ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জয়জয়কার বাংলাদেশে। কিন্তু প্রথম যেবার টিভিতে বিশ্বকাপ দেখি তখন থেকেই জার্মানি আমার প্রিয় দল। কেন? কীভাবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মত জনপ্রিয় দলকে ডিঙ্গিয়ে জার্মানি আমার প্রিয় দল হয়ে গেল? উত্তরটা এককথায় দেয়া কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। আমার ব্যক্তিগত চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের সাথে জার্মানি দলটির মিল খুঁজে পেয়েছিলাম বলে। দল বা টিমওয়ার্কের গুরম্নত্ব আমার কাছে সবচে বেশি, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যতার থেকে। জার্মানি এদিক থেকে সেরা। অত্যনত্দ ক্ষ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি দল। রেফারির দিকে তেড়ে যাওয়া, ফাউল করে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ভড়কে দেয়ার চেষ্টা, ড্রাগ নিয়ে মাঠে নামা, জোচ্চুরি করে গোল দেয়ার চেষ্টা (যেমন ঈশ্বরের হাতের সাহায্যে) এধরনের কোনো কাজে জার্মানির কোনো খেলোয়াড়কে পাওয়া যাবে না (রম্নডি ফয়েলারই যা একটু বেয়াড়া)। আমার চরিত্রের সাথে এটি মিলে।
আরেকটি গুণ তাদের আমার সাথে মিলে, তাহলো সংযত আবেগ। দু' গোল খেয়ে পিছিয়ে আছে না দু' গোলে এগিয়ে আছে তা জার্মানি দলের খেলা মাঝখান থেকে দেখলে কেউ ধরতে পারবে না। সবসময় ছক বাঁধা খেলা। আর দু' গোলে পিছিয়ে থাকা মানে হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়া, অহেতুক ফাউল করা শুরম্ন করা -এসব পথে কখনো যায় না জার্মানি টিম। তারা লড়তে থাকে একই তালে। বরং পিছিয়ে থাকলেই আহত বাঘের মত তারা মরণকামড় দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরো প্রচন্ডভাবে। এই যে লড়াকু মনোভাব আমার খুব প্রিয়। এক তালে নিরাবেগ খেলার ভঙ্গিকে অনেকে যান্ত্রিকতা বলে চিহ্নিত করেন। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ না থাকা ও ছক বাঁধা খেলার কৌশলও দায়ী এই অপবাদের জন্য। কিন্তু ব্যক্তির উপর জোর না দিয়ে টিমের সমঝোতা প্রধান বলেই আমার ভাল লাগে জার্মান দলটিকে। এই যে পুরো ইংলিশ জাতি তাকিয়ে আছে রুনির বুড়ো আঙুলের দিকে এ বড় অশ্লীল মনে হয়।
এবারের জার্মান টিম অবশ্য অন্য ধাঁচে গড়েছেন বলেই দাবী করছেন কোন ক্লিন্সম্যান। বল মাঠে গড়ালেই তার দাবীর সত্যতা বুঝা যাবে। ক্লিন্সম্যান পজেটিভ ফুটবলের উকিল তাই তিনি জার্মান দলকে আক্রমণাত্মক করে গড়ে তুলেছেন। অবশ্য এই দলের রক্ষণভাগ বলে কিছু নেই আর। গত 18 মাসে 14 জন আলাদা ডিফেন্ডার খেলেছেন সেখানে। তবে আক্রমণভাগ মানে মাইকেল বালাকের উপরেই নির্ভরশীল নয় দল। উদ্বোধনী খেলায় বালাক খেলছেনও না। মাইক, অলিভার, মিরোসস্নাভ, জেরাল্ড বা লুকাস কারো দৃষ্টি হয়তো আলাদা করে নাও কাড়তে পারেন তবে আমাদের মত সমর্থকদেরকে বিজয়ের খুশিতে ভাসাতে ভুলবেন না।
রক্ষণভাগের সমস্যার মতই আরেক বড় সমস্যা হচ্ছে দুই গোলকিপারের দ্বন্দ্ব। লেহম্যান আর অলিভার কান দুজন একসাথে কোনো মাঠে উপস্থিত ছিলেন না গত এক বছর। আর্সেনালে খেলা লেহম্যান-ই অবশ্য একনম্বর গোলরক্ষক হিসেবে গোল সামলাবেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বড় সমস্যা হতে পারেন বালাকের অভিনয় ক্ষমতা। এবারের বিশ্বকাপে রেফারিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অভিনেতাদেরকে কড়া শাসত্দি দিতে। ফিফা সর্দার সেপ ব্লাটার আবার সবুজ মাঠে সাঁতারুদের মত ডাইভ দেয়াটা একেবারে সহ্য করতে পারেন না। বালাক আবার সেটাই ভালো পারেন। সুতরাং বালাক যদি ভুলে যান যে তিনি এখন মঞ্চে না মাঠে তাহলে লালকার্ডের খাড়ায় বিপদ ঘাড়ে চেপে বসতে পারে জার্মান দলের।
সবকিছু যদি ঠিকঠাক মত চলে তবে ফাইনালে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে জার্মানি। আলাদা করে কোনো খেলোয়াড় হয়তো দৃষ্টি কাড়বেন না। সুতরাং যারা ব্যক্তির পূজারি তারা হয়তো এই দলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধও হবেন না। তবুও ডেভিডের দৌড় কারো মনে ধরতে পারে। অনত্দত: ইংল্যান্ডের তরুণ প্রতিভা থিও ওয়ালকটের চেয়ে সে জোরে দৌড়ায়। মাঝমাঠের খেলোয়াড় ডেভিডের 100 মিটারের রেকর্ড হচ্ছে 10.9 সেকেন্ড। আর মিরোস্লাভের নাম স্যামন হয়ে যেতেই পারে। হেড করতে সে যখন লাফিয়ে উঠে তখন মনে হয় তার বুটের তলায় বাড়তি সপ্রিং লাগানো আছে। তবে সেরকম হেড থেকে যদি গোল হয় তবেই না, কারণ লাফিয়ে উঠা সেসব হেডের বেশিরভাগ বল যে বারের উপর দিয়ে চলে যায়।
তা এই নিয়ালডার্থাল মানুষদের দেশ জার্মানের টিমটি আশা করি সমর্থকদের নিরাশ করবে না। যারা সমর্থন বদলে এই পতাকার নীচে জড়ো হতে চান তারা তাড়াতাড়ি নাম লেখান। মনে রাখবেন জার্মানি দলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের বিশ্বকাপ শ্লোগান হলো, "আমরাই ফুটবল"
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন