ব্লগের অবস্থা দেখলে মনে হয়, অনেকেই খুঁজে পান না কী বিষয় নিয়ে লিখতে হবে। ফলে, পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর একটা প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে। এতে ব্লগে ঢুকলে হেন-তেন অনেক যাচ্ছে তাই ধরনের পোস্ট দেখে প্রায়ই মন খারাপ হয়ে যায়।
খেয়াল করুন আমি ঝগড়া বলছি, বিতর্ক বলছি না। বিতর্ক খুবই সুস্থ একটি জিনিস। যারা ডিবেটিং সোসাইটির সদস্য ছিলেন বা স্কুল/কলেজ পর্যায়ে বিতর্কে অংশ নিয়েছেন তারা বুঝতে পারবেন একজন তার্কিককে বিতর্কের প্রতিপাদ্য বিষয় (দ্্বন্দ্বসূত্র)-এর পক্ষ ও বিপক্ষে যুক্তি দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। উভয়পক্ষের যুক্তিকে বুঝতে না পারলে আরাধ্য বিন্দুটা কোথায় তা ধরা যাবে না।
কিন্তু এখানে বিতর্ক হচ্ছে না। বিতর্ক না হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথম বিষয় হচ্ছে অনেকেই কোনো বিষয় সম্পর্কে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন না করে বা পড়ালেখা না করেই লিখছেন। সে লেখাগুলোকে আসলে লেখা বলাটাই ঠিক নয়। তাদের লেখার অর্ধেকই হচ্ছে অন্যের লেখার প্রতি আক্রমণ তাও যুক্তিছাড়া। নিজস্ব চিন্তা-ধারার কোনো সারবস্তু এতে নেই।
অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। যদি কেউ যুক্তি না দেয়, তার তথ্যে আপনার আস্থা না থাকে তবে তাকে রেফারেনস দিতে বলুন। এখানে শুধু মিথ্যাচার করতে সবাই এসেছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
পড়ালেখা যাদের করতে ইচ্ছে করে না, এই কষ্ট করতে ইচ্ছে করে না তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দিনপঞ্জী লিখতে পারেন। অনেকেই তা থেকে অনেক কিছু শিখবে বা বিনোদন পাবে। সবার জীবনের অভিজ্ঞতা যে অমি রহমান পিয়ালের মত নাটকীয় হবে তা নয়। ক্লাসে বা অফিসে যেতে প্রতিদিন যে দেরী হয় সে অভিজ্ঞতাও অনেক আনন্দের বিষয় হতে পারে।
আগের একটি লেখায় লিখেছিলাম, যে যে যেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সেসব বিষয় নিয়ে লিখুন। সামহোয়ার ইন ব্লগে এখন অনেক বিভাগ। সবাইকে চিন্তাচেতনামূলক প্রবন্ধ লিখতে হবে তাতো নয়। এমন একটা কিছু লিখুন যাতে নতুনত্ব আছে। চর্বিত চর্বণটা না করলেও হয়।
ব্লগ সাইটে যেহেতু সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন চিন্তার বিভিন্ন দর্শনের মানুষেরা আসে সেহেতু বিভিন্নতা বৈচিত্রতা থাকবে। কারো চিন্তার বিভিন্নতা দেখলেই আক্রান্ত বোধ করার কিছু নেই। আপনার বোধ কেউ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে না।
যে জার্মানিতে এখন বিশ্বকাপ হচ্ছে সেখানে 60,000 রেজিস্টার্ড ন্যাচারিস্ট আছে। সেখানে 160 টি ফ্রিবডি কালচার ক্লাব আছে। তারা বস্ত্রমুক্ত দেহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে গর্বিত। আপনি কাপড় পড়েন বলেই তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত এমন ভাবাটা নেহায়েৎ অযৌক্তিক। স্বর্গের ফেরেশতারা কোনো টেক্সটাইল মিল তৈরি করেছে বলে শুনিনি। বরং অন্য মানুষের চিন্তা ওভাবনা বৈচিত্রের সাথে নিজের পরিচয় থাকাটাই যৌক্তিক। জানুন কেন মানুষগুলো একে প্রাকৃতিক বলছে।
একইভাবে কাপড় বেশি করে পড়ারও চল আছে নানা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে। আছে নানারকম কিম্ভূতকিমাকার লোহার অলংকার পড়ার চল। সুতরাং বিনাপ্রশ্নে অন্যকে নাকচ করে দেয়াটাই যৌক্তিক আচরণ নয়। বরং বিনীত প্রশ্ন করে জানুন তার চিন্তা-ভাবনা।
কেউ যদি নিজের কথা বলে তাহলে সে আপনাকে আক্রমণ করছে তা ভাবা ঠিক নয়। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাবনাই সঠিক এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কেউ যদি মনে করে তার ভাবনাই সঠিক, অন্যের ভাবনা-চিন্তার সাথে তার পরিচয়ের দরকার নেই তাহলে তার শুধু নিজের ভাবনার প্রচারই করা উচিত। প্রচার করে সমর্থক পেতে হলে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে।
'শতফুল ফুটতে দাও' শিরোনামে আমি কোনো লেখা পোস্ট করেছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না। তবে নানা রকমের ফুলকে ফুটতে না দিলে ব্লগের বাগান যে বড় একঘেঁয়ে হয়ে যাবে, এ কথা বুঝাতেও কি যুক্তি দিতে হবে? আপনারা কেউ তেমন নির্বোধ নন নিশ্চয়ই।
আমি জানি একটি মুখস্থ-প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। নতুন কিছু চিন্তা করা, নতুন সৃষ্টি করা ও নতুনের সাধনা করার গোড়ায় গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়েছে আমাদের স্কুল জীবনে। দয়া করে স্কুল শিক্ষকদের এই ভুল শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে অন্যান্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন না।
আপনার কাছে যদি ভিন্ন তথ্য থাকে, নতুন যুক্তি থাকে তবে সুন্দর করে তা একটি পোস্টে দিন। অথবা প্রশ্ন থাকলে জানতে চান, নতুন মন্তব্য জুড়ে দিন। যদি না বুঝতে পারেন, তবে সরাসরি বলুন বুঝতে পারেননি। এতে সম্মান মারা যাবে না। অনেকের কবিতায় আমি মন্তব্য করি যে আমি বুঝতে পারিনি। তাতে সম্মানহানি হয় না, বরং আমার আন্তরিকতা ও অর্থ বুঝতে বা স্বাদ নেয়ার আকাঙ্খাটাই প্রকাশ হয়।
আর দীর্ঘ করবো না। বলবো, নিজেকে নিয়ে ভাবুন। ভেবে দেখুন আমাদেরকে জানানোর মত আপনার কাছে কি এমন নতুন তথ্য, ভাবনা, ধারণা বা অভিজ্ঞতা আছে। তারপর লিখুন। অন্য যার লেখার প্রতি অনুরাগ আছে যে ভাবনার সাথে পরিচিত হতে চান তার লেখা পড়ুন, সুশীল মন্তব্য করুন। অন্যের দিকে কাদা ছিটানোর আগে নিজের জানাশোনার ব্যাপ্তি নিয়ে আত্মসমালোচনা করুন। আপনার যদি অনেক জানাশোনা থাকে তবে যুক্তি দিয়ে লিখুন। বিতর্ক করুন পালটা যুক্তি দিয়ে। ব্যক্তিগত আক্রমণের গোয়াতর্ুমি বাদ দিয়ে বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে আসুন।
নিজের সাথে অন্যের চিন্তাধারাকেও এগিয়ে যেতে সাহায্য করুন।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন