ঈদ ও মেলা শব্দদুটো একসাথে আমরা শুনিই না। ঈদ যদি খুশির দিন হয় আর মেলা হয় মানুষের জমায়েত তবে ঈদ আর মেলার মধ্যে খুব একটা বৈরিতা থাকার কথা নয়। তবু ঈদ উপলক্ষে মেলার আয়োজনের কথাতো কানে আসে না। ব্রিটেনের বার্মিংহাম শহর সেক্ষেত্রে একটা বিরল ব্যতিক্রম। ঈদ উপলক্ষে বার্মিংহামে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। উপলক্ষ ঈদ হলেও মেলাটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর জুন মাসের শেষে, ছুটির দিন রোববারে। যেমন 2005 সালের ঈদ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে 26 জুন। কেনো জুন মাসে ঈদ মেলা? ঈদ পালন করা হয় আরবী পঞ্জিকা অনুযায়ী, যা কিনা চান্দ্র বৎসর। সুতরাং সৌর বৎসরের সাথে তার তারিখ মেলে না। তাতে কোনো অসুবিধা ছিল না। যদি না বিভিন্ন বছর বিভিন্ন ঋতুতে ঈদ ঘুরে ঘুরে আসতো। যেকোনো ঋতুতে তো আর মেলা আয়োজন করা যায় না। ব্রিটেনের আবহাওয়া বলে কথা। জুন মাসটাই মোক্ষম সময় যখন বৃষ্টি ছাড়া রৌদ্রময় দিন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরা দুই ঈদ বছরের যে সময়ই হোক না কেন, ঈদ মেলার জন্য বার্মিংহামের মুসলিম কমিউনিটি মাস ঠিক করেছে জুনকে। অনুদান দেয়ার পাশাপাশি বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিল ঈদ মেলা আয়োজনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ফলে বার্মিংহামের উৎসবের ক্যালেন্ডারে ঈদ মেলা একটি উলেস্নখযোগ্য দিন। মেলা দেখতে প্রায় 30 হাজার দর্শক প্রতি বছর এসে থাকে বার্মিংহাম শহরে। যাদের জন্য ঈদ মেলা খুব বেশিদিন হয়নি এ মেলার আয়োজন হচ্ছে। এ বছর সাতে পা রাখলো ঈদ মেলা। মুসলিম কমিউনিটি'র নামে আয়োজন করা হলেও মেলায় দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীই প্রধান হয়ে ওঠে। হবেই বা না কেন? বার্মিংহামের 30% অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী'র 20% ই দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভুত। এর অর্ধেকই আবার পাকিসত্দানের। মুসলিম সংস্কৃতির শেকড়ও বেশ শক্ত এখানে। পাকিসত্দান ছাড়া অন্য যেসব দেশের মুসলিমরা এখানে বসবাস করছেন সেগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার কারণে উল্ল্লেক্ষখযোগ্য হলো, বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিসত্দান, ইয়েমেন, সুদান, ইরান, সোমালিয়া, বসনিয়া ও আলবেনিয়া। তাছাড়া বয়েছে কুর্দিরাও। মুসলিম কমিউনিটির নেতৃত্ব মূলত: দক্ষিণ এশিয়দের হাতে। সে কারণেই ঈদ শব্দটির সাথে আমাদের মেলা শব্দটি যুক্ত হতে কোনো সমস্যাই হয়নি। কি থাকে মেলায় বাংলাদেশে মেলায় যেরকম হরেক রকমের কারম্নশিল্পের স্টল বসে, বার্মিংহামেও তাই। বলাবাহুল্য বেশিরভাগ স্টলেই শোভা পায় দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প সামগ্রী। মিস্টি রসে টইটুম্বুর জিলাপি হচ্ছে মেলার বড় আকর্ষণ। কুলফি আইসক্রিমও পাওয়া যায় কোনো কোনো দোকানে। অলংকার, শাড়ি-চুড়ির দোকানের পাশাপাশি আসবাব-পত্রের দোকানও বসে মেলায়। দুপুর থেকে শুরুহয়ে মেলা শেষ হয় রাত আটটায়। জুন মাস বলে সূর্য তখনও অসত্দ যায় না। অনেকটা আমাদের দেশের বিকেলের মতো আলোই থাকে। আর এই পুরোটা সময় মঞ্চে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাকিসত্দানের নামকরা শিল্পীরা আসেন প্রতিবছর। তাছাড়া দৰিণ এশিয় বংশোদ্ভুত স্থানীয় শিল্পীরা জমিয়ে রাখেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আশিক-আল-রাসুল নামে একটি স্থানীয় মুসলিম সঙ্গীত গ্রম্নপ আছে যারা উদর্ু থেকে আরবী পাঁচটি ভাষায় গান করে থাকে। তাদের ব্যবহার্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যেও ইসলামের প্রভাব আছে। বিভিন্ন ধরনের ড্রাম ব্যবহার করে তারা। এর মধ্যে রয়েছে আরব অঞ্চলের দাফ, মিশর অঞ্চলের দারাবরৌকা আর আফ্রিকার জেম্বি। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বিচিত্র আয়োজন শুধু দোকান আর অনুষ্ঠান নয়। মেলায় আয়োজন করা হয়ে থাকে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। যেমন এক স্ট্যাম্পের ক্রিকেট চ্যালেঞ্জ। সেই সাথে আছে আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি। পরিবারের সবার জন্য মজার দৌড়ের প্রতিযোগিতা। শিশুদের জন্য নাগরদোলা সহ বিভিন্ন রকম রাইডের সুযোগ থাকে। তাছাড়া থাকে 'কুকিং কর্নার'। মূলত: বিভিন্ন রেস্টুরেন্টগুলো সেখানে আয়োজন করে বাহারি রান্না আর খাবার-দাবারের প্রদর্শনী। ভুলে গেলে চলবে না বার্মিংহামে রয়েছেন বিখ্যাত সব শেফ। ব্রিটিশদের রসনা জয়কারী 'বালটি কুইজিন' আবিষ্কার করেছিলেন বার্মিংহামেরই এক বাঙালি শেফ। মেলায় শেফদের কাছ থেকে দর্শকরা জেনে নিতে পারেন বিভিন্ন রেসিপি। নিজের চোখের সামনে দেখতে পারেন তাদের রান্নার কৌশল। মেলায় যেহেতু পরিবারের সবাই আসে সেহেতু মেলাতে সব বয়সীদের আনন্দ বিনোদনের জন্য কিছু না কিছু আয়োজন রাখা হয়। ব্রিটেনে অনেক উৎসবে ঢুকতেই বেশ কয়েক পাউন্ডের টিকেট কাটতে হয়। ঈদ মেলা একেবারেই ফ্রি। চেয়ারম্যান কাউন্সিলর তারিক খান সহ ঈদ মেলা কমিটির সব সদস্য উদার অভ্যর্থনাই জানান সবাইকে। ঈদ বলতে যদিও ইসলাম ধর্মের প্রাধান্য ফুটে ওঠে বার্মিংহামের ঈদ মেলায় এসে থাকেন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-পেশা নির্বিশেষে সবরকম মানুষ। আনন্দ আর উৎসবের চেহারাতো এরকম সার্বজনীনই হওয়ার কথা।
#এই লেখাটি প্রথম আলোর ছুটির দিনে সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন