আলোচনার দ্বিতীয় ভাগ ।। নিঝুমের গল্প এপিটাফ

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৩/২০০৮ - ৯:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাঠকের মতামত

ব্লগের সবচে বড় সুযোগ হলো যেকোনো লেখা সম্পর্কে পাঠকের দ্রুত মতামত পাওয়া যায়। নিঝুমের গল্প পড়েও বেশ কিছু ব্লগার তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন। তাতে প্রশংসাই প্রধান কিন্তু গল্প, গল্পের বিষয়, চরিত্র, ইত্যাদি নিয়ে গভীর কোনো আলোচনায় কেউ যান নাই।

এপিটাফ গল্পটা পড়ে চারজন বলেছেন তাদের ভালো লেগেছে বা গল্পটা ভালো হয়েছে। দুজন বলেছেন অসাধারণ।

একজন তার লেখায় হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব খুজেঁ পেয়েছেন। আনোয়ার সাদাত শিমুল, যিনি নিজেও গল্প লেখেন, বলেছেন, ‘আপনার গল্প বলার ধরনের প্রশংসা আগেও করেছি।
এটিও চমৎকার লাগলো। তবে মতি হত্যার মূল রহস্য আরেকটু আনা/টানা যেতো
’।

কোনো সন্দেহ নাই নিঝুমের ভাষা খুব স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। সেইসাথে তার বাক্য ও দৃশ্যকল্পনার মধ্যে লুকানো থাকে অনেক রস ও মজা। পাঠক রস ও গতির দোলায় দ্রুতই পৌছেঁ যান গল্পের শেষে। কিন্তু পরিপূর্ণ তৃপ্তি কি পান?

গল্পের আবহ বা ব্যঞ্জনা কি পাঠকের মনে স্থায়ী হয়? পাঠক কি বুঁদ হয়ে থাকেন? নাকি কাহিনী সম্পর্কে দেখা দেয়া নানা প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পাঠক দ্রুত বের হয়ে আসেন গল্পের তৈরি করা দুনিয়া থেকে? এখানেই লেখকের স্বার্থকতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি লুকিয়ে আছে।

এপিটাফ: কিসের গল্প

গল্প মানুষ বলছে সেই আদিকাল থেকে। সুতরাং নানা কারণে নানা উদ্দেশে মানুষ গল্প বলে। বলতে বলতে প্রায় সব সম্ভাব্য গল্পই মানুষ বলে ফেলেছে। সুতরাং পুরনো গল্পকে নতুন ভঙ্গিতে পরিবেশন করতেও শুরু করেছে মানুষ। আবার গল্প বলার ভঙ্গি নিয়ে এতো নিরীক্ষা হয়েছে যে, গল্প বলতে শুরু করে কিছুই না বলাটাকেও গল্প বলে দাবী করেছেন পৃথিবীর অনেক আলোড়ন জাগানো লেখকেরা।

এসব বিবেচনায় নিঝুমের গল্প সাধারণ পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখা সাদামাটা ভঙ্গির গল্প। গল্প বলার ভঙ্গির মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। যদিও গল্পটি কাল অনুসরণ করে একটা সময়ে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে শেষের দিকে এগিয়ে যায় না। মূলত: যে বাস্তবতায় গল্পটি শুরু হয়েছিলো ঠিক সে জায়গাতেই গল্পটা শেষ হয়ে গেছে। মাঝে আমরা পাই মূল চরিত্রের কিছু স্মৃতিচারণ এবং যদিও গল্পটা স্বেচ্ছায় ফাঁসিতে ঝুলতে চাওয়া এক পিতার গল্প কিন্তু শেষে এসে লেখক তার বিপরীত সিদ্ধান্তকে তুলে ধরেন, ‘মজিদের কাছে জীবনটাকে খুব একটা খারাপ লাগে না’

(আরো ধারালো হওয়া উচিত ছিল শেষ বাক্যটা। গল্প লেখক সম্ভবত: গল্পের পরিণতি নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন না।)

যখন কারো মনে হয় আমার একটা বলার বা লেখার মত গল্প আছে তখন সবারই উচিত নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে নেয়া যে গল্পটি কিসের। এর মূল বিষয় কি? জনপ্রিয় ধারার লেখকরা জোর দিয়ে বলেন যে, গল্পটাকে যদি এক লাইনে বলা না যায় তবে গল্পে গলদ আছে। অর্থাত্ এধরনের গল্প পড়ে পাঠক তৃপ্ত হবেন না।

নিঝুমের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম একই জিনিস? এপিটাফ কিসের গল্প? নিঝুম জানিয়েছেন:

সত্যি কথা বলতে আমি এই গল্পের মাধ্যমে পাঠক দের জন্য কোন মেসেজ দেই নি বা দিতে চাই নি। শুধু একজন পরাজিত, সবহারা মানুষের গল্প বলে যেতে চেয়েছি আর কেবল এই পরাজিত ফাঁসির আসামীর জীবনের শেষ কয়েক ঘন্টা স্মৃতিময় করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছি ।

গল্পপাঠ শেষে পাঠকরাও যদি মোটামুটি লেখকের সাথে গলা মেলান তবে তো হয়েই গেল। অন্তত: গল্পের মূলভাব এ মাথা থেকে যোগাযোগের দড়ির ঐ মাথায় পৌঁছালো। লেখক থেকে পাঠকের কাছে।

কাহিনীর উন্মোচন

মূলভাব জানা গেল। এখন দেখা যাক লেখক এই মূলভাব তার মাথা ও মন থেকে পাঠকের হৃদয়ে চালান করে দেয়ার জন্য কী উপায় ও পদ্ধতি নিয়েছেন নিঝুম। সেইসাথে এও জানা হয়ে যাবে লেখক এই চালানের কাজটি কতটা দক্ষতার সাথে করতে পেরেছেন। আমরা এও ভেবে নেব মনে মনে কী করলে কাজটা আরো সফলভাবে করা সম্ভব হতো।

মশাটাকে অনেক্ষন ধরে মারার চেষ্টা করছে মজিদ। মারাটা ঠিক হবে কি না এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা এই মুহূর্তে খুব জরুরী।

মশাটাকে মারা ঠিক হবে কি হবে না এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সংকট উত্থাপন করে নিঝুম শুরু করে দেন এক ফাসিঁর আসামীর শেষ কিছু সময়ের বর্ণনা।

প্রশ্ন হচ্ছে এই বিষয়ের গল্পের জন্য এটাই কি যথার্থ শুরু। একজন লেখককে এটা নিয়ে ভাবতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিল্পে অনেককিছুই স্বত:স্ফূর্ত। কিন্তু সেই স্বত:স্ফূর্ততা পাঠ ও চর্চার এক অভিজ্ঞতার ফলে তৈরি হওয়া অবচেতনের এক যৌক্তিক ছন্দের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে।

শিল্পীর কোনো তুলির আঁচড়ই তার ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরে পড়ে না। কবিতার একটা শব্দ এমনকি কমাও কবি নানাভাবে ওজন-বিবেচনা ছাড়াই জুড়ে দেন না। গল্প সেরকমই একটা শিল্প সৃষ্টি। এখানেও স্রষ্টা কথার জাল দিয়ে আবিষ্ট রেখে তার পরিকল্পিত পথেই পাঠককে চালিত করেন পরিণতির দিকে। প্রতিটি তৈলচিত্রের নিচেই থাকে শিল্পীর খসড়া স্কেচ। তার ওপরেই রং চড়ে। গল্পের চূড়ান্ত রূপের আগেও সেরকম লেখক তৈরি করেন একটা কাঠামো -- তার বিবেচনায় সবচে কার্যকর ছক-- যেভাবে কাহিনীটি উন্মোচন করলে পাঠককে বেশি নাড়া দেয়া যাবে।

গল্পের এই পরিকল্পনা বা ছক সব লেখক যে খাতায় দাগ কেটে করেন এমন নয়। অভিজ্ঞ লেখকরা তাদের মনেই ছকটা নাড়াচাড়া করে মানসচক্ষেই গল্পটাকে ভিডিওর মতো এডিট করতে পারেন। তবে নবীন লেখকদের জন্য প্রাথমিকভাবে অন্তত: কয়েকটা গল্প এরকম ছক কেটে ঠিক করে নেয়া দরকার।

অনেক লেখকই তা করেন না। ফলে তারা তাদের প্রিয় লেখক, চেনা গল্পের ছক ব্যবহার করেন নিজের অজান্তেই। সুতরাং এসব রচনাও এক ধরনের অনুকরণ হয়, সৃষ্টি হয় না।

