দিনের শ্লেট: ১৮ জুলাই: বইয়ের বোঝা

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বুধ, ১৮/০৭/২০০৭ - ১১:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
১.
লন্ডনের নতুন ঝকঝকে লাইব্রেরিটা বাঙালি পাড়ায়। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের হোয়াইটচ্যাপেলে। আইডিয়া স্টোর নামের ভিন্ন ঘরানার এই লাইব্রেরির আইডিয়াটাই এই কাউন্সিলের। বাঙালিরা এরকম একটি কৃতিত্বের সাথে জড়িত। ভাবতে ভালো লাগে। সাথে সাথে মনে হয় সিরাজগঞ্জের কথা। ইসমাইল হোসেন সিরাজির বাড়িতে একটা নামমাত্র লাইব্রেরি আছে। বইয়ের দোকানগুলোয় দুয়েকটা জনপ্রিয় ভারতীয় উপন্যাস ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বাইরের কোনো বই নেই। বাংলাদেশের জেলাশহরগুলোয় ছেলেমেয়েরা কী পড়ে?

২.
এখানে আমার বাসার সামনে আরেকটা আইডিয়া স্টোর আছে।লন্ডনে মোট ছয়টা আইডিয়া স্টোরের একটা। এরা শুধু লম্বা লম্বা শেলফে বই জমিয়ে রাখে না। আকর্ষণীয় স্থাপত্য এর, ভেতরটা সাজানো দামী ব্র্যান্ডের দোকানের মতো। আছে অডিও, ভিডিও, বাচ্চাদের জন্য বিশেষ কর্নার, সারাক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা, বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সুযোগ। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ঠেলে পাঠাতে আইডিয়ার যোগান দেয় তারা। তাই নাম আইডিয়া স্টোর

৩.
যখন মনে হয় আমার শেকড় গজিয়ে গেছে তখন আইডিয়া স্টোরে একবার হানা দেই।ঠিক পড়ি না, তবে নানা বইপত্র নাড়াচাড়া করি ঘন্টা খানেক।কোনোটার প্রচ্ছদ দেখি, কোনোটার ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতির অংশটুকু পড়ি, কোনো বইয়ের সূচি দেখে একটা বিশেষ অধ্যায়ের অংশ পড়ি। তারপর গোটা কয়েক বই নিয়ে বাসায় ফিরি।নিজের বাছাই করা বইগুলো দেখে অস্বস্তি হয় একরকম। এখনও নির্দিষ্ট কোনো বিষয় আমার হলো না বা আমি নিজেকে বিশেষ বিষয়ে ফেলতে পারলাম না। আজকে যে বইগুলো তুলে এনেছি তার মধ্যে রয়েছে আগে পড়া দুটো বই: ১. পারস্পেকটিভস ইন স্যোশিওলজি কিন্তু এটা নতুন সংস্করণ (পঞ্চম)। ২. সারা মিলসের লেখা মিশেল ফুকো; ফুকোর জীবনী তার লেখা ও তত্ত্বের টীকা-টিপ্পনী দিয়ে লেখা একরকম নোট বই। ৩. ভ্রমণের সময় ডিজিটাল ফটোগ্রাফির সুবিধা নিয়ে লেখা মাইকেল ফ্রিম্যানের লেখা একটা বই। ৪. ড. সফিউদ্দিন আহমদের সাহিত্যের সেকাল ও একাল ৫. কাটুনিস্ট আহসান হাবীবের হাই ক্লাস হিউমার লো ক্লাস রাইটার এবং ৬. মিডিয়া স্টাডিজ বিষয়ে একটা বেসিক বই।

৪.
সফিউদ্দিনের বিশাল ৪৮ ফর্মার বইটা আইডিয়া স্টোরে পেয়ে বিস্মিতই হলাম। সফিউদ্দিন কলেজে আমাদের বাংলা পড়িয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। কিন্তু তার মত প্রায়-অখ্যাত লেখকের লেখা দিয়ে এতবড় বই বের করার প্রকাশকও বাংলাদেশে হয়েছে ভেবে অবাক লাগলো। নেপাল যাওয়ার পর নেপালি ভাষার উচ্চারণ শুনে সফিউদ্দিনের চর্যাপদ বিষয়ক একটা লেখা আবার পড়ার ইচ্ছা হয়।অনেক আগে কোনো দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে পড়েছিলাম। চর্যাপদ যে বাংলা ভাষার আদিরূপ হতে পারে না বরং একটা স্বতন্ত্র ভাষা, এ অঞ্চলের আরো অনেক ভাষার আদিরূপ সে বিষয়ে গবেষণাধর্মী লেখা। সেই লেখাটা এই সংকলনে আছে। থাকারই কথা। কলেজে থাকতে তার ‘বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ’ নামের লেখা পড়ে ধাক্কা খেয়েছিলাম। দেখলাম মুক্তচিন্তা, গভীর তথ্যানুসন্ধানের রীতি সত্ যুক্তি প্রয়োগ তার সব গবেষণাপত্রেই তিনি বজায় রেখেছেন।তার একটা লেখা পড়লে ঐ বিষয়ে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ লেখার খবর পাওয়া যায়।বাংলাদেশের মত দারিদ্র্য ও দুর্নীতির দেশেও অনেক নীরব নিভৃত জ্ঞানসাধক থাকেন। কোলাহল থেকে দূরে যারা বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা করে যান। সংস্কৃতির শক্তি অনেক। বাংলাদেশে গেলে এবার সফি স্যারকে খুঁজে বের করতে হবে। এরকম লোকদেরকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে জিইয়ে রাখা দরকার।


মন্তব্য

অপালা এর ছবি

আমাদের স্কুলে ছিলেন কালাম স্যার।জানি না তার লিখা গুলোর সংকলন হয়েছে কি না।

ফারুক হাসান এর ছবি

যদিও হয়তো একটু অপ্রাসঙ্গিক...

সিরাজগঞ্জের কথা দেখে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর বাড়িতে লাইব্রেরিটা দেখেছি। তবে তারচেয়ে বড় দুর্দশার কথা শুনাই। সিরাজগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরীর কথা। যখন স্কুলে পড়ি, তখন প্রায়ই যাওয়া হত লাইব্রেরীটায়। পড়তে নয়, পড়ার ভান করে টেবিলে বসে পড়ে থাকতে এবং সময় বুঝে দুয়েকটা বই মেরে দিতে (কনফেশন টাইম)। তখনকার লাইব্রেরীয়ান ভদ্রলোক ছিলেন মুটামুটিভাবে দূরদৃস্টিহীন (আখখরিকঅর্থে)। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। আমি ততটা পাকা ছিলাম না। তবে আমার বন্ধু,যে এখন জার্মানীতে আছে, ততকালীন সময়কার সেরা স্কুল ছাত্র, তার বাড়িতে গেলে হয়তো এখনও লাইব্রেরীর সিল মারা কাজী নজরুলের সমগ্র রচনা, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়র অনুবাদ সহ অনেককিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের জেলাশহরের ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরীতে পড়তে চায়না, লাইব্রেরীর বই বাড়ির তাকে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসে।

সাথে সাথে আরো একজনের কথা মনে পড়লো। তখন বাবার বদলির চাকুরিসূত্রে পাবনার বেড়া উপজেলায় থাকি। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই। তবে তার মতন বইপাগল লোক আমি খুব কমই দেখেছি। তিনি প্রায়ই নিজের সংগ্রহের বই নিয়ে বেড়া কলেজের দু-একটা ক্লাসরুমে বইমেলার আয়োজন করতেন, নিজ উদ্যোগে বলাই বাহুল্য। তার ইচ্ছা ছিল, লোকে বই কিনুক না কিনুক, অন্তত একটু বেন্চে বসে দুয়েক পাতা জহির রায়হান, মানিক, তারাশংকর, সুকান্ত, আলমাহমুদ পড়ুক। আমি প্রতিবারই তার মেলায় গিয়ে বই নেড়ে দেখেছি, বরফ গলা নদী, সোনালী কাবিনের সাথে তখনই পরিচয়।
কয়েকবার এরকম করার পর দেখা গেল, মেলা করার মত যথেষ্ঠ বই আর তার নেই,কারণটা বিক্রি নয়, চুরি। এরপর তার সাথে দেখা হলে বলতেন, বাড়িতে এসো, বই পড়বে।

দুর্দশার কারণ বুঝতে নিশ্চই কারো বাকি নেই!

(ভালো কথা, লেখাটা খুব ভালো লেগেছে।)

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

উৎস এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

গ্রেট বৃটেনের যে কয়টা সিস্টেম আমাকে চমৎকৃত করে,লাইব্রেরী তার মাঝে প্রথম । এ দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় গেলেও একটা সুন্দর,সাজানো গোছানো এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরী চোখে পড়বে ।
আমি প্রায় বাংগালীবিবর্জিত এক ছোট্ট শহরের লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করেছিলাম নাজমা জেসমিন চৌধুরী'র গল্প সংগ্রহ!
প্রায় নিশ্চিত দেশে আমার বিভাগীয় শহরের কোনো লাইব্রেরীতে ও এই বই খুঁজে পেতাম না ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

বৃটেনের বইপাড়ার বিবরণ ভাল লাগল। পারস্পেকটিভ ইন সোশিওলজি কিনলেন...পড়া শেষ হৈলে যদি অধমরে পাঠায়া দেন তাইলে আপনের প্রাক্তন আজ্ঞাটুকুর সৎকার করতে পারতাম! হাসি

নজমুল আলবাব এর ছবি

সফি স্যার অনেক বিষয়েই নিজের মত খুব শক্তভাবে উপস্থাপন করতেন। অনেকদিন স্যারের সাথে দেখা নাই। এখন ঢাকাবাসি। তার ছেলে মনে হয় সমকালে কাজ করে। খুব ভালো গান লিখে সে।

