লন্ডনে দোতলা বাস খুব সাধারণ একটা বিষয়। কিন্তু দোতলা ট্রেন নেই। চারপাশের দৃশ্য দেখার জন্য দোতলা বাস-ট্রেনের জানালার পাশে বসার মজাই আলাদা। পাহাড় দেখতে হলে যেতে হবে ইন্টারলেকেনে। কিন্তু জিনিভা থেকে সরাসরি কোনো ট্রেন নেই। একটু ঘুরে রাজধানী বার্ন হয়ে যায় ট্রেন। যদিও শহর দেখে সময় নষ্ট করবো না সিদ্ধানত্দ নিয়েছি তবু ভাবলাম দুপুরের খাবারটা বার্নে সারি। টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছে সকাল থেকে। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে একথাটা সুইজারল্যান্ডের জন্য ঠিক প্রযোজ্য নয়। কারণ আমরা নিজেরাই রয়েছি মেঘের উচ্চতায়। সুতরাং ঠিকঠাকভাবে বলতে হলে বলতে হবে, মেঘে দৃষ্টি আটকে যাওয়ায় জন্য বেশিদূর দেখা যায় না। ট্রেন যাবে সেন্ট গ্যালেন; বার্ন, জুরিখ পার হয়ে অস্ট্রিয়ার কাছাকাছি। আমরা বার্নে নেমে ট্রেন বদলাবো। উঠেই দোতলায় জানালার পাশে সিট নিলাম (ছবি-1)। আমাদের ডান পাশে লোসান পর্যনত্দ স্বচ্ছ জলের জিনিভা লেক। ট্রেন ছুটলো লোসান হয়ে বার্নের পথে। বাম পাশে সবুজ ফসলের মাঠ। বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ের সারি। জিনিভার আশে পাশের এলাকায় ঘরে ঘরে ওয়াইন তৈরি হয়। মাঠ ভর্তি তাই আঙুর বাগান। সুন্দর সাজানো পরিচ্ছন্ন সারি সারি আঙুরগাছ (ছবি-3)। কোথাও বা গাছগুলোকে জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আঙুর ছাড়াও রয়েছে সারি বাঁধা আপেলের বাগান। বাগানগুলো অনেকটা সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানের মতো টিলা-পাহাড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তৈরি; যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজের তরঙ্গ চোখে পড়ে। ঘন সারির ভুট্টার ৰেতও রয়েছে কোথাও কোথাও। এর ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট শহর। আর সবুজ পাহাড়ের ক্যানভাস জুড়ে বাদামী লালচে কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী সুইস কুঁড়েঘর-শ্যালে। শ্যালেগুলোর বিশাল বিশাল সব ব্যালকনি আর জানালাতে নানা রংয়ের ফুল ঝুলে আছে (ছবি-2)। সে এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। বৃষ্টি পড়ছে একটু একটু আর তাতে ভিজে সবুজ ঘাসগুলো আরো প্রাকৃতিক হয়ে উঠেছে, সেইসাথে ভিজে যাওয়া শ্যালেগুলোর কাঠের কারম্নকাজ নিয়ে পুরো দৃশ্যটাকে মনে হচ্ছে বিশাল কার্টিজ পেপারে অনবদ্য এক জলরং। আমাদের এই দৃশ্য দেখায় বাধ সাধলো ইট-সিমেন্টের বার্ন শহর। দুপুরের খাবারের জন্য ঘন্টা খানেক বিরতি নিতে আমরা নেমে এলাম ট্রেন থেকে। ট্রেনেই খাওয়া যেত, তবে এই ফাঁকে শহরটাকে একটু দেখা। ঝম্ ঝম্ করে বাংলাদেশের মত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ছুটির দিনে দোকানপাট সব বন্ধ (ছবি-4)। এমনকি ম্যাকডোনাল্ডেও তেমন ভিড় নেই (ছবি-5)। গোটা কয়েক ছবি তুললাম। বৃষ্টির তোড়ে খাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে পরবর্তী ইন্টারলেকেনের ট্রেনে চড়ে বসলাম। নতুন ট্রেনটা দোতলা নয়। কিন্তু ট্রেনের দেয়াল জুড়ে বিরাট বিরাট কাঁচের জানালা। দু'পাশের প্রকৃতিকে প্রাণভরে দেখার সুযোগ। এবার শুরম্ন হলো পাহাড়ি এলাকা। ফসলের মাঠ নেই তবে আছে ঢেউ খেলানো সবুজ সবুজ পাহাড়। মাঝে উপত্যকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলেল শ্যালে। দূরে পাহাড়গুলোর চূড়ায় জমে আছে সাদা বরফ। আর বিভিন্ন উচ্চতায় ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের চাক আটকে আছে। জানালা থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এমনকি সুরভি যেখানে ট্রেনে উঠেই একটা ঘুম দিয়ে নেয় সেও চোখ বড় বড় করে আটকে থাকলো ট্রেনের জানালায়। বার্ন থেকে মাত্র আধঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ইন্টারলেকেন। নাম শুনেই বুঝা যায় দু'টি বড় বড় লেকের সংযোগস্থল ইন্টারলেকেন। বার্নের একটু পরের স্টেশন থুন। সেখান থেকেই শুরম্ন হয়েছে প্রথম লেক থুন। মাঝে ইন্টারলেকেন। এর পরে লেক ব্রিন্জ। ইন্টারলেক স্টেশনে নেমেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেন চমৎকার এক পেইন্টিং-এর মাঝে ঝুপ করে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। স্টেশনটার কোনদিকে কোনো দেয়াল নেই। পস্ন্যাটফর্মের দু'পাশে অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। পাহাড়ের নীচে লেকের পাশেই স্টেশনটি। লেকের পানির রং, নীলাভ নয়, সবুজাভ নয়, অবিশ্বাস্য ফিরোজা ফিরোজা (ছবি-6)। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল টিপ টিপ করে (ছবি-7)। তবু চারপাশের লেক, বোট, পাহাড় আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মনেই হচ্ছিল না দুপুরের খাবারটাই খাওয়া হয়নি। পস্ন্যাটফর্মে ব্যাগগুলো পড়ে রয়েছে, আমরা তখন ভীষণ ব্যসত্দ; দু'পাশের দৃশ্য গিলছি ক্ষুধার্তের মত।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন