে তাতে কল্পনার বিস্ফোরণ ঘটে, তার কাব্যিক মাত্রা আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। অভিজ্ঞতাটা লাভের পর তাকে প্রতীকায়িত করার পথে সবচেয়ে কঠিন কাজটি হচ্ছে, চিন্তার মধ্যে তা ধরে রাখার জন্য, ঝুলিয়ে রাখার জন্য, যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে পারা; এবং সেই চিন্তাটি এমনভাবে প্রকাশ করতে পারা, যাতে পাঠক শ্রোতা সেটা পুনরুদ্ধার করতে পারে, এবং উদ্ধারের পর অজস্র আভাস ইঙ্গিতের বাতাস যাতে তাদের স্মৃতির বনে একটা ঝড় তুলতে পারে।
সুতরাং কবিতা ক্ষণচারী বা নৈমিত্তিক হওয়ার কারণে কাব্যিক নয়, বরং উল্টো সুপরিসর ও সামগ্রিক হওয়ার কারণে কাব্যিক। বেশি মালামালে যদি তা জর্জরিত হয়ে যায়, তবে দোষটা কবির বুদ্ধিবৃত্তির, বিষয়ের ব্যাপ্তির না। যিনি সংশ্লেষী চিন্তা করতে জানেন, চট করে একটা সার্বিক চিত্র দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারেন, তিনি বড়ো বিষয়ও সহজেই বুঝতে পারেন। ব্যাপ্তি বড়ো হলেই কবিতা অগভীর বা দুর্বল হয়ে যায় না, বরং আরো বেশি গভীর ও শক্তিশালী হয়, কারণ ছোটোর মধ্যে যে-একত্ব থাকত বড়োর মধ্যেও সেটা থাকে, শুধু তার আয়তনটা বড়ো এই যা। নাটকের বিশাল কোনো ক্রান্তির মুহূর্তে যেমন আমাদের গোটা জীবন বর্তমানে কেন্দ্রীভূত হয়ে, আমাদের চেতনাকে রাঙায়, সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, তেমনি প্রত্যেক দার্শনিক কবির সামনে মানুষের সমগ্র অস্তিত্ব এক জায়গায় এসে জড়ো হয়; এবং তিনি তখনই সবচেয়ে বড়ো কবি, যখন একটি মাত্র কান্নার মধ্যে মহাবিশ্বে তার জন্য প্রাসঙ্গিক সবকিছুকে আবাহন করতে পারেন, এবং নিজের চূড়ান্ত নিয়তিকে সালাম করতে পারেন। জীবনকে বুঝাই জীবনের পরমোৎকর্ষ। দেবভাষায় কথা বলতে পারাই কাব্যের শিখর।
অনেক হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, শূন্যের মধ্যে যুক্তি কষাকষি। তিন জন দার্শনিক কবির বিশদ পরিচয় দিলেই, আমার বক্তব্য আরো স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রমাণিত হবে।
[চলবে]
This is a translation of George Santayana’s Three Philosophical Poets, Introduction.
মন্তব্য
বেশ! চলুক। অনুসরণ করছি।
গুড জব! অনুবাদ চলুক।
একটা প্রশ্নঃ এখানে উল্লেখিত 'আত্মা' নিশ্চয়ই 'spirit' অর্থে কিন্তু সেটা কি সঠিক হয়? তাহলে 'রুহ্'-এর বাংলা ও ইংলিশ কী হয়? 'নফস্'-এর বাংলা ও ইংলিশ কী হয়?
