বর্ষীয়ান ব্লগার জনাব আব্দুল হক পঙ্গু শরীরে এখন শয্যাশায়ী। তবু তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এই সাইটের তিনি একজন সদস্য। লেখেন খুব কম। সমপ্রতি তিনি 'স্রেয়শী এবং ভূতের বিতর্ক প্রসঙ্গে' শিরোনামে একটি লেখা পোস্ট করেছেন। সংক্ষিপ্ত সে লেখার শেষে তিনি একটি প্রশ্ন তুলেছেন এভাবে, "আমি আসলে নাদানের মতই জ্ঞানীলোকদের কাছে প্রশ্ন করি, 1971 সালের বাঙ্গালীর ইতিহাসের বৃহত্তম গণপ্রতিরোধের ক্ষেত্রে ব্যক্তি শেখ মুজিব কতটা জরুরী?" তার এই প্রশ্নের উত্তরে আমি নীচের মন্তব্যটুকু করেছিলাম। সেটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য নয়। কারণ আমরা জানি সবাই উত্তর জানার জন্য প্রশ্ন করেন না। কারো কারো প্রশ্ন থাকে তারা নিজেরাই উত্তর দিয়ে দেন। আর কেউ কেউ থাকেন যারা অন্যের উত্তর শুনে সেটি নাকচ করে দিয়ে নিজের মতামতটি দেবেন বলে প্রশ্ন করেন। তো আমার বিবেচনার জনাব হক শেষোক্ত কারণেই প্রশ্নটি তুলেছেন। সে কোনো দোষের বিষয় নয়। ক্লাশে শিক্ষকরা এমন করেই আলোচনার শুরুকরেন। তার লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আমি যে মন্তব্যটি করেছিলাম তা অনেকের চোখে পড়বে এ আশায় সম্পাদনা করে আলাদা লেখা হিসেবে পোস্ট করলাম।
জনাব হকের প্রশ্নের উত্তর বিবেচনায় দেখতে হবে প্রশ্নটি তিনি কেনো করেছেন এবং তার সাথে এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক আছে কি না? তিনি নিজেই বলেছেন নাদানের মত জ্ঞানী লোকের কাছে প্রশ্ন করেছেন। আমরা যদি 'রিড বিটউইন দ্যা লাইন' করি তো বুঝতে পারি তিনি হালকা চালে অন্যদের জ্ঞানকে কটাক্ষ করেছেন এবং যদিও নিজেকে নাদান বলেছেন তবু প্রকৃতপক্ষে এর উল্টোটাই বুঝাতে চেয়েছেন। (আমরা তা মনে করিও)।
এবার আসি তার প্রশ্নে। এই প্রশ্নটির পেছনে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা কাজ করেছে। আমার ধারনা যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে তিনি চৈনিক বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার সাথে জড়িত ছিলেন। (তার নাম আমাদেরকে হক-তোয়াহার কথা মনে করিয়ে দেয়)। তো ব্যক্তি নেতৃত্বের বিষয়টির সাথে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার একটি বিরোধ আমরা দেখতে পাই। যেখানে তাত্তি্বকভাবে সমাজকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তি অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। সে আলোকে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উকিলরা নেতৃত্বকে সামষ্টিক হিসেবে দেখতেন। তারা ব্যক্তি নেতৃত্বকে সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন ও অপ্রয়োজনীয় হিসেবে দেখেছেন। এমনকি সেসময়কার রাশান সিনেমায় নায়ক চরিত্র খুঁজে বের করাটা খুবই কঠিন ছিল। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি নায়ককে বলি দেয়ার এই চেষ্টাকে আমি নিজেও খুব একটা খারাপ চোখে দেখতাম না। কিন্তু আব্দুল হকের ব্লগের শিরোনাম (শেষ পর্যন্ত সবকিছুর নির্মম সমালোচনাই টিকে থাকে) মাথায় রেখেই বলি নির্মম হলেও সত্যি মানব-সমাজ নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা হালে পানি পায়নি। পৃথিবী জুড়ে সব সমাজে মানুষ ব্যক্তি নায়কের সন্ধান করে গেছে এবং আজো করছে। বরং বিস্ময়করভাবে সত্যি যে কমু্যনিজম বা সমাজতন্ত্রের কথা ভাবলেই বরং আমরা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওয়ের ছবি দেখতে পাই। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কথা বললে তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাতা খুঁজে পাই না। কি অনাকাঙ্খিত বৈপরীত্য!
