নানাবাড়িতে খুব ফূর্তিতে ছিলাম। আমার দুই মামা ও নানী যে কি মজার মানুষ তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মত না। মা ও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এত বন্ধুত হতে পারে সে ধারণাও আমার ছিল না। তারা নানা গল্পে-গুজবে, খাওয়া-দাওয়া আর অলস আড্ডায় সময় পার করে দেয়ার জমিদার। আরেকটা মজায় জিনিস ছিল তাদের। সবাই মিলে সিগারেট ভাগাভাগি করে ফুঁকতেন। আমার সময়ও কাটছিলো বেশ। আর মাঝে মাঝে যাচ্ছিলাম গন্ড কোনো গ্রামে বেড়াতে, কোনো বন্ধুর মামা-চাচা বাড়ি। এই সময়টাতেই আমার বাংলার দামাল ছেলেদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমার হয়। ধানক্ষেতের আ'ল আটকে পলো দিয়ে বা পানি সেচ করে মাছ ধরা, এয়ারগান দিয়ে ঘুঘু শিকার, বড়শি ফেলে পুকুর ঘাটে আড্ডা, নদীর ঘাটে বাঁশি বাজানোর চেষ্টা, পাটক্ষেতে গ্রাম্য তরুণ-তরুণীর প্রেমে গিয়ে বাগড়া দেয়া, দুপুরের রোদে তেঁতুল গাছের ছায়ায় বিশ-পঁচিশ খেলা, ডুব সাঁতারে নদী পার, আরো কতকি। নানা অভিজ্ঞতায় আমি তখন রঙিন। এক বন্ধুর মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গণিত বইয়ের ভেতরে আবিষ্কার করলাম নিষিদ্ধ গন্ধ মাখা বাক্য, "ভাবী যদি মধু দেয়, মৌচাকের মৌ চাই না আমি"।
তেমনি এক দীর্ঘ গ্রাম ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে শুনি সব কলেজে ভর্তি শেষ। আমার বন্ধুরা যাচ্ছে আগামীকাল এমসি কলেজে ভর্তি হতে। কালই শেষ দিন। আমার ইচ্ছা ছিল নটরডেমে ভর্তি হবো। গ্রামে গ্রামে ঘুরায় খবরই পাই নি কখন শেষ হয়ে গেছে ভর্তি পরীক্ষা। নানা বললেন তিনিও এই কলেজে পড়েছেন। কলেজ খারাপ না। কলেজ নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। ঢাকা ছেড়ে সিলেট যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কপালের ফের। যাক, ভর্তি হয়ে গেলাম মুরারীচাঁদ কলেজে। তখন এর নাম পাল্টে হয়েছিল সিলেট সরকারী কলেজ। পরে আবার মুরারীচাঁদ নামটা ফিরে এসেছে। মুরারীচাঁদের নাম মুছে দেয়ার একটা হীন চেষ্টা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা পরাজিত হয়। পাহাড়ী এলাকায় চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে কলেজ আর বিরাট এলাকা জুড়ে হোস্টেল। আমি পেলাম হোস্টেলের ফার্স্ট ব্লক। রুম নং -2। রুম নং 1 এ প্রিফেক্ট বা ছাত্রাধিনায়ক শাফি ভাই থাকেন। শাফি ভাই কলেজের ছাত্রশিবিরের সভাপতি। আমার চেহারায় শিবির শিবির ছাপ আছে নিশ্চয়ই, শাফি ভাই মোটামুটি ধরেই নিলেন আমি তার দলের সদস্য বা কর্মী। অতি ভদ্র হওয়ার কারণে আমিও মুখ ফুটে বলতে পারি না যে আমি শিবিরের কর্মকান্ডে জড়িত হতে চাই না। শাফিভাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকতে থাকলেন। এই দোটানা থেকে আমাকে বাঁচালেন তপু ভাই। তপু ভাই শাফি ভাইকে বুঝালেন ও নামাজ পড়ে কিন্তু শিবির করতে চায় না। যাক, বাঁচা গেলো এই যন্ত্রণা থেকে। শিবির ছেড়েছি তাই বলে ইসলাম তো আর ছাড়িনি। আমি তখন জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম বাস্তবায়নে সচেষ্ট। প্রথম ব্লকের সাথেই ছিল হোস্টেলের মসজিদ। ভোররাতে ফজরের আজানের আগে গিয়ে সেই মসজিদ খুলে আজান দিতে পারাটাকে ভীষণ জরুরি কাজ মনে হত। কোনোদিন সবার আগে গিয়ে আজান দিতে না পারলে মনটা খারাপ হয়ে যেত।
বড়মামার উৎসাহে আমি তখন ঝুঁকেছি পীর আর মাজারের দিকে। শাহজালালের মাজারে যাই সপ্তাহে একবার। পীর-ফকিরিতে বড়মামার ছিল ভীষণ আগ্রহ। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাজার ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। কতসব অজানা তথ্য জানিয়েছেন তিনি। বড়মামাই একদিন প্রশ্ন করলেন, বল্ তো বাংলাদেশে কোন পীরের সাতটি মাজার আছে? আমি জানতে চাইলাম, সাতটি মাজার হবে কি করে? এক লোক কি সাত জায়গায় মারা যেতে পারে? বড়মামা রহস্যের হাসি হেসে বললেন, পারে। সেই পীরের নাম শাহ মোসত্দফা কামাল। কিন্তু এর চেয়েও কঠিন তথ্য দিলেন আমাকে বড়মামা। বললেন, তুই যদি গভীর মনে চাস, তবে পীরের দেখা পেতে পারিস। তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছেন। চট্টগ্রামে শাহ আমানত নাকি তাকে দেখা দিয়েছেন। স্বপ্নে নয়, একেবারে সশরীরে। গা ছমছম করা তথ্য। আমিও তখন অস্থির। আমাকেও পীরের দেখা পেতে হবে। শাহজালালের মাজারে সেই উদ্দেশ্যেই যাই। এক শুক্রবারে অনেক সময় নিয়ে গেলাম মাজারে। জুম্মার পর থেকে নফল পড়েই যাচ্ছি। আসর শেষ হলো। মাগরিবের সময় হয়ে যাচ্ছে। মোনাজাতের পর আমি চোখ বুঁজে আছি। মনে মনে শুধু বলছি শাহজালাল যদি দেখা না দেন তবে আমি এখান থেকে নড়বোই না। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম কেউ আমার পিঠে হাত রেখেছেন। আমি আরো ভালো করে হাতের স্পর্শ অনুভব করি। তারপর চোখ খুলি। মুখ ঘুরিয়ে দেখি এক সাদা আলখেল্লা পরা লোক আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। মনে হলো তিনি বোধহয় আমাকে বাইরে বেরুতে বলেছেন। নীচে বসেছিলাম তাই কাঁধের উপরে তার শরীরের অংশ বা মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি সাথে সাথে উঠে বেরিয়ে এলাম বাইরে। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করলাম কিন্তু সেই সাদা আলখেল্লা কোথাও দেখতে পেলাম না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন