শতক হাঁকানোর বাধ্যতামূলক বক্তৃতা

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বুধ, ২২/০৩/২০০৬ - ৭:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ব্লগে শতক হাঁকানো উপলক্ষে একটি বাধ্যতামূলক বক্তৃতা দিতে হয়। অনেকেই উশ-খুশ করেছেন আমার সেরকম বক্তৃতা নেই দেখে। আমাদের নেতা হীরক লস্কর একটি বিশাল লেখা লিখেছিলেন তার আগের লেখাগুলোর চারিত্র বিশ্লেষণ করে। সেরকম ইচ্ছা ও ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই। তো আমি মনস্থির করেছি 'কুটিল উত্তর-2' তে নিজের বিষয়ে যে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলাম তার একটা জবাব দেবো। তাতে নিজের কথা বলা হবে। আর বিষয়টা বক্তৃতার মতও শোনাবে।
সেখানে প্রশ্ন ছিল "শোহেইল মতাহির চৌধুরীর এত বিচিত্র জ্ঞানের উৎস কী"? প্রশ্নটা মূলত: হাসান করেছিল। সে যাক। আমি বিনয়ী। চেষ্টা চরিত্র করেও দুর্বিনীত আচরণ করতে পারিনা। তো প্রশ্নটিকে একটু মাজা_ঘষা না করলে বড় বিব্রত লাগছে। বিচিত্র জ্ঞানের বদলে আমি বলবো বিচিত্র আগ্রহের কথা। হ্যা, আমার আগ্রহ বিচিত্র। আর এই যে, বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ এর কারণেই কোনো একটি বিষয়ে থিতু হতে পারিনি আজো। একটি মাত্র মানবজীবন, আর এত কিছু চারপাশে। সব যদি নাগালের বাইরে থেকে যায়। কোনো স্বাদ যদি না পাই এই বিচিত্রতার তাহলে কি হয়? সেই ধারণায় থিতু না হয়ে বিচিত্রতার দিকেই আমার হাত বাড়ানো। তবে তার বোধহয় উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। যদি খুঁজি।
প্রথমে বোধহয় বলতে হয় পড়ালেখার কথা। আগা গোড়া বিজ্ঞানের ছাত্র। চিনত্দা-ভাবনাগুলো ভৌত বিজ্ঞানের ছাত্রদের মতই। তারপর পড়লাম লোক-প্রশাসন ও ব্যবসা-প্রশাসন। পড়লাম মানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন। এ দু'টি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়িয়েছিও। সুতরাং পড়ালেখায় নিবেদিত প্রাণ না থাকলেও খারাপ ছিলাম না। এখন চলছে পিএইচডি পর্যায়ের লেখাপড়া। তবে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য নয় এবার আমার ফ্যাকাল্টি হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান। সার্টিফিকেট পেলে সমাজবিজ্ঞানও নিশ্চয়ই পড়াবো। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। বিষয় পরিবেশ বিজ্ঞান। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমি পেয়েছি এতগুলো বিষয়ে। এগুলোকে উৎস বলা যায় বিচিত্র আগ্রহের।
তারপর আসি প্রশিক্ষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম তখন বিভাগের ক্লাশরুমে যত সময় কাটিয়েছি তার সমান সময় কাটিয়েছি নানা প্রশিক্ষণে আর ওয়ার্কশপে। ছোটখাটো প্রশিক্ষণের কথা বলছি না আমি। বলছি দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ। অবলোকন নামে একটি উঠতি নাটকের গ্রুপে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম নাটক বিষয়ে। ছয় মাসের প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু চলেছে একবছর। কণ্ঠশীলনে আবৃত্তি ও কবিতা বিষয়ক চার মাসের প্রশিক্ষণ চলেছিল প্রায় এক বছর। নিজে একটি চলচ্চিত্র সংসদ করতাম, তার ছয় মাসের ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করেছি। এছাড়া লেখালেখি সংক্রানত্দ বিভিন্ন ছোটোখাটো প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছি। প্রশিক্ষণের কথা আসলে ভাষা শিক্ষার কথাও আসে। গোয়েটে ইন্সটিটিউটে জার্মান ভাষা শিক্ষার জন্য ছয় মাস গেছি। সে ভাষার কিছুই মনে নাই আবার একেবারে যে সব ভুলে গেছি তাও সত্যি নয়। তবে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষার চেষ্টাটা সামপ্রতিক। সুতরাং সেখানকার নয় মাসের বেশ কিছুটা মনে আছে।
চাকুরির কারণেও বেশ কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। তাতে নতুন যেসব বিষয় যুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো; দেশের সংবিধান, আইন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বাজেট ও অর্থ ব্যবস্থাপনা ইত্যাকার বিষয়। সব মিলিয়ে চাকুরিকালীন মোট প্রশিক্ষণের সময় প্রায় এক বছর। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন বিধি ইত্যাদি সম্পর্কেও শিখতে হয়েছে। আর শেখা জিনিসের প্রতি আগ্রহ থেকে যাওয়া স্বাভাবিক।
ঢাকায় বেসরকারী যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আমি পড়াতাম তাতে ম্যানেজমেন্ট ও ব্যবসা-প্রশাসনের বিষয় ছাড়াও এনজিও বিষয়ক একটি কোর্সও নিতাম। সুতরাং এনজিও বিষয়েও আগ্রহ রয়েছে। দুটি সরকারী ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার বেসিক কোর্সের ট্রেনার হিসেবেও কাজ করেছি। সেও এক আগ্রহ আমার।
প্রশিক্ষণ বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছাড়াও মানুষ অনেক কিছু নিজে থেকে শিখে। বিশেষত: যদি তা প্রিয় শখ সংক্রানত্দ হয়। সেরকম বেশ কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমি শিখতে চেষ্টা করেছি। তার মধ্যে আছে ফটোগ্রাফি ও শরীর চর্চা। কিছুদিন হারমোনিয়াম নিয়ে প্যাঁ পুঁও করেছি। তবে কয়েকটি গান লিখেই সে শখ থেকে ইসত্দফা নিয়েছি। আর যেহেতু নাটক, অভিনয় ও ফিল্মও শখের পর্যায়ে ছিল এ বিষয়েও প্রচুর পড়ালেখা করেছি। শৌখিন নাট্যকার হিসেবে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছি ও পরিচালনাও করেছি। একটি 6 পর্বের ধারাবাহিক ও একটি 13 পর্বের ধারাবাহিক করেছিলাম। শেষেরটি লুপ্ত হয়ে যাওয়া একুশে টেলিভিশনের অর্থায়নে। বিটিভিতে একসময় স্ক্রিপট লেখার কাজ করেছি গোটা পঁচিশেক অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছি। আলী ইমাম ভাই অবশ্য এক্ষেত্রে উৎসাহদাতা ছিলেন। নিজের নাটকের দল লোকনাট্য দলের জন্য একটি মঞ্চনাটক লিখেছিলাম। অবশ্য তা লু' সুনের নাটকের রূপান্তর ছিল। লোকনাট্যদল কিছুদিন তা মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চে মঞ্চস্থ করেছে।

এরপর আসি কর্মক্ষেত্রে। এই জায়গাতেই আমি আমার বিচিত্র আগ্রহের সবচে বেশি প্রমাণ রেখেছি। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে সরকারী আমলা সব ধরনের কাজই আমি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কথা আগে বলেছি। আর যেসব জায়গায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দিয়েছি সেগুলো হলো: প্লাস্টিক কারখানায় মেশিনম্যান হিসেবে, সংবাদপত্রে অনুবাদক, প্রদায়ক ও রিপোর্টার হিসেবে, মোবাইল ফোনের দোকানে সেলসম্যান, এনজিও কর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালকের সহকারী হিসেবে, ইন্টারপ্রিটর ও ট্র্যান্সলেটর হিসেবে, টিচিং এ্যাসিসটেন্ট ও ইনভিজিলেটর হিসেবে, ডোর টু ডোর রিসার্চার হিসেবে। গৃহ শিক্ষকতা ও আরো কিছু স্বল্পমেয়াদী কাজ করেছি যা এখনই মনে আসছে না। আর মূলত: পেশাগত অভিজ্ঞতা আমার সরকারী আমলার। বাংলাদেশ সচিবালয়ে কাজ করেছি, কাজ করেছি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। কর্মক্ষেত্রের বিচিত্রতার কারণেও অনেক বিষয়ে আমার আগ্রহ জন্মেছে এবং তা বহাল আছে।

পড়ালেখা, প্রশিক্ষণ, শখ ও কর্মক্ষেত্রের কথা বল্লাম। সব বলা হয়নি। অনেকগুলো জিনিস সম্পর্কে বলা হয়নি। সেসবও বিচিত্র আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তার মধ্যে আছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে সংগীত বিষয়ক একটি পাঠ চর্চায় অংশ নেয়া। সৃজন সাহিত্য সংসদ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ মেয়াদি কর্মশালায় অংশগ্রহণ। কবিতা আবৃত্তি তো ছিলই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম প্রবল আগ্রহে। প্রিয় বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল মূকাভিনয়, বিতর্ক ও ধারাবাহিক গল্প বলা। স্কুল পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমাদের স্কুলের দলনেতা হিসেবে ঢাকা জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কবিতা লেখা ছেড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝামাঝি পর্যায়ে সে চর্চাও নেই। তাই কবিতার বই বের করার স্বপ্নপূরণ হয়নি। তবে কোনো বই-ই বের হলো না এই বোধ থেকে একটি প্রবন্ধের বই লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল "আমলাতন্ত্রের ময়না তদন্ত"। সেটি প্রকাশ করেছিল অবসর।

রাজনীতিও আমার আগ্রহের বিষয়। আমাদের স্কুলে ইসলামী ছাত্র শিবির খুব সক্রিয় ছিল। তারা সাপ্তাহিক বই পড়া ও সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। এগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতাম। স্কুল পর্যায়ে খেলাঘরেরও সদস্য ছিলাম বছরখানেক। তখন নানারকম ক্রিয়াকান্ডে অংশ নিয়েছি। কলেজে এসে যুক্ত হয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। ছাত্রলীগের মিছিলেও যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মিছিলে গেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজনের সাথে আড্ডা দিয়েছি। আর রোটার্যাক্ট ক্লাবও করেছি জোরেশোরে। স্কাউটিং-য়ের কথা বাদ যায় কেন। কলেজে থাকতে বিএনসিসি-তেও নাম লিখিয়েছি। অংশ নিয়েছি তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে।

আর বেশি বিষয় যুক্ত করবো না। খেলাধুলা আর বিদেশ বাস দিয়েই শেষ করি। যত ধরনের খেলা চোখের সামনে পড়েছে সব ধরনের খেলাই রপ্ত করার চেষ্টা করেছি তার মধ্যে লন টেনিস, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, দাবা, ক্যারম, স্নুকার, পুল এসব তো রয়েছেই। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব খেলায় পুরষ্কার পেয়েছি সেগুলো হচ্ছে দাবা, ক্যারম, টেবিল টেনিস ও লন টেনিস। পাঁচ মাইলের ম্যারাথন দৌড়েও একবার দ্বিতীয় হয়েছিলাম আড়াইশ' জনের মধ্যে। এগুলোর কারণে বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ আমার ব্যাপক। অর্থকড়িটাই কামানো হয়নি। তবু বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ এসেছে জীবনে। ভারত, নেপাল, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ছাড়াও দীর্ঘদিন দুই বছর কেটেছে অস্ট্রেলিয়ায়, এর এর অনেকগুলো বিখ্যাত শহরে দীর্ঘ সময় করে কাটিয়েছি। প্রায় মাস তিনেক ছিলাম জাপানে আর গত চার বছর ধরে আছি ব্রিটেনে। আশা আছে আগামী বছরের মধ্যে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ ঘুরে ফেলার।

আর দীর্ঘ করবো না। অনেকেরই জীবনে বহু বিচিত্র কাজের অভিজ্ঞতা হয়তো থাকে। আসে বিচিত্র সুযোগও হয়তো। কিন্তু বুদ্ধিমানরা কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে তার দক্ষতা বাড়িয়ে হয়ে উঠেন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু যেকোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহের কারণেই আমার এই বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠা হয়নি। কিন্তু বহু বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহের কারণে জানার পরিধি ঠিকই বিস্তৃত হয়েছে।

ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।