আমার ধারণা ভুল না হয়ে থাকলে জনাব হক 47 পরবর্তী পূর্ব-পাকিসত্দানের রাজনীতির সাথে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন বা একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার কাছ্ইে প্রশ্ন রাখি। বুকে হাত দিয়ে বলুন, পূর্ব-পাকিস্তানের সিংহভাগ মানুষ আলাদা একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন? বলুন তারা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন? যখন শেখ মুজিব ছয়দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন তার সাথে কয়জন লোক ছিলো জনাব হক? আর আপনি যে বললেন গণপ্রতিরোধ--শতকরা কতভাগ লোক প্রতিরোধ করতে উঠে দাঁড়ালে তাকে গণপ্রতিরোধ বলা যায় আর 1971-এ কতভাগ লোক প্রতিরোধ করেছিল হানাদার বাহিনীকে? (আমি এ প্রশ্ন করবো না আপনি বা আপনার দল সে প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিল কিনা? না কি একে দুই শুয়োরের লড়াই বলে দূরে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের জন্য হাই তুলছিল?)
আপনি বয়স্ক, শ্রদ্ধাস্পদ ও নতুন প্রজন্মের কথা জানতে অসুস্থ শরীরেও এখানে ঢুঁ মারেন বলে আপনার প্রতি অসীম মমতা রয়েছে আমার মনে। আপনার ব্লগের শিরোনাম ধরেই আবার বলি হয়তো নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার জন্য কেবলি সমালোচনা জুটেছে আপনাদের কপালে। কিন্তু অনেকেই তলিয়ে গিয়ে দেখে না যে আপনাদের আত্মত্যাগ কী ছিলো আর কার জন্য কী আপনারা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। মানুষ শেষ পযন্ত ফলাফল দিয়েই সব কাজকে বিচার করে। এটাই বাস্তবতা আর এজন্য ব্যর্থ মানুষদের জন্য মানব সমাজ ছুঁড়ে দেয় সমালোচনার তীর এবং কখনও কখনও তা হয়ে উঠে নির্মম। একথা সবার ক্ষেত্রেই সত্য। আমার, আপনার এমনকি শেখ মুজিবের ক্ষেত্রেও।
তবে বিপ্লবীদের হাতে মস্কোর পতনের সময় ব্যক্তি লেনিন ঘুমিয়ে থাকলেও লেনিন যেমন অস্পৃশ্য হয়ে পড়েন না বরং হয়ে উঠেন বিপ্লবীদের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু তেমনি বিচ্ছিন্ন ও বিচিত্র সব খন্ড খন্ড স্বাধীনতা চেষ্টার কেন্দ্রে এসে মূর্ত হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। বৃহত্তর অর্থে শেখ মুজিব এখানে আর ব্যক্তি থাকেন না (অর্থাৎ কামাল, জামাল, হাসিনা রেহানার বাবা থাকেন না); ইতিহাস, জাতি সত্ত্বা ও মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় হয়ে উঠেন মুক্তির মূর্ত প্রতীক। কাল ও ইতিহাসের আপন গতিপ্রবাহে সে অবস্থানে অন্য কোনো ব্যক্তি থাকতেই পারতেন। তা হয়তো হয়নি। তাতে কী? খালার মোচ থাকলে মামা হতো সে নিয়ে আফসোস করে লাভ কী? সত্য এই, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রে শেখ মুজিবের অবস্থান। ব্যক্তিনায়ক বিরুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা যতই আগাছা বা শাক উৎপাদন করে থাকুক না কেন তার জটাজাল এতো বিস্তৃত হয়নি যে তা দিয়ে এমন স্পষ্ট সত্যকে ঢাকা যাবে।
[উত্তর প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা জানতে আগ্রহী বলেই আগ বাড়িয়ে আপনার সাথে কথা বাড়ালাম। আশা করি আহত বোধ করবেন না। আমরা নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে জানতে পারবো কেনো আপনাদের মহান চেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হলো।]
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন