আসুন পাঠ করি মানুষের নামে

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বুধ, ০৮/০৩/২০০৬ - ৯:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


[গীতা পাঠ করায় খুব বেশি উৎসুক মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্মেমানুষের মন নেই। কিন্তু দীক্ষক বলেছেন, বেশি বেশি পাঠ করার জন্য। আলো ছড়াতে হবে। তাই আমি খুলে বসেছি পাঠের আসর। মানুষ বিষয়ক পাঠের আসর। বিষয়ের পছন্দ আমার, ব্যাখ্যা যার যার নিজের। আজকের পাঠ আহমদ ছফার প্রবন্ধ 'মূলত: মানুষ'।]

"মানুষের মান দাও
মানুষের গান দাও
মানুষ সবার সেরা
মানুষ ঈশ্বর ঘেরা
এ সংসারে।"
ছফা তার লেখা শুরু করেছেন এই লোককবিতার নামহীন কবির অনুভূতির প্রশংসা করে। তারপর তিনি লিখছেন, "মানুষ, মানুষ, মানুষ। এই অপরিসীম, ব্যঞ্জনাময় শব্দটি যতবার উচ্চারণ করি একটা বিস্ময়বোধ শিরায় শোণিতে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ এই দু'পেয়ে প্রাণীটি পারিপাশ্বর্িকের সমস্ত বাধা অপার সৃষ্টি ক্ষমতার বলে অতিক্রম করে এ পর্যন্ত এসেছে ... মানুষই একমাত্র প্রাণী ক্রমাগত প্রতিটি প্রজন্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে করতে এই অবস্থায় এসেছে। নিজেকে নতুনভাবে সৃষ্টি করতে গিয়ে জগতকে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছে। নিজেকে পরিবর্তন করতে গিয়ে সৃষ্টিজগতকে পরিবর্তন করেছে।"

আহমদ ছফা মানুষের এই গুণকীর্তন করেই চলেন এবং জানান দেন মানুষের নানার কীর্তির কথা। তিনি এও বলেন, "মানুষ ধর্মের কল্পনা করেছে, কিন্তু ধর্মের অনুশাসন যখন প্রাণের প্রকাশ পথ রোধ করে দাঁড়ায় মানুষ তার বিরোধিতা করারও ক্ষমতা রাখে।" তবে ছফার প্রবন্ধটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী হলো "আমার কাছে মানুষের ঈশ্বর চিন্তা মানুষের অমরতার চিন্তার সমার্থক"। সে ভাব থেকে মানুষ "ঈশ্বরঘেরা" এই পংক্তিটি তিনি বিশ্লেষণ করেন আর শেষ করেন তার বক্তব্য। সেকথাগুলো খুবই গোছানো। পাঠ করি তারই বয়ানে:
"মানুষ বিচার করে, বিশ্লেষণ করে, স্বীকার করে, প্রয়োজনে ঈশ্বর সৃষ্টি করে, সৃষ্ট ঈশ্বরের নির্বাসন দিতে পারে। মানুষের ঈশ্বরচেতনা বস্তুত: অনন্তের পথে মানুষের আত্মোপলব্ধির একটা পর্যায় মাত্র। মানুষ অনন্তের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে চিন্তা করেছে এবং এই ফাঁকে এক লোকোত্তর ঈশ্বর তার চেতনায় অধিষ্টান নিয়ে বসেছেন। মানুষ নিজেকে যতোদূর জেনেছে, তারও চাইতে বেশিদূর জানতে পারেনি। মানুষ সৃষ্টি জগতের অনেক বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞ, তারও চাইতে বেশি অজ্ঞ নিজের বিষয়ে। এই অজ্ঞতার অবসান যেদিন হবে, বোধকরি সেদিন মানুষের আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না।
মানুষ সৃষ্টিজগত সম্বন্ধে শেষকথা যেমন বলতে পারে না, তেমনি নিজের সম্বন্ধে শেষ কথা বলারও তার অধিকার নেই। সুতরাং একজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়। তিনি ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বর না হলেও কোনো ক্ষতি নেই। ইতিহাসে অনেক সময়েই দেখা গেছে মানুষেরই কল্পনাপ্রসূত নানা জিনিষ ঈশ্বরের স্থান দখল করেছে, আর মানুষ মহা উৎসাহে সেগুলোকে মান্য করতে আরম্ভ করেছে। আশ্চর্য এই মানুষ।
বুদ্ধদেবের কথায় ফিরে যাই। তিনি মানুষের বাইরে অন্য সত্তার প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, ওহে মানুষ তোমার অস্তিত্বের বাইরে কেউ নেই, কিছু নেই, তুমি নিজেই নিজের আলোক বর্তিকা হও। কিন্তু বুদ্ধের শিষ্যরা তাকে ভগবানের আসনে বসিয়ে পূজা করতে আরম্ভ করলেন। মানুষের চেতনার এমনই একটা ধরণ সে ক্রমাগত ঈশ্বর সৃষ্টি করছে। এবং ঈশ্বর ধ্বংস করছে।
মানুষের বাইরে অন্য কোনো ঈশ্বর আছেন কিনা, তা আমার বিচার্য বিষয় নয়। কিন্তু মজার কথা হলো এই ঈশ্বরকে মানুষ কল্পনায় ধারণ করেছে এবং মানুষের কল্পনার মধ্যে এই ধারনাটা চারিয়ে দিয়ে গেছে। মানুষ যে রকম তার হাত পা এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে বাদ দিতে পারছে না সেরকম ঈশ্বরের ধারণা ত্যাগ করাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঈশ্বরের বিকল্প যা কিছু আবিষ্কার করুক না করুক তার মধ্যে ঈশ্বরীয় মহিমা তাকে আরোপ করতে হয়। ইশ্বর যেমন দুর্জ্ঞেয় তেমনি মানুষও দুজ্ঞেয়। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন এটা মেনে নিতে পারলে সমস্যাটা মিটে যেতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষ ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে এবং সেখানেই ভর করেছে সমস্ত জটিলতা।"

ছফা সেই জটিলতার সন্ধানের আগে তাই ডাক দেন মানুষের আবিষ্কারে রত হওয়ার। আর বলেন মানুষ যে কি তার কি কোনো সন্ধান পাওয়া যাবে কোনো কালে?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।