ধর্মীয় মৌলবাদের চাষাবাদ -৮

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: সোম, ১০/০৭/২০০৬ - ১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


"জাহেলিয়া চলছে এখন বিশ্বে। মূলত: নবী মুহাম্মদের পর ধীরে ধীরে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে পৃথিবী। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে এই অন্ধকারমুখী পৃথিবীকে ভেঙে বের হয়ে আসা, তারপর একে ধ্বংস করে দেয়া, আর সেই ধ্বংসস্তুপের উপর প্রতিষ্ঠা করা পরিপূর্ণ ইসলামিক রাস্ট্র"। কথাগুলো আমার নয়। মনে হতে পারে ওসামা-বিন-লাদেনের। কিন্তু কথাগুলো আসলে সাইয়্যেদ কুতুবের (1906-1966)।

মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম থিওরিস্ট সাইয়্যেদ কুতুব 1960 এ তার লেখা বইগুলোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে জেহাদের পথে আগুয়ান হতে উৎসাহিত করেছিলেন এ কথাগুলো বলেই।
তবে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মিশরের আরেক মুসলিম শিক্ষক হাসান-আল-বান্নার হাতে 1928 সালে। সুয়েজ খালের পাশে ছোট্ট একটি গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরবী ভাষার শিক্ষক হাসান বান্না প্রথম জীবনে সুফিজমেই দীক্ষা নিয়েছিলেন। ইংরেজদের অত্যাচারের বিরোধিতা করতে করতে সময়ের ধারাবাহিকতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ব্রাদারহুড। হিজব আল ইখওয়ান আল মুসলিমুন। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী শরিয়া আইনের প্রতিষ্ঠা। আর তাদের সংগঠনের শেস্নাগান ছিল, "আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য, কোরান আমাদের সংবিধান, নবী আমাদের নেতা, জিহাদ আমাদের পন্থা, আল্লাহ্র পথে শহীদ হওয়াই আমাদের সর্বোচ্চ কামনা"। ইসলামিক ছাত্র শিবির করাকালীন এই কথাটিই আমরা একটু ভিন্ন শব্দযোগে ব্যবহার করতাম।

হাসান-আল-বান্নার মতামতগুলো ওহাবিজমের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি ধর্ম পালন ও ধর্মশিক্ষার সাথে যুক্ত করেন জিহাদের ট্রেনিং। ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতার উপায় হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তিনি রাজনীতিতে নতুন একটি ধারার জন্ম দেন, যাকে বলা হয়ে থাকে ইসলামিজম। 'মুসলিম ব্রাদারহুড' প্যালেস্টাইনি মুসলিমদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই শুরু করে। আজ যে 'হামাস' নামের সংগঠনটি প্যালেস্টাইনের ক্ষমতায় সেটি আসলে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্যালেস্টাইন শাখা। বিশ্বের 70টি দেশে এর শাখা রয়েছে। আফগানিসত্দানে এদের শাখার নাম 'মুজাহেদিন'।

মিশরে ক্ষমতা নেয়ার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড সেদেশের সরকারের ভাষায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। 1948 এর 28 ডিসেম্বর তাদের জিহাদী আন্দোলনের প্রথম বলি হন মিশরের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমি নকরাশি। মুসলিম ব্রাদারহুডের শক্তি সম্পর্কে তখন টের পায় সরকার। দু মাস পর, 1949 এর ফেব্রুয়ারিতে বান্না খুন হন সরকারী এজেন্টদের হাতে। সরকার সংগঠনটিকে কখনও নিষিদ্ধ করেন কখনও বা বৈধতা দেন। 1954 তে বৈধতা পাওয়ার পর ঐ বছরই মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায় মুসলিম ব্রাদারহুড। হত্যাচেষ্টার নায়ক আব্দুল মুনিম আব্দুর রউফ নামে এক ব্রাদারের সাথে আরো 5 জনের মৃতু্যদণ্ড হয়। অনেকে গ্রেফতার হন, বাকীরা পালিয়ে যান বিদেশে। 1964 তে বন্দী ব্রাদারদের মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নাসেরকে এরপর আরো তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এসব ঘটনা পরম্পরায় 1966 তে শীর্ষ স্থানীয় নেতারা খুন হন। সাইয়্যেদ কুতুব এদের একজন।

জেলে থাকা অবস্থায় ষাটের দশকে কুতুব দু'টি বই লেখেন। একটি কোরান সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা, 'কোরানের ছায়াতলে'। অন্যটি ইসলামী দলের মেনিফেস্টো যার নাম ছিল মালিম ফিল তারিক বা মাইলফলক। তার এসব বইতে কুতুব 'জাহেলিয়া'র ধারণাটিকে বিস্তৃত করে দাবী করেন পৃথিবীতে এখন জাহেলিয়া চলছে। যেসব দেশে কোরানের শাসন চলছে না তারা জাহেলিয়ায় আছে। সুতরাং কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী এসব জাহেলিয়ার শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যারা নন-মুসলিম দেশে আছেন তাদের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি তেমনি সত্যি মিশরের ক্ষেত্রেও। আদালতে যখন কুতুবের কাছে জানতে চাওয়া হলো এ বক্তব্য তার কিনা। তিনি বীরের মত নিজের বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়ালেন। রায়ে তার ফাঁসি হলো।

নাসেরের পর ক্ষমতায় এলেন আনোয়ার সাদাত। তিনি ঘোষণা দিলেন শানত্দির। ঘোষণা দিলেই শরিয়াই হবে মিশরের আইন। ছেড়ে দিলেন জেলবন্দী ব্রাদারদের। শানত্দির জন্য তিনি চুক্তি করলেন ইসরাইলের সাথে 1979 তে। মুসলিম ব্রাদাররা এটা পছন্দ করলেন না। 1981 এর সেপ্টেম্বরে মুসলিম ব্রাদারের জঙ্গি সদস্যরা তাকে পরপারে পাঠিয়ে দিল।

মুসলিম ব্রাদারহুড বিশ্বের অনেক দেশেই শরিয়া প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছে। পশ্চিমারা তাদের সাথে ওসামা-বিন-লাদেনেরও যোগসূত্র আছে বলে দাবী করেন। সূত্রটি হচ্ছে আইমান জাওয়াহিরি হচ্ছেন মোহাম্মদ কুতুবের ছাত্র। মোহাম্মদ কুতুব হচ্ছেন সাইয়্যেদ কুতুবের ভাই।

কিন্তু হাসান আল বান্নার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ব্রাদারহুডের রং আর কার্যক্রম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেতার হাতে পড়ে বদলেছে ভীষণভাবেই। সাইয়্যেদ কুতুবের হাত ধরে সেটি গিয়ে পৌছায় সহিংসতায়। পরে আরেক মিশরিয় আবদ আল-সালাম ফারাজ একে এগিয়ে নিয়ে যান। ফারাজ জিহাদ শব্দটিকে নতুন সংজ্ঞা দিয়ে একে সমার্থক করে তোলেন 'সহিংস সংগ্রামের' সাথে। তিনি মনে করতেন ইসলামিক রাষ্ট্র গড়তে সহিংসতা একটি জরুরি ধাপ। আনোয়ার সাদাতকে হত্যার সাথে সংযুক্ত থাকার অভিযোগে ফারাজের মৃতুদন্ড হয় 1982তে।

নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল দর্শনটি ঠিকই আছে। সে দর্শন হচ্ছে পৃথিবীতে চলছে জাহেলিয়া। এই জাহেলিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করে নবী মুহাম্মদের সময়কার অবস্থায় ইসলামকে নিয়ে যেতে হবে। মৌলবাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি পরিপূর্ণ মৌলবাদ। তবে এর সাথে এ পর্যায়ে এসে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিত্বও। তবে এইসব মৌলবাদীরা জঙ্গি হোন আর না হোন বিশ্বাস করেন যে ইহুদি, খ্রিস্টানদের বিজ্ঞান আর নানা আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে চলছে এখন অন্ধকার সময়, 'জাহেলিয়া'।

ছবি: আনোয়ার সাদাতের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এক মুসলিম ব্রাদার তার এই কর্মকান্ডের সমর্থনে কোরানের পৃষ্ঠা খুলে দেখাচ্ছেন।


মন্তব্য

মাসরুর এর ছবি

ধর্মব্যবসায়ী মুসলিম ব্রাডারহুডের বিরুদ্ধে লেখা পড়ে ভালই লাগলো। তবে লেখার শেষে ইহুদী খ্রিস্টানদের বিজ্ঞান বলাটা ভুল। মূলত বিজ্ঞানের সমস্ত ভিত্তি মুসলমানদের আর ইহুদী খ্রিস্টানরা সেখান থেকে চুরি করেছে মাত্র।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।