অটঃ 'বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁস' আর 'ঈশ্বরের ইতিহাস'-এর পরের পর্বগুলো কবে পাবো?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খুব ধন্যবাদ স্পিরিটের দ্ব্যর্থতাটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য। ইংরেজিটা আবার পড়ে দেখলাম সান্টায়ানা মাত্র এক জায়গায় soul ব্যবহার করেছেন, আর বাকি সব জায়গায় spirit, তাই আমি এক জায়গায় আত্মা রেখে দিলাম, এবং বাকি সব জায়গায় ‘আত্মা’ কেটে ‘চিত্ত’ করে দিলাম।
তাহলে আত্মা (রুহ), চিত্ত (স্পিরিট, গাইস্ট), মন তিনটা জিনিস পাওয়া গেল। নফসকে চিত্ত বা গাইস্টের সাথে মেলানো যায় কি না ভাবতে হবে।
ঐ সিরিজ দুইটার মধ্যে ঈশ্বরের ইতিহাসটা আসলে ফেলে রাখসি অনেক দিন ধরে। নিশ্চিত জানি না শুরু করব কি না। কিন্তু রেনেসাঁসের লেখাটা যেহেতু আর এক পর্বে শেষ করে দেয়া যায়, একদিন করে ফেলব, যদি চিত্তকে বশে আনতে পারি।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমার ধারণায়,
আত্মা = soul, রুহ্ (ধর্মগুলির মতানুসারে এটি অমর। ইসলামী ব্যাখ্যা অনুযায়ী জন্মের আগে শুরু করে (আ'লামে আরওয়াহ্), পৃথিবীর জীবন (আ'লামে দুনিয়া), কবরের জীবন (আ'লামে বারযাখ) ও স্বর্গ/নরকের শেষ জীবন (আ'লামে আখিরাহ্) পর্যন্ত) - এটির সাথে জীবের বাঁচা বা মরার সম্পর্ক নেই।
প্রাণ = élan vital, জান - এটির বলে জীব বেঁচে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
শৌর্য = spirit, খুদী।
মন = mind, নফস্ - এটিকে চিত্ত বা কখনো কখনো রিপুও বলা যায়।
সজ্ঞা = intuition
প্রতিসজ্ঞা = counterintuition
উপলব্ধি = perception
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সজ্ঞা বানান ব-ফলা আছে না? আমি তো জানতাম স্বজ্ঞা।
প্রায় সবগুলোর সাথে একমত। কিন্তু স্পিরিটকে তারপরও আমি চিত্ত বলতেই চাচ্ছি। মনের যেহেতু দুইটা শব্দ আমাদের আছে, এবং স্পিরিটের কোনো যুৎসই শব্দ যেহেতু নেই, সেহেতু মনের একটা শব্দ স্পিরিটকে দিয়ে দিলে খারাপ হয় না। তাছাড়া রোমান্টিকরা স্পিরিট নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল, যেমন করে রবীন্দ্রনাথ চিত্ত নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। গ্যোটের স্পিরিট আর রবীন্দ্রনাথের চিত্তের মধ্যে একটা মিল দেখা যায় আসলে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
অর্থ বিচার করলে তো 'স্বজ্ঞা' হওয়াই উচিত। বহু বহু কাল আগে রাসেলের একটা বইয়ের বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম ('বহির্জগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা), কার অনুবাদ মনে নেই। সেখানে প্রথম শব্দটা দেখেছিলাম 'সজ্ঞা' হিসাবে। তারপর আরও অনেক জায়গায় 'সজ্ঞা'ই লিখতে দেখেছি। বাংলা উইকিতেও দেখি 'সজ্ঞা' লিখে রেখেছে। এই ভুলটার সংশোধন হওয়া উচিত। আমি নিজে, নিজেকে শুধরে নিলাম। ধন্যবাদ শিক্ষানবিস!
'শৌর্য' শব্দটার স্বাধীন প্রয়োগ প্রায় নেই। সর্বত্র একে কেবল 'শৌর্য-বীর্য' আকারে দেখা যায়। এই কারণে স্পিরিটের বাংলা হিসাবে শৌর্যকে মানতে আমাদের মনে খুঁত খুঁত লাগে। রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত' যুক্তির সীমায় ভাবে আর আবগের ধারায় চলে। গ্যোটের 'স্পিরিট' কি অমন কিছু?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
শৌর্য, খুদীর ভাব বহন করতে পারে, স্পিরিট শব্দটির বাংলা শব্দ হিসেবে শৌর্য আমরা ব্যবহার করি নি, কিন্তু এর ব্যবহার করার যৌক্তিক ব্যবহারিক, ধারণাগত ও হৃদ ভিত্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়
ভাবতে গিয়ে মনে হলো।।।
একজন লেখক তাঁর লেখায় নিজ বিবেচনায় একটা প্রতিশব্দ নির্মাণ (invention অর্থে) করতে পারেন বা আবিষ্কার (discover অর্থে) করতে পারেন বা নতুন ব্যবহার করতে পারেন। সেখানে লেখকের যৌক্তিক ব্যবহারিক, ধারণাগত ও হৃদভিত্তিক কারণ থাকলে বোদ্ধা পাঠকও অনুরূপ অনুভব করবেন। এভাবে ঐ প্রতিশব্দটা বার বার ব্যবহৃত হতে হতে ভাষার জগতে জমি পেয়ে যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আগ্রহ বোধ করছি। আশা করি পরের পর্ব আসতে দেরী হবেনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ভাবছি এই লেখা পড়ে কান্ট আর মার্ক্স কি বলতেন? দার্শনিকের দায়-দায়িত্ব কবির ঘাড়ে চাপানো নিয়ে রবীন্দ্রনাথই বা কি ভাবতেন!
****************************************
লেখা এবং অনুবাদ দুটোই দারুন লেগেছে।
একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এলান পো-র খুব ইন্টারেস্টিং একটা লেখা পেলাম। তার থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেই এখানে, এই লেখার সাথে মিলিয়ে পড়লে হয়তো মজাই লাগবে --
****************************************
১
এলান পো আমার খুবই প্রিয় কবি, এবং তার মতো আমিও মাঝে মাঝে মনে করি, একটা শিল্পের ভালোমন্দ কেবল এক বসায় সেটা উপভোগ করা শেষ করতে পারলেই বিচার করা যায়। কিন্তু তার সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে, আমি এই ক্ষণচারিতাকে আমার শিল্প-সমঝদারির শুধু একটা অংশ মনে করি। আমি মনে করি শিল্প ক্ষণকালীন, দীর্ঘকালীন, বা এমনকি সারা জীবনে ব্যপ্তও হতে পারে। একটা উদাহরণ দিই।
১) যখন ক্ষণিকের শিল্প দিয়ে আধাটা ঘণ্টা ভরতে ইচ্ছা করে, তখন রবীন্দ্রনাথের একটা গান কয়েকবার শুনি।
২) যখন শিল্পের প্রভাব আরেকটু বেশি সময়ের ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে, তখন একটা ভালো সিনেমা কয়েকবার দেখে একটা দিন পার করে দিই, বা একটা উপন্যাস পড়ি।
৩) আর যখন একটা নির্দিষ্ট শিল্পকর্মকে সারা জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পেতে ইচ্ছা করে, তখন হাত দিই কৃষ্ণদৈপায়ন, লুক্রেতিউস, ওভিদ, দান্তে এবং গ্যোটেতে। এগুলোতে ক্ষণিকের তৃপ্তি খুঁজি না। এগুলোকে একটা একক কাজ হিসেবে দেখি, এবং সেই একক সত্যে পৌঁছানোটাকে আমার কাছে আমার সারা জীবনের কাজ মনে হয়, কোনো নির্দিষ্ট ঘণ্টা বা দিনের নয়।
এই তিন ধরনের শিল্পের গুরুত্বই আমার কাছে সমান।
এই কারণে আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত এলান পো-র চেয়ে আমি সান্টায়ানাকে বেশি কদর করব। কারণ, এলান পো যেখানে ৩ নম্বর পুরো বাতিল করে দিয়েছেন, এবং ২ নম্বরকেও ১-এর চেয়ে খাটো করেছেন, আমি সেরকম করব না। আমার কাছে এই ৩ ধরনের শিল্পের মধ্যেই ভালো মন্দ আছে। এবং সান্টায়ানা আসলে সেটাই বলতে চান। তিনি কোনোটাই বাতিল করেননি, শুধু আধুনিক যুগের শিল্পসর্বস্বতার জোয়ারে ৩ নম্বরকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল সেটার বিরোধিতা করেছেন।
২
সত্য নিয়ে এলান পো যা বলেছেন, সেটা আমার মতে সত্যের সংজ্ঞা নিয়ে সমস্যা থেকে এসেছে। এলান পো সত্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটা আমার কাছে সত্যের সংকীর্ণ সংজ্ঞা, যা শুধু সত্যের একটা দিকের কথা বলে। আমি মনে করি বিজ্ঞানের একটা রসহীন সমীকরণে যেমন সত্য থাকে, তেমনি ফাউস্টের পেত্নী-ডাইনি-প্রেতাত্মাদের সাথে উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল নাচানাচির মধ্যেও সত্য থাকে। সত্যের ঘর চিনতে এলান পো ভুল করেছেন।
তাই একদিকে, যেমন সত্য আর কবিতাকে আমি বিরোধী মনে করি না, তেমনি আবার এটাও বলি না যে, শুধু সত্যই শিল্পের লক্ষ্য। আসলে শিল্পের লক্ষ্য হিসেবে যেকোনো একটা জিনিসকে নির্ধারণ করাতেই আমার সবচেয়ে বেশি আপত্তি।
তাই বলে এলান পো-র কাজকে খাটো করছি না। তিনি কবিতার একটা নির্দিষ্ট দিককে খুব গভীরভাবে দেখেছেন, শুধু একটা দিকে মনোনিবেশ করাতে আমরা সেই দিকটা আরো ভালো বুঝতে পেরেছি।
কিন্তু দিন শেষে মনে রাখতে হবে সেটা কেবলই এক দিক। দিন শেষে বিজয়ী হবে জৈন দর্শনের অনেকান্তবাদ।
আমি মনে করি না নির্দিষ্ট শুধু একটা জিনিসকে শিল্পের লক্ষ্য করা উচিত। "শিল্পের জন্যই শিল্প" যেমন পুরোপুরি ভুল একটা কথা, "সত্যের জন্যই শিল্প"-ও তেমনি ভুল কথা, "সৌন্দর্যের জন্যই শিল্প"-ও ভুল কথা। কিন্তু এই প্রতিটাতে যে "জন্যই" শব্দটা আছে, সেখান থেকে "ই" উঠিয়ে দিলে আমি তিনটা কথার সাথেই একমত হবো।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
১।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ প্রমুখ যাদের নাম নেয়া হলো প্রত্যেকের কাজ (ধরি, মহাভারত) কি একক কাজ? এই সকল কাজের লক্ষ্য কি কোন একক সত্য? (মহাভারত/ঈনিদ/ডিভাইন কমেডি/ফাউস্ত কি আমাদের কোন একক সত্যে পৌঁছায়?
২।
সহমত, তবে শিল্প তার চেয়েও বেশি মানুষের জন্য। মানুষ অ্যাপ্রিশিয়েট করে, উপভোগ করে বলেই একটা সৃষ্টিশীল কর্ম শিল্পের মর্যাদা পায়। মারিয়ানা খাতে যেসব ফুল ফোটে বা প্রাণী ঘুরে বেড়ায় তাদের সৌন্দর্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেগুলো মানুষের চোখে না পরা পর্যন্ত কি তাদের রূপের শৈল্পিক দিকটা প্রতিষ্ঠিত হয়?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
"কৃষ্ণদ্বৈপায়নের একক কাজ" কথাটা একটু রূপকার্থে বুঝিয়েছি। অবশ্যই ৭৫,০০০ লাইনের 'মহাভারত' শত মানুষের শত সময়ের সংযোজনের ফল। কিন্তু তারপরও 'মহাভারতের' একটা একক থিম মনের মধ্যে আসে, যেই থিম আবার এতই বিশাল যে তার মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের অনেক বড়ো বড়ো জিনিস চলে আসে। এই কারণেই মনে হয়, হাজার জনের লেখা হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীনেরাও 'মহাভারতের' উপর একটা ঐক্য আরোপের চেষ্টা করেছে, কৃষ্ণদ্বৈপায়নের উপর সব চাপানো যার একটা নিদর্শন। আর আসলে বলতে চাইনি যে মহাকাব্য থেকে কোনো একক সত্য পাওয়া যায়। বরং অনেক সত্যই পাওয়া যায়। শুধু বুঝাতে চেয়েছিলাম সত্য পাওয়া যায়। কাব্য হলেই সেটা সত্যমুখী হতে পারবে না, এই কথার সাথে একমত নই। একইভাবে আবার শুধুমাত্র সত্যের জন্যই কাব্য সেটার সাথে একমত না। উল্লেখ্য, গ্যোটে তার আত্মজীবনীতে 'কাব্য ও সত্য' নিয়ে অনেক চিন্তা করেছেন। আমি এখনো পড়িনি, তবে পাঠ্যতালিকায় আছে। আর সবার উপরে তো 'সত্যের' সংজ্ঞা নিয়েই সমস্যা আছে, সত্য জিনিসটাই বা কি সেটাও পুরোপুরি বুঝি না।
আপনার এই কথার সাথে একমত যে, শিল্পকে শুধুমাত্র মানুষের সৃষ্টি হিসেবেই দেখা যায়। আমি আসলে মনে করি মানুষের সবচেয়ে অনন্য বিশাল সৃষ্টি (যাদেরকে বিদ্যা বলি) চারটা: বিজ্ঞান শিল্প দর্শন ও ধর্ম। এবং এই চারটাই আবার তৈরি হয়েছে মানুষের খেলার ক্ষমতা থেকে; খেলার ক্ষমতাটা নিজে অনেক আগের জিনিস, অন্য অনেক প্রাণীরাও খেলতে পারে, কিন্তু মানুষ এই খেলাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, এবং খেলার ছলেই তৈরি করেছে ঐ চতুর্বিদ্যা। সুতরাং মানুষের সৃষ্টি এবং উপভোগ ছাড়া শিল্প হতে পারে না। কিন্তু অনেকে যে বলেন, সৌন্দর্য জিনিসটাও মানুষের মনেরই সৃষ্টি, সেটা নিয়ে আমার দ্বিধা আছে। অবশ্যই সৌন্দর্যের একটা খুবই মানবিক বোধ আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবি, ত্রিভুজেরও তো মানবিক বোধ আছে, তাই বলে ত্রিভুজ বলে একটা আদ্যন্তহীন চিরন্তন মানুষনিরপেক্ষ রূপ আসলেই থাকতে পারে না? আমি নিশ্চিত না। বিশুদ্ধ রূপ আছে ভাবাটা প্লেটোনিক হলে, আর নেই ভাবাটা এরিস্টটলীয় হলে, আমি এখনো দুই জনের মাঝখানে দোদুল্যমান, তবে প্লেটোর দিকে একটু বেশি ঝোঁকা।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
একটা প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে - সত্য কী? সরল উত্তর হচ্ছে যা প্রত্যক্ষ করলাম (মানে যা দেখলাম/শুনলাম/অনুভব করলাম)। যেমন, এই চা'টা গরম, এই শরবতটা ঠাণ্ডা। কিন্তু আমরা জানি এই সত্যটা আপেক্ষিক। এক গ্লাস তরল নাইট্রোজেনের তুলনায় এই শরবতটা অনেক গরম; বা এক কাপ তরল ইস্পাতের তুলনায় এই চা'টা অনেক ঠাণ্ডা। কোন ফ্রেম অভ রেফারেন্স থেকে দেখলাম, তখন কার গতি কত ছিল, কার অবস্থান কোথায় ছিল ইত্যাদিসব বিষয় বিবেচনায় নিলে সত্য বিষয়টা আর সহজ থাকে না। সামান্য একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর একমাত্র ইলেকট্রনটাকে ধরতে গেলে "এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা" দশা হয়। কর্ণ কি হিরো অথবা অশ্বত্থামা কি ভিলেইন? সত্য বলে আসলেই কি কিছু আছে নাকি সবই আপেক্ষিক। এই আপেক্ষিক সত্যতার ওপর ভিত্তি করে মানুষ তাহলে কী করে পরম বিচার করতে বসে? কী করে বলে এটা ঠিক, ওটা ভুল? কী করে বলে একে পুরস্কৃত করো আর ওকে শাস্তি দাও? "হে কৃষ্ণ কেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কে আমার শত্রু, কেই বা আমার মিত্র। কতদূরে ছড়িয়ে দিয়েছো তোমার কুরুক্ষেত্র, কত দূর"!
বিজ্ঞান, শিল্প, দর্শন, ধর্ম - এগুলো সবই জ্ঞানের শাখা। জ্ঞানের চর্চ্চা ও বিকাশের উপায় আবিষ্কার হচ্ছে মানুষের অনন্য কৃতিত্ব। এখানে সে অন্য অনেক প্রাণের চেয়ে এগিয়ে আছে। যে করে হোক মানুষ স্বজ্ঞাকে উপলদ্ধিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে, এটা আর কেউ এভাবে করতে পারেনি। মানুষের সৌন্দর্যবোধ,শিল্পবোধের ঊন্মেষ এখান থেকে। এই বোধটাকে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং এখানে চিন্তা, ভাবনা, ইচ্ছা ইত্যাদি কাজ করেছে। আগের অনুচ্ছেদে সত্য নিয়ে আমরা যে প্রপঞ্চময় পরিস্থিতিতে পড়েছি তাতে বোঝা যাচ্ছে এখানে সৌন্দর্যের প্লাতোনিক বিশুদ্ধরূপ বলে কিছু হতে পারে না। ‘প্রথম দর্শন থেকে প্রথম চুম্বন পর্যন্ত’ প্লাতোনিক প্রেমের যে জনপ্রিয় ধারণা প্রচলিত আছে (যা আসলে প্লাতোর সরাসরি আবিষ্কার নয়, ‘সিম্পোজিয়াম’ থেকে পরবর্তীতে বানানো) সেখান থেকে বোঝা যায় সম্পর্ক শারিরীক হলেই সেটা বিশুদ্ধতা হারালো সেটা এক কালে সত্য বলে বিশ্বাস করলেও এখন আর তা সত্য নয়। অন্তত এই ক্ষেত্রে প্লাতো সম্ভবত আরিস্ততলের আবির্ভাবের সাথে সাথে মারা গেছেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন