ধর্মবিশ্বাসের সাথে মেলে না বলে ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার অনেক ধর্মের পুরোধারা। এক্ষেত্রে মুসলিম মৌলবাদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী আর ইহুদি মৌলবাদীদের মধ্যে অনেক মিল। সবাই ডারউইনের কঠোর সমালোচক। বিজ্ঞানের আরো অনেক তত্ত্বের মত জীবজগতের বিকাশের ক্ষেত্রে ডারউইনের থিওরি একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কিন্তু ধর্মকে অনেকে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সঠিক প্রমাণ করতে চাইলেও ডারউইনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে কোনো ধর্ম মেনে নিতে নারাজ। কেন? কারণ এতে ধর্মগ্রন্থগুলোতে মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে যে কল্প-কাহিনী দেয়া হয়েছে তা ভন্ডুল হয়ে যায়। সুতরাং যদিও নিজেদের মধ্যে তাদের রয়েছে অনেক বিবাদ-বিসম্বাদ, তবু ডারউইন ঠেকানোতে সব ধর্মের পুরোহিতরা একাট্টা। ।
আমরা জানি মানুষের উদ্ভব বা পৃথিবীতে আসার বিষয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোর বক্তব্য একইরকম। অর্থাৎ উর্দ্ধ আসমানে কোথাও কোনো স্বর্গে ঈশ্বর মানুষকে (আদম ও ইভ/হাওয়া) তৈরি করে রেখেছিলেন। পরে শাস্তি- স্বরূপ পৃথিবীতে তাদের পতন ঘটে। এসব গাল-গল্প বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র দলিল দস্তাবেজে পাওয়া যায় কিন্তু প্রমাণযোগ্য নয় বলেই কোনো জ্ঞানসাধকের পক্ষে তা বিনা প্রশ্নে মানা কঠিন। এদিকে ডারউইন জীবজগত পর্যবেক্ষণ করে একটি তত্ত্ব দাঁড় করালেন যে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা, খাদ্য সংকট সমাধানের চেষ্টা, নানা বিরূপ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করে টিকে থাকার তাগিদেই প্রাণীরা একস্তর থেকে বিবর্তিত হয়ে আরেক সত্দরে উন্নীত হয়েছে। এভাবে ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রাণীর উদ্ভব ও বিকাশ। এই যাত্রাটি শুরম্ন হয়েছে এককোষী ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে। ডারউইন যে তত্ত্বটি দিয়েছিলেন তার মোদ্দা কথা হলো, একটি প্রাণীর টিকে থাকা নির্ভর করে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে তার খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতার ওপর। আমরা জানি পৃথিবীর পরিবেশ বেশ বড় রকমের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রাপ্ত ফসিলের প্রমাণ থেকে বুঝা যায় যে, নতুন পরিবর্তিত পরিবেশে কিছু প্রাণী দ্রুত বেড়েছে। আবার অন্যদিকে যারা খাপ খাওয়াতে পারেনি তারা পটল তোলেছে। শুধু যোগ্যতররাই টিকে থেকেছে।
ধর্মবিশ্বাসীরাতো আছেনই, প্রাণীবিজ্ঞানীদের মধ্যেও যে ডারউইনবিরোধী লোক নেই তা নয়। আর সব তত্ত্বেরই যেমন বিরোধী পক্ষ থাকে, এরও আছে ও ছিল। তো এই বিরোধী পক্ষের একটি মোক্ষম যুক্তি হচ্ছে যে যদি প্রাণী বিবর্তিত হবেই তবে তা ধাপে ধাপে হওয়ার কথা। তো হাঁস থেকে যদি সজারু হয়, তবে মাঝখানে হাঁসজারু বলে একটি প্রাণী থাকার কথা। কিন্তু দুই ধরনের প্রাণীর মাঝামাঝি এরকম কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব বা ফসিলগত প্রমাণ তো মেলে না। তা হলে, জলের মাছ কিভাবে বিবর্তিত হয়ে ডাঙ্গার ইঁদুর হলো। বিবর্তনের মাঝামাঝি সময়ের সেই প্রাণীগুলো গেলো কই? যদি বিবর্তন সত্যি হয়ে থাকে তবে সেরকম প্রাণীতো আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা।
আসলে আমরা সেরকম প্রাণীর ফসিল অনেক আগেই পেয়েছি। যদিও ফসিলের রেকর্ড অসম্পূর্ণ এবং ডারউইন তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর্কিওপটেরিক্স নামের সরীসৃপ-মতো- পাখির ফসিল আমরা পেয়েছি, যা একধরনের প্রাণী থেকে আরেকধরনের প্রাণীর বিবর্তিত হওয়ার প্রমাণ। একইরকম আরো কিছু ফসিলের প্রমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে ডাইনোসরেরই পরবর্তী বংশধর হচ্ছে পাখিরা। আদ্যিকালের কিছু তিমির ফসিল দেখে বিজ্ঞানীরা এও নিশ্চিত হয়েছেন যে প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই হয়তোবা কিছু ডাঙ্গার স্তন্যপায়ী প্রাণী আবার ফিরে গিয়েছিল সমুদ্রে। তাই আমরা জলবাসী প্রাণীদের মধ্যে পাই স্তন্যপায়ী প্রাণীও, যারা আসলে মাছ নয়।
কিন্তু এই সব প্রমাণকে ছাড়িয়ে গেছে সামপ্রতিক একটি আবিষ্কার। লন্ডন বিজ্ঞান যাদুঘরে এই সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে এই সদ্য পাওয়া ফসিলটির প্রদর্শনী। এটি অত্যন্ত অদ্ভুত একটি প্রাণী, যা মূলত: মাছের মত কিন্তু তার মধ্যে বিবর্তনের এমন কিছু চিহ্ন আছে যা প্রমাণ করে এটি ডাঙ্গায় বসত করা শুরু করেছিল। এই ফসিলের প্রাপ্তি মিলে যায় বিবর্তনবাদের এতদিনের মূল দাবীর সাথে। যেখানে বলা হয়েছে সমুদ্রের আদি উৎপত্তিস্থল থেকে প্রাণীরা একসময় বের হয়ে এসে ডাঙ্গায় বসবাস করতে শুরু করে।
কানাডার বরফাবৃত আর্কটিক অঞ্চলে পাওয়া এই প্রায় 9 ফুট লম্বা প্রাণীটির একটি আদুরে নাম রেখেছেন আবিষ্কারকরা; 'ফিশাপড'। স্থানীয় ভাষায় এরকম মাছকে বলা হতো "টিকটালিক", অর্থাৎ ঝর্ণার বড় মাছ। ধারণা করা হচ্ছে 'ফিশাপড' হচ্ছে ডেভোনিয়ান পিরিয়ড বা মাছের যুগের সামনের সারির জীব। আর সে সময়টা ছিল আজ থেকে প্রায় 380 মিলিয়ন বছর আগে। কেমন দেখতে ফিশাপড, তা বুঝার জন্য তার মডেলের ছবিটা দেখুন। তার ছিলো মাছের মত আঁশ, দাঁত ও ফুলকা। কিন্তু একটি বড় বাঁকানো হাড়সহ বুকের খাঁচা ছিলো যাতে বুঝা যায় একই সাথে ফুসফুসও ছিলো এর। বুকের হাড় ও খাঁচা দেখে বুঝা যায় সেটি তার শরীরের ওজন নিতে পারতো, যা মাছের ক্ষেত্রে হয় না। আরো বড় কথা ফিশাপডের ঘাড় ছিল, যা মাছের থাকে না। সবচে বিস্ময়কর হচ্ছে বুকের দিকে পাখনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেল সেখানে রয়েছে চতুষ্পদী প্রাণীর হাতের মত অঙ্গ। আদিতম সেই হাতের হাড়ে আঙুলের মত পাঁচটি হাড়ও রয়েছে। আবিষ্কারক ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর নিল শুবিন তাই বললেন, এটা প্রাণীজগতের কোনো দুর্লভ শাখার সদস্য নয়। এটি আমাদের প্রাচীন এক খালাতো-মামাতো ভাই (কাজিন)।
সদ্য আবিষ্কৃত এই ফিশাপড তাই ডারউইনের তত্ত্বের বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে প্রতিষ্ঠা দিলো। আর তথাকথিত 'ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন থিওরি'র সমর্থকদের ফেললো নতুন লজ্জায়। তবে এটিও বুঝা গেল যে, বিবর্তনের বহু অংশের প্রামাণ্য ফসিলের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি কিন্তু যখনই নতুন ফসিল পাওয়া যায় তা বিবর্তনের তত্ত্বকেই নতুন করে জোরদার করে তোলে। অনেকেই বলে থাকেন বিবর্তনবাদ শুধুই একটি তত্ত্ব। কিন্তু এটি বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচে সফলতম তত্ত্ব, কি ধরনের ফসিল রেকর্ড পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে যে তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী হাজার- লক্ষ বার সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন