তিন দার্শনিক কবি: লুক্রেতিউস, ২

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: রবি, ১০/০৬/২০১৮ - ১২:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘বিশ্বপ্রকৃতি’ লিখতে গিয়ে এপিকুরোসের বিশ্বদর্শনের বিশালতা লুক্রেতিউসকে অভিভূত, বিহ্বলিত করেছিল। গ্রিক ভাষায় শোনা সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ আবিষ্কার তাকে সুললিত, কিন্তু বেয়াড়া লাতিন ভাষায় প্রথম বারের মতো ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে। তার কাজ ছিল কুসংস্কার দূর করা, বিরোধীদের যুক্তি খণ্ডন করা, বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটা নিশ্চিত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করা, এবং মানুষকে নিষ্ঠুরতা ও নির্বুদ্ধিতা বিসর্জন দিয়ে সরলতা ও শান্তির জীবনের দিকে মুখ ফেরাতে আহ্বান করা। তার নিজের চিত্তও অনেক বিক্ষিপ্ত ও বিক্ষুব্ধ ছিল—অনেক সময়ই আমাদের মতাদর্শ আমাদের অর্জনের চেয়ে বেশি নির্ধারিত হয় দুর্ভোগ দিয়ে। কিন্তু মানুষের আসন্ন সুখের শুভসংবাদ প্রচার করতে গিয়ে, এবং দেবদেবীর চিরসুখের চিত্র আঁকতে গিয়ে, তিনি নিজের জীবনেও সুখ অর্জন করেছেন। পাকাপোক্ত ছয়পদীর (দাক্তিল-স্পন্দীয় হেক্সামিটার) ডানায় চড়ে তিনি পরমানন্দ আর অনুধ্যানের আকাশে উড়ে বেরিয়েছেন। তার লাইনগুলো পড়তেই যদি এত ভালো লাগে, তবে লিখতে না জানি কেমন লেগেছিল? কিন্তু তিনি কি জানতেন যে সফল হবেন? এত বিশাল একটা কাজ শেষ করা আসলেই তার ভাগ্যে ছিল? থাকতে পারে, যদি প্রকৃতির চির-অসীম সদা-বিদ্যমান সৃষ্টিশক্তি তার মস্তিষ্ক হয়ে তার চিত্তে প্রবেশ করতে পারে; যদি বাতাসে সর্বক্ষণ উড়তে থাকা দুর্নীতি আর উন্মাদনার বীজ কিছুক্ষণের জন্য সরানো যায়; এবং যদি লেখার সময়টুকুর জন্য হলেও দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের হট্টগোল মনের দরজা দিয়ে বন্ধ করা যায়। পরমাণুদের অনুকূল মিলন থেকে একটি শিশুর জন্ম হয়; আর সুপ্রসন্ন ঋতু বা পরিবেশের অনুগ্রহে একজন কবির অনুপ্রেরণার জন্ম হয়। লুক্রেতিউস জানতেন, তার সফলতা নির্ভর করে এইসব কাকতালীয় শুভক্ষণের উপর, তাই তিনি কবিতাটি শুরুই করেছেন প্রকৃতির মহাশক্তিদের আবাহন করার মাধ্যমে, যাতে তারা তাকে প্রয়োজনীয় দম ও মেধা দেয়। এবং শুরুতেই এই শক্তিরা তাকে এক বিশাল অনুপ্রেরণা পাঠিয়েছিল, যা এম্পেদোক্লিসের (জীবনানন্দের ‘নবপ্রস্থানে’ এম্পিডেক্লেস) অনুপ্রেরণা লাভের কথা মনে করিয়ে দেয়। পরমাণুদের সর্বব্যাপী প্রবাহে একজন নীতিবাদী দুইটি মেরু দেখতে পান: এক দিকে তাদের সৃজনশীল গতি, যা থেকে নীতিবাদীর কাছে মূল্যবান সবকিছু তৈরি হয়, আর আরেক দিকে তাদের ধ্বংসাত্মক গতি, যা মূল্যবান সবকিছু বিনাশ করে। লুক্রেতিউস খুব ভালো করেই জানেন, এই মেরুকরণ কেবলই নৈতিক, বা যাকে আজকের ভাষায় বলা হয় ব্যক্তিক, আত্মকেন্দ্রিক, বা বিষয়ীকেন্দ্রিক। তার মতো এত বেশি স্পষ্ট করে আর কেউ বলেনি,

“প্রকৃতি এক থেকে আরেককে নির্মাণ করে, এক বস্তুর
মৃত্যু দিয়ে আরেক বস্তুকে জন্মের উপহার দান করে।” [১. ২৬৪–৫]

সুতরাং ধ্বংসাত্মক গতিও সৃষ্টি করে, সৃজনশীল গতিও ধ্বংস করে। অথচ, যেকোনো একজন ব্যক্তি বা একটি স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সৃজনশীল আর ধ্বংসাত্মক শক্তির পার্থক্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। এই পার্থক্য করা মানেই প্রকৃতির যান্ত্রিক (মেকানিকেল) কাঠামা অস্বীকার করা নয়, বরং শুধু দেখানো, কীভাবে এই যান্ত্রিক কাঠামোটা নৈতিক-ব্যক্তিক দিক থেকে ফলপ্রসূ হতে পারে, কীভাবে তার প্রান্তিক অংশগুলো আমাদের প্রতি, অর্থাৎ তার সীমাবদ্ধ জৈব সৃষ্টিদের প্রতি, অনুকূল বা প্রতিকূল হতে পারে।

বাস্তবতাকে দুই রঙে রাঙানো দার্শনিকের জন্য খুব আকর্ষণীয়; এতই আকর্ষণীয় যে, তার ভৌত বিজ্ঞান যান্ত্রিক স্তরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত, তিনি বস্তুর দ্বৈত চরিত্রকে বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত একটি দ্বৈতনীতি হিসেবে দেখতে বাধ্য হন। এম্পেদোক্লিসের কাছে এই নীতি দুটিই ছিল প্রেম আর দ্বন্দ্ব, যারা ধারাবাহিকভাবে সবকিছু জড়ো করে, আবার ছিন্নভিন্ন করে; দু-জনে মিলে পেনেলোপি’র শ্রমকে বৈশ্বিক স্তরে উন্নীত করে: এক জন চিরকাল বুনতে থাকে জীবনের কাঁথা, আরেক জন চিরকাল খুলতে থাকে সে-কাঁথার সুতা।

