বাংলাদেশের সংবিধানেই স্বীকার করা আছে জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। মাওবাদীরা বলতেন বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। শফিক রেহমান অবশ্য এক্ষেত্রে 'চামড়ার নল'-কে সবচে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। জনগণ যে ভোটের দেশে ক্ষমতার মূল বিন্দু তা বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় জোর গলায় বলেন। কিন্তু দেশ পরিচালনায় তার কোনো প্রতিফলন ঘটে না।
দারিদ্র দূর করতে সম্পদের বন্টন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে, আরো অনেক উন্নয়নশীল দেশের মত, সম্পদের বন্টন অসম। ভীষণ অসম। জনসংখ্যার খুব ক্ষুদ্র অভিজাত অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সামরিক বা বেসামরিক পদের জোরে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা পেশাগত অবস্থানের কারণে বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত। তারা শিক্ষিত, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের সুবিধাভোগী, নিজের ক্ষমতা বলয় ধরে রাখার জন্য তারা সংগঠিত। জনগণের আয়ের উৎসকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে। রাখে সেটা নিজের জিম্মায়। জমি, সম্পত্তি, ব্যবসা, সরকার প্রদত্ত লাইসেন্স এসব আয়ের উৎস তাদের দখলে। অর্থ, ব্যাংকের বড় লোন, বড় চাকুরি, বিশেষ প্রতিষ্ঠানের সামাজিক ভাবে উঁচু পদ এসব ক্ষমতার জায়গাগুলোও তাদের দখলে।
দেশের যে বিশাল গরীব, অশিক্ষিত, অসংগঠিত জনগোষ্ঠী তারা দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকা। আয়ের উৎস ও ক্ষমতার সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। দেশের উচ্চবিত্ত 5 ভাগের হাতে যেখানে দেশের শতকরা 20 ভাগ আয়, সেখানে নিম্নবিত্ত 5 ভাগের হাতে 1.20 ভাগ আয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী, শিক্ষিত ও সংগঠিত উচ্চবিত্তরাই এগিয়ে। রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে খরচ হচ্ছে রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থ। উচ্চবিত্ত 20 ভাগ লোক ভোগ করে জাতীয় আয়ের মোট 46 ভাগ আর নিম্ন আয়ের 20 ভাগ লোক ভোগ করে মোট আয়ের 7 শতাংশ। কি অন্যায়!
আমরা দেশের সিংহভাগ যে জনগোষ্ঠীকে কৃষক বলে চিহ্নিত করি তাদের আসলে চাষযোগ্য জমিই নেই। দেশে সম্পূর্ণ বা কার্যত ভূমিহীনের সংখ্যা 56%। কিছু কিছু ভূমিহীন মানুষের কিছু বৃত্তিমূলক কাজ থাকলেও তাদের অধিকাংশই কৃষি মজুর বা দৈনিক শ্রমজীবি। মুটে বা দিন-মজুর হিসেবে যারা আমাদের অবহেলা আর নির্যাতনেরই শিকার হয় প্রতিদিন।
গরীব , দ্ররিদ্ররা যে অর্থনৈতিক গতিধারার প্রধান স্রোত থেকে বঞ্চিত তা নয়। তাদের সাথে সামাজিক বা রাজনৈতিক মূলধারারও কোনে সম্পর্ক নেই। ফি বছর নির্বাচনে ভোটের পোস্টার দেখেই তারা তাদের ক্ষমতার বিষয়টি জানতে পারে। সে ক্ষমতার প্রয়োগ বড় জটিল প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনে বাঁধা।
ক্ষমতার উৎস শেস্নাগানটি শোনা যাচ্ছে অন্তত: এতেই তৃপ্ত থাকতে পারেন অনেকে। তবে সমাজে গণতন্ত্রায়নের চর্চা ভীষণ জরুরি। এই গণতন্ত্রায়নের প্রথম ধাপ হতে হবে ন্যায্য বন্টন ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। নতুবা গুটি কয়েক পত্রিকার বক্তব্যের স্বাধীনতা, র্যাব বা পুলিশ বাহিনীর হাতে 'লাইসেন্স টু কিল' দিয়ে সমাজের দগদগে ঘা-গুলোকে সারানো যাবে না। এই ঘা ক্যান্সারের লক্ষণ। সময়ের সাথে সাথে এই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়বে সারা শরীরে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন