কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ: বাবার পচে যাওয়া লাশের সামনে অসহায় সন্তান

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৭/২০০৮ - ৪:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বন্দ্বে শিশু গণতন্ত্র হোঁচট খেলো আরেকবার। তারপর পর্দার অন্তরালে ক্ষমতার কুরসি ধরে ঝুলোঝুলি শুরু করে দিলো নানা শক্তি, অপশক্তি, পরাশক্তির ছায়া-প্রচ্ছায়ারা। বাস্তবে আমরা দেখছি সুশীল গোষ্ঠীর বয়স্কাউটমার্কা কুচকাওয়াজ – তাদের নেপথ্যে নাকি রণযাত্রার কায়দায় ছক কেটে পথ বাতলে দিচ্ছেন রথী মহারথীরা। বাংলাদেশের জনগণ প্রায় দেড় বছর ধরে এই অদ্ভুতুড়ে শাসক গোষ্ঠী/পদ্ধতির বোলচাল আর হুমকি-ধমকির মধ্যে নির্বাক হয়ে আছেন। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এই সরকার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছে। পরিবর্তন আনা দূরের কথা সেরকম কোনো আশার সুবাতাস বইবে এমন পূর্বাভাষও কেউ করছেন না। কেমন আছেন জনগণ – এই প্রশ্ন করাটাও এখন একরকম ঠাট্টার শামিল।

আপদকালীন সরকারের দায়িত্বে যে বাংলাদেশ – তা আমাদের অচেনা। ঠিক এরকম একটা বাংলাদেশ জনগণ চেয়েছে তা ক্ষমতারোহীরা দাবী করলেও জনগণের সায় পাওয়া যায়নি। এটা ঠিক যে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নীতিহীনতার খরার মধ্যে আপদকালীন সরকারের আবির্ভাবে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন অনেক মানুষ। আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন অনেকে। তাদের আশাও ভাঙতে সময় লাগেনি। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায়, ষড়যন্ত্রে, নির্যাতনে সুদিনের আশা ক্রমশ রূপ নিচ্ছে আশংকায়।

আপদকালীন সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ড আর দেশের জনগণের এই আশাভঙ্গের বেদনাকে যদি একটা ছবিতে রূপ দেয়া যায় তবে তা হবে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশ হওয়া ছবিটার মত। এই একটা ছবিই হতে পারে এই দেড় বছর বা বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডের স্থিরচিত্র।

প্রতিবেদকের কলমে ছবিটার বর্ণনা এরকম: “চোখের সামনে ঝুলে আছে বাবার লাশ। চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই উপায় নেই ছেলে আলাউদ্দিনের। তাঁর ভাষায়, ‘বাবা ওই সাত তলায় ঘুমিয়ে আছেন। আলাউদ্দিন ভাবেন, একটা লোকও কি নেই, যে তাঁর বাবাকে বের করে আনবে? বাবাকে না নিয়ে তো তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না – ‘খালি হাতে বাড়ি গিয়া মায়েরে কী জবাব দিব?’

কীভাবে ঘটলো এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। কীভাবে তৈরি হলো এই ছবি।

নয়া সরকার ক্ষমতায় আসে চটকদার দুর্নীতি বিরোধী শ্লোগান নিয়ে। আগের সরকারগুলো ছিল দুর্নীতির আখড়া –এটাই ছিল তাদের মূল বক্তব্য। সেসময় ভোটে জনগণ যাকে নির্বাচিত করেছে তারা ছিল সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, অসৎ লোক। সেসব সরকারের সময় দেশে যা হয়েছে সবই দুর্নীতি। বিদ্যুত খাতে দুর্নীতি, মিগ কেনা নিয়ে হয়েছে দুর্নীতি, সেনাপ্রধান জেনারেল হয়েছেন তাও দুর্নীতি। দালান উঠেছে তাও দুর্নীতি, দালান ভাঙা হয়েছে তাও দুর্নীতি। এতসব দুর্নীতির যে বহুতলা দালান তার এক প্রতীক হচ্ছে ড়্যাংগস্ ভবন। জনপথকে আটকে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে দুর্নীতির অট্টালিকা।

এই ঝা চকচকে বহুতল ভবন যদি হয় আগের সরকারগুলোর দুর্নীতির মূর্তরূপ তবে এই সরকারের ফরজ দায়িত্ব হবে একে ধ্বসিয়ে দেয়া। তবেই না মিলবে জনগণের বাহবা। তবেই না বুঝা যাবে নয়া সরকার আর দুর্নীতিবাজ সরকারের ফারাক। সুতরাং শুরু হলো ভাঙার খেলা। তবে ভাঙবার কাজটাো খুব একটা সহজ নয়। দুর্নীতির দালান তর তর করে ওঠে কিন্তু শাবল-খুন্তির ঘায়ে তাকে নোয়ানো এতো সহজ নয়।

যে আদালত এতদিন ঝিমাচ্ছিল তারা দু:স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠে দ্রুততালে ভাঙার পক্ষে রায় দিয়ে দিলো। মাইকে ঘোষণা হলো। নয়াজমানার নয়া কর্মকান্ডে খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে জনগণ অপেক্ষায় বসলো । একবিংশ শতাব্দীতে সর্বশেষ মডেলের যুদ্ধবিমান ছাড়া যাদের রোচে না তারা বাস্তুহীন কিছু মানুষকে প্রস্তরযুগের কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে নামিয়ে দিল ভাঙাভাঙিতে । এইসব মানুষের মধ্যে আলাউদ্দিনের বাবা রুহুল আমিনও ছিলেন।

নয়া সরকারের দুর্নীতির দালান ভাঙা এসব কর্মীরা বিরাট রাজধানীর ভাসমান বাসিন্দা - মাথার ওপর ছাদ নেই। তাই যে ভবন তারা দিনের বেলায় ভাঙেন সে ভবনেই তারা রাতের বেলা পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমান। কিন্তু সেই সাময়িক আশ্রয়টুকুও গেলো একদিন। ভবনের এক অংশ ধ্বসে পড়লো এক রাতে। আরও ১০ জন শ্রমিকের সাথে চাপা পড়লেন রুহল আমিন।

দুর্নীতির দালান উঠে গেছে তরতর করে। কিন্তু নয়া সুনীতির ভাঙাভাঙির চাল ঠিকমত চলে না। নয়া সরকার সব থামিয়ে মিটিং-এ বসে। ঝুকিঁপূর্ণ ভবনে তখন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। এ আর নতুন কি? দেশটাই তো ঝুকিঁপূর্ণ আর তাতেই জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। জনগণ প্রায় নিষিদ্ধ হয়েই আছে দেশজুড়ে।

লাশ আর ধ্বংসস্তূপ পাহারায় বাহিনীলাশ আর ধ্বংসস্তূপ পাহারায় বাহিনী

হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে বিপর্যস্ত দেশ আর পাহারা বসিয়েছে শান্তিরক্ষা বাহিনী। একই কায়দায় ভাঙার পরিকল্পনায় ত্রুটির কারণে বেমক্কা নিজেই ভেঙে পড়া ঝুকিঁপূর্ণ ভবনের সামনে পাহারা দিচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীরা। কিন্তু অশ্রুসজল আলাউদ্দিন একদার উদ্ধত দুর্নীতির আধভাঙা ভবনের চারপাশে পাক খান। তারপর সতর্ক চোখ ফাঁকি দিয়ে আসেন সাত তলায় – বাবার সন্ধানে।

ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা দুটি পা এবং পরনের লুঙি দেখে বাবা রুহুল আমিনকে চেনার চেষ্টা করেন আলাউদ্দিন। আমাদের আলাউদ্দিনের কাছে কোনো যাদুর চেরাগ নেই। পাঁচদিন ধরে তার বাবা ঝুলে আছেন সুনীতি আর দুর্নীতির মাঝামাঝি বিরাট অট্টালিকায়। ঝড়-বৃষ্টিতে চারদেয়ালের আশ্রয়ও জুটেনি যে বাবার, তিনি এখন ঝুলে আছেন বিরাট ভবনে। নিরীহ, শান্ত আলাউদ্দিনও একসময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ‘এত বড় রাজধানী! এত মানুষ! সরকারি লোকজন খালি আসে আর যায়। পাঁচদিন হইল একটা লাশ বাইর করতে পারে না। এইটা কেমুন কথা?’

রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায় অবস্থা। বিরাট বিরাট কর্মকান্ড করে দেশের চেহারা বদলে দেবে যারা তারা পাঁচদিনেও লাশগুলো নামিয়ে স্বজনদের হাতে দিতে পারে না।

আলাউদ্দিনের বাবার সঙ্গে ড়্যাংগস ভবনে তখন আরো পড়ে আছেন প্রতিবেশি গ্রামের সহকর্মীরা। কম মজুরির শ্রমিক বলে যাদেরকে রাষ্ট্র ভবন ভাঙার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত করেছিল। এখানে আছেন উজানদিয়া গ্রামের ফরিদ শেখ, জাহিদ মোল্লা, দেলোয়ার শেখ, কাউজার হোসেন। নচলন্দপুরের আ. মান্নান ও আব্দুর রহিম, খোপঘাটের জিরু মোল্লা। তাদের লাশ পড়ে থাকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আর তাতে কীটনাশক ছিটিয়ে বাইরে পাহারা বসিয়ে সুনীতির কর্তারা সময় কাটান মিটিং-সিটিং-এ।

বিশাল আধ-ভাঙা ভবনে দিনমজুরের লাশ। সামনে তার উর্দি পরা পাহারা। রাস্তার উল্টাদিকে স্বজন হারানো অশ্রুসজল মানুষের ভিড়। এই যে চিত্র – এ আসলে আপদকালীন সরকারের অধীন বাংলাদেশের। সারা দেশের চিত্র। নিজের বাবার লাশের কাছে চুরি করে আসতে হয় আলাউদ্দিনকে। ‘লাশটা তো পইচা যাচ্ছে। ওনারা নাকি মেডিসিন দিছে, তাইলে এত গন্ধ কেন?’