গতানুগতিক রেটরিকে একটু পরিবর্তন আনলেই এম্পেদোক্লিসের দৈবী জুটি, অর্থাৎ প্রেম আর দ্বন্দ্বকে, ভেনাস আর মার্সের সাথে মেলানো যায়, যাদেরকে রোমান পুরাণে যথাক্রমে প্রেম আর দ্বন্দ্বের দৈবীরূপ হিসেবেই দেখা হতো। লুক্রেতিউসের ভেনাস-মার্স পরমাণুর কর্মপদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো সচেতন নৈতিক শক্তি না, বরং স্বয়ং সেই কর্মপদ্ধতিরই উপমান, যদি ভেনাস-মার্সকে শুধুমাত্র জীবনের বা যেকোনো মূল্যবান জিনিসের স্রষ্টা ও হন্তা রূপে দেখা হয়; লুক্রেতিউসের বিশ্বোদ্ধার-কাব্যের জন্যও তাই তাদেরই সাহায্য প্রয়োজন। সংগমরত ভেনাস-মার্স একসাথে পুরো মহাবিশ্ব শাসন করে; এটা আসলে জন্মের সাথে মৃত্যুর সংগম; একজনে সংগম হয় না; একের মৃত্যু ছাড়া আরেকের জন্ম হয় না। কিন্তু কবির মতে, যখন জীবন্ত কোনো জিনিস নিজগুণে মৃতের তুলনায় বেশি সুখী হয়, বা আমাদের রুচিসম্মত হয়, তখন ভেনাসের জয় হয়; এমন সময় ভেনাস প্রণয়বন্দী মার্সকে অলাভজনক উন্মত্ততা সাময়িকভাবে ছাড়াতে সমর্থ হয়। তখন পৃথিবীতে নামে বসন্ত; ঝড় পালায়, মাঠে ফুলের মেলা বসে, সূর্যালোকে আকাশ ভাসে, এবং সব প্রাণীর হৃদয়ে ভেনাসের দোলা লাগে। ক্ষেতে শস্য ফলে, জাহাজ নির্বিঘ্নে সমুদ্রে পাল তোলে। ‘বিশ্বপ্রকৃতি’ শুরুই হয়েছে এভাবে:

“আইনেয়াসের মাতা, দেবদেবী আর মানুষের পরমানন্দ,
বিপুলা ভেনাস, তুমি ভাসমান তারাপটে শান্তিতে শুয়ে,
প্রাণ সঞ্চার করো তরী-ভরা সমুদ্রে, সুফল ভূমিতলে;
তোমারই অনুগ্রহে সব প্রজাতির জীব আবির্ভূত হয়,
অন্ধ ভূমিগর্ভ থেকে জেগে সূর্যকিরণে আপ্লুত হয়;
তুমি আসলেই, দেবী, স্বর্গের বায়ুদল মেঘদল পালায়,
বিচিত্রিতা পৃথিবী সুরভি ফুলের রাঙা পসরা সাজায়,
ঊর্মিল সমুদ্র দিগন্ত-বিস্তৃত হাসিতে ভুবন ভরে,
শান্ত আকাশ হুট করে দীপ্ত কিরণে ঝলমলিয়ে উঠে।
যেই দিন বসন্ত তার মনোহর রূপ প্রকাশিত করে,
আর দখিনা বাতাস, মুক্তির আনন্দে, সৃষ্টির সুখে,
ধেয়ে আসে, সেই দিন গগনবিহারী পাখি, প্রথমে, বাসন্তী,
তোমার অভিষেকের গান গায়, বুঁদ হয়ে তোমারই মায়ায়।” [১. ১–১৩]

তবে জীবনদায়িনী ভেনাসের সবচেয়ে বড়ো উপহার স্বয়ং রোমান জনগোষ্ঠী। প্রকৃতির গঠনমূলক শক্তি সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশিত হয়েছে এই গোষ্ঠীর প্রাণশক্তির মধ্য দিয়ে, বিশ্বজয় আর আত্তীকরণের ক্ষমতার মধ্য দিয়ে, যে-জয়যাত্রা তাদেরকে দিন দিন তুলনামূলক সভ্য ও শান্ত করেছে। লোকগাথায় ভেনাসকে করা হয়েছে আইনেয়াসের মাতা, আর আইনেয়াসকে রোমান জাতির জনক। লুক্রেতিউস এই সুভগ কাকতালের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন, উপকথার ভেনাসের সাথে সম্পর্কিত করেছেন আসল ভেনাসকে, যিনি প্রকৃতির সুপ্রসন্ন শক্তি, আর রোম যে-শক্তির এক বিরাট বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কবি যদি তার কাজে সফল হতে চান, তবে তাকে সেই একই সুপ্রসন্ন শক্তির উপর নির্ভর করতে হবে, যাতে তিনি মানুষকে প্ররোচিত করার ভাষা খুঁজে পান। ভেনাসকে তার শিল্প ও দর্শনের পৃষ্ঠপোষক হতে হবে। তাঁকেই মেম্মিউসকে যুদ্ধ আর অসার উচ্চাভিলাস থেকে বিরত রাখতে হবে, যাতে মেম্মিউস কবিতাটা পড়তে পারে, আর রাজনৈতিক ডামাডোল সাময়িকভাবে দূর করতে হবে, যাতে লুক্রেতিউস তার গুরু এপিকুরোসের অনুশাসনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে, এবং তার সমগ্র হৃদয় ঢেলে দিতে পারে একটি মহামহিম বন্ধুত্বের উদ্দেশে, যে-বন্ধুত্বের মধুর আশাই তাকে রাজি করিয়েছে নক্ষত্রের রাতের সবগুলো ঘড়ির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে, প্রত্যেকটা অদৃশ্য পরমাণুর গতিপথ অনুসরণ করতে, এবং খোদ দেবালয়ে পাড়ি জমাতে:

“সেহেতু এ-কাব্যের সাথী হিসেবে কামনা করি তোমাকেই, . . .
হে অমৃতভাষিণী, আমার বাণীতে ঢালো চিরজীবী সুধা:
সেই সাথে দূর করো যুদ্ধের হিংস্রতা, দুর্গতিনাশিনী
জলে, স্থলে, সবখানে, ঘুমপাড়ানির মিষ্টি গান শুনিয়ে। . . .
কারণ দেশে এমন অরাজকতা চলতে থাকলে আমি
পারব না শান্তিতে পদচারণ করতে, আর এ-মহান
মেম্মিউস পারবে না দেশসেবা ভুলে সে পদধ্বনি শুন‌তে। . . .
কিন্তু তোমার গুণ, বন্ধুত্বের আশা আর আনন্দ,
আমার মনকে রাজি করিয়েছে এই ঘানি টানতে, আর
নিস্তরঙ্গ এই রাতগুলো নির্ঘুম নিবেশে কাটাতে;
আমি খুঁজে চলেছি সঠিক শব্দ আর সরল ছন্দ,
যা-দিয়ে তোমার মনে জ্বালব সমুজ্জ্বল প্রদীপের শিখা,
যে-দীপে তুমি দেখবে বস্তুর সাত্ত্বিক গুপ্ত রূপ।” [১. ২৪, ২৮–৩০, ৪১–৪৩, ১৪০–৪৫]

জীবনের জন্য দরকারি সবকিছুকে ভেনাসের সাথে সম্পর্কিত করাটা যান্ত্রিক বিশ্বদর্শনের জন্য সহায়ক তো হতোই না বরং ক্ষতিকর হতে পারত, যদি না এই অনুকূল শক্তির বিপরীতে আরেকটি প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক শক্তি কল্পনা করা হতো; যদি না জন্মচঞ্চল ভেনাসীয় শক্তিকে ভারসম করা হতো একই পরিমাণ সর্বজনীন একটি মৃত্যুপাগল শক্তি দিয়ে।

কবিতার উপক্রমণিকায় রণদেব মার্স (ভারতীয় পুরাণের মঙ্গলের সাথে মিল আছে) একটু সময়ের জন্য রতিদেবী ভেনাসের প্রেমে পরাভূত হয়েছিল, কিন্তু বাকি কবিতা জুড়ে মার্সেরই জয়জয়কার। প্রত্যেক রূপান্তরের দুটি দিক থাকে—সৃষ্টি করতে গিয়ে এক জিনিস আরেক জিনিসকে ধ্বংস করে। এবং এই রূপান্তর যেহেতু অবিরাম অন্তহীন, একমাত্র শূন্যস্থান, পরমাণু আর তাদের গতি ছাড়া আর কিছুই যেহেতু চিরস্থায়ী নয়, সেহেতু যে-কোনো নির্দিষ্ট জিনিসের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে মৃত্যুর দিকে—একমাত্র মৃত্যুই বিজয়ী। ভেনাস আর মার্স নাম দুটি যেহেতু শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেহেতু একটু পরই কবি শব্দ দুটো পুরোপুরি ভুলে যান, এবং যে-প্রক্রিয়ার উপমান হিসেবে তাদেরকে ব্যবহার করেছিলেন স্বয়ং সেই প্রক্রিয়াই নগ্নভাবে তুলে ধরতে শুরু করেন। কিন্তু লুক্রেতিউস যদি কবিতাটা মরার আগে শেষ করে যেতে পারতেন, এবং শেষটাকে শুরুর সাথে সুরবন্ধনে বেঁধে যদি একটি একক মহাবিশ্বচক্র তৈরি করতে চাইতেন, তাহলে সম্ভবত কবিতাটির শেষে শুরুর মতোই একটি পৌরাণিক অনুচ্ছেদ জুড়ে দিতেন; এবং আমরা দেখতাম শেষে মার্স বিলাসতন্দ্রা থেকে জেগে আবার তার অমরত্ব প্রতিষ্ঠা করছে, রতিপ্রাসাদ থেকে অগ্নিধ্বজা হাতে সবেগে বেরিয়ে মহাবিশ্ব জুড়ে ধ্বংস ছড়াচ্ছে, যতক্ষণ না সবকিছু পুড়ে ছাই হয়, নেমে আসে ধূসর গোধূলি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সবকিছু ধ্বংস করতে পারবে না, কারণ রতিদেবী নিজে তার অবহেলিত পঞ্চচূড়া নিয়েও থেকে যাবেন বরাবরের মতো বিশালা, বিপুলা, ঐশী, কমনীয়, রমণীয়, পূজনীয়। গণহত্যা-গণধর্ষণ-বিশ্বযুদ্ধের মদে উন্মত্ত আর ক্লান্ত হয়ে রণদেব আবার স্বজ্ঞার কাছে হার মেনে ঢলে পড়বে কামদেবীর বক্ষপর্বতে; এবং পুরাতন বিশ্বের শতচ্ছিন্ন পরমাণু থেকে ফিনিক্সের মতো জেগে উঠবে আরেকটি বিশ্ব, আরেকটি উর্বর ঊষা।

এই অন্তহীন পরাবর্ত বাস্তবতার সুঁইকে ভারসাম্যে রাখে; এবং আমি মনে করি, নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে, এই জন্ম-মৃত্যু-চক্র, একটিমাত্র বিশ্বের অনন্তকাল টিকে থাকার তুলনায়, কোনোভাবেই বেশি দুঃখের নয়। তাছাড়া প্রকৃতি আমাদেরকে যতটা দিয়েছে তার চেয়ে বেশি কেড়ে নিতে পারে না, এবং তাকে শুধুমাত্র বা প্রধানত ধ্বংসাত্মক ভাবাটা—ইদানিং কালের অনেক ফ্যাশন-সচেতন নৈরাশ্যবাদী যে-রকম ভাবেন—অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। প্রকৃতি সৃষ্টির জন্য ধ্বংস করে, ধ্বংসের জন্য সৃষ্টি করে, নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিসের অস্তিত্ব বা স্থায়িত্ব নিয়ে এক বিন্দু মাথা ঘামায় না, বরং তার মাথা ব্যথা সবকিছুর অধঃস্থিত গতি নিয়ে, সবকিছুর আড়ালে থাকা চিরন্তন সারবস্তুর নিরন্তর প্রবাহ নিয়ে। কিন্তু জীবন বিমূর্ত রূপের সাথে সম্পর্কিত, মূর্ত পদার্থের সাথে নয়; বা লুক্রেতিউসের ভাষায় বলতে গেলে, জীবন একটা ‘দৈবঘটনা’ (‘eventum’), পদার্থের একটা রূপভেদ মাত্র, যার কাজ পদার্থের ভারসাম্য বিধান; পাশার ঘুঁটিবাক্স ভালোমতো ঝাঁকিয়ে চাল দেয়ার পর হঠাৎ ছক্কা উঠে আসাটা যেমন ‘দৈবঘটনা’। কিন্তু ছক্কা হাঁকানো যেমন পাশা খেলার সবচেয়ে ভালো দান বা শীর্ষচূড়া, তেমনি হঠাৎ জীবন তৈরি হয়ে যাওয়াটা পরমাণুদের নৃত্যনাট্যের সবচেয়ে ভালো অর্জন বা শীর্ষচূড়া; এবং শুধুমাত্র এই দৈবঘটনার দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা সমগ্র বিশ্বপ্রক্রিয়াকে দেখতে পারি, বিচার করতে পারি; অন্য কোনো দৃষ্টিকোণ অসম্ভব। দার্শনিক তরঙ্গের চূড়ায় থাকেন, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে তিনি হলেন উদ্বেল ফেনা; কিন্তু দার্শনিকের জন্মের জন্য যেমন ঘূর্ণিতরঙ্গটিকে আগে জন্ম নিতে হয়েছে, অতটা উপরে উঠতে হয়েছে, তেমনি জন্মের পর দার্শনিকের দেখার জন্য বাকি থাকে কেবল তরঙ্গটির পতন। বাস্তুজগতের সবকিছুর অবিরাম অবক্ষয়ই তার একমাত্র ভবিষ্যৎ; তার গোটা দর্শনকেই তাই হতে হবে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী, ঘূর্ণিঢেউ ভাঙার আগাম সতর্কসংকেত। পরজীবন, অর্থাৎ পরমাণুদের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি নতুন বাস্তবতা তিনি কল্পনা করতে পারেন না; জীবন বলতে তিনি যা বোঝেন, যা-কিছু সামনে দেখেন, যা-কিছু সবার সাথে ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকেন, তার সবই ক্ষীয়মান, প্রায় অতিক্রান্ত, অতিবাহিত।

এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন বলেই লুক্রেতিউসের উপর ভর করেছিল এক প্রগাঢ় বিষণ্ণতা। বসন্ত, প্রেম, কাম, উচ্চাভিলাস, বিকাশোন্মুখ সংস্কৃতি, বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়ের যত বলিষ্ঠ ও স্পন্দমান বর্ণনাই দিন না কেন, শেষ পর্যন্ত এই সবকিছু ম্লান হয়ে যায়, যখন তার মুখে শুনি মৃত্যুর আগমনি যাত্রার কথা—ইচ্ছাশক্তির অবসাদ, আনন্দের নিস্পৃহতা, সমাজের দুর্নীতি অবক্ষয় বিখণ্ডায়ন, মাটির তৃষ্ণা অনুর্বরতা, বুনো পশুদের বিলুপ্তি বা পোষ-মানানো, দারিদ্র্য, প্লেগ, মহামারী, আর দুর্ভিক্ষের কথা; এবং ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রে, সামান্য একটি মুহূর্তে তার আত্মার সব পরমাণুর শেষবারের মতো দেহ থেকে বেরিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে, সর্বজনীন কলঙ্কের ভাগীদার হয়ে যাওয়ার কথা। সারবস্তুর জগতে শূন্য থেকে কিচ্ছু আসে না, শূন্যে কিচ্ছু ফিরে যায় না; কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য বাহ্যবস্তুর জগতে সবকিছুই শূন্য থেকে আসে, সবকিছুই শূন্যে ফিরে যায়—প্রেম ভালোবাসা অভিজ্ঞতা সবকিছু। শূন্যস্থান আর পরমাণুর উপর সময় কোনো ছাপ ফেলতে পারে না, কারণ সময় নিজেও শূন্যের মধ্যে পরমাণুর অস্থির চলাচল থেকে তৈরি একটি ‘দৈবঘটনা’; কিন্তু ব্যক্তি, জাতি, আর বিশ্বের জগতে সময় সবার উপর সার্বভৌম:

“তাই মৃত্যু তখনই ধেয়ে আসে, যখন কণার স্রোতে
বস্তুর ত্বক তনু হতে থাকে, যখন সে কোনো বহিঃশক্তির
মুহুর্মুহু আঘাতে পরাজিত হয়ে লুপ্তির ভাগ মেনে নেয়; . . .
একইভাবে মহাবিশ্বের দুর্গপ্রাচীর ঝোড়ো বর্শার কোপে
শতচ্ছিন্ন হয়ে ধূলিসাৎ ধ্বংসস্তুপের ভাগ মেনে নেবে। . . .
আর বৃদ্ধ কৃষক মাথা নেড়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, আক্ষেপ কোরে,
প্রায়শই বলে, তার হাতের কঠিন শ্রম পণ্ড হলো আবার,
এবং অতীতের দিকে ঈর্ষাকাতর আঁখি তুলে স্বগতোক্তি
করে, বাপদাদার আমলে এই জমিতে কত ভালো শস্য ফলত।
এ-তাপের প্রতিধ্বনি শুনি শীর্ণ আঙুরক্ষেতের চাষীর মুখে,
যে যুগের প্রবণতা ঘৃণা করে, সমকাল যার গালির লক্ষ—
রাগে গরগর করতে করতে বলে, সত্য আর ত্রেতা যুগের
ধর্মানুরাগী পূর্বসূরিরা কী স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতেন,
এর চেয়ে আরো ছোটো জমি চষে শান্তিতে সংসার চালাতেন;
এরা কেউ বুঝল না, সবকিছু ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়ে যেতে থাকে,
কালরেখা দংশনে ধীরে ধীরে পড়তে থাকে মৃত্যুকুয়া ধরে।” [২. ১১৩৯–৪১, ১১৪৮–৪৯, ১১৬৪–৭৪]

আত্মা আর অমরত্ব নিয়ে কথা বলার সময় লুক্রেতিউস অদক্ষ মনোবিজ্ঞানী, স্বেচ্ছাচারী নীতিবাদী। তিনি আত্মাকে মরণশীল প্রমাণ করতে চান পরকালের শাস্তির ভয় থেকে মুক্তির জন্য, মনকে ইহকালের শান্ত, কুসুম-গরম সুখ উপভোগের উপযোগী করে তোলার জন্য। এতে নিশ্চয়ই কিছু লাভ আছে, বিশেষ করে যেহেতু পরকালীন শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষের অযৌক্তিক কাজকে বৈধতা দেয়া হয়, গরীবদেরকে ভাগ্য উন্নয়নে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু অন্যদিকে, অমরত্ব আমাদের সামনে শুধু নরকের সম্ভাবনাই উন্মোচন করে ধরে নিলে অমরত্বের প্রতি অবিচার করা হয়; এবং ধর্মীয় উপকথা মৃত্যুর পর যেসব শাস্তির কথা বলে সেগুলো যে বহুলাংশে পাপকর্মের ফলে জীবিত অবস্থায়ই আত্মার অবক্ষয়ের উপমা সেটা একেবারেই লক্ষ না করলে ধর্মের প্রতিও অবিচার করা হয়; কারণ ধর্ম একদিকে যেমন অযৌক্তিক আচরণের ইন্ধন যোগায়, আরেক দিকে তেমনি এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাও মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের সামগ্রিক চিত্রটা চোখের সামনে তুলে ধরা হলে, জীবনকে জাহান্নামের তুলনায় কোনো অংশে কম নিপীড়ক বা অবরোধক মনে হতো না।

অমরত্বের বিরুদ্ধে এই তর্কযুদ্ধের মধ্যে আরেকটা জিনিস আছে যা একটি ক্ষয়িষ্ণু যুগের পরিচয়বাহী হিসেবে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হলেও আসলে একপাক্ষিক এবং শেষ পর্যন্ত আদর্শ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। সেটা হচ্ছে জীবনের ভয়। এপিকুরোস বিশুদ্ধ ও কোমলপ্রাণ নীতিবাদী হলেও, শেষ পর্যন্ত দুর্বলচিত্ত। দুঃখ পাওয়া, দুঃখ দেয়া, এবং ঝুঁকি নেয়ার প্রতি তার এতই ভয় ছিল যে তিনি জীবনকে একটা সংক্ষিপ্ত মামুলি ঘটনা হিসেবে দেখেছেন, যাতে বড়ো কোনো পরিবর্তন আনা যায় না, বড়ো কিছু অর্জন করা যায় না। সুতরাং তিনি বলতেন, পরমাণুদের বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে সম্ভাব্য সব জীব ইতিমধ্যে তৈরি করে গেছে, কারণ পরমাণুরা সংখ্যায় অসীম হলেও প্রকারের দিক দিয়ে সসীম, তারা শুধু নির্দিষ্ট কয়েক ধরনেরই হতে পারে। তাই সম্ভাব্য জীব বা সত্তার সংখ্যা সসীম, এবং তাদের বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার অল্প সময়ের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়; বর্তমান বিশ্বের জন্ম বেশিদিন আগে হয়নি, যদিও সে ইতিমধ্যেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যেকোনো স্থানের বা যেকোনো সময়ের অন্য যেকোনো বিশ্ব আমাদের এই বিশ্ব থেকে খুব বেশি আলাদা হতে পারে না। সব সূর্য গড়পরতায় একই রকম, এবং তাদের তলে নতুন বেশি কিছু নেই। সুতরাং বিশ্বকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই; কারণ তা আমাদের চিরচেনা, একান্ত আপন—আমাদের আরামদায়ক ঘর, ছোট্ট বাগান, ছয় ফুটের সামান্য আশ্রয়। বেশি কিছু হারানোর নেই, বেশি কিছু পাওয়ার নেই, ভয়ের কিচ্ছু নেই; তারপরও মানুষ এত রাগারাগি চেঁচামেচি করে কারণ তারা বদ্ধ উন্মাদ। এপিকুরোস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি উন্মাদনায় গা ভাসাবেন না, যুক্তি-সচেতন হবেন, নৈতিক দিক দিয়ে আরামদায়ক, অসীম একঘেয়েমির এই ছোট্ট বিশ্বে সামান্য এক নশ্বরের জন্য যে-ধরনের আবেগ-অনুভূতি মানানসই শুধু তাই চর্চা করবেন। এডওয়ার্ড ফিট্‌সজেরাল্ডের ওমর খৈয়ম-অনুপ্রাণিত সেই সুপরিচিত লাইনগুলো এই অনুভূতিটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে:

“গাছের ছায়াতলে একটি কবিতার বই,
এক কুজা ওয়াইন, এক ফালি রুটি—আর তুই
আমার পাশে শুয়ে গাইছিস অরণ্যের গান—
হে অরণ্য, তুমি ছাড়া আর স্বর্গ কই?”

কিন্তু এই সূর্যকরোজ্জ্বল প্রমোদ বিহারে যদি অগণ্য সম্ভাবনার ছায়া এসে পড়ে? মৃত্যুর পর যদি আমরা সত্যিই এমন এক রাজ্যে জাগরিত হই যেখানে পরমাণুর দর্শন আগাগোড়া অকেজো? মনে রাখতে হবে, পরমাণুবাদের পক্ষে বিজ্ঞান যত যুক্তিই দিক না কেন, কিছু দিয়েই এর সম্ভাবনা পুরো নাকচ করা যাবে না। মহাবিশ্ব সম্পর্কে এপিকুরোস যা-কিছু শিখিয়েছেন সব হয়ত এই জগতে একদম সঠিক; কিন্তু আগামী কাল যদি একটি নতুন মহাবিশ্ব এসে এর জায়গা দখল করে? এই অনুমান নিঃসন্দেহে ভিত্তিহীন, এবং কোনো কর্মমুখর মানুষ কখনোই এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হবে না; কিন্তু হৃদয় যখন শূন্য হয়ে যায় তখন এইসব শীর্ণ স্বপ্ন দিয়েই নিজেকে ভরাট করে। এপিকুরোস প্রাজ্ঞ ঋষির যে-কুসুম-কোমল আনন্দের কথা বলেছেন, তা শেষ পর্যন্ত অতিপ্রাকৃতবাদের ইন্ধন যোগায়। তা একটি বড়ো শূন্যতা রেখা যায়, যা পূর্ণ করার জন্য অচিরেই ধেয়ে আসে অতিপ্রাকৃতবাদ—যা দেখব দান্তের মাঝে—; আর এসে প্রাণের স্পন্দনে নতুন আশা-মায়া-ভ্রমের দোল দেয়, বা আর কিছু না পারলেও অন্তত আতঙ্ক, গোঁড়ামি, উন্মাদনা আর অন্ধত্ব বিস্তার করে, যা নাই-মামার চেয়ে অন্তত খারাপ না। এ-ধরনের প্রবণতা যেহেতু ইতিমধ্যেই প্লেটোর পুরাণ আর মতবাদে প্রচ্ছন্ন ছিল, সেহেতু এপিকুরোস মৃত্যু-পরবর্তী অস্তিত্বের চিন্তা পুরোপুরি দূর করা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। আত্মার বস্তুগত কাঠামো এবং দেহের উপর তার পরম নির্ভরতা নিয়ে সব যুক্তি তিনি এই উদ্দেশ্যেই খাড়া করেছেন।

আত্মাকে বস্তুঘটিত, ভৌত বা জড় বলাটা আধুনিক কানে বেশ অদ্ভুত, বা এমনকি বর্বর ঠেকে। আমরা দেকার্তের উত্তরসূরি, যিনি ইতিমধ্যে বলে দিয়ে গেছেন, আত্মার ধাত বা এসেন্স হচ্ছে চেতনা; আর চেতনার বস্তুত্ব নিয়ে কথা বলা সাদার কালোত্ব নিয়ে কথা বলার মতো। কিন্তু প্রাচীন বিশ্বে আত্মার অর্থ বেশ আলাদা ছিল। তাদের কাছে আত্মার মূলধাত সচেতন হওয়া না, বরং দেহের গাঠনিক কাঠামো পরিচালনা করা, দেহকে গরম করা, চালানো, পথ দেখানো। এই অর্থে চিন্তা করলে আত্মাকে ভৌত বলাটা স্ববিরোধী তো নয়ই, এমনকি স্বতঃসত্যও হতে পারে। কারণ বস্তুর আগে থেকেই বিরাজমান কোনো চেতনা কীভাবে ভৌত দেহকে নিয়ন্ত্রণ করবে, চালাবে, গরম করবে, পথ দেখাবে? সেরকম আত্মা-চিত্ত-চেতনা যদি থেকেও থাকে, তবে তাকে আর যাই হোক মানুষিক আত্মা বলা চলে না, বরং হয়ত দৈবী বলা উচিত। সুতরাং লুক্রেতিউস যে-আত্মা নিয়ে কথা বলছেন তাকে চেতনার সাথে মিলালে হবে না, বরং দেখতে হবে চেতনার ‘ভিত্তি’ হিসেবে, দেহে জীবনের ‘কারণ’ হিসেবে। এই আত্মা, তার মতে, ছোটো ছোটো উদ্বায়ী পরমাণু দিয়ে গঠিত—অনেকটা ইথারের মতো—যারা সব জীবন্ত বীজের মধ্যে বাস করে, জন্মের সময় প্রশ্বাসের মতো প্রবেশ করে, মৃত্যুর সময় নিশ্বাসের মতো বেরিয়ে যায়।

এই তত্ত্ব যদি সত্যিও হয়, বা মেনেও নেয়া হয়, তারপরও এটা দিয়ে লুক্রেতিউসের আসল বক্তব্যটা প্রমাণ করা যায় না—বলা যায় না যে, পরজীবন অসম্ভব। আত্মার পরমাণু (আত্মাণু) অবিনশ্বর, অন্য সব পরমাণুর মতোই; এবং অল্প কয়েক ধরনের পরমাণুর সাথে, বা শুধু এক ধরনের পরমাণুর সাথে (যেমনটা পরে লাইবনিৎস ভেবেছিলেন) যদি এক পর্যায়ে চেতনা যুক্ত হয়, তাহলে পরমাণুগুলো দেহ থেকে বেরিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও, চেতনা টিকে থাকতে পারে। উল্টো এভাবে টিকে থাকাই হয়ত চেতনার জন্য বেশি রোমাঞ্চকর, অনেকটা যেমন মৌমাছির কাছে মধুকোষের চেয়ে আকাশ আর বাগান বেশি আকর্ষণীয় লাগতে পারে। লুক্রেতিউস আত্মার বিভাজ্যতা, দেহ-নির্ভরতা, আর দেহ বিনা তার বিপন্নতা নিয়ে যত কথা বলেছেন, সেগুলো আসলে তার মূল মাথাব্যথাটা দূর করতে পারে না—পরজীবনের অলক্ষুণে সম্ভাবনাকে নাকচ করতে পারে না।

মৃত্যুতে আমরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাই, এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি শুধু স্থূল অভিজ্ঞতা আর সবকিছুর অন্তর্নিহিত সম্ভাব্যতা ব্যবহার করেছেন: যার পরিবর্তন ঘটে তা অবিনশ্বর হতে পারে না; যার শুরু আছে তার শেষও আছে; মানসিক বিকাশ, স্বাস্থ্য, বিচারবুদ্ধির সুস্থতা সার্বিকভাবে সব সময়ই দেহের দশার উপর নির্ভর করে (যদিও দেখানো যায় না যে, আত্মাণুর উপর নির্ভর করে); আমাদের আবেগ একটি ইহজাগতিক ভৌত অস্তিত্বের জন্যই বিশেষভাবে মানানসই; সম্পূর্ণ আলাদা কোনো মুখোশে বা পরিবেশে আমরা আর আমরাই থাকব না; কোনো অতীত জন্মের কথা আমাদের মনে নেই, আর তাই ভবিষ্যতেও যদি কিছু থাকে, তখন বর্তমান জীবন আমাদের মনে থাকবে না। এই চিন্তাগুলো অবশ্যই হৃদয়ে ছাপ ফেলার মতো, এবং লুক্রেতিউসের বর্ণনাও এখানে বরাবরের মতো প্রাণবন্ত, বিবস্ত্র বাস্তবতায় মাখা। এসব যুক্তি দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব না, কিন্তু দর্শন ও কবিতা হিসেবে এগুলো চমৎকার; এখানে অনেক অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে সমন্বিত করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে একটা বিশাল রায় দেয়া হয়েছে। শিল্পীর চোখ এখানে মডেলের দিকে, স্বরূপের দিকে; তিনি জীবনের উপর মৃত্যুর ছবি আঁকছেন।

এসব অনুধ্যান যদি পরজীবনের চিন্তা মন থেকে দূর করতেও পারে, তার পরও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভয় থেকে যেতে পারে; এবং হ্যামলেটের মতো আমরা যদি মৃত্যুর পর আর স্বপ্ন নেই বলে মৃত্যুভয় থেকে বের হতে পারি, তারপরও স্বজ্ঞাগতভাবে মৃত্যুর মুহূর্ত আমাদেরকে আতঙ্কিত করতে পারে, অনেকটা মরণফাঁদে আটক শুয়োরের মতো। এই স্বজ্ঞাভয়ের বিরুদ্ধে লুক্রেতিউসের অনেক সাহসী যুক্তি আছে। তিনি বলেন, গাধার মতো এমন একটা জিনিসকে কেন ভয় পাচ্ছ যা তোমাকে স্পর্শই করতে পারবে না? কারণ যখন বেঁচে আছ তখন মৃত্যু নেই, আর যখন মারা যাবে তখন এতই মৃত থাকবে যে, মরে যে গেছ সেটাও জানতে পারবে না, তা নিয়ে আক্ষেপ করা তো দূরের কথা। মৃত্যুর পর ঠিক তেমনই নির্বিঘ্ন থাকবে, যেমন ছিলে জন্মের আগে। না কি হিমগর্ভ কবরের শীতল শয্যা নিয়ে ভয় পাচ্ছ, বাচ্চা খোকার মতো? না কি ভাবছ পৃথিবীর ভর তোমাকে শ্বাসরুদ্ধ করবে? কিন্তু তুমি তো থাকবেই না; তোমার আত্মাণু—যারা নিজেরাও অচেতন—অনেক দূরের কোনো সূর্যরশ্মিতে চপল ছন্দে নেচে বেড়াবে, কোথাও আর তোমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না; তোমার অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। মৃত্যু সংজ্ঞা অনুসারেই অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে, মৃত্যু মানে অভিজ্ঞতাহীনতা। যদি এই জিনিসকে ভয় পাও, তাহলে শুধুই একটা শব্দকে ভয় পাচ্ছ।

এর জবাবে মেম্মিউস বা অন্য কোনো অবাধ্য পাঠক বলতে পারেন, তিনি আসলে অস্তিত্বহীনতা বা নিখিল-নাস্তি নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন না, বরং স্বয়ং মৃত্যুর প্রক্রিয়াটির শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। জন্ম যতটা উদ্ভট, মৃত্যু ততটা জঘন্য; এবং এই জগতে ঢুকতে বা তা থেকে বের হতে যদি কোনো দৈহিক কষ্ট নাও হতো, তার পরও আমরা দান্তের ফ্রাঞ্চেস্কা’র মতো বলতে পারতাম: “এর হাবভাবে আমার বুক কাঁপে।” লুক্রেতিউস কখনো বলার চেষ্টা করেননি, সবকিছু যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমনই; এবং আমাদের এই জগতে প্রবেশটা যদি কদর্য হয়, আর প্রস্থানটা যদি মর্মান্তিক হয়, সেই দোষ তার দর্শনের না। ‘মৃত্যুর ভয়’ যদি কেবলই ‘মরার ভয়’ হতো, তবে তা দমনের জন্য যুক্তির চেয়ে ওষুধই বেশি কাজে লাগত। ভালো ভাবে, কষ্ট ছাড়া, স্বেচ্ছায়, উপযুক্ত মৌসুমে ‘মরার শিল্প’ একদিন হয়ত মানুষের আয়ত্তে আসবে—এথেন্স ও তার আশপাশের আত্তিকি সমাধিফলকের শান্ত সৌম্য বিদায়-মুহূর্তের ছবিতে যেমন দেখা যায়—বিশেষ করে যদি আমরা আমাদের মৃত্যুর সময় নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারি, লুক্রেতিউস যা নিঃসন্দেহে চাইতেন।

কিন্তু আমার মতে, মৃত্যুর মূল কষ্টটা একেবারেই অন্য রকম। তা হলো জীবনের মায়া, জীবনের প্রেম। এপিকুরোস যে-আদিম মহাশক্তিটির বিরুদ্ধে লড়ছিলেন তার ভিত্তিমূলটাই ধরতে পারেননি, কারণ তিনি জীবন ভয় করতেন। যদি পারতেন, তবে তিনি সেই আদিশক্তির আরও মূলে আঘাত হানতেন, একটা সর্বগ্রাসী আন্দোলনের মাধ্যমে, বলা যায়, তাকে পিছন থেকে আক্রমণ করতেন। জীবনের মায়া যৌক্তিকও নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিতও নয়। বরং তা স্বতঃস্ফূর্ত, শুরু থেকেই মনের মধ্যে বিরাজমান; অনেকটা বিপুলা জননী ভেনাসের মতো, যিনি প্রাণী আর উদ্ভিদ দিয়ে পৃথিবীর ত্বক সাজান। এই মায়া প্রত্যেক প্রাণীকে বাধ্য করে খাবার আর যৌনসঙ্গী খুঁজতে, সন্তান রক্ষা করতে; দেহে কোনো জখমের সম্ভাবনা দেখলেই প্রাণ বাজি রেখে দৌড় লাগাতে, যেকোনো মূল্যে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে। এটাই আদিমতম তাড়না, যার মাধ্যমে ভালোকে আলাদা করা যায় খারাপ থেকে, আশাকে ভয় থেকে।

সুতরাং যে-মৃত্যুভয় জীবনের শক্তি ও আত্মরক্ষার প্রবণতারই আরেক নাম না তার বিরুদ্ধে যুক্তিযুদ্ধে নামা কেবলই পণ্ডশ্রম। যুক্তির জন্য প্রতিজ্ঞাবাক্য লাগে, আর এই ক্ষেত্রে যেসব প্রতিজ্ঞাবাক্য ব্যবহার করা হয় তারা জীবনপ্রেমেরই একটা রূপ প্রকাশ করে; যে-কারণে মৃত্যু একেবারেই অশুভ নয় এটা প্রমাণ করা সম্ভব না এবং মৃত্যুভয় পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়াও সম্ভব না। কারণ আমরা এই কথা ভেবে ভয় পাই না যে, মৃত্যুর প্রক্রিয়াটা যন্ত্রণাদায়ক, বা হয়ত মৃত্যুর পর অস্তিত্ব না থাকলেও আমরা অনস্তিত্বের কষ্ট অনুভব করতে পারি। এখানে আতঙ্কের উৎসটা হচ্ছে, জীবন সংরক্ষণের জন্য আমাদের বর্তমান ইচ্ছাশক্তির পরাজয়ের আশঙ্কা। এই ‘বর্তমান ইচ্ছাশক্তিকে’ যুক্তিঝাড়ু দিয়ে দূর করা সম্ভব না, শুধু হয়ত কিছুটা দুর্বল করা সম্ভব—এর অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ, আমাদের অভিজ্ঞতার আয়রনিক বিড়ম্বনা, বা তপস্বার মাধ্যমে। জীবনমায়া জীবনপ্রেম উপশমের আসল উপায় তাহলে তাপসিক সাধনা, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিড়ম্বনাগুলো ফুটিয়ে তোলা, এবং জীবন রক্ষণেচ্ছার স্ববিরোধগুলো ফাঁস করা; মৃত্যুভয় হচ্ছে জীবনপ্রেমের আগুনের ধোঁয়া, তাই যখনই জীবনপ্রেমাগ্নির নির্বাণ ঘটবে, তখনই মৃত্যুভয়ের ধোঁয়া মিলিয়ে যাবে।

এবং লুক্রেতিউসের কবিতার তৃতীয় খণ্ডে মৃত্যুভয়ের বিরুদ্ধে যা বলা হয়েছে তার ভিত্তি আসলে জীবন-উন্মাদনার চিত্র। তার দর্শন লোলুপতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রোমান্টিক প্রেম, এবং ধর্ম চর্চার অনুমতি দেয় না; জীবনের সব ব্যাকুলতাকে বেদনাময় ও শেষ পর্যন্ত অসম্মানজনক আখ্যা দেয়ার মাধ্যমে, তিনি জীবন পুরোপুরি কোরবানি করে দেয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সবকিছু ত্যাগ করতে পারলেই পরিত্রাণ মিলবে। এবং জিনিয়াসদের যেহেতু অন্তত কিছু না কিছু নিয়ে ব্যাকুলতা থাকতেই হয়, তাই লুক্রেতিউস তার সব ব্যাকুলতা তাক করেছিলেন এপিকুরোসের দিকে, যিনি মানুষের জন্য এই পরিত্রাণের গসপেল নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এ তো কেবল নাজাত-প্রক্রিয়ার সূচনা, এই প্রক্রিয়াকে যদি তার যৌক্তিক উপসংহারের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে এক পর্যায়ে স্বয়ং এপিকুরিয়ান জীবনকেও বিসর্জন দিতে হবে, এই জীবনে গ্রিক এবং প্রাকৃতিক যা-কিছু অবশিষ্ট ছিল তাও ঝেড়ে ফেলতে হবে, ত্যাগ করতে হবে বিজ্ঞান, বন্ধুত্ব, দেহের স্বাস্থ্যকর সব আনন্দ। এগুলো পরিত্যাগ করতে পারলে এপিকুরোসবাদ হয়ে যেতো পুরোপুরি তাপসিক, মৃত্যুবরণের তন্ত্র, মৃত্যুপথযাত্রার দর্শন। যারা সত্যিকার অর্থেই মৃত্যুর পিছে ধায়, তাদের জন্য মৃত্যু তো অশুভ নয়ই, বরং সর্বোচ্চ শুভ। সেক্ষেত্রে মৃত্যুভয়ের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি সাজানোরই দরকার পড়ে না, যেহেতু মৃত্যু কোনো ব্যাপারই না; কারণ কোনো ব্যাপার না হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক প্রাণশক্তিপূর্ণ প্রাণী যে-ভাবে মৃত্যুকে ভয় করে, সেই একই ভাবে একটি অবসন্ন ও মায়ামুক্ত চিত্ত কোনো ব্যাপার না বলেই মৃত্যুকে ভালোবাসবে।

এই প্রসঙ্গে আমার শুধু আর একটা কথা বলার বাকি। প্রাচীন (গ্রিক্রোমান) সংস্কৃতি ছিল খুবই অলঙ্কারপ্রধান, রেটরিকপ্রবণ (আমার মনে হয় না বাঙালি সংস্কৃতি এই দিক দিয়ে তার থেকে এক বিন্দুও আলাদা)। সেখানে এমন অনেক ধারণা ও মতবাদ ছিল যেগুলো শুনতে সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্যই লাগে, এবং গণভাষণের বিষয় হিসেবে উৎরেও যায়, কিন্তু এক মুহূর্ত থেমে একটু বিশ্লেষণ করলেই তাদের অমার্জনীয় মিথ্যা বেরিয়ে পড়ে। এরকম একটা ভুলবিশ্বাস বা হেত্বাভাসমূলক প্রবচন হচ্ছে, মানুষ যা দেখতে পায় না তার জন্য বাঁচতে পারে না। তর্কসভা মাতাতে আমরা বলতেই পারি, তোমার জন্মের আগে কী ঘটেছে বা মৃত্যুর পর কী ঘটবে তাতে তোমার কী আসে যায়? বক্তার থুতুমাখা মুখের জাদুতে শ্রোতারা হয়ত আসলেই গলে যায়, বা অন্তত মানুষের আপাত বোকামির কথা ভেবে জনরোলে একটা স্থূল হাসির ঢেউ উঠে। কিন্তু যারা এই কথা শুনে হাততালি দিচ্ছে তাদের প্রত্যেকে ঠিকই পূর্বসূরিদের নিয়ে গর্বিত, উত্তরসূরিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, এবং যার যার শেষ উইলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে ভাবিত। মৃত্যুর পর কী হবে তা নিয়ে কারও চিন্তার কমতি নেই; এই কারণে না যে, তারা স্বর্গ বা নরক থেকে তা দেখতে পাবে, বরং অতীত ও ভবিষ্যতের শুধু বিমূর্ত ভাবনাটাই তাদের বর্তমানকে সমৃদ্ধ করে বলে। লুক্রেতিউস নিজেই যখন প্রকৃতির প্রতি সমবেদনা বোধ করছেন, মানুষের আলোকপ্রাপ্তিকে আলিঙ্গণ করছেন, ইফিগেনিয়ার পুরাণমৃত্যুর জন্য অশ্রু ফেলছেন, তখন ঠিক দেখা-জিনিসের জন্য কাতর হচ্ছেন না, এমনকি আগে দেখা জিনিসের স্মৃতির জন্যও না, বরং তার আবেগ উত্তেজিত হচ্ছে অদেখা জিনিসে। তিনি নিজেকে ভুলে যান। সমগ্র মহাবিশ্ব তার সত্য গতিতে, সত্য অনুপাতে তার সামনে বিস্তৃত হয়; তিনি মানুষকে কুসংস্কারের দুঃস্বপ্ন আর আবেগের দুর্যোগ থেকে মুক্ত হিসেবে দেখেন। এই ভিশনই তার কৌতুহলের ইন্ধন, কল্পনার খড়ি, তার কবিতার ঐকান্তিকতার খোরাক।

