ড. রবার্ট ব্রাডনক। দীর্ঘদিন লন্ডন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অরিয়েন্টাল ও আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) ও কিংস কলেজে অধ্যাপনার পর এখন স্বেচ্ছা অবসরে আছেন। তবে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে এখনও যুক্ত রয়েছেন কিংস কলেজের সাথে। ড. ব্রাডনক দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত: ভারত, পাকিসত্দান ও বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এই অঞ্চলের স্বার্থ ও নীতি সংশিস্নষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি বই এবং বিশ্বের নামকরা গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে অর্ধশতাধিক গবেষণা-পত্র। সমপ্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছেন ভারত বাংলাদেশ সহযোগিতা স্থাপনের ওপর বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী কনফারেন্সে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করার জন্য। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে স্বনামখ্যাত এই গবেষকের সাথে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে আমার আলাপচারিতার অংশবিশেষ।
শোহেইল: একজন ব্রিটিশ হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে কি আপনি নিজেকে বাইরের লোক বলে মনে করেন না? এরকম একটি দ্বি-পাক্ষিক বিষয়ে বাইরের লোকের মন্তব্য কতটা গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত।
ড. ব্রাডনক: যেকোনো বিবেচনায় আমি বাইরের লোক। এমন কি এই তথ্যটুকুও যদি বিবেচনায় ধরা হয় যে, আমার জন্ম হয়েছিল ভারতে এবং আমার স্ত্রী রমা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। গবেষক হিসেবে আমার জীবনের প্রায় পুরোটাই আমি দক্ষিণ এশিয়ার নীতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়েছি। সে হিসেবে এ বিষয়ে কথা বলার একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তো আমি অর্জন করেছি। হতে পারে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা বাইরের লোকের। কিন্তু দুই পক্ষ যখন নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে এবং যদি তাদের মধ্যে আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আশংকা থাকে তখন বাইরের কারো নিরপেক্ষ বিশেস্নষণ উভয় পক্ষের কাজে আসবে-এমনটিই আমরা ধারণা করে থাকি।
শোহেইল: তাত্তি্বক বিবেচনায় আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে আরো বেশি গুরম্নত্বের সাথে স্থান পাওয়া উচিত?
ড. ব্রাডনক: অবশ্যই। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের শেকড় বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়েও অতীত সময়ে প্রোথিত। দুদেশের ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস একই। ঔপনিবেশিকতার পরাধীনতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়েই জন্ম হয়েছে ভারত ও পাকিসত্দানের; আর তার পথ ধরেই বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এই নতুন পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক নতুন দেশ আরো বেশি করে বুঝতে পেরেছে শক্তিশালী আনত্দ:রাষ্ট্র সম্পর্কের গুরুত্বের কথা। ঠান্ডা-যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে এটা এখন একটি স্বীকৃত বাসত্দবতা। দ্রম্নত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে বিগত ত্রিশ বছরের সম্পর্কের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা অবশ্যই আরো বেশি সুদৃঢ় অবস্থান অর্জনের দাবীদার।
শোহেইল: কিন্তু আপনি কি মনে করেন না দু দেশের সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার ক্ষেত্রে বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ভূমিকা আরো সক্রিয় হওয়া উচিত?
ড. ব্রাডনক: ছোট রাষ্ট্রের ওপর বৃহৎ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব-প্রতিপত্তির আশংকা রাষ্ট্রসমূহের মাঝে সুসম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অনাস্থার জন্ম দেয়। ইউরোপ বা আসিয়ানের ক্ষেত্রে আমরা এটা দেখেছি। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও ভারতের তুলনায় তার এলাকার ক্ষুদ্রতা অবশ্যই দেশটির জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণার ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। 14 কোটি মানুষের দেশ হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও চারপাশ দিয়ে ভারত দেশটিকে ঘিরে আছে এই বাসত্দবতায় বাংলাদেশবাসীরা খুব বেশি জোরদার অবস্থান নিতে পারে না। এর সাথে যখন এই বিষয়গুলো যুক্ত হয় যে, বাংলাদেশের পানি সম্পদের 90% এর উৎপত্তি সীমানত্দের বাইরে, বা তৃতীয় কোনো দেশের সাথে বাংলাদেশের ছোট্ট এক চিলতে ভূ-খন্ডের মাত্র সীমানত্দ রয়েছে মায়ানমারের সাথে, বা অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের অর্থনৈতিক অর্জনের কাছে খাঁটো হয়ে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এদেশে ভয় ও অবিশ্বাসের রাজনীতির কিছু শ্রোতা-দর্শক সবসময়ই পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের একটি সরাসরি প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই এতবড় প্রতিবেশির সম্ভাব্য আচরণকে উপেক্ষা করতে পারে না। আর কোনো বিষয় যদি বিবেচনায় নাও ধরা হয়, তবু অনত্দত: পানি সম্পদের কারণে দুই রাষ্ট্রকে বারবার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা থাকতেই পারে কিন্তু যে কোনো রাষ্ট্রই এধরনের বিষয়কে রাষ্ট্রস্বার্থের আলোকেই বিচার করবে।
শোহেইল: বাণিজ্য বিশেষ করে জ্বালানি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনত্দত: দুটি দেশের মধ্যে আরো বেশি সমঝোতা প্রতিষ্ঠা হওয়ার সুযোগ আছে বলে কি আপনি মনে করেন?
ড. ব্রাডনক: বাংলাদেশে বিপুল গ্যাস সম্পদের আবিষ্কার ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক ও বাণিজ্যের ৰেত্রে অবশ্যই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনাবিষ্কৃত মজুদ হিসেবে ধরলে 32 ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ নিয়ে বাংলাদেশ এখন বেশ বড় একটি গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। এ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে আরো সুসংহত জ্বালানী নীতি। তবে জ্বালানি সংশিস্নষ্ট আরো বৃহত্তর কৌশলের কথা ভুলে গেলে চলবে না। যেখানে অভ্যনত্দরীণ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর বাংলাদেশে নির্ভরতার মাত্রা এখন 60%, ভারত সেখানে আনত্দর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহের ওপর আরো অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে দ্রম্নত বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে দুটি দেশই আরো বেশি পরিমাণে দূষণমুক্ত জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হয় তবে তা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না।
যোগাযোগের সুবিধা বলতে পরিবহনের চেয়ে বেশি কিছু বুঝায়। কিন্তু এশিয়ান হাইওয়ে নিয়ে সামপ্রতিক মতপার্থক্য থেকে বুঝা যায় যে, তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে বৃহত্তর ভূ-কৌশলগত স্বার্থ মার খেয়ে যায়। ম্যাপের ওপর সামান্য চোখ বুলালেই বুঝা যায় যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিবেচনায় মায়ানমারের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক। সড়ক যোগাযোগের একমাথায় পশ্চিমবঙ্গ ও আরেক মাথায় ভারতের পূর্বাঞ্চল থাকাতে তা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করে ঠিকই। তবে পশ্চিমবঙ্গের সাথে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন থেকে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় পৰই সুবিধা পাওয়ার কথা। ইউরোপ তার একীভূত হওয়ার প্রচেষ্টায় সবচে' বড় সুবিধা পেয়েছে সীমানত্দগুলোর দরজা খুলে দেয়ায়। যা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এক সুবাতাস বয়ে এনেছে। কিন্তু এরকম প্রচেষ্টা নেয়ার আগে প্রয়োজন পারষ্পরিক আস্থা অর্জন।
শোহেইল: আপনার কি মনে হয় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের আরো উন্নতির ক্ষেত্রে এরকম আস্থার অভাব কাজ করে?
ড. ব্রাডনক: খুব চিনত্দা না করেই অনত্দত: একটি ক্ষেত্রের নাম বলা যায়। তা হলো, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা। বাইরের লোক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি অনেক সময়ই আমার কাছে বোধের অতীত মনে হয়। অতীত ইতিহাসের কারণে যে দুটি দেশের মধ্যে পানি সম্পদ নিয়ে সবচে বেশি বিরোধ থাকার কথা সেই ভারত ও পাকিসত্দানের মধ্যে রয়েছে অত্যনত্দ শক্তিশালী পানি বন্টন চুক্তি। ইন্দাজ পানি চুক্তি দু দেশের জন্যই সুবিধা বয়ে এনেছে। নদীর উজান অংশের মানুষের সাথে ভাটির অংশের মানুষের স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুধু দুই দেশ নয় একই দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যেও সচরাচর দেখা যায়। ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যে এই বিরোধ খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। সেই বিবেচনায় গঙ্গা-যমুনা-মেঘনার পানি ভাগ-বাটোয়ারা বা বরাক নদীতে প্রসত্দাবিত টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি নদীর উজান-ভাঁটি অঞ্চলের স্বার্থের বিরোধ হিসেবে দেখতে হবে যা রাজনৈতিক সীমারেখার উধের্্ব। তবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে উদ্বৃত্ত পানির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণেই দু দেশের মধ্যে সহজে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে না। ফলে কোনো যথার্থ প্রমাণ ছাড়াই বন্যা থেকে খরা সবকিছুই বাংলাদেশের কাছে চিহ্নিত হচ্ছে ভারতের অসৎ-ইচ্ছা হিসেবে। আমার মনে হয় আস্থার ভিত্তি তৈরি করতে দুটি দেশ এক্ষেত্রে যৌথভাবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ ও বিশেস্নষণের ওপর জোর দিতে পারে।
শোহেইল: কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কি ভারত-বাংলাদেশের আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই উপকারী হবে?
ড. ব্রাডনক: অনেক দিক দিয়ে পৃথক হলেও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মূল কৌশলগত সমস্যার মিল রয়েছে। উভয় দেশেই গ্রামীণ সমাজ ভেঙে মানুষ দ্রম্নত শহরমুখি হয়ে উঠছে। সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের বেশি সংখ্যক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে। অভ্যনত্দরীণ বা আনত্দর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে এসব জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বা অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার অভাব বিরাট প্রভাব ফেলছে। যা দুই দেশের জন্যই সমস্যার। অভ্যনত্দরীণ বিনিয়োগ থেকে দুটি দেশই উপকার পেতে পারে। সাফটা চুক্তিতে যে ধরনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের কথা প্রসত্দাব করা হয়েছে তার বিরোধিতা করার কোনো যু্িক্তসঙ্গত কারণ থাকার কথা না। যদিও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের ক্ষমতার পার্থক্য এই ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আসিয়ান বা এশিয়ার সাথে বৃহৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে ভারত বাংলাদেশ উভয়েই সুবিধা পাবে। কিন্তু এ ধরনের বৃহৎ আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে সুবিধা নেয়াকে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প ভাবাটা কখনও ঠিক হবে না।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন