আগের বাড়িতে শুরু করেছিলাম থিওরি টেস্টিং। তো তত্ত্ব কেন প্রয়োজন সেকথা এখানে আর পাড়ি না। যারা সেসব কথা ঝালাই করতে চান তারা এখানে খোঁচা মারতে পারেন।
এখানে জাতি সম্পর্কে একটা তত্ত্ব দিয়েই শুরু করতে চাই। নৃতত্ত্বে যে আমার গভীর আগ্রহ তা আপনারা তত্ত্ব পড়লেই ধরতে পারবেন। আর তত্ত্ব সম্পর্কে মতামতটা মন্তব্যে দিলে আপনাদের মর্জি বুঝতে সুবিধা হবে।
বাঙালি একটা খাউক্কা জাতি
আমাদের খাদ্যের অভাব সুতরাং জাতি আমাদের ক্ষুধার্ত। দুর্ভিক্ষ? সেও আমাদেরই আছে (দুর্ভিক্ষ শব্দটাও আমাদের; আর কোনো দেশে অর্থনৈতিক অবস্থাকে "ভিক্ষার অভাব ঘটেছে" নামে চিহ্নিত করা হয় না)। এক বাঙালিতো নোবেল প্রাইজ বাগালেন তা এই দুর্ভিক্ষের থিওরি দিয়েই। আরেকজন পেলেন এমন দরিদ্রমানুষকে কিভাবে ঋণ ধরানো যায় তার উপর। তবে দারিদ্র বা দুর্ভিক্ষ এ নিয়ে আর নতুন তত্ত্ব আমি দিতে চাই না। আমি বরং বলতে চাই বাঙালি ভোজনরসিক, খেতে ভালবাসে। দুর্জনে বলতেই পারে দরিদ্র আর ক্ষুধার্তরা খাবার পেলেই পেটে পুরে রাখে, অভাবের সময়ের সঞ্চয় হিসেবে। 'এইবেলা পেটপুরে খেয়ে নাও, ওইবেলায় নাও পেতে পারো'-ই কি মূলমন্ত্র? (একে আবার ভোজনরসিক বলে নাকি?) -সে তর্ক থাক। আগে মূলদাবীটাকে প্রতিষ্ঠা করি।
ভোজনরসিক শব্দটি বেশ রসমাখানো যোগবাদী (পজেটিভ) শব্দ। খাদক উপাধি দিলে দানব বা রাক্ষসের কথা মনে হয়। সুতরাং খাদক বা ভোজনরসিক এই দুটির তুলনায় খাউক্কা শব্দটা বেশি লাগসই; পোমো ভাব আছে, পূর্ববঙ্গের ঢক মালুম হয়। যোগ ও বিয়োগবাদ দুটো বিষয়ই এর মাঝে খেলা করে। শব্দটি কীভাবে ব্যবহার করবেন তার উদাহরণ দেই: ওরা 'খাউক্কা' পরিবারের সন্তান।
বাঙালি যে জাতি হিসেবে খাউক্কা, তার প্রমাণ বাঙালির জীবন থেকেই দেয়া যায়। জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহ; মানুষের জীবনের তিন গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মৃত্যুতে শোকপালন আর জন্ম ও বিবাহে আনন্দ সবাই করে। বাঙালির এ সবক'টা অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হলো খানা-দানা। তারা বিয়া খায়, কুলখানি খায়, চলি্লশা খায়। কেউ মারা গেলে শোকের সময় কাটতে না কাটতে বিরাট খানার বিপুল আয়োজন। তবে মারা গেলে একবার খানা দিয়া আত্মীয়স্বজনের রক্ষা নাই। ফি বছর মৃত্যুবার্ষিকী। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে আরো হ্যাপা আছে। পথে-পথে মোড়ে-মোড়ে এলাকায় এলাকায় প্যান্ডেল বান্ধো। সাথে খানাও লাগাও; খবরে বলা হবে কাঙালিভোজ, আসলে এর নাম হওয়া উচিত বাঙালিভোজ।
পশ্চিমাদের দেখাদেখি জন্মদিন পালনটাও শুরু করলো বাঙালি। তবে কেক কেটেই থামে না তারা। পোলাও-বিরিয়ানি না খাওয়াতে পারলে জন্ম নিয়ে দুনিয়াকে কী আর এমন দিলেন?
অবিবাহিতদের দেখলে লেজকাটা বয়োজ্যেষ্ঠরা খাওয়া-দাওয়ার কথা বলে সম্বর্ধনা জানায়। 'অনেকদিন পোলাও-বিরানি খাই না মিয়া, এই শীতে বিয়া লাগাও'। শীতে বিয়া লাগাইলে বিরানি খাইতে সুবিধা হয় কিনা সেই জরিপ চালানো দরকার। গরমে বিয়া হইলে পাড়া-প্রতিবেশির অসুবিধা কী?
জন্ম-মৃত্যু-বিয়াতে খাওয়া-দাওয়া নিয়া আর উদাহরণ দিবো না। জায়গার অভাব। গায়ে-হলুদ, মেহেদী সন্ধ্যা, পানচিনি, আকিকা, হাতেখড়ি, সাতমাইস্যা; জীবনের ধাপে ধাপে বাহারি খাওয়ার উত্সবের নাম আমার চেয়ে আপনারাই বেশি জানবেন। এবার অন্যদিকে চোখ ফেরাই।
পরীক্ষায় পাশ দিয়েছেন, নতুন চাকরি পেয়েছেন, প্রমোশন হয়েছে, নতুন বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড জোগাড়, বৃত্তি পেয়েছেন, লটারিতে ১২ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি জিতেছেন; খাওয়া দিয়ে দিন। ইংরেজরা যেসব ঘটনায় বন্ধু-স্বজনকে বলে, 'লেটস্ সেলিব্রেট'। বাঙালিরা বলে 'মিয়া, একটা খানা দেও!'। সেলিব্রেশনের পোষাকী অনুবাদ 'উদযাপন' হলেও ব্যবহারিক বাংলা তাই 'খানা দেয়া'। উদযাপনের মত বিষয়টিকে খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও কি বলা যাবে না বাঙালির খাদ্যপ্রীতি মারাত্মক? তারা আসলে একটি খাউক্কা জাতি!
জীবনের মোড়ে মোড়ে ছাড়াও অনুষ্ঠান আছে নানা রকমের। মিলাদের কথা মনে পড়ে আগে। পূজা, কীর্তন, বড়দিন - বাঙালি যে ধর্মেরই হোক না কেন, ধর্মের কোন্ অনুষ্ঠান বড় বুঝতে হলে আগে জানতে হবে কোনটায় খানা-পিনার এন্তেজাম বড় করে করা হয়। মাজারে শিনি্ন, মানত থেকে শুরু করে খানা-দানার আয়োজন নাই কোথায়? ব্যান্ড-কনসার্টেও নাকি আজকাল প্যাকেট লাঞ্চ দেয়া হয়। জাতীয় কবিতা উত্সব বাদ দিলাম, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলনে উঁকি দিয়ে দেখেছি আয়োজকরা খানা-দানার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত।
খাটি বাঙালি খানার সাথে পিনা শব্দ ব্যবহার করে না বলে, খানা-দানা। (অর্থাত দানাদার খানা খাওয়া)। সুতরাং অভিধানে থাকলেও কোনো পান করায় বাঙালি নাই। বাঙালি পানকেও তুলে এনেছে খাওয়ার পর্যায়ে। পাশের প্রদেশের ভারতীয়রা তাই টিটকারি দেয়, 'বাঙালি সব কুছ খাতা হ্যায়, কুছ পিতা নেহি'। নির্ভুল নৃতত্ত্ব। বাঙালি সিগারেট খায়, সিরাপ খায়, শরবত খায়, কোল্ড ড্রিংকস্ খায়, পানিও খায় এবং কালেভদ্রে হলেও মদও খায়।
যারা খাওয়াকে এত ভালবাসে তারা যখন রাষ্ট্র বানালো ১৯৭১-এ তখন খাদ্যের কথা ভুলেনি। তাদের জাতীয় পতাকা দেখলে মনে হয় সবুজ দস্তরখানের মধ্যে লাল সুরুয়াভর্তি তরকারির গোলাকার বাটি। বাঙালি তরকারিতে লালমরিচ ভালবাসে সেকথা বুঝতে লঞ্চ স্টেশনের রেস্টুরেন্টগুলোয় যাওয়ার দরকার নাই, তাদের পতাকার দিকে তাকালেই হবে। জাতীয় খাবার বলে জাতিরা কিছু ঠিক করে না। সুতরাং বাঙালির পছন্দের জাতীয় খাবারের নাম জানা কঠিন। তবে জাতীয় ফল একটা আছে মাশাআল্লাহ। জ্যাক সাহেবের এই ফল দিয়ে দশজনের একবেলা খানা দেয়া যায়। এই ফল আবার তারা খায় নানা প্রকারে। কাঁচা, পাকা ও শুকনো কাঁঠাল খাওয়ার চলও আছে। খাউক্কা জাতি ফলটি নিয়ে খুব গর্বিত; এর নাকি কিছুই ফেলা যায় না, সবই খাওয়া যায়। আষাঢ়ে গল্প শুনতে নাকি কাঁঠাল বিচি ভাজা খেতে হয়।
আমার তত্ত্বের এসব অকাট্য প্রমাণ যাদের সহ্য হচ্ছে না তারা মুখ বাঁকা করে বলতেই পারেন, ফল তো খাবার জন্যই। তা জাতীয় আর বিজাতীয় হোক। এর সাথে জাতিকে খাউক্কা বলার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকীটুকু শুনুন।
ফলতো খাওয়ার জন্যই, তাই বলে ফুল? কাঁঠালের মত ফলে যাদের পেট ভরে না তাদের জন্য রইলো শাপলা ফুল। বাঙালির জাতীয় ফুল। পৃথিবীর আর কোনো জাতি তাদের জাতীয় ফুল পেটপুরে খেতে পারে বলে শুনিনি। বাঙালি পারে। গোপালগঞ্জের ছেলে শাপলাকে যখন জাতীয় ফুল বানালো তখন এর খাদ্যবৈশিষ্ট্যের কথা একেবারেই ভাবেনি একথা কেউ দিব্যি দিয়ে বলতে পারবে না। দুর্ভিক্ষে, অনাহারে বাঙালিতো এর আগে শাপলাকে খাদ্য বলেই জানতো!
যে জাতি জাতীয় ফুল পর্যন্ত খায়, তাকে আপনি কী বলবেন...?
আপনি যাই বলুন, আমি বলবো খাউক্কা জাতি। (কিমজা)
মন্তব্য
সবাই খুব সিরিয়াস পাঠক এখানে মনে হচ্ছে।
এরকম রসের দেখি একেবারেই বেইল নাই।
কেউ মন্তব্য পর্যন্ত করেন নাই।
একজন শুধু দুই তারা দিয়া গেছেন।
কি লজ্জা!
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
না পড়ে মন্তব্য দেই কিভাবে। তবে আমি কোনো তারা দেই নাই। হি হি..পড়ে পড়া হবে।
আমি আরো দু্টা খাওয়ার কথা উল্লেখ করি যেগুলি আমার কাছে বাংগালীর খাওইন্না মনোভাবেরই প্রমাণ। একটি হল মুসলমানি উপলক্ষ্যে খাওয়া। আরে, একটা বাচ্চা ছেলের শরীরের কিয়দংশ কেটে ফেলা হবে, সে বেচারা কি ভাবছে না ভাবছে তার খেয়াল নেই; খাওয়াই সেখানে মূল বিষয় হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়টি ইউনিভার্সিটি লাইফে দেখা। নতুন না, এমনকি পুরানো একটা শার্ট অনেকদিন পরে পড়লেও বন্ধুদের একটা বা দুইটা অংশ বলে উঠবে, "আরে নতুন জিনিস লাগাইছস, খাওয়া দে।"। কোন কোন ক্ষেত্রে একই কথা ভিন্ন ভাবে বলা হয়। যেমন, আমার এক বন্ধু বলত, তোর নতুন স্যান্ডেলের ট্যাক্স দিবিনা?
বাংগালীর খাওয়া নিয়ে বেগম রোকেয়ার লেখাটা আমরা সবাই জানি। আর আপনার লেখার সাথে এক মত না দুই মত তা বলতে চাইনা। তবে একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, আমরা খাওয়ার জন্যই বাঁচি।
শেষ কথা:
আপনি জাতীয় পতাকা নিয়ে যেসব আজেবাজে () মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে আবার কেউ দেশদ্রোহী ফতোয়া দেয় কিনা। পরক্ষণেই ভাবছি, যারা এসব ফতোয়া দেবে, জাতীয় পতাকা নিয়ে তাদের কোন পতাকানুভূতি আদৌ আছে কি? সে হিসেবে আপনি এযাত্রায় হয়তো বেঁচে যাবেন।
...............................
আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।
হুম, খাওয়া দেয়ার দুটো উদাহরণ যোগ করায় ধন্যবাদ।
খাওয়ার জন্য বাঁচা আর বাঁচার জন্য খাওয়া নিয়ে তত্ত্ববাজি আছে। তবে ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কে ঢুকতে গেলে একটা বিরাট সাইনবোর্ড চোখে পড়তো। একটাই বোর্ড আর তার মূল বাণী খাওয়া সংক্রান্ত। পার্কে কি কারণে এমন বাণী তার রহস্য আমি বুঝতে পারিনি। বাণীটি হলো:
পৃথিবীতে না খেয়ে যত মানুষ মারা গেছে, খেয়ে মারা গেছে তার চেয়ে বেশি।
বুঝুন এবার। বাঙালি পার্ক ম্যানেজার দর্শনার্থিদের প্রথম জ্ঞান দিচ্ছেন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে।
(ভদ্রলোককে বোকা ভাববেন না। ঐ পার্কে বছরে একবার যারা যান তাদের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু খাওয়া-দাওয়া করা। বাঙালি বনে প্রকৃতিদর্শনে যায় না। যায় বন-ভোজনে।)
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
মুসলমানির মাধ্যমে একটা ছেলে মুসলমান হয়। সুতরাং খাওয়া দাওয়া হতেই পারে।
পড়েছি পোস্ট হবার পরপরই। মোল্লাপোকার কামড়ে গা জ্বালা করছে খুব। মাথা ঠান্ডা করে আবার পড়বো। তখনই লিখবো যা লেখার।
বাঙালীর খাওন নিয়া যা কইলেন তা মানতে কষ্ট হইলেও সত্যইতো লাগতাছে শুনতে...
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
ক্ষুধার্ত জাতির কাছে খাওয়া-দাওয়া প্রধান না হয়ে পারে?
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
হুমম…বাঙালি একটা খাউক্কা জাতি ।
তা নাইলে এরা আকাশের চাঁদ খাওয়ার চিন্তা করে? কিংবা মানচিএ?
এরা কিন্তু জল্পাই ও খায়!
খুবই মজাদার লেখা, খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে!
অবশ্য একটা জায়গায় একমত না, জাতীয় পতাকা দেখে আমার কখনও খাবার জাতীয় কিছু মনে হয় নি! পিচচীকাল থেকে "সবুজের বুকে লাল সূর্য" জেনে অভ্যাস।
--তিথি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
মনের গোপনে খাওয়ার আকাঙ্খা ঘাপটি মেরে বসে থাকলে সূর্য আঁকলে তা সুরুয়ার বাটি হয়ে যায়।
তবে অভ্যাস থেকে বের হয়ে আমার তত্ত্ব বিশ্বাস করতে হবে এমন চাপাচাপি আমি করছি না। এটা তো তো আর ধর্ম না। রসিকতা।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
নতুন মন্তব্য করুন