নিঝুম জেনে বা না-জেনে, সচেতন বা অসচেতনভাবে, যে গল্পের ছক ব্যবহার করেছেন তা খুলে-মেলে দেখা যাক।

শুরুটার কথা আমরা পড়েছি. মশা মারা বা না মারার দ্বন্দ্ব। প্রতীকি কী? বিশ্লেষকের মন নিয়ে ভাবুন।

একজন খুনের আসামী যার ফাসিঁ হতে আর ছয় ঘন্টা চল্লিশ মিনিট বাকী। লেখক তার ভাষায় একজন পরাজিত ব্যক্তির স্মৃতিময়তার গল্প করতে বসেছেন। সুতরাং সময়ের কথা উঠতেই তিনি শ্বশুরের কিনে দেয়া ঘড়ির কথা পাড়েন। এই অংশটুকু পরিণতি পায় দোকানদারের এই বাক্যে যে, মজিদের এখনো স্পষ্ট মনে আছে দোকানদার পেছন থেকে “শালা খবিশ বুইড়া” বলে গাল দিয়েছিলো

একজন পরাজিত, শীঘ্র ফাসিতেঁ ঝুলতে যাবে এমন মানুষের মনে ঘড়ির এই গল্প মনে পড়তেই পারে। কিন্তু এত শত শত স্মৃতির মাঝ থেকে কোনগুলো লেখক তার পাঠককে শোনাবেন তার ভিত্তিতেই গল্পের মূল আবেদনটা তৈরি হবে পাঠকের মনে।

দেখা যাক, নিঝুম কীভাবে সাজিয়েছেন তার গল্প।

চারটা ভাগ করেছেন নিঝুম তার গল্পের।

১. প্রথম অংশে তিনি পাঠককে জানান মজিদ ও তার শ্বশুরের কিনে দেয়া ঘড়ির স্মৃতি। যৌতুক বিরোধী নাটকে তার অভিনয়। তার বাবার ভুল সময় বলা এবং মজিদের সেটা সংশোধন না করা।

২. দ্বিতীয় অংশের শুরুতেই আমরা জানতে পাই, মজিদের প্রায় সময়ই কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা। সে কারণে মিথ্যা সাক্ষ্যে তার ফাসিঁর আদেশ হয়ে গেলেও সে মুখ খোলে না। মিথ্যা মামলার সাক্ষী নিজের বউ আয়েশাকে সে কিছুই বলে না। তার পর কোর্টদৃশ্য থেকে লেখক আমাদের নিয়ে যান আয়েশার সাথে মজিদের প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্যে। এরপর আয়েশাকে ভাবী ভাবী বলতো এমন এক বাবুলের প্রসঙ্গ এনেই লেখক অসমাপ্ত রেখে দেন বাক্য - অথচ এই বাবুলই… দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে মজিদ।

৩. গল্পের তৃতীয় অংশে এসে লেখক জেলসুপারের মুখোমুখি দাঁড় করান মজিদকে। তুলে দেন তাদের কথোপকথন। (এ আলোচনার প্রথম পর্বে এ অংশ থেকেই উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে)। এই অংশেই মজিদ জানায় যে বাবার ফাঁসির কথা মনে হলে তার ভয় লাগে। (পাঠক হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে সেই লোক কিনা নিজের ইচ্ছায় সাজা মাথায় নিয়ে ফাসিতেঁ মরতে আসলো। লেখকের মনে এই প্রশ্ন দেখা দেয় না। এর উত্তরও তিনি গল্পে দেন না।)

৪. শেষ অংশে লেখক মজিদের মৃত্যুভয়কেই আরো বিস্তৃতি দেন। পীর দাদাজানের সূত্রে কিছু দার্শনিক কথাবার্তার পরই লেখক আবার কাহিনীতে ফিরে আসেন, মজিদের হঠাত করে খুব আয়েশা কে দেখতে ইচ্ছে হয়।আচ্ছা আয়েশা কি করে এখন? সে কি জানে আজকে তার ফাঁসি? মজিদের খুব পানির তৃষ্ণা পেতে থাকে। মশাটাও খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে। পিন পিন পিন পিন…
তারপর মজিদ দিবাস্বপ্ন বা দু:স্বপ্নের ধোঁয়াশার মধ্যে ঢুকে যায়। দেখতে পায় প্রিয় কিছু দৃশ্য। এবং মজিদ যখন তার নিহত পুত্র মতিনকে নিয়ে ছড়া কাটছে তখন লেখক গল্পের শেষ বাক্যটি লিখে ফেলেন, মজিদের কাছে জীবন টাকে খুব একটা খারাপ লাগে না।

এই হলো সংক্ষেপে নিঝুমের এপিটাফ গল্পের ছক। একজন ফাসিঁর আসামীর জীবন নিয়ে স্মৃতিকাতরতা। লেখকের বাছাইতে স্মৃতির উপাদান হিসেবে আমরা পাই হাতঘড়ি, শ্বশুর, মশার পিন পিন, আয়েশার দৃষ্টি, বাবুলের ভাবী ডাক, মজিদের কথা বলতে ইচ্ছা না হওয়া, মজিদের বাবার ফাসিঁ, দাদাজান। এর সাথে জেলসুপারের প্রশ্ন নিয়ে তৃতীয় অংশ।

ফাসিঁর আসামীর স্মৃতিময়তাকে পাঠকের মনে চালান করে দেয়ার জন্য এসব দৃশ্যকল্প, এসব চরিত্র, ডিটেইলস্ কতটা যথার্থ। এসবের বিকল্পই বা কী কী বিষয়বস্তু ছিল এ নিয়ে লেখকের নিজস্ব একটা ভাবনা-চিন্তা-বিশ্লেষণ থাকা জরুরি।

দৃশ্যকল্প, চরিত্র, নানা ডিটেইলসের গভীরে গল্পের একটি প্লট আছে। এপিটাফ গল্পে সে প্লট নেপথ্যের বিষয় হলেও পাঠকের কাছে তা কম জরুরি নয়। মজিদ তার পুত্রকে মারার দায়ে দোষী হয়েও মামলায় মুখ খুলে না। দোষ মেনে নেয়। কেন? এ বিষয়ে লেখক নীরব। বাবুলের সাথে আয়েশার সম্পর্কের একটা ইঙ্গিত আছে কিন্তু কেন বা কোন পরিপ্রেক্ষিতে তা মতিনের মৃত্যুর কারণ ঘটালো। সেই মৃত্যুর দায় কেন মজিদের ওপর বর্তালো। সে দায় কেন সে অস্বীকার করলো না – এরকম বেশ কিছু প্রশ্ন অবধারিতভাবেই এসে যায়।

আনোয়ার সাদাত শিমুল ছোট্ট করে সেরকম একটা প্রশ্ন করেছেন তার মন্তব্যে। এসব প্রশ্নের জবাব যে লেখককে গল্পে সরাসরি দিতেই হবে তা নয়। কিন্তু গল্পের উপাদান, দৃশ্যকল্পে, বর্ণনায় এমন যথেষ্ট তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উচিত যা থেকে পাঠকরা ভূল-শুদ্ধ একটা অনুমান তৈরি করতে পারে।

সমস্যা হলো প্লটের এসব গুরুত্বপূর্ণ উত্তর যদি না পাওয়া যায় তখন পাঠক ধৈর্য হারায়, লেখকের ওপর আস্থা হারায়। লেখক যেখানে ডট ডট ডট দিয়ে নীরব হয়ে যান সেটাকে তার কল্পনা শক্তির বা সৃজনশীলতার অভাব বলে মনে হয়।

লেখক পাঠককে যেটুকু বলেন সেটুকুই পূর্ণাঙ্গ গল্প নয়। লেখক অতিঅবশ্যই এর চেয়ে বেশি জানেন কাহিনীটা। কিছুটা তিনি বলেন সরাসরি কিছুটার ইঙ্গিত দিয়ে যান পাঠকের বুঝে নেয়ার আশায়। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই নেপথ্যের কাহিনী লেখকের মনে স্পষ্ট থাকতে হয়। তা যদি না থাকে তবে গল্পের অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলতা দেখা দেবে। তার তখনি গাঁজার নৌকা পাহাড় বেয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এসব কারণেই নিঝুমকে অতি অবশ্যই জানতে হবে মতিনকে কে হত্যা করেছিলো, মজিদ কেন চুপ হয়ে যায় বা ইত্যাকার জরুরি সব প্রশ্নের উত্তর। ফাসিঁর আসামীর স্মৃতিচারণ শোনার আগে যে কেউ জানতে চাইবে কেন তার মৃত্যুদন্ড হয়েছে। নিজের পুত্রের খুনির গল্প শুনলে মানুষ জানতে চাইবে কেন সে তা করলো। নিঝুমের গল্পে এর কোনো গ্রহণযোগ্য ইঙ্গিত নাই। যা তার প্লটের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। প্লটের সংকটকে সমাধান না করাটা হচ্ছে তার পরিশ্রমবিমুখতা।

পরের খসড়ায় যদি পাঠকের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন নিঝুম তবে ঐ খসড়াটাই আমরা পড়তে চাইবো। আর লেখক যদি নিজেও এসব প্রশ্নের উত্তর না জানেন তবে এটা লেখকের এরকম গুনাহ বলেই মানতে হবে।


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

ভীষণ উপকৃত হলাম পুরো আলোচনায়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

শিল্পীর কোনো তুলির আঁচড়ই তার ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরে পড়ে না। কবিতার একটা শব্দ এমনকি কমাও কবি নানাভাবে ওজন-বিবেচনা ছাড়াই জুড়ে দেন না। গল্প সেরকমই একটা শিল্প সৃষ্টি। এখানেও স্রষ্টা কথার জাল দিয়ে আবিষ্ট রেখে তার পরিকল্পিত পথেই পাঠককে চালিত করেন পরিণতির দিকে। প্রতিটি তৈলচিত্রের নিচেই থাকে শিল্পীর খসড়া স্কেচ। তার ওপরেই রং চড়ে। গল্পের চূড়ান্ত রূপের আগেও সেরকম লেখক তৈরি করেন একটা কাঠামো -- তার বিবেচনায় সবচে কার্যকর ছক-- যেভাবে কাহিনীটি উন্মোচন করলে পাঠককে বেশি নাড়া দেয়া যাবে।

গল্পের এই পরিকল্পনা বা ছক সব লেখক যে খাতায় দাগ কেটে করেন এমন নয়। অভিজ্ঞ লেখকরা তাদের মনেই ছকটা নাড়াচাড়া করে মানসচক্ষেই গল্পটাকে ভিডিওর মতো এডিট করতে পারেন। তবে নবীন লেখকদের জন্য প্রাথমিকভাবে অন্তত: কয়েকটা গল্প এরকম ছক কেটে ঠিক করে নেয়া দরকার।

অনেক লেখকই তা করেন না। ফলে তারা তাদের প্রিয় লেখক, চেনা গল্পের ছক ব্যবহার করেন নিজের অজান্তেই। সুতরাং এসব রচনাও এক ধরনের অনুকরণ হয়, সৃষ্টি হয় না।

-- ক্লাসিক!!

আগের পর্বে শিমুল ভাইয়ের দাবীটার প্রতি জোরালো সমর্থন জানাই। এ ধরণের বিশদ বিশ্লেষণে সিনিয়র যাঁরা আছেন তারা আরো এগিয়ে আসবেন সেই প্রত্যাশা করছি হাসি

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

দাবীর সাথে গলা মিলাই।
বিরাট বিশ্লেষণ না হোক, একটু যাচাই-বাছাই, বিচার-বিবেচনার পথে আমাদের হাঁটা উচিত।
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অতিথি লেখক এর ছবি

আগের পর্বে মন্তব্য করতে যেয়ে একটু ভুল বুঝাবুঝি হলো ! লেখক নিঝুম ধরেই নিয়েছেন যে , আমি বলতে চাইছি ,তার লেখায় কূহক ও বিভ্রমে ঠাসা !!
নিঝুম , আমি আসলে বলতে চেয়েছি সেই কূহক ও বিভ্রমের কথা , যার চক্করে পড়ে নিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছি , আপনার আমার মতো নবীন সাহিত্য-যশোপ্রার্থীরা !
সাহিত্য যে করে খাওয়ার বিষয় নয়,নয় মজাখোর পাঠকের মনোরন্জনের কসরত -- এই বিষয়টা বুঝে গেলেই ভলো ।
সাহিত্য যদি কিছু হয়েই থাকে তো , সেটা পাঠককে ভাবনা ও প্রবেশের জায়গা করে দেয়া । ভালো থাকুন নিঝুম । ভালো লিখুন ।

ধন্যবাদ শোহাইল মতাহির চৌধুরী আপনাকে ও । নিরন্তর চলুক এমন বিশ্লেষন । তাতে লাভ লেখক /পাঠক দু'পক্ষেরই ।

অরিত্র আন্দালিব

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

এক-আধটু ভুল বুঝাবুঝি হওয়া দোষের না। তাতে পরষ্পরকে বুঝার সুযোগটা খুলে যায়।
শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শেখ জলিল এর ছবি

সচলদের লেখা নিয়ে একমাত্র বিশ্লেষক শোহেইল মতাহির চৌধুরী...আবারও অভিবাদন।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ।
শিমুলের নতুন গল্পটার বিষয়ে কয়েক লাইন মন্তব্য দিয়ে এসেছি। বিশেষত: আপনি শিমুলকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন সে প্রেক্ষিতে মন্তব্যটা পড়ে দেখতে পারেন।
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নিঝুম এর ছবি

শোহেইল ভাই কে অনেক ধন্যবাদ এত সময় নিয়ে,শ্রম দিয়ে এপিটাফ পল্পের উপর এই ধরনের একটা লেখার জন্য।

আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম এই লেখাটা সম্পর্কে বা পালটা যুক্তি দিয়ে কিছুই লিখব না।মজিদের মত আমারও প্রায় কিছু বলতে ইচ্ছা করে না।

একটা ভুল শুধু সংশোধন করে দিতে চাই, শোহেইল ভাই লিখেছেন,

এই অংশেই মজিদ জানায় যে বাবার ফাঁসির কথা মনে হলে তার ভয় লাগে। (পাঠক হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে সেই লোক কিনা নিজের ইচ্ছায় সাজা মাথায় নিয়ে ফাসিতেঁ মরতে আসলো। লেখকের মনে এই প্রশ্ন দেখা দেয় না। এর উত্তরও তিনি গল্পে দেন না।)

আমার গল্পে মজিদের বাবার কিন্তু ফাঁসি হয়নি। এবং সে কথা মনে করেও তার ভয় লাগার প্রশ্নও আসে না। জেল সুপার হাসেম রব্বানী'র বাবা'র ফাঁসি হয়েছিলো।

আমি এপিটাফ থেকে ওই অংশ টুকু নীচে দিয়ে দিলাম-

কোনো আসামীর ফাঁসির সময়ের খবর পেলে হাসেম রব্বানী’র সবসময়ি জানতে মন চায় ,এখন তার কেমন লাগে? কিন্তু কোনভাবেই এই প্রশ্ন কাউকে করা সম্ভব না।মানুষ তাকে পাগল মনে করবে।কিন্তু মজিদ কে মনে হয় জিজ্ঞেস করা যাবে।সে হয়ত কিছু মনে করবে না। হাসেম রব্বানী প্রতিটি ফাঁসীর আসামীরই চোখের দিকে তাকায়।সবার চোখই কেমন জানি ঘোলাটে আর আবেগ শূন্য লাগে।মানুষ গুলো কেমন যেন স্থিতু হয়ে যায়।আচ্ছা, তার বাবার যখন ফাঁসি হয়েছিলো ষেশ মুহূর্তে তার কেমন লেগেছিলো?

হাসেম রব্বানীকে সম্পূর্ন অবাক করে দিয়ে মজিদ বলে উঠে, ভয় লাগে স্যার। ভয় লাগে।

আমি গল্পবাজ মানুষ। গল্প বলি।বলে যাই। আমার লেখার বিশদ বা গল্প পড়ে শোহেইল ভাইয়ের অনুভূতি জানলাম ।আমার কাছে এই জানা টা একটা বড় পাওয়া।আমার সামনেরর দিকের লেখাগুলো'র জন্য হয়ত বা খুব কার্যকর হবে।

আমি সামান্য ,অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ।যে কি না দিন শেষে নিজেকে একজন "লেখক" এই অযাচিত সান্তনা নিয়ে, বিশ্বাস করে আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যায়।যে কিনা মনে করে যদি অন্তঃত একজন মানুষও এই অধমের লেখাতে কিছু খুঁজে পায় তাতেই এই অভাজন নিজেকে স্বার্থক মনে করে।

সবাইকে ধন্যবাদ যারা পড়লেন,পাশে থাকলেন।আর শোহেইল ভাইকে আর একবার ধন্যবাদ।

এই রকম একজন বড়ভাই থাকলে নিজেকে ছায়াহীন মনে হয় না।

--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।