যতই বন্ধু-বান্ধবরা আমার ছাত্রশিবির করা নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন করা শুরু করলো, ততই আমি বেশি জড়িয়ে পড়তে লাগলাম শিবিরের কর্মকান্ডের সাথে। আরো বেশি করে ইসলামী বই পড়া। আরো বেশি বেশি করে জামাতে নামাজ পড়া শুরু করলাম। এলাকায় ও স্কুলে যারা ছাত্রশিবির হিসেবে চিহ্নিত তাদের সাথে ঘুরাঘুরির মাত্রাও বাড়িয়ে দিলাম। কেন করছিলাম জানি না। তবে আমি চাচ্ছিলাম বন্ধুদের কাছে এ সত্যটা তুলে ধরতে যে ইসলামকে জানা, চরিত্র গঠন করা, এগুলো খুব একটা খারাপ কাজ নয়। কিন্তু কাউকে টলাতে পারলাম না। তবে কারো সাথে আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হলো না। পরে অবশ্য সেটাই সমস্যা হয়ে দেখা দিলো। ছাত্রশিবিরের সভ্য হয়েও আমি অ-ছাত্রশিবির বন্ধুদের সাথে ঘুরতাম এ বিষয়ে ছাত্রশিবিরের বন্ধুরা আপত্তি জানালো। আমি বললাম ওরাতো আমার বন্ধু, অসুবিধা কী? কিন্তু সিনিয়র যারা তারা বুঝালেন দাওয়াতের পরও যে বন্ধু দ্বীনের দিকে ফিরে না সে বাতিল পথের পথিক। তার সাথে দ্বীনদারের বন্ধুত্ব হতে পারে না। আমি বুঝলাম না, এসব কথা। তখন আমাকে দেখানো হলো রেজিস্টার খাতা। আমিতো অবাক দেখে।
আমাদের স্কুলে যে সিনিয়র ভাই ছাত্রশিবিরের দায়িত্বে ছিলেন তার কাছে স্কুলের সব ক্লাসের রেজিস্টার খাতা আছে। তাতে সব ছাত্র-ছাত্রীদের রোল নং সহ নাম লেখা। কিন্তু তার পরে অনেকগুলো ঘরে বিভিন্ন মনত্দব্য লেখা। তা দেখে বুঝলাম প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে শিবিরের পথে আনতে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সে বিকেলে নামাজের পরে বা খেলার মাঠে যাকে যেখানে পায় সেখানে দেখা করে ঘন্টা দুয়েক আলোচনা করে। ইসলাম সম্পর্কে তার মতামত জানে, তাকে নামাজের দাওয়াত দেয়। তো প্রতিটি ছাত্রের পাশে দিন-তারিখ দিয়ে লেখা আছে কোন সপ্তাহে কে ঐ ছাত্র-ছাত্রীকে দাওয়াতের দায়িত্বে ছিল। এবং সেই দাওয়াতের ফলাফল কি। আমি মনোযোগ দিয়ে ফলাফলগুলো পড়তে লাগলাম। কারো ক্ষেত্রে লেখা, নামাজী কিন্তু জেহাদের বিরোধী। আরো সময় লাগবে। কারো কারো নামের পাশে লেখা, বেনামাজী, ধর্ম-বিরোধী। কাজ হবে না। আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের নামের পাশের মনত্দব্যগুলো পড়তে লাগলাম। স্বপনের নামের পাশে লেখা, জুম্মা ও অন্যান্য নামাজ পড়ে। তিনবার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। বাতিল।
এইসব গোপন খাতা দেখে গা শিরশির করে উঠলো। মাসুদরানা ও ইত্যাকার স্পাই থ্রিলার তখন একদমে পড়ি। এসব খাতা দেখে মনে হলো স্পাই থ্রিলারের কান্ড। সবার গোপন কথা এখানে লেখা। ভালোও লাগলো। শিবিরের প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়ে গেলো। একটি দল কত গুছিয়ে কাজ করে। প্রতিটি মানুষকে নিয়ে আলাদা আলাদা করে ভাবে। দেশ ও ধর্মের জন্য তাদের এই প্রবল নিবেদন আমাকে আরো উৎসাহিত করে তুললো। সমর্থক, সক্রিয় সমর্থক থেকে আমি পুরোপুরি কর্মী হয়ে গেলাম শিবিরের। এখন আমাদের এলাকার বাইরে বড় যেসব গোপন শলা-পরামর্শের সভা হয় সেখানেও আমি যেতে শুরু করলাম। আমার উৎসাহের কোনো ঘাটতি ছিলো না। এতদিন পরে লিখতে বসে সব কথা মনে পড়ছে না। তবে যেহেতু অ-ছাত্রশিবির বন্ধুদের সাথেও আমি আড্ডা পিটাতাম, ক্রিকেট খেলতাম, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কে সিনেমার শুটিং দেখতে যেতাম সেহেতু ছাত্রশিবিরের অতি সিরিয়াস কর্মীদের মাঝে আমাকে একটু ব্যতিক্রমীই লাগতো। অথবা আমি তাই ভাবতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে বন্ধুদের সূত্রে পাওয়া প্রশ্ন সিনিয়রদের করে বিরাগভাজন হয়ে পড়তাম। তারা সন্দেহের চোখে দেখতো। ভাবতো, এখনও দ্বীনের জন্য যথেষ্ট অনুরাগী আমি হয়ে উঠিনি। আমি চেষ্টা করতাম আমার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে।
ইসলামের পাঁচ সত্দম্ভের ধারণা থেকে পাঁচের প্রতীকটি নেয়া হয়েছে ছাত্রশিবিরে। লোগোতে তা দেখা যায়। সংগঠনের সত্দরেও তার প্রতিফলন ছিলো। সদস্যদের মধ্যে পাঁচটি সত্দর। সমর্থক, সক্রিয় সমর্থক, কমর্ী, সাথী ও সদস্য। সদস্যদের মিটিং-এ কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব সদস্যরা আসতেন তাদের সাথে মিটিং ছাড়া এমনিতে অনেক আলোচনাই হতো। কিন্তু এই সত্দরের বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবাতো। হঠাৎ একদিন আমি নিজে আরেকটি সত্য আবিষ্কার করলাম। সেটি সত্দর সম্পর্কিতই। কিন্তু অন্যরকম। আবিষ্কার করে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম। আগেই বলেছি আমি থাকতাম সমরাস্ত্র কারখানায়। একধরনের ক্যান্টনমেন্ট বলা যায়। সবাই কলোনীতে থাকে। কলোনীগুলোর টাইপ আছে। বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন টাইপের বাসায় থাকেন। এ থেকে জি টাইপ। এ টাইপে একটি বাসা, মহাপরিচালকের জন্য, কিন্তু সেটা খালিই থাকতো কারণ মহাপরিচালক ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন। অফিসাররা বি থেকে ই টাইপগুলোতে থাকতেন। এফ থেকে এইচ হচ্ছে সাধারণ কর্মচারীদের জন্য। তো আমি আবিষ্কার করলাম আমাদের ছাত্রশিবিরে যারা আছে তারা সবাই জি ও এইচ টাইপের বাসিন্দা। অর্থাৎ বি, সি, ডি, ও ই টাইপের কেউ শিবির করে না। কেনো এই বিভাজন? আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম শিবিরের এক সাথী ভাইকে। দেখা দিলো সমস্যা।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন