রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেননি তখনও সার্টিফিকেট দিতেন। নিজস্ব প্যাডে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরসহ। তখন ইংরেজ আমল। বাঙালির হাতে বাংলা ব্যাকরণ ধরিয়ে দেয়ার পর ইংরেজশাসক তখন কলেজ খুলে বাঙালিকে বাংলা শেখাচ্ছে। কলেজে বাংলা জানা অধ্যাপক দরকার। ইংরেজ প্রিন্সিপাল 'যাত্রা-নাটকের' ইংলিশ ভঙ্গির বাংলা ভাষায়, 'টুমি বানগালা জানে তো' বলে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়োগ দিচ্ছেন। বঙ্কিমও তেমন ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন আর এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন আপদ। সে কথা থাক। রবীন্দ্রনাথকে ধরে এক বেকার কবি সার্টিফিকেট নিয়ে কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন। অন্য বেকার কবিদের কানেও পেঁৗছে গেল সেকথা। কী সার্টিফিকেট, কী সার্টিফিকেট। সবাই উদগ্রীব। খুবই স্মার্ট ছিলো সে সার্টিফিকেট।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেটে কত কথা লিখে সার্টিফিকেটে। রবীন্দ্রনাথ কবিতাতে যতই রমণীয় হোন না কেন সার্টিফিকেটে ছিলেন টান টান। অবশ্য বর্তমান সময়ে হয়তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও এরকম সার্টিফিকেট দেয়। আমার পছন্দ হয়েছিল ডারহাম ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম, নীচে ভাইস-চ্যান্সেলারের সিল। মাঝে ছাত্রের নাম ও ডিগ্রি। ব্যস। 'দিস ইজ টু সার্টিফাই.' দিয়ে শুরু করে বাড়তি কোন রচনা নেই। মগাদিসু চৌরাসিয়া, এমবিএ। ঠিক যেরকম ভিজিটিং কার্ডে নাম ও ডিগ্রি লেখে অনেকে, সেরকম। নীচে স্বাক্ষর দেয়া। যেন বলে দেয়া হলো নামধারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এই। রবীন্দ্রনাথের ঘটনা এর একশো বছর আগের। তারপরও তার সার্টিফিকেট সমান স্মার্ট। তিনি সার্টিফিকেট দিতেন এরকম, 'আমার সুনীল বাংলা জানে'। রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরযুক্ত এই পত্র দেখেই বেকার কবিকে চাকরি দিয়ে দিল ইংরেজ প্রিন্সিপাল। সে খবর চাউর হয়ে গেল অখন্ড ভারতময়। কবির অভাব বাংলায় কোনো কালেই ছিলনা। কবিতা লেখে বলে চাকরি করবে না, সব কবির গোড়ালির জোর অতো বেশি না। সুতরাং চাকরির বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়লো উঠতি কবিরা। তবে সবাই আর কষ্ট করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত গেল না। তারা নিজেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে নিজেকে সার্টিফিকেট দিত। চার শব্দের সার্টিফিকেটে কলেজের অধ্যাপকের চাকরি। এই সুযোগ হেলায় কে ছাড়ে। এরকম বেশ কিছু নব্য-রবীন্দ্রনাথের খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী একটা আসল-নকল যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলো। খুব একটা সাড়া না পাওয়ায় নিশ্চিত হওয়া যায়নি রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে কয়জনকে এই সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
ভাষাসৈনিক হিসেবে গোলাম আজমের সার্টিফিকেটও তেমনি নিশ্চিত-অনিশ্চিতের পদ্ধতির উর্দ্ধে চলে গেছে। এক্ষেত্রে সার্টিফিকেট দাতা হিসেবে নাম আছে রবীন্দ্রনাথের নয়, শেখ মুজিবের। তিনি পরপারে। আব্দুল গাফফার চৌধুরী স্টাইলে মৃত ব্যক্তির সার্টিফিকেট ব্যবহারের এ কায়দাটি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন মুহাম্মাদ কামরম্নজ্জামান। গোলাম আযমের জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন তিনি, নাম "অধ্যাপক গোলাম আযমের সংগ্রামী জীবন"। অধ্যাপকের জীবন সংগ্রামীতো হবেই। তবে তার জীবনের সাথে বাংলাদেশের সংগ্রামকে বোধহয় একটিমাত্র বিন্দুতে মেলানো যায়, সেটি হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। সেই বিন্দুর উপর তাই তার সমর্থকরা কুতুব মিনার বানান। ভাষা-সৈনিক আব্দুল মতীন এবছরের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন যে গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। বললেই হলো। তার চেয়ে অনেক বড় ব্যক্তির সার্টিফিকেট দেয়া আছে কামারুজ্জামানের বইতে। বইটি প্রকাশ হয়েছে 1989 এর ফেব্রম্নয়ারিতে। তবে রবীন্দ্রনাথের মত চার শব্দের সার্টিফিকেট নয় পুরো একটা বাক্যের সার্টিফিকেট।
জীবনীগ্রন্থের ভাষা আন্দোলন অংশের শেষ প্যারাটিই তুলে দিই:
"1954 সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী অভিযান উপলক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রংপুর সফরে যান। জনসভা শেষে রংপুর মিউনিসিপ্যাল হলে এক সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সুধী সমাবেশে অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযমকেও দাওয়াত দেয়া হয়। সেখানে শেখ মুজিবও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে ছিলেন। শেখ মুজিবই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে অধ্যাপক গোলাম আযমকে এই বলে পরিচয় করিয়ে দেন যে, "ইনি আমাদের ভাষা আন্দোলনের নেতা গোলাম আযম যিনি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন।" (পৃ: 22)।
এই প্যারাগ্রাফের পর ভাষা আন্দোলন অধ্যায় শেষ। অর্থাৎ এটি সবচে বড় সার্টিফিকেট গোলাম আজমের জন্য বুঝা যাচ্ছে। যাক, শেখ মুজিব কতজনের কত কাজে লাগলেন। গোলাম আজমের সার্টিফিকেট-দাতা হিসেবেই নাহয় জামায়াতে ইসলামী শেখ মুজিবের কথা স্মরণ রাখবে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন