আরবের সাহসী যোদ্ধা ও রণকুশলতার জোরে পৃথিবীর মানচিত্রে ইসলাম ও মুসলিমদের অবস্থান পাকাপোক্ত ছিল দীর্ঘদিন। অটোমান সাম্রাজ্য টিকে ছিল 1918 সাল পর্যনত্দ। সে পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলিমদেরকে বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার ক্ষয় শুরু হয়েছিলো অনেক আগে থেকেই। বাহুবল বা সমরশক্তি কমে যাওয়াটাই এই ক্ষয়ের কারণ নয়। ইউরোপের সাথে মুসলিম বিশ্বের মূল পার্থক্য তৈরি করে দেয় শিল্প বিপ্ল ব। নানা আবিষ্কারে, যন্ত্র ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে থাকে ইউরোপ। তৈরি করতে থাকে আধুনিক অস্ত্র। রেলগাড়ি, বিদু্যত, মোটরগাড়ি ইত্যাদির আবিষ্কার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে সেকু্যলার প্রতিষ্ঠান তৈরি ইউরোপকে দাঁড় করায় সভ্যতা ও অগ্রগতির এক শক্ত ভিত্তির উপর । মুসলিম বিশ্ব তখন বিভিন্ন আধুনিক পণ্যের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে পশ্চিমা বিশ্বের উপর। শুধু পণ্য নয় পশ্চিমাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির প্রতিও তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে খুব ধীরে বদলাচ্ছিল মুসলিম বিশ্ব। অন্যদিকে পরিবর্তনের হাওয়া তখন পশ্চিমাদের পালে। মুসলিম জনপদগুলো নিজেদের তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আস্থা হারাতে শুরম্ন করলো। অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা বিশ্বের আদলে আদালত, ব্যাংক, স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা পেল। মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো যুগের এই পরিবর্তনের হাওয়ায় জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো। এই পরিবর্তনগুলো পশ্চিমা বিশ্ব থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কারণ অটোমান সাম্রাজ্যের পতাকা তখনও উড়ছে প্রবল প্রতাপে।
কিন্তু ক্ষয়টা টের পাওয়া যাচ্ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফাকে ইসলামের খলিফা মানতে রাজি ছিলো না অনেক মুসলিম দেশ। তাদের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার ছিলো অনেকেই। তাদের ধর্মপালন ও ইসলামকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আরো অনেক আগেই। সুতরাং বিশ্বের মুসলিমরা তখন দ্বিধাবিভক্তির কারণে নেতৃত্বশূন্য ও স্বাভাবিক কারণেই পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মোহে আক্রান্ত। নিজেদের এই পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ ছিল সময়ের সাথে নিজেদের পরিবর্তন না করা এবং বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণায় রত না হওয়া। কিন্তু মৌলবাদী অংশ মুসলিমদের এই ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করলেন অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা শত্রু হিসেবে দেখলেন পাশ্চাত্যের পণ্য ও আবিষ্কারকে। তাদের প্রতিষ্ঠান ও জীবনাচরণকে। সুতরাং তাদের কাছে মনে হলো এর সঠিক সমাধান হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার বিরোধিতা।
1870 এর দিকে তাই সৃষ্টি হলো নতুন এক ইসলামী পুনর্জাগরণের। তাদের মূলমন্ত্র হলো পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতা। সেসময়কার একজন সম্মুখসারির মুসলিম ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন জামাল আল-আফগানি (1838-97)। আল-আফগানি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ঘুরে ঘুরে তার পশ্চিম বিরোধী প্রচারণা চালালেন। তিনি দাবী করলেন যে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা ব্রিটিশ, ফরাসী ও রাশিয়ার শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ লুটে নিচ্ছে এবং মুসলিমদেরকে শোষণ করছে।
আল-আফগানি প্রতিষ্ঠা করলেন 'ইসলামী আন্দোলনের'। তার উদ্দেশ্য ছিলো মুসলিম বিশ্বের একতা সৃষ্টি। তিনি কড়াকড়িভাবে শরিয়া আইনের অনুসরণের দাবী জোরালো করে তুললেন। কিন্তু এসবের পাশাপাশি তিনি আহ্বান জানালেন পশ্চিমা শক্তিগুলোকে আক্রমণের। এই আক্রমণে প্রয়োজনে পশ্চিমাদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতেও তিনি মুসলিমদেরকে উদ্বুদ্ধ করলেন। আল-আফগানির 'ইসলামি আন্দোলন'-এর মূল লক্ষ ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে ইসলাম ও মুসলিমদের যে শক্তি ও মর্যাদা ছিল তা ফিরিয়ে আনা। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের কাছে নিজের অনুসারীদের নিলর্জ্জ আত্মসমর্পণের অন্তর্গত কষ্টই অনেক মুসলমানকে আরো বেশি মৌলবাদী করে তুললো। তারা নিজ ধর্মভাই ও ধর্মের এই দৈন্যদশা দেখে আরো বেশি অনত্দর্মুখী হওয়ার সিদ্ধানত্দ নিলো। সময়ের সাথে ক্ষমতা বজায়ের কৌশল যে পাল্টায়, ক্ষমতা ও প্রতাপ যে শুধু অস্ত্র আর শক্তিবলেই ধরে রাখা যায় না তা তারা বুঝতে ব্যর্থ হলো। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, সমর কৌশলে পশ্চিমা দেশগুলো এগিয়ে গেছে অনেক। অন্যদিকে শুধু ধর্মকথা নিয়ে পড়ে থাকা আরব-মুসলিম বিশ্ব হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখে বদলে গেছে পাশার দান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হলো অটোমান সাম্রাজ্য। উটের গতি দিয়ে যুদ্ধজয় তখন আর সম্ভব নয়। সুতরাং সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যটাই হাওয়া হয়ে গেলো পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের দখলদারিত্বের তোপে। এই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন প্যালেস্টাইন, ইরাক, জর্দান, সিরিয়া ও লেবানন চলে যায় ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে তুরস্ক, মিশর ও ইরানে স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। নতুন এসব অঞ্চলে নতুন দায়িত্ব পাওয়া হতভম্ব নেতারা পশ্চিমমুখী হয়ে পড়েন আর সে কারণে এসব রাষ্ট্রে বা সমাজে ধর্মের ভূমিকা কমতে থাকে। এসব বেশিরভাগ দেশ রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রতিস্থাপন করে।
স্বাভাবিক ও সঙ্গত কারণেই এ সময়ে বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের জন্ম হয় যারা এসব নতুন রাষ্ট্রের পশ্চিমা-আধুনিক ধ্যানধারণা মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং পশ্চিমাদের দৌরাত্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরম্ন করে। এসব গ্রুপের মধ্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে হাসান-আল-বান্না কর্তৃক 1928 সালে মিশরে প্রতিষ্ঠিত 'মুসলিম ব্রাদারহুড'।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন