সম্প্রতি স্কুলে একটা নতুন দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে বসায় আমার বেশিরভাগ সময় কাটছে কলেজ বিল্ডিং এ। কাজটা লম্বা সময়ের যদিও, কিন্তু করতে হয় থেমে থেমে। আর আমাদের স্কুল বিল্ডিংটা থেকে কলেজ বিল্ডিংটা বেশ খানিকটা দূরে। এই কারণে একটু সময় পেলেই দৌড়ে স্কুল বিল্ডিং এ আমার পরিচিত গন্ডিতে আড্ডা দিয়ে কাটাবো সেই উপায়ও নেই। কাজেই এই সময়টাতে আমি বই পড়ি। সিরিয়াস টাইপ বই না। কলেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসি হালকা কোনো বই। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কিছু সাইন্স ফিকশন, হুমায়ুন আহমেদের পুরোনো কিছু বই, এইসব। বেশিরভাগই আগে পড়া বই। এগুলোর পাশাপাশি অন্যের সাথে কথাবার্তায় যোগ দিতেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। গতদিন একটা বই জমা দিয়ে আরেকটা বই নেয়ার জন্য খুঁজছি।
একটা সময় ছিলো, ইমদাদুল হক মিলনের বইগুলো খুব ক্রেজ তৈরি করেছিলো তরুণ সমাজে। হাতে গোনা কয়েকটা বই পড়েছি আমি। খুব বেশি টানতে পারেনি আমাকে তার লেখার ধরন। তবু ইমদাদুল হক মিলনের একটা বই, নাম দেখেই টেনে নিলাম। "বন্ধুবান্ধব"। মনে হলো ট্র্যাডিশনাল প্রেম ভালোবাসা থেকে আলাদা কিছু হবে নিশ্চয়ই। উল্টেপাল্টে দেখি। একটা নাম চোখে পড়লো। মুহম্মদ জুবায়ের। একটা হার্টবিট মিস করলাম। দ্রুত হাতে আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা ওল্টাই আমি। যখন দেখলাম, ইংরেজির ছাত্র। একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করার চেষ্টা করছেন, বুঝলাম আমাদেরই জুবায়ের ভাই। বইটা লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসি।
বন্ধুসভার সক্রিয় এক বন্ধু ছিলো আমার বন্ধু। তার কাছে ইমদাদুল হক মিলনের বন্ধুসভা-বিষয়ক কার্যক্রমের কথা শুনতে শুনতে নামটা আমার কাছে বহুদিন থেকে শুধুই "মিলন ভাই"। দেখা নাই, সাক্ষাত নাই। তবুও মিলন ভাই।
ডুবে যেতে বেশি সময় লাগে না আমার। লেখকের যতো বন্ধুবান্ধব আছে, বইটা তাদেরকে নিয়ে লেখা। আফজাল, হাসান হাফিজ, আলীমুজ্জামান নামগুলো প্রথমদিকে। নামগুলো চেনা। অন্যসময় হলে স্বাভাবিকভাবেই পড়তে পারতাম হয়তো। কিন্তু এখন আমার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে পরিচিত একটা নাম শুধু। অবশেষে পেলাম।
সচলায়তনে এসে প্রথমদিকে জুবায়ের ভাইকে পেয়েছি আমি। কিসব হাবিজাবি লিখেও তার কিছু কমেন্ট পেয়েছি। তখনো ভালো করে জানিই না, ঠিক কতোটা বড়োমাপের মানুষের কমেন্ট পেয়েছি আমি। জানলাম আস্তে আস্তে। এর থেকে কিছু, তার থেকে কিছু। কিন্তু নিজের মতো করে চিনে নেয়ার আগেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন তিনি। তবুও বুঝি, ঠিক কতোটা ভালোবাসা অর্জন করতে পারলে অরূপের মতো অভিমানী মানুষও অভিমান ভুলে বছরে অন্তত একটা দিন সচলে লিখে। আর এই দিনটাতে সচলায়তনের ব্যনারে আটকে থাকা মুখটা আমার ভীষণ প্রিয় মুখগুলোর একটা। অযৌক্তিভাবেই। তাকে আমি আমার মতো করে জানার সুযোগ পাইনি কখনো।
বন্ধুবান্ধব - বইটার কয়েকটা পৃষ্ঠায় আমি চিনলাম জুবায়ের ভাইকে আরো একটু বেশি করে। আমার চোখে লেখালেখির বাইরের নতুন একটা মানুষ।
ছবি দেখে আমার ধারণা ছিলো, তিনি বোধহয় শ্যামলা। নাকি আমি শ্যামলা ছেলে পছন্দ করি বলে সেটা আরোপ করেছি তার ওপর? কে জানে।
মিলন ভাইয়ের লেখায় যে মানুষটাকে পাই, তিনি অনেক ফরসা, লম্বা, জীবনীশক্তিতে ভরপুর টগবগে এক যুবক। একইসাথে চঞ্চল আর উদাসীন। খামখেয়ালি।
জানলাম ভার্সিটি লাইফের কথা। সূর্যসেন হল। রুম নাম্বার ২১৭। (নাকি ২৭০ পড়লাম?) রাতভর জমিয়ে আড্ডা। এক কাপ চা তিন-চারজন ভাগ করে খাওয়া। হোস্টেলে রাতের বেলা যখন সব সিগারেট শেষ, সবগুলো সিগারেটের ফেলে দেয়া অংশ খুলে নতুন করে বানিয়ে আবার খেতেন। বন্ধুদের সাথে ভাগ করে। অসম্ভব সিগারেট খেতেন। কাশতেন সেই তখন থেকেই। তবুও খেতেন। সমস্যাটা তখনো এতোটাই বেশি ছিলো যে, পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা মানুষের কাশি শুনে সামসুন্নাহার হলে থাকা তার বোন দিব্যি বুঝে ফেলতে পারে, রাত এগারোটার দিকে ওই পথে হেঁটে গেছে তার বড়ো ভাই, মুকুল ভাই। মানা করতো অনেকেই। কিন্তু তিনি যা করবেন, করবেনই।
একদিন মনে হলো, মোটরসাইকেল কিনবেন। টাকা ধার চাইলেন এক বন্ধুর কাছে। ত্রিশ হাজার। তখনো তো স্টুডেন্ট ওরা। দিতে পারলো না সে। কয়েকদিন পর সেই বন্ধুর চোখের সামনে দিয়ে ঠিকই বাইক চালিয়ে গেছেন তিনি। হঠাত মনে হলো, একটা দোকান কিনে ফেলবেন। টাকা ধার চাইলেন। সেই সময়ে সত্তর হাজার টাকা বের করা চাট্টিখানি ব্যাপার ছিলো না। দিতে না পারলে কী হবে। কয়েকদিন পরে দেখা গেলো, দোকান কিনে ঠিকই সেটাতে জমিয়ে বসেছেন তিনি। খামখেয়ালি বলে এসব ছেড়ে দিতেও সময় লাগেনি তার। আর আমেরিকা থেকে ফিরে যার যার টাকা, পাই পাই মিটিয়ে দিতেও ভোলেননি তিনি।
তীব্র অভিমান। উঠতি বয়সে যা হয়, কয়েক বন্ধু আড্ডায় মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়লো। ওই অবস্থায় তো আর বাসায় যাওয়া যায় না। মিলন ভাই আর আরেকজন, এসে উঠলেন জুবায়ের ভাইয়ের একা বাসায়। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখলেন, সেদিনই মাত্র বগুড়া থেকে তার বাবা-মা এসেছেন বাসায়। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। যদিও রাতে থাকার ব্যবস্থা উনি করলেন, কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগেনি তার। এতোটাই, যে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন মিলন ভাইয়ের সাথে। এমনকি শাহিন ভাবীকে যখন বিয়ে করলেন, তাকে জানাননি পর্যন্ত। বড়ো মানুষদের অভিমানও এতো বড়ো হয়!
এই অভিমান ভাংতে সময় লেগেছে অনেক বেশি। কিন্তু ভেঙ্গেছে। বন্ধু তো! ডালাসের এলেনে ছবির মতো সুন্দর একটা বাড়ির বর্ণণা যখন পড়ি, সেটা কি আমিও দেখতে পাই না? টিপটপ করে সাজানো একটা বাড়ির সারাঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সাইজের ডাইনোসর। খেলনা। অর্ণবের সবচে প্রিয় জিনিস। ওগুলো দেখিয়ে হাসতে হাসতে তিনি যখন মিলন ভাইকে বলেন, "অর্ণবের এইম ইন লাইফ, সে বড়ো হয়ে ডাইনোসর হবে", আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিতৃপ্ত একটা শান্ত মুখ দেখতে পাই। মিলন ভাইকে সেবার হোটেল থেকে কিডন্যাপ করে দশদিনই তিনি তার বাড়িতে রেখেছিলেন। ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন পুরো শহরের বিখ্যাত সব জায়গা।
কে কী বললো বা ভাবলো, সেটা নিয়েই কি কখনো ভেবেছেন তিনি? ভাবলে, হাফপ্যান্টে টিশার্ট গুঁজে, কেডস পায়ে দিব্যি একগাদা ফরমাল মানুষের মধ্যে তাদের প্রশ্নবোধক চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না। করতেন সেটাই, যেটা করতে তার ভালো লাগে।
আরেকটা ঘটনা শুনে অবাক হয়েছি, মজাও পেয়েছি। কোনো একটা আড্ডায়, মিলন ভাইয়ের এক বান্ধবী, নামটা নাহয় না বলি, একটা ফুল নিয়ে এসে মিলন ভাইয়ের হাতে দিলেন। তারা বেশ কয়েকজন বন্ধু ওখানে দাঁড়িয়ে। মিলন ভাই এক এক করে সবার হাতেই ফুলটা একবার করে দিলেন, তাতে করে সবারই পাওয়া হবে। সবশেষে জুবায়ের ভাইয়ের হাতে যখন পৌঁছালো, তিনি ওটাকে হাতে নিয়ে সোজা ছেড়ে দিলেন, জুতোর কাছাকাছি হতেই সেটাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলেন। আমি এটা নিয়ে একটু ভাবলাম।কী চলছিলো তার মনে ওই মুহুর্তে? মুডি? কোনো কারণে মুড নিশ্চয়ই ভালো ছিলো না তার! কিংবা কে জানে, অতো হাত ঘুরে আসা জিনিস হয়তো তার পছন্দ নয়।
জুবায়ের ভাইয়ের সবকিছু নিয়েই আমার ভেতর বাড়াবাড়ি রকম মুগ্ধতা কাজ করে। কবে থেকে এরকম, সচেতনভাবে বুঝিনি কখনো। শুধু তার ছবিটা দেখার পর যখন আর কিছু পড়তে কষ্ট হয়, একটু একটু বুঝতে পারি, কিছু একটা সমস্যা আছে। আর, সবকিছুর ব্যাখ্যা হয় না।
সস্ত্রীক আনিস ভাই বগুড়া থেকে যাবেন ঢাকায়। আমি যাবো স্কুলে। স্কুলে নামিয়ে দেবেন বলে রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নেন তিনি। মাঝখানে তুলে নেবেন আরো একজনকে। ভাবীর সাথে গল্প করতে করতে আমরা মাঝখানে পৌঁছাই। আনিস ভাই বাড়িটার সামনে থামেন। বাড়িটা আমার কল্পনার সাথে মেলেনি। ভেবেছিলাম, কোনো নির্জন একটা জায়গায় প্রচুর গাছপালায় ঘেরা একটা বাড়ি হবে। এই বাড়ির বর্ণণা কেউ আমাকে দেয়নি। তবু কেন ওরকম ভেবেছিলাম, কে জানে। আমার মুগ্ধতায় ভাটা পড়ে না বিন্দুমাত্র। জানালার কাচে মুখ লাগিয়ে দেখতে থাকি আর ভাবতে থাকি। জুবায়ের ভাইয়ের বাড়ি! একটু পরে যাকে তুলে নেয়ার কথা, তিনি আসেন। আনিস ভাই পরিচয় করিয়ে দেন। শাহিন ভাবী। মেহবুবা জুবায়ের। তার নিজস্ব অস্তিত্ব ছাপিয়ে আমি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, জুবায়ের ভাইয়ের বউ!
আরেকটা ব্যাপার। মিলন ভাই যখনই কোনো কথার পর তার হাহা করে হাসির বর্ণণা দিয়েছেন, তাতে মুগ্ধতার প্রকাশ এমন ছিলো, যে আমি আমার ভেতর একধরনের তীব্র তৃষ্ণা অনুভব করেছি। অদ্ভুতভাবেই। ভীষণ রকম একটা মিসিং ফিলিং। আনিস ভাইও হাহা করে মন খুলে হাসেন। হাসির শব্দ দিয়েই তিনি আনন্দটা অনেকটা সময় জুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারেন। তিনিও কি ওরকম করে হাসতেন? নাকি আরো অনেক বেশি সুন্দর করে? আমি আর জানবো না কখনো।
জুবায়ের ভাইয়ের অংশটুকু পড়ে বইটা সরিয়ে রাখি আমি। ভারী লাগে ভেতরে। আর কিছু পড়ার নেই...
মন্তব্য
কিছু মানুষ না চেনা হয়েও অসম্ভব রকমের চেনা। সকাল সকাল মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
আমার কী যে আফসোস এই মানুষটার সাথে পরিচিত না হবার! কী যে আফসোস!
মাসুদ বা আনিস ভাইকে কখনি সেটা বলতে পারিনা। ভাবীকেও পারিনাই!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
সচলে জুবায়ের ভাইকে ভীষণ মিস করি
আমি সচলে আসার আগেই জুবায়ের ভাই চলে যান। ওনার লেখাগুলো পড়ি আর বুঝতে পারি কেমন একটা মানুষকে আমরা হারিয়েছি।
জুবায়ের ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করি।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
মিলন ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডায় মাঝে মধ্যেই জুবায়ের ভাইয়ের কথা আসে, অনেক গল্প শুনি। সারোয়ার ভাই, অরুণদার কাছেও শুনি এসব গল্প। সদ্য প্রয়াত হুমায়ুন ফরিদী ভাইও জুবায়ের ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই লেখাটা পড়ে স্থির থাকা যায় না। এই লেখাটা পড়ে আর ভালো থাকা হয় না।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আসলেই!
বইটা পড়ার আগ্রহ হচ্ছে। খুঁজে দেখতে হবে পাওয়া যায় কি না।
এবার দিয়ে অনেকবার তোমার লেখাটা পড়লাম, শিমুল। প্রতিবার পড়া শেষ করে ভেবেছি একটা কিছু লিখি। একটা কিছু মন্তব্য করি, কিন্তু তোমাকে বলার জন্য এতো এতো কথা, সব একসাথে, এমন করে ঝাপিয়ে পরেছে যে, কী ছেড়ে কী লিখবো, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
'ও' না থেকেও আমার সবটা জুড়ে আছে, সেটাই থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সারে তিন বছর পরও (সামান্য কজন সচল ছাড়া) সম্পূর্ণ অদেখা, অচেনা জুবায়েরকে তোমরা যে ভাবে তোমাদের মাঝে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় বাচিয়ে রেখেছো সেটাকে আমি কী বলবো? অস্বাভাবিক! অসাধারণ! অবিশ্বাস্য! আমি জানিনা, আমি সত্যিই জানিনা। শুধু এটুকু জানি জুবায়ের চলে গেছে কিন্তু আমাকে দিয়ে গেছে সচালয়তন নামে একটি অসাধারণ রত্নভান্ডারের চাবি। যে রত্নদের সান্নিধ্যে আমি আমার জীবনের শেষ কটা দিন কাটাতে পারলে নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবতি মনে করবো।
ভালো থেকো তোমরা সবাই।
--------------------------------------------------------------------------------
......
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
নতুন মন্তব্য করুন