আপনার মন কি আপনার দখলে? প্রশ্ন পড়ে মনে হতে পারে, "এটা একটা স্টুপিড প্রশ্ন"। কিন্তুআসলে প্রশ্নটি মোটেই স্টুপিড না। অনেক মানুষ আছে যাদের কাজ দেখে বুঝা যায় যে তাদের মনের কলকাঠি অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে।তারা এলোমেলো পা ফেলে ঘুরে বেড়ায়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। একজন মানুষের কাছ থেকে কোনো একটা কথা শুনে, আরেকজনের কাছ থেকে আরেকটা আইডিয়া নেয়। ধার করা মতামত আর ভাবনা নিয়ে তারা জীবন চালায়। আসলে তারা যা করছে তা হলো, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করার দায়িত্ব দিচ্ছে অন্যকে। অন্যের দেখানো আলোতে পৃথিবীকে চিনছে। মা-বাবা, শিক্ষক, ধর্মগুরু, অথবা বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে শেখা-জানা মূল্যবোধগুলোকে তারা গ্রহণ করছে, বিনা প্রশ্নে।
চেনা গানটিকে বদলে দিয়ে লিখি:
তোমার মনে বসত করে কোন জনা, ও মন জানো না..
তোমার মনে বসত করে কয়জনা.....
নিজের মনের মালিকানা ধরে রাখাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ক্লাশ সিনিয়র ছিলেন নার্গিস আপা। সাংঘাতিক মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াতেন। চোখগুলো থাকতো ফোলা ফোলা। তার বান্ধবীদেরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জানতে পেরেছিলাম যে রাতভর তিনি নামাজ পড়েন আর কাঁদেন। কাঁদেন তার প্রথম প্রেম যাতে বেঁচে থাকে সেজন্য। তার প্রেমিক রউফুল ভাই নাটক, আবৃত্তি, মঞ্চে গান করা মানুষ, কিন্তু নামাজ পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত। তার সাথে সম্পর্কের সুবাদে নার্গিস আপাও শুরু করলেন নামাজ। কিন্তু সম্পর্ক টিকলো না। রউফুল ভাই বিয়ে করে ফেললেন অন্য কাউকে। নার্গিস আপার পরবর্তী প্রেম হলো কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী পনির ভাইয়ের সাথে। পনির ভাই ধর্ম-কর্মের ধার ধারেন না। সাহচর্যে দু'এক মাসের মধ্যে নার্গিস আপাও ছেড়ে দিলেন তার নামাজ-দোয়া।
এরকম উদাহরণ সবারই জানা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি আপনার মা-বাবার রাজনৈতিক মতের অনুসারী? সেটা কি একারণে যে তারা যা বলেছেন আপনি তাই বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার সময় আপনার ছিল না তাই? যদি আপনার ছেলে মেয়ে থাকে বা হয় তবে কি আপনি একইভাবে তাদেরকে বড় করবেন, যেভাবে আপনার মা-বাবা আপনাকে বড় করেছেন? কেন?
আমি বলছি না অন্যের যুক্তিসঙ্গত কথাকে আপনি উড়িয়ে দেবেন। এটাই বরং বোকামি হবে। আমি বলছি আপনার নিজের মনকে প্রভাবমুক্ত রাখার কথা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া এবং অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গী যাতে আপনাকে নির্ভরশীল না করে ফেলে।
নির্ভরশীলতার এক ভালো উদাহরণ হতে পারে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু (আমরা বান্ধবী শব্দটা ব্যবহার করতাম না। বন্ধু বা দোস্ত বলতাম।) নাসরিন। ফাঁকিবাজ ছাত্র-ছাত্রীরা শর্টকাট মেথডের জন্য আমার কাছে আসতো। ও অবশ্য ফাঁকিবাজ ছিল না, আত্মবিশ্বাসী কম ছিল আর আমার উপর অগাধ আস্থা ছিল ওর। কিন্তু ও কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল তা বুঝা গেল মাইক্রোবায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময়। আমি অন্য গ্রুপে পড়েছি। সুতরাং পরীক্ষার সময় সাহায্য করার উপায় নেই। তাই ভালো করে ওদেরকে শর্টকাট মেথড বুঝিয়ে দিলাম কিভাবে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ব্যাকটেরিয়া দেখে ছবি আঁকবে। তা নার্ভাস নাসরিন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে আরো নার্ভাস। মহা ব্যস্ত। এক্সটানর্াল এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন ও দেখেনি। নিয়ম হলো মাইক্রোস্কোপের লেনসটা উপর থেকে নীচে নামাতে হয়। আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি আগে লেনসটাকে স্লাইডের একদম কাছে এনে তারপর আস্তে একটু তুললেই পরিষ্কার ব্যাকটেরিয়া দেখা যাবে। ও তাই করছিল। এক্সটার্নাল পাশ থেকে বললেন, "এই তুমি উলটা করছো"। ও বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো, "শোহেইল বলেছে এভাবেই সহজ"। এক্সটার্নাল ওর বকা খেয়ে সরে গিয়ে পাশে গিয়ে আরেক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন "শোহেইল কে? তোমাদের নতুন কোনো টিচার?"। আর অপেক্ষা করতে লাগলেন বিকাল বেলা আমি আসলে ধরবেন।
নাসরিন এরকম অনেক ক্ষেত্রেমানসিক নির্ভরশীলতা দেখেছি। আরো অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই এরকম দেখা যায়। আড্ডায় বসলে দেখা যায়, অনেক ছেলে-মেয়ে কথা বলে ওদের বাবা-চাচার ভাষায় ও চিন্তার ভঙ্গিতে। শুনলেই বুঝা যায় মেকি। নিজের মন, চিন্তা করার ক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তারা অর্জন করতে পারেনি। বড়র প্রভাবে হারিয়ে ফেলেছে তার প্রশ্ন করার ক্ষমতা।
সজল নামে একজনের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেলো টিএসসি থেকে । সারা পৃথিবীর সব প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে সে। বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, সফল ব্যবসায়ী এদের বিরুদ্ধে। পুরনো বন্ধুদেরকে সময় কম দিয়ে তার সাথে আমি বেশি সময় কাটাতে লাগলাম। বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করলাম স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি, গোষ্ঠী ও দলগুলোর প্রতি তার চরম বিদ্্বেষ। কেন বুঝতে পারছিলাম না। তারপর তার কাছ থেকে তার জীবনের গল্প শুনলাম। সে তার পরিবারের কথা বললো। সর্বহারা ধরনের দলের নেতৃত্বের সাথে জড়িত তার পরিবার। মাওবাদী বামপন্থী চিন্তার মানুষ তারা। তাদের কারণে সেও একই চিন্তার অনুসারী। এবং এই চিন্তা-ভাবনা থেকে একচুল সরে আসতেও সে রাজি নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে সে দুই শুঁয়োরের লড়াই বলেই মানে। আমাদের দুজনের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মিল ছিল। কিন্তু এই বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়া মানুষের সাথে দীর্ঘসময় কাটানো আমার পক্ষে সম্ভভ ছিল না। বন্ধুত্বে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো ধীরে ধীরে। আমি বিশ্বাস করি না, প্রশ্ন না করে বিনাবাক্যে জীবনের সবকিছু মেনে নেয়া যায়। এবং আমার সেই বন্ধুটি মনে করে তার চিন্তা একটি শুদধ চিন্তা, পরিবারের সৌভাগ্যে সে এই চিন্তার স্পর্শ পেয়েছে এবং এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার মানে হয় না।
সেকেন্ড-হ্যান্ড আইডিয়া, বা অন্যের চিন্তার দাসত্ব করে মানুষের জীবন কাটানোকে আমার পরগাছার জীবন মনে হয়। সচেতন মানুষরা কখনই তা করেন না। তাদের মূল মন্ত্রই হলো:
ভাবো, বিশ্বাস করার আগে....
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন