খৈয়ামি রুবাই: ১. সুরার গ্রাস

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: বুধ, ১১/০৭/২০১৮ - ১২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্ধের হঠাৎ দেখার সাধ হলো—এক বাক্য ফার্সি না জেনেও অনুবাদ করতে বসে গেলাম খৈয়ামি রুবাই। ‘খৈয়ামের’ রুবাই না, ‘খৈয়ামি’ রুবাই। স্বামী গোবিন্দ তীর্থ ১০৬৯টি খৈয়ামি (বা ওমরীয়) রুবাই মূল ফার্সি থেকে প্রথমে মারাঠি (‘গুরু করুণামৃত’) এবং পরে ইংরেজিতে (‘দ্য নেক্টার অফ গ্রেইস’) অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে স্বয়ং ওমর খৈয়ামের লেখা রুবাই ৭২ টার বেশি হবে না। নজরুল ২০০র মতো রুবাই মূল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেছিলেন, এবং তার কাছে মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের তুলনায় তার নিজের কবিতা যত খারাপ, এই দুশ’র তুলনায় বাকি খৈয়ামি রুবাইগুলো তত খারাপ। খৈয়াম যে-ধরনের কবিতা লিখতেন সে-ধরনের অনেক রুবাইকেই পরবর্তী যুগের কবিরা খৈয়ামের নামে চালিয়েছেন, যা ইন্দো-ইরানি সংস্কৃতিতে খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, এতই স্বাভাবিক যে এ নিয়ে ত্যানা প্যাচানোর কোনো দরকার নাই। অধ্যাপক মেহদি আমিনরযভি মনে করেন, কোনটা খৈয়ামের লেখা আর কোনটা না সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের ভাবা উচিত কোন রুবাইগুলো খৈয়ামের দর্শনের সাথে খাপ খায় আর কোনগুলো খায় না। যেগুলো খৈয়ামের দার্শনিক অভিব্যক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তার সবগুলোকেই ইন্দো-ইরানি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা উচিত—এবং একসাথে ‘খৈয়ামি দর্শনধারার রুবাই’ বলা উচিত—ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে খারাপ হলেও নজরুলের কবিতাও বাঙালির অমূল্য সম্পদ। আমি আমিনরযভি’র ‘দ্য ওয়াইন অফ উইজডম’ পড়ে তার সাথে যোগাযোগ করেছি, এবং তার সহায়তায় গোবিন্দ তীর্থ অনূদিত ১০৬৯টি রুবাইয়ের মূল ফার্সি, কয়েকটি ইংরেজি অনুবাদ, এবং আমার বঙ্গানুবাদ একসাথে করে একটা গুগল স্প্রেডশিট বানাতে শুরু করেছি। মাত্র শুরু, যেতে হবে অনেক দূর। এখানে আহমদ সাইদি’র অনুবাদ করা ১৬৫টি রুবাইয়ের প্রথম ২৭ টার অনুবাদ দিলাম। এর সবগুলোই গোবিন্দ তীর্থের বইয়েও পাওয়া যায়, এবং মূল ফার্সি আর অনুবাদগুলো পাশাপাশি দেখতে চাইলে এই স্প্রেডশিটটা খুলতে পারেন

রুবাইগুলোর আসল নকল নিয়ে বেশি ভাবি না আমি, আমার কাছে সবগুলোই ‘ইন্দো-ইরানি’ সংস্কৃতির সম্পত্তি, ইন্দো-ইরানি মানুষ হিসেবে আমার নিজের সম্পত্তি। ‘প্রত্যায়িত কপি’ তো দূরের কথা, আমার কাছে মাঝে মাঝে বোত্তিচেল্লি’র ‘প্রিমাভেরা’র ফটোটাই আসল চিত্রকর্মের প্রতীক, বা এমনকি প্রতিস্থাপক হয়ে যায়। ল্যাপটপের ডেস্কটপ ব্যাকগ্রাউন্ডে বোত্তিচেল্লির ভেনাসকে দেখে অনেক সময় আসল ভেনাসের কথাই ভুলে যাই। এক জন বড়ো কবির ঋগ্বৈদিক বক্তব্য আমার মতো একজন সাধারণ অকবি যখন অথর্ব ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে চায়, তখন তার চেষ্টার সাথে ‘প্রিমাভেরার’ ফটো তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া একজন অতি সাধারণ ফটোগ্রাফারের তুলনা না করে পারি না। এবং মনে পড়ে যায় আব্বাস কিয়ারোস্তমি’র ‘সার্টিফাইড কপি’ (২০১০) সিনেমাটার কথা। সিনেমায় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, নকলের গুরুত্ব কি এত কম হওয়া উচিত? শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো শিল্পকর্মটাও কি প্রকৃতির একটা বাস্তব জিনিসের ‘কপি’ না? ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’র হাসিটা একজন রক্তমাংসের নারীর বাস্তব হাসির ‘কপি’ না? তাছাড়া আমরা সবাই কি আমাদের পূর্বপুরুষদের ডিএনএ-র কপি না? আমার কাছে এই সিনেমার মূল বক্তব্য শেষ পর্যন্ত এই রকম: পৃথিবীর কোনো এক কোণার কোনো এক সাধারণ মধ্যবিত্ত কেরানি অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ একটা টিলার আড়ালে সূর্য ডুবতে দেখে যখন দুলে ওঠে, বা ঘরে ফিরে তার স্বামী আর সন্তানকে দেখে যখন কেঁপে ওঠে তখনই ‘আসল’ শিল্পের জন্ম হয়, বাকি সবকিছু ‘নকল’, এমনকি এই সাধারণ মধ্যবিত্ত নারীকে নিয়ে পাবলো পিকাসোর আঁকা ছবি আর জীবনানন্দের লেখা কবিতাও নকল, একমাত্র সেই নারীর ক্ষণিকের অনুভূতিটাই আসল; কিন্তু নকল বলেই পিকাসোর ছবি আর জীবনানন্দের কবিতার গুরুত্ব কম না—এদের গুরুত্ব মানুষের বাস্তব ‘আসল’ জীবনের চেয়ে বেশি না হলেও, অন্তত সমান। ওমর খৈয়াম আর ফরোগ ফরোখযাদ-দের উত্তরসূরি হিসেবে, কিয়ারোস্তমি যেমন সিনেমার শিল্পাশিল্প নিয়ে বেশি চিন্তা না করে তার ক্যামেরা ভাসিয়ে দিয়েছেন বাস্তবতার গাঙের জলে, তেমনি আমি ভেসে গেছি সব খৈয়ামি রুবাইয়াতের জটপাকানো জঞ্জালে। উদ্দেশ্য একটাই, রুবাইগুলোর ছবি তুলব বাংলা ভাষায়, যাতে ছড়িয়ে দেয়া যায় ইন্টারনেটে।

ফার্সি ভাষার অন্য অনেক কবিতার মতো খৈয়ামি কাব্যেও শরাব, ওয়াইন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওয়াইন মানে এখানে শুধুই ওয়াইন না। প্রেমের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যায়। একজন নারীর পক্ষে একজন পুরুষের সাথে প্রেম করা নিঃসন্দেহে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের একটা জিনিস, কিন্তু যে-নারী শুধুই পুরুষপ্রেমের মধ্যে নিজের কামপ্রেমকে সীমাবদ্ধ রেখেছে তার চেয়ে হতভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। যে-নারী বুঝতে পারেনি, পুরুষের রোমে যেমন প্রেম আছে, তেমনি প্রেম আছে স্বয়ং পৃথিবীর রোমে—সবুজ ঘাসে—তার মতো অভাগী মহাবিশ্বে আর কে আছে? যে-নারী বুঝতে পারেনি, পুরুষরোম আর পৃথিবীরোম অনেক সময় একে অপরের প্রতীক হতে পারে, একটি ছুঁলে আরেকটির অনুভূতি হতে পারে, দুটো একসাথে মিশে যেতে পারে, তার মূর্খতা নিয়ে সে বসে থাকুক, আমরা বরং খৈয়ামের বহুরূপী ওয়াইন আরেকটু বোঝার চেষ্টা করি।

কেইপ টাউনে প্রথম যেদিন এসেছিলাম, তার সমুদ্র, পাহাড়ছাদ, পাখি, ঘাস, সাদা-কালো-রঙিন মানুষ, আর নদী একসাথে একটা সভা ঢেকে আমাকে সম্ভাষণ জানিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই শহর ছেড়ে যাওয়া কঠিন হবে। তার পর একদিন বিকালে দেখি, আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ ‘ফল্‌স‌‌’ উপসাগরের কোলে ঢোকার পর শান্ত হয়ে যাচ্ছে, ঢুলতে ঢুলতে পারে ভিড়ছে, আর তারপর তার ক্লান্ত দেহের মহাসঙ্গম ঘটছে ‘এর্স্টে’ নদের সাথে। এই নদের উজান বেয়ে যেতে থাকলে এক সময় আসে ছোট্ট ‘স্টেলেন্‌বশ’ শহর, আর তার চারদিকে ছোটো ছোটো পাহাড়ের ঢালে অগুণতি আঙুরবাগান। এই বাগানের লাল ওয়াইন যখন আমার জিভ ছুঁয়েছিল তখন ভেবেছিলাম, কেইপ টাউন ছাড়া আরও কঠিন হয়ে গেলে। কিন্তু তারপর অন্য আরেক দিন: বিকাল বেলা পাহাড়ের ঢালে শুয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ-কাব্য ‘ফনের দিবাস্বপ্ন’ পড়ছিলাম; সামনে একটা শীর্ণ নদী, আশপাশে দুই একটা নিঃসঙ্গ গাছ; ওয়াইনের মোহে হঠাৎ দেখি গাছের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে নজরুলের দুই ‘তন্বী সাকি’ [নজরুলের রুবাই: ৪]। সুরার নেশায় ভাবলাম ওদেরকে ধরতে হবে যেকোনো মূল্যে। এগাছ ওগাছ করে অনেক গাছের শরীর ধরলাম, কিন্তু রক্তমাংসের কোনো নারী ধরা দিল না। বুঝলাম ওরা ছিল কেবলই আমার মনের সৃষ্টি; সুধীন্দ্রনাথ আমাকে বললেন, এই বরনারীদের “পরিচয় এই যে তারা তোমারই ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞান পরিণত সচিত্র পুরাণে!” এবং হাট করে খুলে আত্মার দোর, শুরু হলো নক্ষত্রের দৌড়, চিত্ত হয়ে কথা বললাম চিত্তের সনে। ওয়াইন, নারী, গাছ, নদী, নক্ষত্র, বাতাস, বিশ্বপ্রকৃতি সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। বুঝলাম খৈয়ামের ওয়াইন কি জিনিস। বুঝলাম গ্যোটের ফাউস্টকে এক ঋষি যা বলেছিল:
“চিত্তলোক বরাবরের মতোই উন্মুক্ত;
শুধু তোমারই ইন্দ্রিয় বন্ধ, হৃদয় মৃত!
ওঠো, শিষ্য, নির্ভয়ে এই অক্ত
ঊষার লাল ঊর্মিতে বুক করো পরিস্নাত।”

খৈয়ামি রুবাই আমাকে এই ‘ঊষার লাল ঊর্মির’ স্বাদ দেয়। আমি ‘স্বরপয়ার’ ছন্দে, অর্থাৎ স্বরবৃত্ত ছন্দে আর পয়ার বন্ধে, রুবাই অনুবাদ করছি। কিন্তু আমার আসল বাঁধন কবিতার বন্ধন না, মনের বন্ধন। তাই কবিতার ছন্দকে বেশি কাঠখোট্টা করিনি; অধিকাংশ লাইনে ১৪টা সিলেবল থাকলেও, কখনো সেটা বেড়ে ১৫ হয়েছে, কখনো আবার কমে ১২/১৩ হয়েছে। মূল ফার্সির মতো, এবং নজরুলের অনুবাদের মতো, ১ম, ২য় আর ৪র্থ লাইনে অন্তমিল রেখেছি। প্রতি লাইনে স্বরান্ত/মুক্ত (তা) আর হসন্ত/রুদ্ধ (ধিন) সিলেবলের সংখ্যা নিয়েও ভেবেছি। অধিকাংশ লাইনে রুদ্ধ সিলেবলের সংখ্যা ৩, ৪, বা ৫ টি তবে কয়েক জায়গায় তা কমে ২ বা বেড়ে ৬/৭ হয়ে গেছে। আর ‘পর্বসম্মিতি’ একেবারেই রাখিনি—গতানুগতিক পয়ারের ৮+৬ বন্ধ তো নয়ই, স্বরবৃত্তের ৪+৪+৪+২ বন্ধও না। আমার প্রতিটা লাইনই এই দিক থেকে ‘মুক্তক’। এর ফলে নজরুলের তুলনায় আমার অনুবাদ অনেক বেশি গাদ্যিক। রবীন্দ্রনাথ যেদিন আমাকে বললেন, “ভাষার উচ্চারণ অনুসারে ছন্দ নিয়মিত হলে তাকেই স্বাভাবিক ছন্দ বলা যায় . . . যদি কখনো স্বাভাবিক দিকে বাংলা ছন্দের গতি হয়, তবে ভবিষ্যতের ছন্দ রামপ্রসাদের ছন্দের অনুযায়ী হবে” [‘ছন্দ’, আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ. ২৬] সেদিনই ‘রামপ্রসাদের ছন্দ’, অর্থাৎ স্বরবৃত্তের প্রেমে পড়েছিলাম।

ফার্সি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে আমাকে দুই বার ভাবতে হয়নি, কারণ বাঙালির মুখের ভাষাতেই ফার্সির ছড়াছড়ি। আমার ব্যবহার করা ফার্সি শব্দগুলো হচ্ছে: মিনার, শরাব, গোলাপ, পেয়ালা, খুশি, খোশ, সাকি, খোদা, রসদ, কুজা, জাহান, বেহেশত, দোজখ, বালিশ, নওরোজ, দিল, মুশকিল, জাদু, দিলদার, মজা, হাজার; আর আরবি শব্দগুলো হচ্ছে: ফজর, নকিব, তওবা, নামাজ, মেজাজ, হাকিম, আরশ, মোল্লা, আল্লাহ, রদ, মেরামত, তাবু, জলসা, শামিল। এবং আরবি-ফারসির মিলনেও শব্দ তৈরি হয়েছে, যেমন, খোশমেজাজ। আর একটা কথা। মূল ফার্সিতে প্রতিটা রুবাই (চার লাইনের স্তবক) স্বাধীন কবিতা, এবং তাদেরকে শুধুমাত্র অন্তমিলের সিলেবলের বর্ণানুক্রমে সাজানো হয়। এখানে পাঁচ পর্বে ২৭টি রুবাই পরিবেশন করা আমার সিদ্ধান্ত। আর কথা বাড়াব না। আরো জানতে চাইলে রুবাইগুলোর শেষে ‘রুবাইভাষ্য’টা পড়তে পারেন।

