জর্জ সান্টায়ানার অনুবাদের পরের কিস্তিটা এখনো শেষ করে উঠতে পারিনি। এই ফাঁকে আগে করা হুইটম্যানের ‘সং অফ মাইসেল্ফ’-এর একটা অনুবাদ দিচ্ছি। প্রথম ১১টা সেকশন আমার সাইটে রেখেছিলাম, এখানে আরো ২টা যোগ করে মোট ১৩টা সেকশন প্রকাশ করলাম। সৈয়দ আলী আহসান এটা অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু আমার এখনো পড়ার সুযোগ হয়নি। আমি অনুবাদটা করছিলাম নিছকই শখের বশে, অনুবাদে হাত পাকানোর জন্য, নিঃসন্দেহে কাঁচা হাতের ছাপ পড়েছে প্রায় প্রত্যেক লাইনে।
আমি উদ্যাপন করি নিজেকে, গাই নিজের গান,
এবং আমি যা সত্য বলে মেনেছি, তা মানবে তোমরাও,
কারণ আমার যত পরমাণু আছে, তার প্রতিটি আছে তোমাদেরও।
আমি ঢিমে তালে আবাহন করি আমার আত্মা,
আমি হেলান দিয়ে বসে, আয়েশে নিরীক্ষণ করি, গ্রীষ্মঘাসের বর্শা।
আমার জিভ, আমার রক্তের প্রতিটি পরমাণু, গঠিত এই মাটি দিয়ে, এই বায়ু দিয়ে;
জন্মেছি এখানে, যেখানে জন্মেছিলেন আমার বাবা-মা, দাদা-দাদি, তাদের বাবা-মা, আর তাদের;
এখন, এই সাইত্রিশ বছর বয়সে, পরিপূর্ণ সুস্বাস্থ্যে, শুরু করলাম,
আশাকরি এক মুহূর্ত থামব না মৃত্যুর আগে।
ধর্মশালা আর বিদ্যালয় আপাতত মুলতবি,
বুঝি তাদের প্রয়োজনীয়তা, ভুলিনি তা, কিন্তু অবসর নিয়েছি এই বেলা;
এখন প্রশ্রয় দেবো, নিঃশর্তে, ভালো বা মন্দে, এমনকি ঘন দুর্যোগে,
আদিম আত্মশক্তিতে বলীয়ান অবাধ প্রকৃতিকে।
বাড়ি ঘর সৌরভে মুখরিত, বইয়ের তাকে সুগন্ধের সমারোহ,
নিজেই পাচ্ছি সে সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে, চিনি তাকে, পছন্দও করি,
ঠিকমতো নিংড়ে নিলে আমিও মাতাল হতাম, কিন্তু হতে দেবো না।
বায়ুমণ্ডল সুরভি নয়, নিংড়ালেও তার স্বাদ নেই, গন্ধ নেই,
ও চিরকাল শুধু আমার মুখের জন্য, আমি ওর প্রেমে পড়েছি,
আমি বনপ্রান্তের ঐ দিঘির পারে যাবো, সব বেশ খুলে নগ্ন হবো,
পাগল হয়েছি গায়ে তার ছোঁয়া পেতে।
আমার শ্বাসধোঁয়া;
প্রতিধ্বনি, হিল্লোল, মৃদু গুঞ্জন, প্রেমতরু, রেশমি সুতা, শাখামূল, আঙুরলতা;
আমার নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাস, হৃদ্স্পন্দন, ফুসফুসে বাতাস আর রক্তের আসা-যাওয়া;
গন্ধ শোঁকা, ভেজা আর শুকনো পাতার, বেলাভূমির, গাঢ়বর্ণ সমুদ্রশৈলের, গোলাঘরে খড়ের;
শব্দ শোনা, আমার কণ্ঠনিঃসৃত বাক্যের বাতাসচক্রে বিলীন হওয়ার;
কয়েকটি হালকা চুমু, আলতো আলিঙ্গন, বাহুতে বাহুতে কোলাকুলি;
আলো-ছায়ার খেলা, নমনীয় ডালপালার আন্দোলনে, গাছের গায়ে;
আনন্দ, একাকিত্বের, অথবা রাস্তাঘাটে বা মাঠ-ক্ষেতে আর পাহাড়পারে জনস্রোতের;
সুস্বাস্থ্যের অনুভূতি, পূর্ণচন্দ্রের সুরধ্বনি; আমার শয্যা ছেড়ে উঠে সূর্যসাক্ষাতের গান।
তুমি কখনো হাজার একর আদ্যোপান্ত গুণে দেখেছো? পৃথিবীর পরিধি মেপে দেখেছো?
কখনো পড়তে শেখার জন্য এত সময় ধরে অনুশীলন করেছো?
কবিতার মর্ম বুঝতে পেরে কখনো এত গর্ব অনুভব করেছো?
আজ এই দিনে, এই রাতে আমার সাথে একটু দাঁড়াও: পাবে সকল কাব্যের উৎসাধার,
অর্জন করবে পৃথিবী ও সূর্যের ভালো সবকিছু, (লক্ষ সূর্য তো বাকি,)
কোনোদিন গ্রহণ করবে না দুই তিন হাত ঘুরে আসা কিছু, দেখবে না মৃতের চোখ দিয়ে, বাঁচবে না বইপত্রের প্রেতাত্মা খেয়ে,
এমনকি দেখবে না আমার চোখ দিয়েও, নেবে না কিছু আমার কাছ থেকেও,
বরং তুমি নিজে কান পাতবে সব দিকে, সবকিছু পরিশ্রুত করবে স্বীয়ছাঁকনিতে।
শুনেছি বলিয়েরা কী বলছিল—শুরু আর শেষের কথা,
কিন্তু আমি শুরু বা শেষের কথা বলি না।
কোনোদিন এত জন্ম ছিল না, যতটা এখন আছে,
এত যৌবন বা জরা ছিল না, যতটা এখন আছে,
আর এত উৎকর্ষ থাকবে না, যতটা এখন আছে,
এত স্বর্গ বা নরক থাকবে না, যতটা এখন আছে।
তাড়না, তাড়না, আর তাড়না,
সারাক্ষণ শুধু বিশ্বের সংগমতাড়না।
অস্ফুট অদ্বৈত থেকে দুই বিপ্রতীপ সমানের জন্ম, সারাবেলা সারবস্তু আর বৃদ্ধি, সারাবেলা মৈথুন,
সারাক্ষণ পরিচয়ের বোনাবস্ত্র, সারাক্ষণ স্বাতন্ত্র্য, সারাক্ষণ প্রাণের আরেকটি প্রজাতি।
বেশি ব্যাখ্যা বৃথা—জ্ঞানী আর অজ্ঞান সবাই বোঝে এই কথা।
সবচেয়ে-দ্বিধাহীন নিশ্চয়তার মতো নিশ্চিত, ওলনদড়ির মতো উল্লম্ব, কড়িকাঠের অবলম্বনে আন্তর্বদ্ধ,
ঘোড়ার মতো দৃঢ়হৃদয়, মায়াময়, উদ্ধত, বিদ্যুদ্দীপ্ত
এই রহস্য আর আমি, দাঁড়িয়েছি এইখানে।
স্বচ্ছ আর মিষ্টি আমার আত্মা, স্বচ্ছ আর মিষ্টি যা আমার আত্মা না তা।
একজনের নাই তো দুই জনেরই নাই, অদৃশ্যের প্রমাণ মেলে দৃশ্যমানে,
যতক্ষণ না সে নিজে অদৃশ্য হয়ে পালাক্রমে হয় প্রমাণিত।
সবচেয়ে ভালো বয়সকে সবচেয়ে খারাপটা থেকে আলাদা করে দেখানো বয়সের অপমান,
সবকিছুর নিখুঁত সাবল্য আর মনোভারসাম্য জানি বলে, ওরা যখন তর্ক করে আমি তখন নিশ্চুপ, তারচেয়ে গিয়ে স্নান করি আর নিজের তারিফ করি।
স্বাগত প্রতিটি প্রত্যঙ্গ আর গুণ আমার, এবং সতেজ আর নির্মল যে-কারও,
এক ইঞ্চি না, একটি কণার এক ইঞ্চিও নোংরা না, এবং কেউ কারও চেয়ে কম আপন হবে না।
আমি সন্তুষ্ট—আমি দেখি, নাচি, হাসি, গাই;
আশ্লেষী, অনুরাগী শয্যাসঙ্গী যখন আমার পাশে ঘুমিয়ে রাত কাটায়, আর দিন উঁকি দেয়ামাত্র উঠে চুপিসারে চলে যায়,
রেখে সাদা রুমালে ঢাকা অসংখ্য ঝুড়ি, পুরো বাড়ি ভর্তি করে,
তখন আমি কি আদান আর বোধন স্থগিত রেখে আমার চোখের সাথে চেঁচামেচি করব,
যাতে সে অপলক দৃষ্টি সংযত করে রাস্তা পানে তাকায়,
আর অবিলম্বে গুপ্তলিপি পড়ে আমাকে পয়সার হিসাব বোঝায়,
দেখায় এক আর দুই পয়সার মূল্যটা ঠিক কী, আর কোনটা বেশি বড়ো?
আমার চারপাশ ঘিরে থাকে পর্যটক আর জিজ্ঞাসুক,
নবপরিচিত আগন্তুক, আমার অতীতজীবনের প্রভাব, অথবা আমার মহল্লা, শহর, জাতি,
সর্বশেষ তারিখ, আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সমাজ, পুরনো আর নতুন লেখক,
নিশাভোজ, পোশাক, সহযোগী, সাজ, প্রশংসা, বকেয়া,
ভালোবাসার নারী-পুরুষের আসল বা নকল উদাসীনতা,
কোনো আত্মীয়ের বা আমার অসুখ, বা দুর্দৈব, লোকসান, অর্থকষ্ট, অথবা বিষাদ আর পরমানন্দ,
বিগ্রহ, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের বিভীষিকা, অনিশ্চিত খবরের জ্বর, পৌনঃপুনিক ঘটনা;
এগুলো দিবারাত্রি আসতে থাকে আমার কাছে, আবার চলে যায়,
কিন্তু এরা আমার সত্তা নয়, এরা আমি নই।
এই টানাহেঁচড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি আমি,
আমোদিত, পরিতৃপ্ত, সমবেদনা-ময়, অলস, ঐকিক,
দাম্ভিক, উন্নতশির, কখনো স্পর্শাতীত নিশ্চিত কোনো অবলম্বনে একটি বাহু বাঁকা করে রাখা,
একপাশে হেলানো মাথা নিয়ে তাকিয়ে, এরপর কী আসবে তার সাগ্রহ প্রতীক্ষায়,
একইসাথে খেলার বাইরে ও ভিতরে, তা দেখে আর বিস্মিত হয়ে।
পেছনে তাকালে দেখি আমার আপন-কালে ঘাম ঝড়াতাম ভাষাবিদ আর প্রতিযোগীদের কুজ্ঝটিকায়,
আমার কোনো বিদ্রূপ বা যুক্তি নেই, শুধু দেখি আর অপেক্ষা করি।
তোমাকে বিশ্বাস করি, আমার আত্মা; অন্য-আমি নিজেকে হীন করবে না তোমার কাছে,
তুমিও কখনো হীন হবে না অন্য-আমির কাছে।
আমার সাথে অলস পায়চারি করো ঘাসের বুকে, গলায় যা আটকে আছে ঝেড়ে ফেলো,
চাই না শব্দ, সঙ্গীত, অন্তমিল, চাই না প্রথা, ভাষণ, সবচেয়ে ভালোটা হলেও না,
শুধু চাই ঘুমপাড়ানির গীত, তোমার কপাটকণ্ঠের গুন-গুন।
মনে পড়ে একদিন আমরা কীভাবে শুয়ে ছিলাম, গ্রীষ্মের কী স্বচ্ছ এক সকালে,
কীভাবে তুমি আড়াআড়ি মাথা রেখেছিলে আমার কটি ‘পরে, আলতো ঘুরে উঠে এসেছিলে আমার উপরে,
বক্ষপিঞ্জরের কাছে জামার বোতাম খুলে দিয়ে, তোমার জিভ হেনেছিলে সোজা আমার সংবিবস্ত্র হৃদয়ে,
এবং সবেগে সাঁতরেছো, যতক্ষণ না পেয়েছিলে আমার দাড়ির স্পর্শ, যতক্ষণ না ধরেছিলে আমার পা।
দ্রুত তুমি জেগেছিলে, আমাকে ঘিরেছিলে সেই শান্তি আর জ্ঞানে, যা নিষ্পন্ন করে পৃথিবীর সব যুক্তি,
আমি জানি ঈশ্বরের হাত আমার হাতের প্রতিশ্রুতি,
আমি জানি ঈশ্বরের আত্মা আমার আপন ভাই,
জানি এযাবৎ জন্মানো সব পুরুষ আমার ভাই, সব নারী আমার বোন বা প্রেমিকা,
জানি সৃষ্টির বন্ধনস্তম্ভ প্রেম,
জানি গুণে শেষ করা যাবে না ক্ষেতে নেতানো বা অনম্য পাতা,
তাদের পেছনে ছোটো ছোটো কুয়োতে বাদামি পিঁপড়া,
আর কীটবেড়ার গায়ে শ্যাওলার মামড়ি, পুঞ্জীভূত পাথর, এল্ডার, মালিন আর আগাছা।
একটি শিশু বলেছিল ‘ঘাস কী?’, দু-হাত ভরে এক গোছা তুলে দিয়ে আমার হাতে;
কী উত্তর করব তাকে? এ-নিয়ে আমার জানার দৌঁড় তো তার চেয়ে বেশি না।
হয়ত ঘাস আমার স্বভাবের পতাকা, আশার সবুজ কাপড় দিয়ে বোনা।
বা হয়ত সে প্রভুর রুমাল,
স্মরণেচ্ছুর জন্য ইচ্ছা করে ফেলে যাওয়া সুগন্ধী উপহার,
কোণায় মালিকের নামের আদ্যক্ষর, যাতে আমরা দেখে প্রশ্ন করতে পারি, এটা কার?
বা হয়ত ঘাস নিজেই একটি শিশু, গাছপালার গর্ভজাত আদরের সন্তান।
বা হয়ত সে কোনো সুষম গূঢ়লিপি,
যাতে লেখা: প্রশস্ত বা সরু সবখানে সমানভাবে গজাও,
কালো আর সাদা সবার মাঝে সমানভাবে জন্মাও,
ক্যানাক, টাকাহো, কংগ্রেসনেতা, কাফ, সবাইকে সমানভাবে দাও, সমানভাবে নাও।
আর এখন মনে হচ্ছে, সে কবরের সুন্দর আকাটা কেশ।
তোমায় খুব কোমলভাবে ব্যবহার করব, কোঁকড়া ঘাস,
হয়ত তুমিই ভর করে বসো যুবক ছেলেদের হৃদয়ে,
হয়ত তাদেরকে চিনলে ভালোবাসতাম,
হয়ত তুমি থাকো বৃদ্ধদের মাঝে, বা মায়ের কোল থেকে অকালে ছিনিয়ে নেয়া নবজাতকের মাঝে,
আর এখানে স্বয়ং তুমিই মায়ের কোল।
এই ঘাস বৃদ্ধ মায়ের সাদা মাথা থেকে আসার পক্ষে বড্ড গাঢ়,
বৃদ্ধ পুরুষের বর্ণহীন দাড়ির চেয়ে গাঢ়,
মুখের ধূসর-লাল তালুর নিচ থেকে আসার পক্ষেও গাঢ়।
আহ্, আমার উপলব্ধি এসেছে, শত শব্দমুখর জিভের পর,
আমি বুঝতে পেরেছি, ওরা মুখের তালু থেকে আসে না কোনো কারণ ছাড়া।
যদি পারতাম যৌবনে মারা যাওয়া নারী-পুরুষের আভাসগুলো অনুবাদ করতে,
এবং বৃদ্ধ পুরুষ আর মায়েদের আভাস, মায়ের কোল থেকে অকালে ঝরে পড়া সন্তানদের আভাস।
ঐ যুবক আর বৃদ্ধ পুরুষদের কী হয়েছে মনে করো?
নারী আর শিশুদের কী হয়েছে মনে হয়?
তারা সবাই বেঁচে আছে কোনো খানে,
সবচেয়ে ছোটো অঙ্কুরটিও বুঝিয়ে দেয়, মৃত্যু বলে আসলে কিছু নেই,
আর যদি থাকতও, তার কাজ হতো জীবন এগিয়ে নেয়া, আয়ু শেষে তার গতিরোধের অপেক্ষা করা নয়,
এবং জীবন আসামাত্র সে বিদায় নিতো।
সবকিছু প্রবাহিত সম্মুখে বহির্মুখে, কারও ধ্বস নেই,
এবং মৃত্যু, সবাই যা মনে করে তার থেকে অনেক আলাদা, অনেক বেশি ভাগ্যের।
কেউ কি ভেবে বসে আছে, জন্ম সৌভাগ্যের?
তাকে এই মুহূর্তে জানিয়ে দিতে চাই, মৃত্যু সমান সৌভাগ্যের, আমি নিশ্চিত জানি।
মৃত্যুর দেখা পাই মৃতের সাথে, জন্মের পাই নবজাতকের সাথে, আমি জুতাটুপির মাঝে সীমাবদ্ধ নই,
একান্তমনে দেখি বহুবিধ বস্তু, কোনো দুটি এক রকম নয়, প্রত্যেকটি শুভ,
পৃথিবী শুভ, নক্ষত্র শুভ, তাদের অনুবন্ধী সবকিছু শুভ।
আমি পৃথিবী নই, পৃথিবীর অনুবন্ধীও নই,
আমি মানুষের বন্ধু, সঙ্গী, যে-সব মানুষ আমারই মতো অমর অতল,
(ওরা জানে না কত অমর, আমি জানি।)
প্রতি জাত স্বজাতের তরে, আমার তরে আমার নর নারী,
আমার তরে তারা, যারা বালক ছিল, মেয়েদের ভালোবেসেছিল,
আমার তরে সেই পুরুষ, যে উদ্ধত, যে উপেক্ষার হুল বিঁধলে কেমন লাগে জানে,
আমার তরে প্রিয়তমা, বুড়ো কাজের-মহিলা, আমার তরে মা, মায়ের মা,
আমার তরে ঠোঁট, যা হেসেছে, চোখ, যা অশ্রু ঝরিয়েছে,
আমার তরে শিশু, আর শিশুদের জনক-জননী।
কাপড় খোলো! তুমি আমার কাছে দোষী নও, সেকেলে নও, বাতিল নও,
আমার চোখ ভেদ করে যায় পুরু পশম রেশম, যা-ই থাকে সামনে,
আমি সর্বব্যাপী, নাছোড়বান্দা, অর্জনপ্রিয়, অক্লান্ত, দুর্নিবার।
ছোট্টো শিশু ঘুমায় তার দোলনায়,
আমি মশারি তুলে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকি, নীরবে হাত দিয়ে মাছি তাড়াই।
যুবক ছেলে আর লালমুখো মেয়েটি ঝোপঝাড়ঘেরা পাহাড় বেয়ে সন্তর্পণে ওঠে,
আমি চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধো চোখে তাদের দেখি।
আত্মঘাতী এলোমেলো ছড়িয়ে থাকে, শোবার ঘরের মেঝেতে,
আমি রক্তভেজা চুলের লাশটি দেখি, খেয়াল করি পিস্তলটা কোথায় পড়েছে।
ফুটপাতের বকবক, গাড়ির টায়ার, জুতার থপথপ, পদবিহারীর আলাপচারিতা,
বিশালবপু বাস, ড্রাইভারের প্রশ্নবোধক বুড়ো-আঙুল, গ্রানাইট মেঝেতে নাল-পরানো ঘোড়ার ঠংঠং,
তুষার-স্লেজের টুংটাং, উচ্চকণ্ঠের রসিকতা, তুষার-বলের পেলবতা,
সাপোর্টারের জয়ধ্বনি, জাগ্রত গুণ্ডাদলের রোষ,
পর্দাঘেরা ময়লার বাক্সের পতপত, রোগী নিয়ে হাসপাতালে ছোটা গাড়ি,
মুখোমুখি শত্রু, আকস্মিক শপথ, আঘাত আর পতন,
উত্তেজিত জনতা, ভিড় ঠেলে তারক পুলিশের কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা,
হাজার প্রতিধ্বনি দেয়া-নেয়া নিরাবেগ পাথর,
বেশি খেয়ে যে নাভিশ্বাস, সূর্যের আঘাতে বা মূর্ছারোগে বেহুশ যে অনাহারী,
হঠাৎ কাতর নারীর মুখে সে কী বিস্ময়যাতনা, ত্বরায় ঘরে ফিরে যে প্রসব করে নতুন শিশু,
জ্যন্ত বা সমাহিত কত শত বাক্য স্পন্দমান এইখানে, ভব্যতায় দমানো সে কী হুঙ্কার,
আটক অপরাধী, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, পরকীয়ার নিমন্ত্রণ, গ্রহণ, বা উত্তল ঠোঁটে বর্জন,
আমি তাদের লক্ষ্য করি, তাদের রঙ্গ, তাদের অনুনাদ—আমি আসি আবার চলে যাই।
গ্রামের গোলাঘর তার বড়ো দরজার ডালা খুলে প্রস্তুত,
নবান্নের শুকনো ঘাসে মন্থর ঠেলাগাড়ি ভর্তি,
সবুজ আর ধূসর বাদামির হালকা মিশেলের উপর স্বচ্ছ আলো খেলে,
রাশি রাশি কাটা-ঘাসে দেবে গেছে গাড়ি।
আমি উপস্থিত সেখানে, কাজও করছি, ঘাসের আসনে চড়ে এসেছি,
পায়ের উপর পা তুলে, ঠেলার লক্কর ঝক্কর উপভোগ করেছি,
কড়িকাঠ থেকে এক লাফে নেমে জড়িয়েছি ক্লোভার আর টিমোথি’র বিচালি,
খেয়েছি লুটোপুটি, ঘাসের আঁটি দিয়ে জট পাকিয়েছি চুলে।
সুদূর বনে পাহাড়ে শিকার করি একা,
নিজের চপলতা আর উল্লাসে নিজেই বিস্মিত হয়ে ঘুরে বেড়াই,
পড়ন্ত বিকেলে নিরাপদ কোনো জায়গা বেছে নিই রাত কাটাতে,
আগুন জ্বালিয়ে সদ্য-ধরা শিকার ঝলসাই,
জড়ো করা ঘাসের বুকে ঘুমিয়ে পড়ি, পাশে রেখে কুকুর আর বন্দুক।
গগনচুম্বী পালের নিচে ইয়াংকি ক্লিপার জ্বলজ্বলে জল কেটে তরতরিয়ে ধায়,
আমি অস্তগামী সৈকতে চোখ রাখি, তার গলুইয়ের বাঁকে বাঁকি, ডেক থেকে আনন্দে চিৎকার করি।
মাঝি আর ঝিনুক-শিকারীরা খুব ভোরে উঠে আমার জন্য অপেক্ষা করে,
আমি বুটের ভিতর প্যান্টের তলা গুঁজে, তাদের সাথে যাই, এবং ভালো একটা সময় কাটাই;
তোমার উচিত ছিল সেদিন আমাদের সাথে থাকা, মাছের হাড়ি ঘিরে গোল করে বসা।
সুদূর পশ্চিমে, খোলা আকাশের নীচে এক ট্র্যাপারের বিয়ে দেখেছিলাম, পাত্রী ছিল এক লাল মেয়ে,
তার বাবা আর বাবার বন্ধুরা আড়াআড়ি পায়ে বসে নিঃশব্দে ধূমপান করছিল, তাদের পায়ে মোকাসিন চটি, আর কাঁধে ঝোলানো মোটা কম্বল,
একটা সোফায় আয়েশ করে বসে ছিল ট্র্যাপার, পরনের সবকিছু চামড়ার, সুবিস্তৃত দাড়ির পাক রক্ষা করে তার ঘাড়, কণেকে সে হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল,
কণের চোখের পাতা লম্বা লম্বা, মাথায় কিছু নেই, রুক্ষ ঋজু চুলের রাশি তার কমনীয় দেহ বেয়ে পৌঁছেছিল পা অবধি।
এক পলাতক দাস আমার বাড়ি পর্যন্ত এসে বাইরে থেমেছিল,
কাঠের গাদায় তার নড়াচড়ার শব্দ শুনেছিলাম,
রান্নাঘরের খোলা অর্ধ-দরজা দিয়ে তাকে দেখেছিলাম, ক্ষীণ, দুর্বল,
যে-কাঠের গুড়িতে সে বসা সেখানে গিয়ে তাকে ভিতরে আসতে বলেছিলাম নিশ্চিন্তমনে,
পানি এনে টাব ভর্তি করেছিলাম তার ঘর্মাক্ত শরীর আর রক্তাক্ত পায়ের জন্য,
তাকে শোবার ঘর দিয়েছিলাম, যাতে যেতে হয় আমার ঘর হয়ে, আর দিয়েছিলাম কিছু রুক্ষ পরিষ্কার কাপড়,
স্পষ্ট মনে আছে তার চোখ কপালে তোলা, জবুথবু ভাব,
মনে আছে তার ঘাড় আর হাঁটুর ক্ষতে ব্যান্ডেজ লাগানোর কথা;
ও এক সপ্তাহ আমার সাথে ছিল, তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে চলে গিয়েছিল উত্তরে,
তাকে টেবিলে নিজের পাশে বসাতাম, এক কোণায় থাকত আমার ফায়ারলক বন্দুক।
আটাশ জন তরুণ তীর ঘেষে স্নান করছে,
আটাশ জন তরুণ, কী দারুণ বন্ধুত্ব;
আটাশ বছরের নারীজীবন, কী ভীষণ একাকিত্ব।
তীর যেখানে উঁকি দেয়, সেখানেই তরুণীর সুরম্য বাড়ি,
জানালার পর্দার আড়ালে সে নিজের সুশ্রী রূপ, দামি পোশাক লুকিয়ে রাখে।
কোন্ তরুণকে তার সবচেয়ে পছন্দ?
আহ্, যে সবচেয়ে সাদাসিধা, সে-ই তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর।
কোথায় চলেছ, তরুণী? ঠিকই দেখতে পাচ্ছি তোমাকে,
ঐ জলে তুমিও কেলি করছ, যতই থাকো না ঘরের মধ্যে রুদ্ধ হয়ে।
তীর ঘেষে নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে এল ঊনত্রিশ নম্বর স্নায়ী,
অন্যরা তাকে দেখেনি, কিন্তু সে তাদেরকে দেখেছে, এবং ভালোবেসেছে।
তরুণদের ভেজা দাড়ি চকচক করছিল, লম্বা চুল থেকে গড়ানো জলে,
পুরো দেহ জুড়ে প্রবাহিত ছোটো ছোটো ঝর্ণার ধারা।
একটি অদৃশ্য হাতও তাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল,
কাঁপতে কাঁপতে কপাল থেকে পাঁজর হয়ে সবখানে বইছিল।
তরুণেরা চিত হয়ে ভাসছিল, তাদের সাদা পেট সূর্যের দিকে স্ফীত, তারা প্রশ্ন করে না, কে তা আঁকড়ে ধরেছে,
তারা জানে না, দেহের প্রতিটি বাঁক নিয়ে খেলতে খেলতে, হাঁপাতে হাঁপাতে, কে পরিশ্রান্ত,
তারা জানে না, কাকে তারা ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে পানিতে, ভিজিয়েছে ঝর্ণাস্রোতে।
কসাই-ছেলে তার কসাই-কাপড় খুলে রাখে, বাজারে তার দোকানে বসে ছুরিতে শাণ দেয়,
আমি কাছেপিঠে ঘুরি ফিরি, উপভোগ করি তার কথার ধারালো ছুরি, তার শাফল আর ব্রেকডাউন নাচ।
লোমশ পোক্ত বুকের কামারেরা নেহাই ঘিরে দাঁড়িয়ে, লোহার বেড়ির মতো,
প্রত্যেকের হাতে ভারী হাতুড়ি, সবাই বেরিয়েছে, আগুনের ভীষণ উত্তাপ।
দরজার কয়লা-মলিন তক্তায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের দেহতরঙ্গ দেখি,
তাদের নিটোল চিকন কোমড় খেলা করে বিশাল বাহুর সাথে,
উত্তাল হাতে হাতুড়ি দোলে, উত্তাল ধীরতায়, উত্তাল নিশ্চয়তায়,
এক বিন্দু তাড়া নেই, যার যার হাতুড়ি পড়ে তার তার জায়গায়।
নিগ্রোর শক্ত হাতে তার চার ঘোড়ার লাগাম, নিচে শিকলে বাঁধা মালামাল,
নিগ্রো, যে পাথরঘাটার লম্বা ঠেলা চালায়, অটল, লম্বা, তক্তার উপর এক পা রেখে দাঁড়িয়ে,
তার কটির-দিকে-ঢোলা নীল শার্টের বোতামের ফাঁকে উঁকি দেয় প্রশস্ত ঘাড়, বুক,
তার দৃষ্টি প্রশান্ত, কর্তৃত্বপূর্ণ, হাত দিয়ে সে টুপির নিচুপ্রান্তটা কপাল থেকে সরিয়ে দেয়,
সূর্য পড়ে তার কেতাদুরস্ত চুল আর মোচে, পড়ে তার চকচকে নিখুঁত অঙ্গের কালোতে।
আমি লক্ষ করি এই চিত্রল দানবকে, এবং ভালোবাসি, কিন্তু সেখানেই থামি না,
ভিড়ে যাই গোটা দলটার সাথে।
আমার ভিতরে প্রাণের প্রণয়ী ঘুরে বেড়ায় যত্রতত্র, সামনে বা পিছনে,
অনুকূল প্রাণারণ্যে, বা নগণ্য বাঁকে, একটা ব্যক্তি বা বস্তুও বাদ থাকে না,
সবকিছু শুষে নিই নিজের মধ্যে, আর এই গানের মধ্যে।
এই যে ষাঁড়, যে জোয়াল-শিকল ঝনঝনাচ্ছ, বা পাতার ছায়া দেখে থামছ, তোমার চোখ কী বলতে চায়?
মনে হয় জীবনে যত পাতা পড়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
দূরের পথে আমার দিনব্যাপী লক্ষ্যহীন পায়চারিতে চমকে ওঠে কাঠপাতিহাঁস আর কাঠপাতিহাঁসী,
তারা একসাথে ওঠে, ধীরে ধীরে চক্কর খায়।
আমি ঐ পাখাওয়ালা পরমার্থে বিশ্বাস করি,
এবং স্বীকার করি, আমার ভিতরে খেলা করে লাল হলুদ সাদা,
এবং মনে করি সবুজ বেগুনি আর ঐ গোছার মুকুট, সবই অভিপ্রেত,
এবং অন্য কিছু হতে পারেনি বলে কচ্ছপকে মূল্যহীন বলি না,
এবং বনের নীলকণ্ঠ স্বরগ্রামের ‘স্ব’ না বুঝলেও, আমার কাছে অতি সুমধুর,
এবং পিঙ্গল অশ্বিনীর চাহনির সামনে লজ্জায় হেঁট হয় আমার বোকামন।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন