মানুষ আশাবাদী। অন্যায়, অবিচারের যখন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায় না তখন প্রচন্ড আশা বুকে বেঁধে মধ্যবিত্ত মানুষ উচ্চারণ করে, যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে তখন কিছুতেই আর মানুষকে আটকে রাখা যাবে না। সে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত মানুষের পিঠ দেয়ালে গিয়ে আর ঠেকে না, সে ঘুরেও দাঁড়ায় না। অন্তত: আমার চোখে তা কখনও দেখিনি। বরং মধ্যবিত্ত মানুষকে দেখেছি নিজের চারপাশে দেয়াল তুলতে। আরো নিরাপদ, আরো সুকঠিন দেয়াল তুলে তারা নিজেরাই নিজেদের দেয়ালবন্দী করে তুলছে। নিজস্ব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়েই মাঝে মধ্যে হা-পিত্যেশের ঢেঁকুর তুলছে; পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে কি জানি কি করে ফেলার কথা তাও তারা আলোচনা করে ঐ দেয়ালের মধ্যেই। দেয়াল নিরাপদেই আছে। আর মধ্যবিত্তরা সেই অবিকল একই কায়দায় চালিয়ে নিচ্ছে। না তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকছে। না তারা বাধ্য হয়ে ঘুরে দাড়াচ্ছে।
দেশের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা নিয়ে নাকি সেখানকার শিক্ষকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। স্কুলে-কলেজে সারাটা দিন কাটানোর পরও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ছুটতে হয় সি. হক, ডি. হক কোচিং সেন্টারে। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নামতে নামতে সেগুলো দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির প্রতিষ্ঠান হয়ে গেলো। পিঠ তো দেয়ালে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কই কিছুই তো হলো না। বরং হাজির হলো প্রি-ক্যাডেট, ইংলিশ-মাদ্রাসা, ও লেভেল, এ লেভেল, কত কি? মধ্যবিত্ত সেদিকেই ছুটলো। নিজের বেতনের চেয়ে সন্তানের স্কুলের বেতন বেশি। অভিভাবকের আয়ের সিংহভাগ খসে যাচ্ছে সন্তান-সন্ততির শিক্ষা খরচে। সেই যুক্তিতে মধ্যবিত্তের ঘুষের বাজারও শক্তিশালী হলো। কিন্তু পিঠ? কি এক অদৃশ্য কায়দায় দেয়ালে ঠেকলো না। প্রতি বছর বাজেটের সিংহভাগ যে শিক্ষা খাতে যায় সে খাতের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন শ্লোগান হলো না।
শুধু শিক্ষাব্যবস্থা নয়, বিভিন্ন খাতেরই একই দৃশ্য। চলচ্চিত্রের কথা ধরুন। সরকারী টাকায় এফডিসি বানিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিশেষ সুযোগ দেয়া হলো দেশীয় শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের। ভারতের ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে ব্যবস্থা করা হলো শিল্প বিকাশের। নানা অজুহাতে, দর্শকের চাহিদার কথা বলে, প্রতিযোগিতার কথা বলে, সময়ের সাথে তাল মেলানোর কথা বলে, তা গেলো অধ:পতনের দিকে। মধ্যবিত্ত সিনেমা হল ছাড়লো। সিনেমা পত্রিকা পড়া ছাড়লো। ঘরের কোণে টিভি আর ভিসিআর নিয়ে পড়ে থাকলো। এফডিসি নামতে নামতে পর্নো বানাতে শুরু করলো, কাটপিস তার কোডনেম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মত ছবি আমাদের থাকলো না। কুমির ছানার মত ঝুলি থেকে বের করে দেখাতে হয় সূর্য দীঘল বাড়ি, দহন, সীমানা পেরিয়ে এরকম গুটিকয়েক সৃষ্টি। সবাই বললো, একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। কিন্তু কই? মধ্যবিত্ত সোফায় হেলান দিয়ে আঙুল রাখলো রিমোট কন্ট্রোলের বোতামে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে সে এখন পাশ্ববর্তী দেশের চলচ্চিত্রের খরিদ্দার। 'আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের রইলো না'। কারা বানায় সেসব ছবি, কারা দেখে, তার কোনো আলোচনাই ভদ্রসমাজে হয় না। ধ্বংসের প্রান্তে পুরো শিল্প। ঘটনা সেই একই। দেয়ালে পিঠ ঠেকলো না, মধ্যবিত্তের ঘুরে দাঁড়ানো হলো না।
পাবলিক লাইব্রেরিগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিবছর জনগণের টাকায় রাজনৈতিক লেখকদের 'বই' নামের ছাপা-অযোগ্য মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলো কিনছে। মধ্যবিত্ত সে খবরই রাখে না। জাতীয় এয়ারলাইনস বিমান ডানা ভেঙে পড়ছে। জাতীয় টিভি পর্দা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে গেল, হয়ে যাচ্ছে। ক্লাবের নামে, সংঘের নামে, সমিতির নামে। মধ্যবিত্তের সনত্দানরা খেলা ছাড়লো, মাঠ ছাড়লো। আর ঘরেই আটকে গেলো। পিঠের উপর চাপ দিয়ে বসে থেকে, শুয়ে থেকে। ঘুষ, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঘোড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পত্রিকার পাতায় পাতায় দেশবাসীর নাভিশ্বাস। বোমাসন্ত্রাস, নষ্ট রাজনীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বাড়ছে দিনের পর দিন। বারিধারা এ্যাম্বেসিগুলো উপাসনালয়ের থেকে আর বিদেশি ভিসা বেহেশতের টিকেটের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠলো মধ্যবিত্তের কাছে। কর্মঠ, বুদ্ধিমান, মেধাবী তরুণেরা স্রোতের মত দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। 'মেধা পাচার' নিয়ে চায়ের কাপে অনেক ঝড় হলো। হয় সোফার নরোম তুলোর বালিশে বা দেয়ালে হেলান দিয়ে । কিন্তু ঐ পর্যন্তই। পিঠ দেয়ালে ঠেকার পর যে ঘুরে দাঁড়ানো সে পথে কেউ গেল না, কেউ যাচ্ছে না।
তবে কি মধ্যবিত্তের পিঠ নতুন কোনো কায়দা শিখে ফেলেছে? মানুষের স্বাভাবিক সমাজ সূত্রকে অস্বীকার করার মতো কোনো কায়দা? পিঠ দিয়ে দেয়ালকেই ঠেকাচ্ছে তারা? নাকি দেয়ালকে দিয়েছে তারা তাদের বুক? পিঠকেই কি কোনো কায়দায় উধাও করে দিয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্ত?
আপনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখলাম। আপনাদের জানার কথা। নিজস্ব একটা উত্তরও থাকার কথা আপনাদের।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন