আমাদের এই ব্যর্থতা ক্ষমা করবেন হুমায়ুন আজাদ, ক্ষমা করবেন

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০৩/২০০৬ - ৮:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আমাদের কথা ওরা কেউ বিশ্বাস করেনি। ওরা আপনার আক্রান্ত হওয়া নিয়ে নানা অশ্লীল গল্প ফেঁেদছে। জামাতী মন্ত্রীর দেয়া ইংগিতের গন্ধ শুঁকে ওরা কেচ্ছা ছাপিয়েছে নিউজপ্রিন্ট ম্যাগাজিনে। যখন বাংলাদেশ ক্ষোভে সোচ্চার, শিক্ষার্থীরা কফিন বানিয়ে প্রতিবাদ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তখন ওরা লেলিয়ে দিয়েছে মাস্তানবাহিনী আর ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উপর বইয়ে দিয়েছে ঝড়। আমরা চিৎকার করে বলেছি এ আক্রমণ হিংস্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর। যারা আপনার ছাপপান্ন হাজার বর্গমাইলের পাতা থেকে বের হয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আপনার উপর। চিরচেনা বাংলা একাডেমি, রমনা পার্কআর টিএসসির আলো-আঁধারিতে তারা আপনার শরীর থেকে ঝরিয়েছিলো রক্তবন্যা। ক্ষতবিক্ষত করেছিলো আপনার মুখমন্ডল। আমরা মুহুর্তেই চিনেছিলাম কারা তারা। ওরা স্বাধীনতার শত্রু। ওরা দেশের শত্রু, ওরা মানবতার শত্রু। ওরা নব্য রাজাকার-আলবদর আর অন্ধকারের ঘৃণ্য কীট। আমরা ঠিকই চিনেছিলাম তাদের। কিন্তু কিছু চেনামুখ সংস্কৃতিসেবী আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। তারা ঘাতকের পৃষ্ঠপোষকদের কাঁধে কাঁধ ঘষে আমাদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হেসেছে।
হুমায়ুন আজাদ আপনি কি কখনো কল্পনা করেছেন এই তাদের সত্যিকার রূপ? যখন বিপন্ন হয় একজন অধ্যাপক-লেখকের জীবন তখন সব সাংবাদিক-সম্পাদক-লেখক কেনো একজোট হতে পারেন না প্রতিবাদে?কেনো তারা গল্প ফাঁদেন হামলাকারীর হয়ে? হুমায়ুন আজাদ তো কারো দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে যান নি। নিভৃতে নীরবে তিনি করেছেন সাহিত্য চর্চা । লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, সভ্যতা ও ভাষাতত্ত্বের বই। রাজনীতিও করেননি কোনো দলের হয়ে । তবে কেনো আমরা একযোগে দাঁড়াতে পারিনা তার হামলার বিপক্ষে। কেনো আমাদের তাড়িত করে না একজন লেখকের জীবন ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা ।
যখন আপনি চার কি পাঁচটি বইয়ের জনক, তখন থেকেই আমার সংগ্রহে ছিল আপনার বই। রাতভর বন্ধুরা মিলে আবৃত্তি করে যেতাম জ্বলো চিতাবাঘ আর অলৌকিক ইস্টিমার। কী আবৃত্তিযোগ্য ছিলো একেকটি কবিতা। কবিতার সে পাতাগুলো, চরণগুলো এখনও ভাসে চোখে। যদিও আপনার কোনো ক্লাসে ছাত্র হয়ে বসিনি পাঠ নিতে তবু তো শিক্ষক আপনি আমার। কিশোরদের জন্য লেখা লাল নীল দীপাবলী (বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী) আর কত নদী সরোবর ( বা বাংলা ভাষার জীবনী) পড়ে পড়েই তো বাংলা ভাষার সাথে আমার হৃদ্যতা। আজো দেশের শত-সহস্র কিশোরের লাইব্রেরিতে শোভা পায় সেই বই। শুধু আপনি আপনিই চলে গেছেন অকস্মাৎ হুমায়ুন আজাদ। যদিও ফিরে এসেছিলেন ঘাতকের আক্রমণকে মিথ্যে প্রমাণ করে, যদিও পেয়েছিলেন দ্্বিতীয় জনম, তবুও তা ছিল ক্ষণকালের।

আকর-গ্রন্থ নারী লিখে আপনি ঠাঁই করে নিয়েছিলেন অজস্র বাঙালি রমণীর হৃদয়ে। আর আজ নারী দিবসে ঘাতকেরা স্বীকার করলো সেই মর্মবিদারক সত্য। অন্ধকারের সেনাপতি সে, যদিও নাম তার 'সানি' সেই ছিলো দায়িত্বে আপনার হত্যাযজ্ঞের। আপনাকে হত্যা করে তারা এদেশে অন্ধকারের শাসন চেয়েছিলো। আর এই কথাটাই আমরা যখন অভিযোগ করে বলেছিলাম, তখন কত খ্যাতিমান সাংবাদিক আর সম্পাদক অশ্লীল গল্প ফেঁেদে আমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করলো। কিছু কিছু মানুষকে তৃপ্তির ঢেকুঁরও তুলতে দেখেছি আপনার আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে। অনেকেই নির্বিকার ছিলেন যেন তারা নিজেরা আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বলার কিছু নেই। আজ যখন এসব ধর্মের গুন্ডারা স্বীকার করে আপনার হত্যাচেষ্টার কথা তখন তারা বিস্মৃতির ভান করে। তারা মনে করতে পারে না কে এই হুমায়ুন আজাদ। এইসব ঘৃণ্য মানুষের দেশে, বিবেকহীন ভদ্রলোকদের ছায়ায় এখনো হাঁটছি আমরা।
সোয়াস লাইব্রেরীতে এখনও আপনার পিএইচডি থিসিসটি আছে। পরম মমতায় আমি তাতে রেখেছি হাত। আর নির্মম ধ্বংস কামনা করেছি সেসব অন্ধকারের কীটদের আর তাদের যারা সাময়িক স্বার্থের আশায় হাত মিলায় ওদের সাথে।
আজ আপনি নেই হুমায়ুন আজাদ। বাংলা সাহিত্যের সাহসী যুবরাজটিই নেই আজ। বুকে তাই আগলে রাখি আপনার সৃষ্টির বিচিত্র বর্ণের দীপাবলী। বাংলায়, বাংলা সাহিত্যে তারা ছড়াবে নানা রঙের ছটা। আর অশ্রুসজল চোখে স্মরণ করবে আপনার নাম। মৃতুর মুখ থেকে ফিরে এলেও আপনাকে পারিনি রাখতে ধরে আমরা হৃদয়ের উষ্ণতায়। আপনি বেঁচে থাকতে পাকড়াও করতে পারিনি ঘাতকদের বরং কাদা ছোড়াছুড়ি করেছি অক্ষম আমরা। যে সাহসে আপনার কলম সাহিত্যে প্রজ্জ্বলিত করেছে আলোকবর্তিকা আমরা তাকে দিতে পারিনি নিরাপত্তার ছায়া। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশে আপনাকে আমরা দিতে পারিনি নির্বিঘ্নে লেখবার একটি টেবিল। বরং তাকিয়ে দেখেছি নিষ্কর্মা 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে' গেছে। আমাদের এই ব্যর্থতা ক্ষমা করবেন হুমায়ুন আজাদ। ক্ষমা করবেন।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।