ডানাকাটা মন-১

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: সোম, ১৯/০৬/২০০৬ - ১০:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


চিন্তা আমরা সবাই করি। কিন্তু সবাইকে আমরা চিন্তাবিদ বলি না। বরং যারা কোনো বিষয়ের আগাপাশতলা ভেবে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাদের কারো কারো কাছে আমরা পরামর্শের জন্য যাই। গিয়ে সাহায্য চেয়ে বলি, "আমার মাথা কাজ করছে না। আমি আর চিন্তা করতে পারছি না। তুমি ভেবে বলো কোনটা করা ঠিক হবে?"। সবাই মাথা ঠান্ডা রেখে বিপদের সময় চিন্তাও করতে পারে না। অনেকের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে আবেগ বেশি প্রভাব ফেলে। দুশ্চিন্তার কথা এখানে আসছে না সঙ্গত কারণেই। কিন্তু সবাই চিন্তা করতে পারলেও আমরা মনে করি না সবাই সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে পারে। বা সবার চিন্তা-ভাবনাই যৌক্তিক ও গ্রহণীয়। দাবাড়ুদের কেউ কেউ নাকি আট চাল আগে চিন্তা করে চাল দেয়। সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও মত প্রকাশের অধিকার দেয়া হয়। এটা মানব-অধিকারের অংশ। ...স্বাধীনভাবে চিন্তা করা? সে আবার কী? চিন্তার ক্ষেত্রে পরাধীনতার কি আছে? চিন্তা করে মানুষ মন দিয়ে। মন তো স্বাধীন। সে কারো বাধা মানে না। ...কথাটা সত্যি কি? কতটা স্বাধীন আমাদের মন? স্বাধীন যদি হবেই তো মানুষ খোলামনে চিন্তার কথা বলে কেন? কেনইবা মুক্তমন, মুক্তচিন্তার কথা ওঠে। তবে কি মন সবসময় মুক্ত নয়? চিন্তাও বন্দী থাকে কোথাও? কোথায়?

নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন, আপনার চিন্তাগুলো কিসের শেকলে বন্দী? কেন মনে মনে মাংসের বিরিয়ানী খেতে পারলেও সে মাংসটা কখনও জেব্রা বা কুমিরের হয় না। খাসি বা গরুর মাংস হলেই মনটা বেশি আরাম পায়। কে আটকে দেয় মনের এই স্বাধীনতা। মনে মনেই তো মাংস খাওয়া। সত্যি তো আর নয়। মনের এই চিন্তা কে গড়ে দেয়? এই যে মনটা ইচ্ছে মত বিরিয়ানী খাওয়ার কল্পনা করতে গিয়ে গরু বা খাসির মাংসের বাইরে যেতে পারছে না, কেন? কে পড়ালো মনের পায়ে শেকল। ঘটনা তাহলে 'তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়'-ধরনের না। বরং আমারই অজান্তে 'পাখি আমার শেকল পরে আটকে আছে খাঁচায়'। সব পাখি কি খাঁচা ছেড়ে উড়তে চায়? পাখিকেই জিজ্ঞেস করম্নন। খাঁচার পাখিতো খাঁচাকেই ভালবাসে। রবীঠাকুর ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। খাঁচার পাখির অনেক যুক্তি খাঁচার সপক্ষে। খাঁচার ভেতর বড়ো নিশ্চয়তা। জল-খাদ্য পাওয়া যায় নিয়মিত। নিরাপত্তা পাওয়া যায় বেড়ালের থাবা থেকে। কিন্তু পাওয়া যায় না উড়বার সুনীল আকাশ। বড় সীমাবদ্ধ এই খাঁচা।...বন্দী দেহের ভেতরের মনপাখি তাই উড়তে চায়। উড়তে চায় ডানা মেলে, অসীমে, শূন্যে। অথচ খাঁচাটাই বাধা। মনখুলে চিন্তারও কত সীমারেখা। মনের পায়ে কে শেকল পরায়, কে ছেঁটে দেয় তার ডানা? কে তারে উড়তে করে মানা?

মনের মাঝে রয়েছে কত বিশ্বাস, কত ধারণা। চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে মনের মধ্যে আছে নানা ধারণা, পূর্বধারণা, বিশ্বাস। নানা সূত্র থেকে পাওয়া মত, পরামর্শ। কিছু তার শুনে বিশ্বাস, কিছু দেখে, কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া। কিছু নিষেধ, কিছু উপদেশ। "জঙ্গলে সাপ আছে, সেখানে গেলে সাপে কাটতে পারে"। আমি কখনও জঙ্গলে যাইনি, সাপের ভয়ে। সব পরামর্শ, উপদেশ মানতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে ভেঙে উল্টা কিছু করতে ভালো লাগে। কিন্তু সবগুলো বিশ্বাস, ধারণা এক এক করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার সময় কই। সবাই মানে, সুতরাং আমিও মানি। ভেড়ার দলের মত হয়ে গেলো, কিন্তু তাতে কি? চিনত্দা করার কষ্ট থেকে তো বাঁচা গেলো। "আমি ওতো কঠিন চিন্তা করতে পারি না"। তবে বিশ্বাসের শক্তি আছে। যে নিজের শক্তিতে বিশ্বাস করে কাজে নেমে পড়ে সে নিজের কাজ দিয়ে বিশ্বজয় করতে পারে। তাকে নিশ্চয়ই অনেক নিষেধকে জয় করতে হয়। পার হতে হয় অনেক বাধা। কিন্তু যে বিশ্বাস কাজে বাধা দেয়। নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে না। ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। থামিয়ে দেয়। তা নিশ্চয়ই ক্ষতিকর। মারাত্মক ক্ষতিকর। মনের ভেতর এই ধারণাগুলো কোথা থেকে আসে? এই যে মীনা ভাবে, "আমি একটি গ্রামের মেয়ে, আমার কি আর বিদেশ যেয়ে পড়ার চিন্তা করা উচিত?" কোথা থেকে কে থামিয়ে দেয় মীনার এই ভাবনগুলো।

বই ঘাঁটলে অনেক উত্তর পাওয়া যাবে এর। কিভাবে বিশ্বাস বা ধারণা তৈরি হয় মনের ভেতর তার উপর কত জ্ঞানী, চিন্তাবিদের কত বই, প্রবন্ধ আছে। তবে দুটো উপাদান সবচে গুরুত্বপূর্ণঃ
1. পরিবেশ
2. পড়াশোনা

পরিবেশ আর পড়াশোনাই মনের ভেতর বিশ্বাস আর ধারণাকে নিয়ে খেলা করে। কোনোটা ভাঙে, কোনোটা গড়ে। এসব ভাঙাগড়ার কোনোটা হয় মনের অজান্তে। আর কোনোটা হয় সচেতন সিদ্ধান্তে। ...তবে মনপাখিকে শেকল পরালো কে?...এই দুই?...হুমম, অনেকটা তাই। কিভাবে? পরিবেশ তবে কি শেকল? আর পড়াশোনা? পড়াশোনা সে তো শেকল ভাঙার কথা...সেও কি শেকল পরায়?

পরিবেশের কথাই বলি। পরিবেশ হচ্ছে: ক) কোন দেশে, কোন সমাজে, কোন মন-মানসিকতার পরিবারে আপনার জন্ম হয়েছে বা আপনি বড় হয়েছেন? খ) কীভাবে আপনাকে বড় করা হয়েছে? গ) আপনার অভিভাবকরা কীভাবে আপনাকে বড় করেছেন? কী মূল্যবোধ আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন? কী ধারণা দিয়ে বড় করেছেন? ঘ) আপনার আয়ত্ত্বের মধ্যে মনের জানালা খোলার কী আয়োজন ছিল? কোন টিভি আপনি দেখতেন? কী সংবাদপত্র পড়তেন? কী ধরনের বইয়ের পাতা উল্টাতেন? ঙ) কী ধরনের বন্ধু-বান্ধব ছিল আপনার? তাদের পরিবার, তাদের মূল্যবোধ, তাদের পড়াশোনা, তাদের জীবনাচরণ, তাদের বিশ্বাস-ধারণা কী ছিল?

এগুলোই হচ্ছে আপনার পরিবেশ। যার মধ্যে আপনি বড় হয়ে উঠেন। আর সাথে সাথে পরিপক্ক হয় আপনার মন। এই পরিবেশের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়া আছে বিমূর্ত একটি জগৎ-পড়ালেখার। বই, পাঠাগারের। যেখানে জ্ঞানকে, চিনত্দাকে, ভাবনাকে, বেঁধে রাখা হয়েছে অক্ষরের মধ্যে। সেই সমুদ্রের হাওয়ায় আপনি কতটা হেঁটেছেন, কতটা পা ডুবিয়েছেন সমুদ্রের জলে, কতটা নুড়ি কুড়িয়েছেন, কী ধরনের নুড়ি কুড়িয়েছেন তার একটা প্রভাব পড়বে আপনার মনের বিশ্বাসগুলোর উপর। এই প্রভাব পরিবেশ থেকে পাওয়া আপনার বিশ্বাস-ধারণাকে ভেঙে দিতে পারে, সে বিষয়ে সন্দিহান করে তুলতে পারে। অথবা পরিবার, বন্ধুবান্ধবের পরিবেশ থেকে পাওয়া ধারণা বা বিশ্বাসকে আরো শক্ত করে তুলতে পারে। ...এই পরিবেশ আর পড়াশোনা আপনার মনের পায়ে দিতে পারে বেড়ি, অথবা আপনার মনপাখির ডানার দিতে পারে গতি...।

যে প্রশ্নগুলো দিয়ে শুরম্ন করেছিলাম, সেগুলো উত্তরেই শেষ হোক। উত্তর তো বলা হয়েই গেছে। এখন পুনরায় উচ্চারণ। এই পরিবেশ আর পড়াশোনাই তবে মনের পায়ে শেকল পরায়? মনের ডানা দেয় ছেঁটে? আসলে দুটোর ভূমিকা সমান বলা যাবে না। পরিবেশটাই দায়ী বেশি। পড়াশোনা বরং উড়তেই সাহায্য করে। তবে তা যথার্থ পড়াশোনা হতে হবে। পড়াশোনাকেও যদি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে তবে তা পরিবেশের পক্ষেই যাবে। তখন মনটা পরিবেশের দেয়া ধারণায় বন্দী হয়ে যাবে। মন তখন না হবে মুক্ত, না আমরা করতে পারবো মুক্তচিন্তা।

এতদূর এসে আরো কি নতুন প্রশ্ন দেখা দেয় মনে? দিতেই পারে। মনের কত চিন্তা। সে কথা পরের কিসত্দিতে। শুভেচ্ছা। যাবার আগে মার্ক টোয়েনের একটা কথা বলে যাই। চিন্তার জন্য খোরাক।

"Whenever you find you are on the side of Majority it is time to pause and reflect." Mark Twain


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।