সুতরাং লুক্রেতিউসকে অনুসরণ করলে বলতে হবে, আমাদের ব্যক্তিগত সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য মর্ত্যের একটি সংক্ষিপ্ত ও আংশিক ক্ষণের মধ্যে জড়ো করা মানেই আমাদের আগ্রহের সবকিছুকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করা নয়। বরং উল্টো, আমরা কুসংস্কার ও সস্তা আবেগ-আশাকে যত ঘৃণা করব, এবং আত্মভোলা কল্পনাকে যত প্রশ্রয় দিব, মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের উদ্বেগের আদিম প্রবৃত্তি ততই আরো বেশি শক্তিশালী হবে, আমরা মহাবিশ্বের অতীত, ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়ে ভাবব, আমাদের চিন্তাবৃত্ত ছাড়িয়ে যাবে পরিচিতের সীমানা। লুক্রেতিউস এবং অন্য সব দার্শনিক কবির মতো, আমরাও যদি সকল সময় আর সকল অস্তিত্বের মধ্যে নিজেদের ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে আপন ব্যক্তিসত্তা ভুলে যাব, এমনকি মনেপ্রাণে ভুলে যেতে চাইবও, যেমন চেয়েছিলেন লুক্রেতিউস; শর্ত থাকবে শুধু একটা, যাতে আমাদের পছন্দের জিনিসগুলো টিকে থাকে; আমার সন্তান নয়, আমার মহাবিশ্ব, আমার প্রকৃতি যাতে থাকে দুধে ভাতে। স্পিনোজা বলেছিলেন, যে সত্যিই ঈশ্বরকে ভালোবাসে সে কখনো চাইতে পারে না, ঈশ্বরও তাকে ভালোবাসুক (ঈশ্বর বলতে স্পিনোজা কী বুঝিয়েছিলেন তা না বুঝলে পাঠক এই কথার আসল অর্থ জীবনেও বুঝতে পারবেন না)। যে মহাবিশ্বের জীবন যাপন করে সে নিজের জীবন নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হতে পারে না। হাজার হোক, মহাবিশ্বের জীবন তো আমাদের জীবনেরই পটভূমি আর সম্প্রসারণ। যেসব পরমাণু এতদিন প্রাণ তৈরি করে এসেছে, তারা আজও একই রকম প্রাণ তৈরিতে সক্ষম; এবং পরবর্তীতে তারা যা তৈরি করবে সেগুলো নতুন হলেও, এবং তাদের জীবনের গতিপথ আমাদের থেকে আলাদা হলেও, লুক্রেতিউসের মতে তারা একেবারে ভিন্ন কোনো জাতের হবে না; এমনকি আমরা নিজেরা একে অপরের থেকে যতটা আলাদা, বা এক বয়সের আমি আরেক বয়সের আমি থেকে যতটা আলাদা, নতুন জীবগুলো আমাদের থেকে ততটা আলাদাও না হতে পারে।

সুতরাং লুক্রেতিউসের মতে, প্রকৃতির আত্মার মৌলিক উপাদানগুলো অমর, তাদের কাকতালীয় সাময়িক বিন্যাস থেকে যেসব ব্যক্তিমানুষ তৈরি হয়েছে তারা যতই মরণশীল হোক না কেন; সুতরাং মানুষ যদি জীবদ্দশায় তার সতীর্থ মানুষ নিয়ে, বা নিজের শৈশব ও বার্ধক্য নিয়ে চিন্তিত হতে পারে, তবে সেই একই কল্পনাসূত্র কাজে লাগিয়ে, তার জন্মের আগের বা মৃত্যুর পরের বিশ্ব নিয়েও চিন্তামগ্ন হতে পারে। এতে সে ব্যক্তিজীবনের সসীমতা ও অবিচারের কথা মাথায় রেখেও এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পাবে; স্বার্থপরতার ভ্রম দূর হবে; এবং সে নিজেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারবে: আমি কল্পনা করতে পারি, তাই বাস্তব কোনোকিছুই আমার পর নয় (মহাবিশ্বের প্রেমালিঙ্গণ আমাকে ঘিরে রাখবে অনাদি থেকে অনন্তে, ফ্রিদা কালো’র মতো আদরে)।

[চলবে]

This is a translation of Geroge Santayana’s ‘Three Philosophical Poets: Lucretius.’ The bracketed lines are mine.


মন্তব্য

কর্ণজয় এর ছবি

মুগ্ধ। বিষয় আর বিন্যাস- তাদের সঙ্গতটা খুবই সুন্দর, কিন্তু মুগ্ধতা ভাষার জন্য। ছবির মতো-

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ। যদিও আসল কাজটা সান্টায়ানাই করসেন। অনুবাদে আমি যতটা সম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করসি। সান্টায়ানা নিজেও কবি ছিলেন এবং প্লেটোর সংলাপ দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেও কয়েকটা দার্শনিক সংলাপ লিখসিলেন, যদিও মতাদর্শের দিক দিয়ে তিনি একদম প্লেটোনিক না; তিনি আগাগোড়া বস্তুবাদী, তবে সেরকম বস্তুবাদী যারা বস্তুর মধ্যেও অবস্তুর, প্রকৃতির মধ্যেও অতিপ্রাকৃতের জাদু খুঁজে পান। সান্টায়ানার এক ছাত্র ওয়ালেস স্টিভেন্স To an Old Philosopher in Rome কবিতাটা সান্টায়ানাকে উদ্দেশ্য করেই লিখসিলেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

এ পর্বটাও পড়লাম, ভালো লাগলো আগের পর্বটার মতই। অনুবাদ চলুক চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

এক লহমা এর ছবি

একদিনে পড়ে উঠতে পারিনি। তবে পড়তে ভাল লাগছে। চলুক।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।