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কেউ নেই। প্রশ্ন করাটাই এখন দ্রোহের শামিল। সরকার ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে ভাবছে। কিন্তু এখানে জমায়েত হওয়া স্বজনেরা ক্ষতিপূরণ নিয়ে চিন্তিত না। তাদের কথা একটাই, ‘লাশ দিব কবে? কেউ তো কিছু বলেও না। কারে জিগাই?’

কাকে জিজ্ঞেস করবে দেশের মানুষ। এ কেমন সরকার যে জনগণের সাথে প্রহরার দেয়াল তুলে রাখে। চুপ করিয়ে রাখতে চায় আবার নিজেদের মুখেও পড়ে থাকে ঠুলি। এ কেমন সরকার যারা জনগণের দাবীর মুখে থাকে নিশ্চুপ বসে থাকে সুশীলতার মুখোশ পড়ে। আর লাশ চাইতে আসা জনতার ওপর হামলে পড়ে তাদের উর্দি পরা বাহিনী। এ কেমন সরকার?

ভবনে লাশ রেখে ঘুমাতে পারে না আত্মীয়রা। দিনমান তারা দুর্নীতির মূর্ত প্রতীক ড়্যাংগস ভবনের চারপাশে ঘুরপাক খায়। আর পাশের কলমীলতা বাজারের ছাদে কাটে তাদের নির্ঘুম রাত। তারা ক্ষতিপূরণ চায় না, সুবিচার চায় না, তারা জানতে চায় না কেন তাদের স্বজনরা ভবনে ঢুকে লাশ হয়ে গেল, তারা জানতে চায় না কার দোষ কিংবা কার পাপে তাদের এই করুণ পরিণতি। তারা বিনত হয়ে শুধু প্রার্থনা জানায়, পচে গলে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে লাশগুলা দ্যান। গ্রামে মায়ের কাছে নিয়া যাই।

কিন্তু লাশ চাইতে এসে তাদের এই অপেক্ষা শেষ হয় না। প্রতিবেদক টিপু সুলতানকে আলাউদ্দিন জানান, ‘লাশের আশায় আমরাও এখন জীবন্ত লাশ’।

এটা কোনো রূপকথার গল্প নয়, কল্পলোকের ছবি নয়। কিন্তু যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আয়ু হবে একশো বছর, তখন বাংলাদেশের মায়েরা এসব দু:শাসন নিয়ে রূপকথা ফাঁদতে গিয়ে এই গল্পই শোনাবে শিশুদের। এই গল্প, এই ছবি দ্রুতই রূপকথা হয়ে যাবে, শীঘ্রই দূর অতীত হয়ে যাবে – এই আশাই এখন বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্বাস।


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এখন যে ভয়াবহ দুঃসময়!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

এই জনমে সুসময় আর দেখা হলো না....
-----------------------------------------------
সচল থাকুন... ...সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

দুঃসময়ের সাথে অভিযোজিত হয়ে গেছি হয়তো।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সৌরভ এর ছবি

আশা করার সাহসও পাই না আর।


আহ ঈশ্বর, আমাদের ক্ষোভ কি তোমাকে স্পর্শ করে?


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হোক দুর্নীতির ভবন, সেটা না ভেঙে সম্পদ হিসেবে ব্যাবহার করা গেলোনা!
হাঁটু বাহিনীর কোলাবোরেটর স্যুট-টাই সুশীলদের কাছ থেকে সাধারণ জনগনকে অবহেলা করার চাইতে আর কী-ই বা আশা করা যায়!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কাকে জিজ্ঞেস করবে দেশের মানুষ। এ কেমন সরকার যে জনগণের সাথে প্রহরার দেয়াল তুলে রাখে। চুপ করিয়ে রাখতে চায় আবার নিজেদের মুখেও পড়ে থাকে ঠুলি। এ কেমন সরকার যারা জনগণের দাবীর মুখে থাকে নিশ্চুপ বসে থাকে সুশীলতার মুখোশ পড়ে।

কেউ নেই উত্তর দেবার । নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে অথবা মেনে নিতে হবে ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

গল্প শেষ করতে করতে ঝাপসা হয়ে গেছে, কারণ ততক্ষণে চোখ জলে পূর্ণ। আমরা বাঙালি; ভাল কাঁদতে পারি!

--------------------------------
সহজ করে বলতে মোরে কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।