------------------------------------------------------

বাংলাদেশের জেলাশহরের ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরীতে পড়তে চায়না, লাইব্রেরীর বই বাড়ির তাকে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসে।

ফাহা বেজার লাগতাছে কইলাম।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

সফি স্যার চাকরিতে নেই।এখন ঢাকায় আছেন।যোগাযোগের কোন উপায় জানি না।তবে মফস্বলে থাকার কারনেই হয়তো জীবনের কাছ থেকে প্রাপ্য খ্যাতিটুকু পেলেন না।

শোহেইল ভাই,স্যারের সংস্করনটির নাম কী?প্রকাশক কে?

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অপালা, নিজের শিক্ষকদের নিয়ে ব্লগে একটা ধারাবাহিক লিখতে চেয়েছিলাম। মনে করিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ।

অ হাসান, গোলাম আজমের জীবনী থেকে ব্লগে একটা পোস্টও করেছিলাম। খাবনামা ও স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য টাইপ বইগুলো কিন্তু চরম আনন্দের। আমাদের এক বন্ধু যে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল তাকে উপহার দিয়েছিলাম বেহেশতি জেওর। সেখানে একটা লাইন হলুদ মার্কার দিয়ে উজ্জ্বল করা ছিল; “বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীদের বিবাহ করিলে তাহাদের মন পাওয়া যায় না। কারণ তাহাদের মন তাহাদের আগের স্বামীর প্রেমচিন্তায় মশগুল থাকে"।

ফাহা, আপনার মন্তব্যটা হচ্ছে এ পোস্টের অলংকার। বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে লেখেন। ব্লগ বা ইন্টারনেট আমাদেরকে নানারকম ভান থেকে মুক্তি দিয়েছে। এরমধ্যে একটা হচ্ছে নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য অতীতের অসততাকে লুকিয়ে ফেলার প্রচলিত প্রথা থেকে মুক্তি। কীভাবে বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলো বইশূন্য হয়ে পড়ে তার ওপর লিখে ফেলুন একটা ধারাবাহিক। অথবা লাইব্রেরির জ্ঞান-পুস্তককে নিজের বাড়িতে এনে সাজানোর উপায় কী তার একটা ম্যানুয়াল।
প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে এলাকাতে একটা গ্রন্থাগার খুলে দিন।

উত্স, ধন্যবাদ।
হাসান মোরশেদ, নাজমা জেসমিন চৌধুরী! অনেক পুরনো কথা মনে করিয়ে দিলেন। তবে তাঁর মারা যাওয়ার পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন। স্বজনের শোককে ধারণ করে নির্মোহ একটা বিশ্লেষণ- অথচ বাক্যে বাক্যে কাঁপা কাঁপা আবেগ লুকানো।

সুমন রহমান, কিনি নাইতো। এ তো গ্রন্থাগারের বই। দোকানের না। কোন আজ্ঞা বুঝলাম না। সমাজ বলে কিছু নাই? হা, হা, হা, আপনি তো দর্শনের ছাত্র। দর্শন বলে কিছু নাই, -কথাটা যেন কে বলেছিলেন?

নজমুল ও আরিফ ধন্যবাদ। বইয়ের পেছনেই সফি স্যারের একটা ঠিকানা দেয়া আছে। তা পুরানা পল্টনের গাজী ভবনের। বইটির নাম সাহিত্যের সেকাল ও একাল। প্রকাশ করেছে অনন্যা। বিশাল সংকলনটার দাম মাত্র চারশো টাকা।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ফারুক হাসান এর ছবি

নিজের অভিঙ্গতা থেকে বলেছি। সবাই যে এরকম তা অবশ্যই নয়। @নজমুল আলবাব, শোমোচৌ

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

ফরিদ এর ছবি

আইডিয়া স্টোরে বই সাপ্লাই দেবার স্বপ্ন দেখছি কতদিন ধরেঃ(

উঁচু মানের প্রচুর বই থাকলেও নিতান্তই ভূয়া বইয়েরও অভাব নাই। লোকাল কমিউনিটির কথা চিন্তা করে প্রচুর ইসলামিক বই নেয় ওরা, কিন্তু সাপ্লাইয়ার তো সব ইস্ট লন্ডন মসজিদের দোকান। তাই বলাই বাহুল্য মওদুদীর তফসীরের ছড়াছড়ি কেন।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ফরিদ সাপ্লাই দিতে হলে যোগাযোগ করুন।

তফসিরের ছড়াছড়ি- বিনা কারনে হয় নাই। এখানে লাইব্রেরি পাঠকদের কাছ থেকে পরামর্শ চায়। জামাত-কর্মীরা সেসব ফরম পূরণ করে মওদূদীর বইয়ের চাহিদা লেখে। অন্যদের সেরকম দায় থাকে না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।