খৈয়ামি রুবাই

১. আজ নওরোজ, বসন্তের প্রথম সকাল

ওঠো! আঁধার-মিনারে লেগেছে সূরের ফাঁস,
দিনের খসরু শরাবে ভরেছে রাতের গ্লাস;
গিলো! ফজর-নকিব তারার পাল তাড়িয়ে
শঙ্খসুরে বলছে, “দুই হাতে তোল্ সুরার গ্রাস।” [১]

বসন্ত এসে গেছে, মাঠ ক্ষেতে আলোর আভা,
প্রাণের মেলায় মেতেছে গ্রামের সবুজ সভা;
মূসার শাদা হাত ছুঁয়ে গেছে গাছের শাখা,
ঈসার নিশ্বাস ফিরিয়ে দিল লতার শোভা। [২]

বসন্ত বাতাসে ঘুম ভেঙে উঠল গোলাপ—
ঘাসের শরীরে আধশোয়া আমার প্রেম চুপচাপ;
অতীত নিয়ে বিলাপ বৃথা—উপভোগ করো
এই মুহূর্ত, এখনই নিও না ছায়ার মাপ। [৩]

গরমও না ঠাণ্ডাও না, দিনটা স্বচ্ছ সুন্দর,
ভোরের শিশিরে স্নান করে বাগান ভাস্বর;
বুলবুল ধূসর গোলাপকে পাহ্‌লভিতে বলে,
“শরাব-রাগে তোর হলুদ গালে আরক্ত সর!” [৪]

নওরোজের টিউলিপের মতো তুলে ধরো পেয়ালা,
আজ সঙ্গীর লাল গালে আঁকো প্রেমের দেয়ালা;
আর পান করো নিঃশেষে, কারণ সময়ের চাকা
কালই তোমাকে দিয়ে গড়বে মাটির শেয়ালা। [২০]

২. ফজর ওয়াক্ত, প্রাতঃপানের প্রহর

হে চপল প্রেম, প্রাতঃপানের ক্ষণ এলো, পড় নামাজ,
পেয়ালা আনো, শরাব ঢালো, গান গাও খোশমেজাজ;
আষাঢ় পৌষের চিরকেলে চাকার কর্ষণে
মাটিতে লক্ষ কায়কোবাদ জামশেদের কারুকাজ। [৬]

শরৎ, বসন্ত যেমন আসে, যখন যার পালা,
জীবনের পাতা তেমনি ঝরে, যখন যার বেলা,
চিন্তা ঝেরে মদ ঢালো—হাকিম তো বলেই গেছেন:
“জীবনের মায়া বিষ, মদ তার নিরাময়ক ইলা।” [৭]

প্রতি ভোরে শপথ করি, “রাতে করব তওবা—
ওয়াইন পেয়ালার মায়া চিরতরে ছাড়ব, তওবা;”
কিন্তু বসন্ত এলো, শপথ কী করে রাখি?
হে খোদা! আজ তওবা না-ভাঙতে পড়ব তওবা। [৫]

এক গ্লাস ওয়াইনের ওজন ভারতবর্ষের চেয়ে বেশি,
কায়-রাজাদের মুকুট আর আরশের চেয়েও বেশি;
সকালে প্রেমিকের আকুল দীর্ঘশ্বাসের কাছে
ভাব-গদগদ মোল্লার ব্যাকুল মোনাজাত নস্যি। [৮]

আহ্, যদি পেতাম এক টুকরো নরম রুটি,
এক কুজা ওয়াইন, হাড়ের গোশত এক পাটি,
আর তুমি আমি অরণ্যে পাততাম তাবু—
আমাদের আনন্দে সুলতানের জলসা হতো মাটি। [১৬]

সাকির কাপ থেকে মর্ত্যে পড়ে যে কয় ফোঁটা মদ,
সে কয়েক ফুটন্ত চোখে দুঃখের আগুন হয় রদ;
হে আল্লাহ, তুমি এ সুধার নাম দিয়েছ ওয়াইন,
যা শত বেদনার ক্ষত মেরামতের রসদ। [১৩]

৩. নিদ্রাবিহীন গগনতলে প্রেমের বহর

পরম সত্যের মহাগ্রন্থের সারমর্ম প্রেম,
যৌবনের মহাসঙ্গীতের মূল ধর্ম প্রেম;
প্রেমের স্বরূপ না-দেখা অন্ধকে বলি,
জেনে রাখো: জীবনের আসল বর্ম প্রেম। [১১]

করুণ সে হৃদয় যাকে ছোঁয়নি প্রেমিকের দৃষ্টি,
আবেগহারা যার বুকে ঝরেনি প্রেমের বৃষ্টি;
যে-দিনটি কাটালে প্রেমের পরশ ছাড়া,
তার চেয়ে খারাপ দিন দো-জাহানে হয়নি সৃষ্টি। [১৭]

কৃত্রিম কামসর্বস্ব প্রেম দিয়ে আগুন জ্বলে না,
আধমরা দীপশিখা থেকে যেমন তাপ ফলে না;
প্রাণের প্রণয়ী শত রাত দিন মাস আর বছরেও
নাওয়া খাওয়া বিশ্রাম বা ঘুমের ঘোরে টলে না। [২২]

আসল প্রেমিকের কাছে ফর্সা আর কালো সমান,
সে চায় না বেহেশত বা দোজখের কোনো প্রমাণ,
পরোয়া করে না, প্রেমিকা পড়ল সিল্ক না ত্যানা,
পাথর না বালিশে মাথা রেখে ধরল তার প্রাণ। [১৯]

পরম প্রেমের দোলায় আমার হৃদয় অনিরূদ্ধ,
মুখ ভরা কত কথা, অথচ জিভ আবদ্ধ;
কোনো জন্মে দেখেছ এমন অদ্ভুত কিছু:
অবারিত ঝর্ণার তীরেও কেউ তৃষ্ণাদগ্ধ? [১৮]

৪. শ্যামল মাটির ধরাতলে মদের নহর

জানি না, যে আমার মাটিকে দিয়েছিল মিশতে
সে চেয়েছিল, আমি যাই দোজখে না বেহেশতে;
পেয়ালা, প্রেম, বীণা, আর ঘাস ঘেরা এই মর্ত্যে
থাকব আমি, তুমিই থাকো তোমার বেহেশতে। [২৫]

জাগো, হে আমার প্রেম, দখল করো আমাদের দিল,
মায়ার জাদু দিয়ে দূর করো আমাদের মুশকিল;
আর মাটির কলসি থেকে শরাব ঢালো—পান করি,
যদ্দিন না কুমোর আমাকেই করে মাটির শামিল। [২১]

ওঠ্, প্রভাতের সাথে প্রেম কররে অজাতশ্মশ্রু,
স্ফটিক হৃদ-পেয়ালায় ঢাল লাল শরাবের অশ্রু;
এই মর্ত্যলোকে ধারে পেয়েছিস কিছু নিশ্বাস,
আর খুঁজে পাবি না হারায় যদি কল্পতরু। [২৪]

ওঠ্, প্রভাতের সাথে প্রেম কররে সুরসুন্দরী,
আস্তে আস্তে অন্তরে ঢাল শরাব আর বাঁশরি;
জীবিত কেউ আর বেশি দিন থাকবে না বেঁচে,
মৃত কেউ আর কোনো দিন আসবে না ফিরি। [২৬]

এসো, দিলদার, হাতে তুলে নাও কাপ আর কুজা,
নদীর পারে ঘাসের ঘরে খোঁজো প্রাণের মজা;
হৃদয়হীন চাকাটা কত প্রেমিক আর প্রেমিকার
শরীর দিয়ে বানালো ঘটি আর বাটির মাজা। [২৩]

৫. সময়ের হাত লিখছে অবিরাম

মধুর হোক বিধুর হোক, জীবন তো ঠিকই ফুরায়,
মরলাম বাগদাদে না বালখে তাতে কী আসে যায়?
ওয়াইন ঢালো, কারণ আমরা মরলেও শাদা চাঁদ ঘুরবে
অমা থেকে পূর্ণিমায়, পূর্ণিমা থেকে অমায়। [১০]

যেহেতু আগামী কালের নেই কোনো ভরসা
বন্ধ্যা হৃদয়ে এখনই নামুক খুশির বর্ষা;
চাঁদের আলোয় মদ ঢালো, হে আমার চাঁদ, কারণ চাঁদ
ঘুরতেই থাকবে, কিন্তু পাবে না আমাদের দিশা। [১৫]

প্রাণের স্ফূর্তিতে যদি হাতে না রাখি হাত,
পারব না দুঃখের মূর্তিতে করতে পদাঘাত;
ভোর ভাঙার আগে চলো তুলি এক পেয়ালা—
আসবে অনেক ভোর, পাবে না আমাদের সাক্ষাৎ। [১২]

খৈয়াম, মদ-মাতাল যদি হও, নাচো খোশমেজাজে,
সুন্দর মুখের মুখর সঙ্গ যাচো খোশমেজাজে;
মহাবিশ্ব যেহেতু মহাশূন্যে বিলীন হবে,
যদ্দিন জীবন উড়ে না যায়, বাঁচো খোশমেজাজে। [১৪]

যেহেতু চিরকাল থাকবে না এই পান্থশালা,
পাপ এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকা প্রেমিকার পেয়ালা;
মহাবিশ্ব অনাদি না আদিভূত, পণ্ডিত?—
মরলে ভাবব না কত পুরান এ পানের মেলা। [৯]

হে সাকি, আর কত বকে যাবে পাঁচ আর চার—
এক মুশকিল দূর হলে, আসবে আরো হাজার;
আমরা কেবলই মাটি—সেতার আনো, সুর তোলো,
আমরা শুধুই বাতাস—মদ ঢালো, চাই না কিছু আর। [২৭]

রুবাইভাষ্য

[১] ফেরদৌসির ‘শাহনামা’য় প্রাচীন ইরানের আধাপৌরাণিক রাজবংশ ‘কায়’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বংশের প্রথম তিন রাজা হলেন কায়কোবাদ, কায়কাউস, আর কায়খসরু। এখানে সূর্যকে বলা হচ্ছে ‘দিনের খসরু’। আমি এই রুবাই মনের মাধুরি মিশিয়ে এইভাবে চিন্তা করেছি: সূর্য, সূর, বা খসরু ঘোড়ায় চড়ে আসছে, তার হাতে আলোর দড়ি; রাত একটা ওয়াইন গ্লাস যার নিচ দিকটা মিনারের মতো সরু; খসরু আলোর দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগায় এই মিনারে, তার পর রাতের গ্লাসে ঢেলে দেয় শরাব, অর্থাৎ আলো; ঐ দিকে ‘ফজর-নকিব’ অর্থাৎ মুয়াজ্জিন (আদালতে যে বিচারকের আগমন ঘোষণা করে তার নাম নকিব) শঙ্খসুরে আজান দিতে শুরু করে, আর গরুর পালের মতো তারাগুলো রাতের শরীর থেকে সরে যেতে থাকে; মুয়াজ্জিন নামাজের আহ্বায়কের বদলে পরিণত হয় খসরুর জ্যোতির্মদ পানের আহ্বায়ক: ‘দুই হাতে তোল সুরার গ্রাস’। মূল ফার্সিতে অন্তমিলবিশিষ্ট তিনটি লাইনই শেষ হয়েছিল ‘অফগন্দ’ শব্দটি দিয়ে যার অর্থ তিন লাইনে তিন রকম। ‘অফগন্দের’ সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আমি এখানে ‘স’ আর ‘র’ দিয়ে তৈরি তিনটি শব্দকে তিন অর্থে ব্যবহার করেছি: ‘সূর’ (সূর্য) ‘সুর’ (সঙ্গীত) আর ‘সুরা’ (ওয়াইন) যারা একে অপরের উপমা।

‘খৈয়ামের’ রুবাইয়াৎকে যিনি ইংল্যান্ড আর যুক্তরাষ্ট্রে শেক্সপিয়ার আর বাইবেলের পরই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ে পরিণত করেছিলেন সেই এডওয়ার্ড ফিট্সজেরাল্ড এই রুবাইয়ের একটা অন্তরানুবাদ (অন্তরে মিল আছে, যদিও বহিরঙ্গে মিল কম) দিয়েই শুরু করেছিলেন তার বইটি:

Awake! for Morning in the Bowl of Night
Has flung the Stone that puts the Stars to Flight:
And Lo! the Hunter of the East has caught
The Sultán's Turret in a Noose of Light.

ফিট্সজেরাল্ড বিভিন্ন রুবাই থেকে লাইনপত্র নিয়ে নিজে প্রায় মৌলিক আরেকটি কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, মোট ১০১টি ‘কোয়াট্রেইনের’ সমন্বয়ে; তাছাড়া তিনি ফার্সি যথেষ্ট ভালো জানতেনও না। তিনি নিজেই বলেছেন, তার কবিতা ‘ট্রান্সলেশন’ না, ‘রেন্ডিশন’; তিনি খৈয়ামের অনুপ্রেরণাকে সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে বুদ্বুদের মতো উঠতে দেখেছেন, আর সেই বুদ্বুদ সমুদ্রের পৃষ্ঠে এসে যখন ফেটে গেছে তখন জন্ম হয়েছে তার নিজের রেন্ডিশন। আমিনরযভি মনে করেন, এর পরও খৈয়ামের মূল চেতনাটা ইংরেজি ভাষায় ধারার ক্ষেত্রে আর কেউ ফিট্সজেরাল্ডের ধারে কাছেও আসতে পারেনি।

[২] ইরানে নওরোজ, বসন্তের প্রথম দিন—২১ মার্চের আশপাশে—,সবচেয়ে বড়ো জাতীয় উৎসব। এই দিনের আগে থেকেই উৎসব শুরু হয়, এবং ১২ দিন ধরে চলে। উৎসবের জন্য অনেক শহরকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়, এবং একেক দিন একেক ওয়ার্ডের মানুষ বাড়িতে থাকার জন্য ছুটি পায়। ১৩তম দিনের নাম ‘সিজদাহ্’, যেদিন অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যায় ঋতু পরিবর্তন উপভোগের জন্য। এই রুবাইয়ে ‘মেতেছে গ্রামের সবুজ সভা’ দিয়ে এই পিকনিকের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে।

‘মূসার শাদা হাত’ কুরআনের একটি আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে: “এবং তোমার হাত তোমার বুকে রাখো, তা বের হয়ে আসবে শুভ্র নির্মল অবস্থায়।” [২৭:১২] মূসার হাত এখানে বসন্তে সাদা ফুলের আকস্মিক আবির্ভাবের উপমা। ‘ঈসার নিশ্বাস’ কুরআনের আরেকটি আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে: “. . . আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্য মাটি দিয়ে পাখির একটি স্বরূপ তৈরি করব, তারপর তাতে নিশ্বাস ফুঁকে দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখি হয়ে যাবে।” [৩:৪৯] মুসলমানরা মনে করে ঈসা (যিশু) নবীর অলৌকিক ক্ষমতার উৎস তার নিশ্বাস।

[৩] গোলাপকে ঘাসের বুকে আধশোয়া মাশুক, দয়িতা, বা প্রেমিকা হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে খৈয়ামের কাছে প্রকৃতিপ্রেমই সর্বোর্ধ্ব প্রেম। এমন না যে, প্রকৃতিকে তিনি মানুষিক প্রেমের উপমা হিসেবে ব্যবহার করছেন, বরং মানুষকেই ব্যবহার করছেন প্রকৃতিপ্রেমের উপমা হিসেবে।

[৪] ইসলাম আসার আগে ইরানে তিনটি প্রধান ভাষা ছিল: জরথুস্ত্রীয় ধর্মগ্রন্থের ভাষা ‘আবেস্তা’, যার সূচনা ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এবং যা ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মুখের ভাষা হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, সংস্কৃতের মতো, ধর্মযাজকদের ভাষা হিসেবে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল; হাখমানেশি সাম্রাজ্যের ভাষা ‘পুরান ফার্সি’, যার নিদর্শন পাওয়া যায় ৫৫০–৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; এবং ‘পাহ্‌লভি’, যা ৪র্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু হয়ে তের শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। খৈয়াম (১০৪৮–১১৩১) সম্ভবত পাহলভি জানতেন, এবং ধারণা করা হয়, তার বাবা জরথুস্ত্রীয় ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; মাত্র দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলমান হওয়াতে খৈয়ামের উপর প্রাক-ইসলামি সংস্কৃতির অনেক প্রভাব ছিল, এবং ইরানি জাতীয়তাবাদেও তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন।

ফার্সি সাহিত্যে বুলবুল—নাইটিংগেল, নজরুলের ‘বুলবুলি’—পাখির সাথে সব সময় গোলাপের প্রেমের কথা বলা হয়। এছাড়া আরো চার ধরনের প্রেমের কথা পাওয়া যায়, যার মধ্যে আছে সূর্যের সাথে লিলি ফুলের, চাঁদের সাথে পদ্ম ফুলের, আর মোমবাতির সাথে মথ, বা দেয়ালি পোকার প্রেম।

[৫] মদ্যপান ইসলামে হারাম। কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ: “ওহে যারা ঈমান এনেছ! নিঃসন্দেহে মাদবদ্রব্য ও জুয়া, আর প্রস্তর বেদী বসানো ও তীরের লটারি খেলা—নিঃসন্দেহে হচ্ছে অপবিত্র, শয়তানের কাজের অন্তর্ভুক্ত, কাজেই এ-সব এড়িয়ে চলো, যেন তোমরা সফলকাম হতে পারো। নিঃসন্দেহে শয়তান কেবলই চায় যে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগরিত হোক মাদকদ্রব্য ও জুয়ার মাধ্যমে, আর তোমাদের ফিরিয়ে রাখবে আল্লাহর গুণগান থেকে ও নামাজ থেকে। তোমরা কি তাহলে পরিহৃত থাকবে?” [৫:৯০–৯১] এদিক থেকে ইসলামি বিশ্বে খৈয়ামের সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের কোনো পার্থক্য নেই। এখনকার মতো তখনও ওয়াইন নিষিদ্ধ ছিল, গোপনে ওয়াইনের ব্যবসা ইরানে অবশ্যই ছিল, তবে সেটা জোগাড় করা এখনকার মতোই কষ্টের ব্যাপার ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যেমন চেনাজানা থাকলে এবং টাকা থাকলে ঠিকই মদ জোগাড় করা যায়, তেমনি খৈয়ামের সময়কার অভিজাতরাও ওয়াইনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। ইবনে সিনা অনুপ্রেরণার জন্য কখনো যেতেন মসজিদে, কখনো যেতেন ওয়াইনের কাছে। আমার মনে হয়েছে খৈয়ামের পানাভ্যাস অনেকটা আমার মতো। জিহাদ যেমন ‘বড়ো’ আর ‘ছোটো’ দুই রকমের আছে, তেমনি, আমার, এবং খৈয়ামের, জীবনে মদ্যপান দুই রকমের: ‘বড়ো’ মদ হচ্ছে আকাশ, বাতাস, নক্ষত্র, ঘাস, স্বপ্ন, নদী, নারী, পানি, পাখি, বিশ্বপ্রকৃতি, মহাবিশ্ব, বাস্তবতার ভিত্তি, ঈশ্বর, অস্তিত্ব; আর ‘ছোটো’ মদ হচ্ছে ওয়াইন, মূলত লাল ওয়াইন। ছোটো মদ দিনে সর্বোচ্চ দুই গ্লাস খাওয়া যায়, কখনো কখনো অলসতা পেয়ে বসলে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আর বড়ো মদের সংখ্যা এত বেশি যে সেটা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খাওয়া যায়, এমনকি ঘুমের মধ্যেও। আমার মনে হয়েছে, এই রুবাইয়ের প্রথম দুই লাইনে খৈয়াম ছোটো মদের জন্য তওবা করছেন, কিন্তু পরের লাইনে বড়ো মদ এসে পড়াতে তওবা ভুলে যাচ্ছেন—এমনকি বড়ো মদের মোহে ছোটো মদ ত্যাগের তওবাও আর তার রাখা হচ্ছে না।

নজরুলের অনুবাদ এরকম:
“নিত্য দিনে শপথ করি—করব তৌবা আজ রাতে,
যাব না আর পানশালাতে, ছোঁব না আর মদ হাতে।
অমনি আঁখির আগে দাঁড়ায় গোলাপ ব্যাকুল বসন্ত,
সকল শপথ ভুল হয়ে যায়, কুলোয় না আর তৌবাতে।” [১২১]

[৬] ওয়াইন নিষিদ্ধ হওয়ায়, ফজরের ওয়াক্তে যখন বেশি ধার্মিকরা মসজিদে যেতো, আর কম ধার্মিকরা ঘুমিয়ে থাকত, তখন মদ্যপায়ীরা পানের আসর জমাতো; ওয়াইনের মাধ্যমে তারা রাতকে বিদায় দিত, আর নতুন দিনকে স্বাগত জানাত। এছাড়া ইসলামপূর্ব জরথুস্ত্রীয় ধর্মেও প্রতিটা দিন এক পেয়ালা ওয়াইন দিয়ে শুরু করার বিধান ছিল। এখানে ‘প্রাতঃপানের’ মাধ্যমে এই দুই সংস্কৃতিকে একসাথে তুলে ধরা হচ্ছে, সম্ভবত।

[৭] মূল ফার্সিতে ‘তির’ (২২ জুন শুরু) ও ‘দেয়’ (২২ ডিসেম্বর শুরু) মাস দুটির কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইরানে এখনও যে ‘জালালি বর্ষপঞ্জি’ অনুসরণ করা হয়—যা পশ্চিমের গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির চেয়ে বেশি নিখুঁত—তা ওমর খৈয়াম, আর তার সহ-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মিলে তৈরি করেছিলেন সেলজুক রাজা মালিক শাহ’র (১০৫৩–৯২) নির্দেশে। খৈয়াম এক বছরের যে-দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন তা দশমিকের পর ৫ ঘর পর্যন্ত সঠিক, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

কায় রাজবংশের আগের আধাপৌরাণিক রাজবংশের নাম ‘পিশদাদি’। জামশেদ ৪র্থ, এবং সবচেয়ে বিখ্যাত, পিশদাদি রাজা, যাকে পার্সেপলিসের নির্মাতা মনে করা হয়; পার্সেপলিসের আরেক নাম ‘তখতে জামশেদ’।

[৮] মূল ফার্সিতে ‘এক গ্লাস ওয়াইনের ওজন তূস নগরীর চেয়ে বেশি’ বলা হয়েছে। আমি ‘ভারতবর্ষ’ করেছি আসলে ‘আরশের’ সাথে অন্তমিল আনার জন্য, কিন্তু পরে দেখলাম ‘ভারতবর্ষের’ মাধ্যমেই কবিতার মূলভাবটা বাংলায় বেশি আনা গেছে। নজরুলের অনুবাদ:
“কায়কোবাদের সিংহাসন আর কায়কাউসের রাজমুকুট,
তুষের রাজ্য একছিটে এই মদের কাছে সব যে ঝুট!
ধর্ম-গোঁড়ার উপাসনার কর্কশ যে প্রভাত-স্তব
তাহার চেয়ে অনেক মধুর প্রেমিক-জনের শ্বাস অফুট।” [৯৪]
নজরুল গোঁড়া ধার্মিকদের উপর একটু বেশিই ক্ষেপে ছিলেন মনে হয়।

[৯] মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, অর্থাৎ আদিভূত, না-কি অনাদি, অর্থাৎ সময়ের সাথে সহবাসী, সে নিয়ে গ্রিক দর্শনে অনেক তর্কবিতর্ক ছিল, যা আরব-ইরানি দার্শনিকদেরও স্পর্শ করেছিল। এরিস্টটলের কথা মতো মহাবিশ্ব যদি অনাদি হয়, তাহলে আল্লাহ কীভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারেন, সে নিয়ে ইসলামি বিশ্বে দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের অনেক মাথাব্যথা ছিল। এরিস্টটলপন্থী ইবনে সিনা অনাদি মহাবিশ্বের ধারণার সাথে ইসলামের বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করেছিলেন। খৈয়াম নিজেকে ইবনে সিনার ছাত্র বলতেন; সময়ের বিবেচনায় সেটা যেহেতু সম্ভব না, ধারণা করা হয় খৈয়াম ইবনে সিনার সেরা ছাত্রের ছাত্র ছিলেন।

[১০] বাল্‌খ আফগানিস্তানের একটি শহর। গোবিন্দ তীর্থ তার ইংরেজি অনুবাদে বাগদাদ আর বালখকে ফ্রান্স আর স্পেন করে দিয়েছিলেন, আহমদ সাইদি যা জানলে পছন্দ করতেন না। বাগদাদ আর বালখের তাৎপর্য শুধু তাদের আদ্যমিলে না, বরং মানচিত্র খুললে দেখা যাবে খৈয়ামের শহর নিশাপুর থেকে এই দুই শহরের দূরত্বই আনুমানিক ১৫০০ মাইল, বাগদাদ পশ্চিম দিকে, আর বালখ পূর্বে।

নজরুলের অনুবাদ:
“জীবন যখন কণ্ঠাগত—সমান বলখ নিশাপুর,
পেয়ালা যখন পূর্ণ হলো—তিক্ত হোক কি হোক মধুর।
ফুর্তি চালাও, নিভে যাবে হাজার তপন লক্ষ চাঁদ,
আমরা ফিরে আসব না আর এই ধরণীর পথ সুদূর!” [১০৯]
নিশাপুর দিয়ে অন্তমিল বানাতে গিয়ে নজরুলও বাগদাদ আর বালখের ধ্বনিগত আর দূরত্বগত ব্যঞ্জনা বিসর্জন করেছেন দেখা যাচ্ছে।

[১১] গোবিন্দ তীর্থ আর আহমদ সাইদির অনুবাদ তুলনা করার জন্য এই রুবাই একটি ভালো মাধ্যম। তীর্থ হায়াদ্রাবাদের নিজামের সচিব হিসেবে কাজ করতেন, এবং একজন হিন্দু ‘গুরু’ ছিলেন, আর সাইদি আধুনিক ইরানি-অ্যামেরিকান, যিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিভাগেও কাজ করেছেন। দুজনেই আমলা, কিন্তু এছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনো মিল নেই, দুজন দুই মেরুর, যা তাদের অনুবাদে প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তীর্থ সবকিছুতেই মরমিবাদ, পরম বাস্তবতা, ঈশ্বর, আর তপস্যার ছায়া দেখতে পান, আর সাইদি সবকিছুকে খুব সাধারণ কথায় সীমাবদ্ধ রাখেন, তীর্থের মতো তিনি উপমানের জায়গায় সরাসরি উপমেয় বসিয়ে দেন না। এই রুবাইয়ে সাইদি যেখানে বলছেন ‘Book of Truth’ তীর্থ সেখানে বলছেন ‘Courts of mystic truth’; সাইদি যেখানে সত্যগ্রন্থের কথা বলেই থেমে যাচ্ছেন, তীর্থ সেখানে এক পা এগিয়ে তার মরমিসত্যের জলসার সভাপতির জায়গায় সরাসরি ঈশ্বরের সর্বনাম His বসিয়ে দিচ্ছেন। আমি দুয়ের মাঝামাঝি থাকার চেষ্টা করে বলেছি ‘পরম সত্যের মহাগ্রন্থের’; এখানে ‘পরম’ শব্দটা হয়ত সাইদি পছন্দ করতেন না।

[১৩] পানের আসরে কয়েক ফোঁটা ওয়াইন মাটিতে ফেলাকে উদারতার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। অবশ্য অনেকে বলেন এর মাধ্যমে মৃতদের স্মরণ করা হতো, বা শুধুমাত্র মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির কামনা করা হতো। সব অর্থই এখানে প্রযোজ্য হতে পারে। আর মৃতদের স্মরণের সাথে তো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি অবশ্য আরো একটি অর্থ দেখতে পাচ্ছি: সাকি যদি ঈশ্বর হয় (আমার কাছে ‘স্পিনোজার ঈশ্বর’, এবং খৈয়ামের ঈশ্বরও সাধারণ বিশ্বাসের ঈশ্বর ছিলেন না)—বা যারা ঈশ্বর শব্দটা একেবারেই ব্যবহার করতে চান না তাদের জন্য যদি স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি হয়—তাহলে ভাবা যায় এই ঈশ্বর/প্রকৃতি তার মদের পেয়ালা থেকে মাত্র কয়েকটা ফোঁটা মর্ত্যে ফেলছে, আর তাতেই আমরা অভিভূত হয়ে যাচ্ছি; এর চেয়ে বেশি কিছুর স্বাদ পাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব, যদিও প্রকৃতির ভাণ্ডার অফুরন্ত। স্পিনোজার ভাষায় বললে, ঈশ্বর বা প্রকৃতি একমাত্র সারবস্তু (substance), যার অসীম সংখ্যক রূপ (attribute) আছে, যে-প্রতিটি রূপের আবার আছে অসীম সংখ্যক গুণ (mode); এর মধ্যে আমরা শুধু একটি গুণের জগতে বাস করি, বাকি সবকিছু আমাদের কল্পনারও ঊর্ধ্বে। উপনিষদের ভাষায় বলতে গেলে, নির্গুণ ব্রহ্মের অসংখ্য সগুণ রূপ আছে যার মধ্যে একটা সগুণ রূপ হয়ত ঈশ্বর। পরের লাইনে আল্লাহকে সরাসরি সম্বোধনের মাধ্যমে সাকির সাথে আল্লাহর সংযোগ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মূল ফার্সিতে ‘সুবহানাল্লাহ’ ব্যবহার করা হয়েছিল যাকে ইংরেজিতে সবাই ‘praise to God’ করেছেন, কিন্তু সাইদির মতে এখানে আল্লাহকে প্রশংসা করা হচ্ছে না।

[১৫] তিন নম্বর লাইনের মূল ফার্সি ‘মেয় নুশ বেনুরে মাহ্ অ্যায় মাহ্ কে মাহ্’। এখানে মাহ্ (চাঁদ) তিন বার ব্যবহারের মাধ্যমে একটা ব্যঞ্জনা আনা হয়েছে, যা চাঁদ তিন বার ব্যবহারের মাধ্যমে এনেছি; এবং ‘মাহ্’-এর সাথে ‘মেয়’ এর অনুপ্রাস বাংলা ‘চাঁদ’ আর ‘মদ’-এর মধ্যেও আনা সম্ভব হয়েছে। ওয়াইন বুঝাতে ফার্সিতে ‘মেয়’ ‘বাদহ্’ আর ‘শরাব’ তিনটা শব্দই ব্যবহার করা হয়। আর ‘নুশ’ হলো ‘পান’। ‘মেয় নুশ’ খৈয়ামকে অনেক ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইন্দো-ইরানি সাহিত্যে প্রেয়সীকে চাঁদের সাথে তুলনা করা (‘অ্যায় মাহ্’) খুব স্বাভাবিক ব্যাপার; এবং হয়ত পাশ্চাত্যেও—যে-কারণে শেক্সপিয়ার যখন জুলিয়েটকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘Arise, fair Sun, and kill the envious Moon’ তখন ইংরেজি সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ‘নুরে মাহ্’ হচ্ছে ‘চাঁদের আলো’।

‘মেয় নুশ’ দিয়ে শুরু হওয়া একটি খৈয়ামি রুবাই ইরানের বিখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী মোহাম্মদ-রেজা শাজারিয়ানের কণ্ঠে নতুন প্রাণ পেয়েছিল:

[১৬] ফিট্সজেরাল্ডের অনুবাদের মাধ্যমে এই রুবাইটি পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। জর্জ সান্টায়ানা’র ‘তিন দার্শনিক কবি’ বইয়ে উদ্ধৃত এই রুবাই পড়েই আমি খৈয়াম আবার মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং অনুবাদ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলাম। ফিট্সজেরাল্ডের অনুবাদ হচ্ছে:
“A Book of Verses underneath the Bough,
A Jug of Wine, a Loaf of Bread—and Thou
Beside me singing in the Wilderness—
Oh, Wilderness were Paradise enow!”

এর সাথে নজরুলের অনুবাদ মিলিয়ে দেখা যায়:
“যতক্ষণ এ হাতের কাছে আছে অঢেল লাল শরাব
গেহুঁর রুটি, গরম কোর্মা, কালিয়া আর শিক কাবাব,
আর লালা-রুখ, প্রিয়া আমার কুটির-শয়ন-সঙ্গিনী,—
কোথায় লাগে শাহানশাহের দৌলৎ ঐ বে-হিসাব।” [৬৩]

[১৯] নজরুল:
“প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরণ,
পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন বসন।
থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,
নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।” [৯৭]

[২০] ‘চাকা’ দিয়ে ভাগ্য, অদৃষ্ট, কাকতাল, নিয়তি বুঝানো হয়, এবং খৈয়াম অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অর্থই করেছেন। অর্থটা আরো স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে আমি অনুবাদ করেছি ‘সময়ের চাকা’। তবে অন্য জায়গায় ‘চাকা’ দিয়ে খৈয়ামি রুবাইয়ে আরো যা বোঝানো হয় তা হলো: আকাশগোলক, মহাবিশ্ব, সমাজব্যবস্থা যা দারিদ্র্য দুর্দশা আর অসাম্যের ইন্ধন যোগায়, এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদী ধর্ম।

নজরুলের অনুবাদ:
“পেয়ালাগুলি তুলো ধরো চৈতী লালা ফুলের প্রায়
ফুরসুত তোর থাকলে, নিয়ে বস লালা-রুখদিল প্রিয়ায়।
মউজ করে শারাব পিও, গ্রহের ফেরে হয়ত ভাই
উল্টে দেবে পেয়ালা সুখের হঠাৎ-আসা ঝঞ্ঝাবায়।” [১১৫]
ফার্সিতে টিউলিপ হচ্ছে ‘লালা’ বা ‘লালে’ (لاله)। নজরুল ‘লালা’ই ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু শব্দটা বাংলায় প্রচলিত হয়নি।

[২২] খৈয়ামের গসপেল বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা এই: ‘প্রাণের প্রণয়ী শত রাত দিন মাস বছরেও নাওয়া খাওয়া আরাম বা ঘুমের ঘোরে টলে না’—অর্থাৎ সারা জীবন ব্যাপী দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা প্রকৃতিমদ পান করে।

[২৪, ২৬] এই দুটো রুবাই খুব কাছাকাছি। আমি একটাকে পুরুষের উদ্দেশ্যে (‘অজাতশ্মশ্রু’) অনুবাদ করেছি, আরেকটি নারীর উদ্দেশ্যে (‘সুরসুন্দরী’)। ফিট্সজেরাল্ডের অনুবাদ ইংল্যান্ড-অ্যামেরিকায় মানুষ কিছুটা ভুল বুঝেছিল, যার ফলে তার মৃত্যুর পর রুবাইয়াতের অনেক সংস্করণে একজন বিমর্ষ দার্শনিকের পাশে এক বা একাধিক অর্ধনগ্ন সেক্সি ইরানি রমণীর ড্রয়িং জুড়ে দেয়া হয়, ফিট্সজেরাল্ড বেঁচে থাকলে যার অনুমতি দিতেন না। কারণ অধিকাংশ রুবাইয়ে খৈয়াম আসলে কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করছেন না, এবং অনেক ক্ষেত্রে তিনি ‘প্রেমিক’ বলে পুরুষকে সম্বোধন করছেন। এই প্রেমিকের সাথে হয়ত সক্রেটিসের সমকামী বালক-প্রেমিককে মেলানো যায়, কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই ‘প্রেমের বস্তু’ পুরুষ, নারী, গাছ, পাথর, নদী, ঈশ্বর বা গোটা মহাবিশ্ব হতে পারে। নারী-পুরুষ-প্রেমের কথা এতে অবশ্যই আছে, কিন্তু এর পাশাপাশি আছে আরো অনেক কিছু, এবং অনেক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ-প্রেম কেবলই উপমা। তাছাড়া ‘রুবাইয়াৎকে’ যদি নারীর উদ্দেশ্যে কোনো পুরুষের কাম বা প্রেম নিবেদন হিসেবে দেখা হয়, তাহলে নারীর জন্য আর তা প্রাসঙ্গিক থাকবে না, কারণ নারী সেখানে হয়ে যাবে কেবলই ‘প্রেমের বস্তু’, স্বয়ং ‘প্রেমিক’ না। বর্তমান যুগে রুবাইয়াৎ এমনভাবে অনুবাদ করা উচিত যাতে নারী বা পুরুষ যে-কেউ সেখানে চালকের আসনে বসতে পারে, নারী যাতে কেবল পুরুষচালিত বাসের যাত্রী না হয়ে যায়।

[২৫] নজরুল:
“স্রষ্টা মোরে করল সৃজন জাহান্নামে জ্বলতে সে,
কিংবা স্বর্গে করবে চালান—তাই বা পারে বলতে কে!
করব না ত্যাগ সেই লোভে এই শারাব সাকি দিলরুবা,
নগদার এ ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?” [১৭২]
‘শারাব সাকি দিলরুবা’ তে ছন্দের ব্যবহারটা ভালো লেগেছে যদিও তা আমি ব্যবহার করতে পারব না।

[২৭] ‘পাঁচ’ দিয়ে পাঁচটি ইন্দ্রিয় (দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ) আর ‘চার’ দিয়ে গ্রিক আর ভারতীয়দের বলা চারটি মৌলিক উপাদান (অগ্নি, বায়ু, মৃত্তিকা, জল) বোঝানো হচ্ছে। সক্রেটিসপূর্ব গ্রিক দর্শনে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চার উপাদানের কথা এসেছিল, আর এরিস্টটল পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ধারণাটিকে পাকাপোক্ত রূপ দিয়েছিলেন। মুসলমানরা ভারত ও গ্রিস থেকে এসব ধারণা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল। চার উপাদানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় প্লেটোর ‘টিমেয়াস’ সংলাপে, যা ইয়োহানেস কেপলারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।

নজরুল:
“ওগো সাকি! তত্ত্বকথা চার ও পাঁচের তর্ক থাক,
উত্তর ঐ সমস্যার গো এক হোক কি একশো লাখ!
আমরা মাটির, সত্য ইহাই, বেণু আনো, শোনাও সুর!
আমরা হাওয়া, শরাব আনো! বাকি যা সব চুলোয় যাক।” [৯২]
এর পাশে আমার অনুবাদটা নিতান্তই বাজে।


মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

চলুক চলুক
এত কিছু জানি না, তবে অনুবাদ বলুন, অনুসৃজন (ট্রান্সক্রিয়েশন) বলুন, 'প্রায় মৌলিক সৃষ্টি' বলুন, আমার কাছে ফিটজেরাল্ডেরটাই সেরা লেগেছে। অন্যগুলি এর ধারে কাছেও লাগেনি তাই পুরো পড়ার ইচ্ছাও হয়নি! অবশ্য আমি ফিটজি-রে ছাড়া আর কোনো অনুবাদ বলতে গেলে পড়িও নাই - পেঙ্গুইন থেকে বেরুনো একটা তথাকথিত "বিশ্বস্ত" ও আধুনিক অনুবাদ হাত দিয়েছিলাম অনেক আগে, প্রথম পৃষ্ঠাটাই টপকাতে পারিনি!!
বাংলায় কোনো অনুবাদই ভাল লাগেনি কেবল খানিকটা নজরুলেরটা ছাড়া - খুব সম্ভবত তাঁর অনুবাদে পারসিক/একজটিক একটা স্বাদ, একতা আমেজ বা মেজাজ বজায় রেখেছেন বলে।

****************************************

শিক্ষানবিস এর ছবি

@মন মাঝি: অনুসৃজনের ধারণাটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ। বিশ্বায়নের চাবিকাঠি যেহেতু কর্পোরেট বিশ্বের হাতে, বর্তমান যুগে অনুসৃজনের মাধ্যমে এক সংস্কৃতির সাথে আরেক সংস্কৃতির সংযোগ সাধনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকারই কথা। ফিট্সজেরাল্ডের কবিতা নিঃসন্দেহে খৈয়াম-অনুপ্রাণিত ইংরেজি কবিতার সেরা নিদর্শন; এর সাথে অন্য কিছুর তুলনা করা আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সাথে হুমায়ুন আজাদকে তুলনা করা এক কথা। তবে আমি ফিট্সজেরাল্ডে শেষ পর্যন্ত শান্তি পাব না, কারণ আমি কাব্যরসের চেয়েও বেশি আগ্রহী খৈয়ামের দর্শনরসে, আর সেই রসের স্বাদ পেতে চাইলে মূল ফার্সি আর মূলানুগ ইংরেজি অনুবাদের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

কর্ণজয় এর ছবি

ফিটসজেরাল্ডের অনুবাদ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অনুবাদ বলে অনেকে বিবেচনা করেন। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, ফিটসজেরাল্ডের ছিল ভাষার দক্ষতা, কিন্তু ছিল না ভাবচিন্তার দর্শন। এবং খৈয়ামের নিজের গভীর ভাব দর্শন প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা ছিল না। খৈয়ামের ভাব দর্শন আর ফিটজেরাল্ডের ভাষাগুণ এই দু্ইয়ে মিলে এই অনুবাদটি শ্রেষ্ঠতম হয়ে উঠেছে।িএ নিয়ে তর্ক থাকবে-
তবে আপনার কথা স্বীকার্য, যে কারণে আপনি ফিটসজেরাল্ড্ভিএ শান্তি পান নি,
কারণ এই ভাষার গুণই হয়তো খৈয়ামকে বুঝতে খৈয়ামের কাছ থেকে নিয়ে যাবে দূরে,
আপনার পোস্ট খৈয়ামকে বুঝতে চান যারা (উপভোগের বাইরেও) তাদের কাজে দেবে।।।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাজারে অনেক রথী-মহারথীর করা খৈয়ামের কাব্যের অনুবাদ পাওয়া যায় (শুধু খৈয়াম নন্‌, হাফিজ-রুমী-হাল্লাজ-আত্তার-গালিব-ত্বকী কে নেই সেখানে!)। সেগুলোর বেশিরভাগ ফিটজেরাল্ড বা অন্য কারো ইংলিশ অনুবাদ থেকে করা বঙ্গানুবাদ। মূল ফারসী থেকে বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি বোধহয় (অন্ততঃ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না)। পূর্বোক্ত বাজারে মেলে এমনসব খৈয়ামের কাব্যের অনুবাদ বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের কারাগারগুলোতে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদেরকে কায়িক শ্রমের বদলে শাস্তি হিসাবে পড়তে দেয়া যেতে পারে। সেগুলোতে ভাষা-অর্থ-শিল্প-দর্শন-কাব্যরস-সাহিত্য মান ইত্যাদির আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়া হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

খৈয়ামি রুবাই নিয়ে এই লেখা কি আরো চলবে? বিশেষ করে শিরোনামে নম্বর দেখে আশাবাদী হচ্ছি। বড় লেখা বলে পড়বার সময় করে উঠতে পারছিলামনা এতোদিন অবশেষে পড়ে ফেললাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

শিক্ষানবিস এর ছবি

আমি ফেসবুকে প্রতিদিন একটা করে রুবাই দিচ্ছি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুবাদ হলে সেগুলো আবার বিষয় অনুযায়ী সাজিয়ে এখানে প্রকাশ করব সম্ভবত। তবে ফেসবুক থেকে প্রতিদিন পড়তে পারেন একটা যদি ইচ্ছা করে। আমার প্রফাইল: https://facebook.com/kmbasad

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।