নার্সের রুম থেকে বেরিয়ে রেস্টরুমে যাওয়ার করিডোরের বামপাশে যে বিশাল জর্জিয়ান জানালা তার খোপ খোপ কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আজাদ বুঝতে পারলো দিনটা হঠাত্ই বদলে গেছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় যে গুমোট ভোর দেখেছিল সেই রূপ বদলে আকাশ এখন আলোয় ঝলমল করছে আর সেই উজ্জ্বলতার টানেই কিনা আজাদ আরেকটু এগিয়ে যায় জানালার দিকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে চোখ রাখে বাইরে, বিল্ডিংটার ছায়া যেটুকু ঘাসে পড়েছে তার রং ঘনসবুজ অথচ ছায়ার পর লনের বাকী ঘাস সূর্যের ছটায় জন্ডিস হলুদ হয়ে আছে। জানালার খুব কাছে চলে গিয়েছিল বোধহয় আজাদ টুং করে একটা মৃদু শব্দ হতেই সাবধান হয়ে হাতের দিকে তাকায় আর তখন তার মনে পড়ে টেস্ট টিউবটির কথা। বেঁটে খাটো ক্যাপ লাগানো টেস্ট টিউব দেয়ার সময় নার্স তাকে শেলফে সাজানো প্লে-বয় ম্যাগাজিনগুলো দেখিয়ে ইঙ্গিত করেছিলো সেখান থেকে সে প্রয়োজনে যেকোনো সংখ্যা তুলে নিতে পারে কিন্তু আজাদের মনে নুপুরের স্মৃতি এখনও তাজা অতএব সে মৃদু মাথা নেড়ে আপত্তি জানায় যে তার ওসব দরকার হবে না। এরকম একটা অশোভন ইঙ্গিত করা সত্ত্বেও নার্সটা মুচকি হাসিও হাসে না দেখে আজাদের খুব বিরক্ত লাগে তবু জবাবে মুখে প্লাস্টিক হাসি এঁটে ধন্যবাদ জানিয়ে রেস্টরুমের দিকে পা বাড়াতেই নার্সটা ব্যারিটোনে বলে, টেক ইয়োর টাইম, ডিয়ার।
জানালার কাছ থেকে টেস্টটিউবটা দ্রুত সরিয়ে কোথাও আঁচড় পড়লো কিনা পরীক্ষা করতে করতে আজাদ নিজের সাথে কথা বলে, যতই সময় হাতে থাকুক, এখন প্রকৃতি দেখার সময় নয়, আজাদ। নারী কি প্রকৃতি এবং প্রিয় নারীর কথা মনে ভাবাও কি প্রকৃতি দেখার মত কাজ এরকম একটা এঁড়ে তর্কের বিষয় আজাদের মনে গুঞ্জন তোলে কিন্তু রেস্টরুমের দরজা খুলতেই বিস্ময় ও অজানা এক ভয়ের মিশ্রিত অনুভূতিতে সামনের মূর্ত বাস্তবই তার সব মনোযোগ কেড়ে নেয়। খুব বেশি বড় না হলেও সোফা, কার্পেট, রকিং চেয়ার, বইয়ের শেলফ, টবে বুনো গাছ সব দিয়ে এমন সাজানো একটা রুম হানিমুন স্যুট হতে পারে, রেস্টরুম হতে যাবে কেন? আজ এইসময় বোধহয় আজাদ ছাড়া কারো এখানে থাকার কথা না তাই একরকম একান্ত নীরবতার ঢেউ টের পায় আজাদ চারপাশে আর তখন তার চোখ পড়ে আরো দুটি দরজার দিকে। ভুল জায়গায় আসেনি এই সন্তুষ্টিতে সে একটা দরজা খুলে পা রাখে ভেতরে।
আধঘন্টা ধরে বসে আছে আজাদ ছোট্ট ঘরটিতে কিন্তু নুপুরের কোনও স্মৃতি এই সময়টায় তার কাজে আসে না। অনেক জান্তব উদ্দাম সময় কেটেছে তাদের এবং নুপুরও জীবন-যৌবন নিংড়ে সবটুকু সুখ চুমুক দিয়ে পান করা নারী তবু এই জরুরি মুহুর্তে নুপুরের চলে যাওয়ার দু:খমাখা আলো-আঁধারি সন্ধ্যায় একা বসে থাকা শূন্য বেডরুমটার দৃশ্য মন থেকে তাড়াতে পারে না আজাদ। প্লে-বয় ম্যাগাজিনটা নিয়ে আসার সুযোগটা নিলে কতটা সুবিধা হতো তার একটা যাচাই মনে মনে আজাদ করে তখন এও তার মনে হয় নার্সটাকে ভালো করে খেয়াল করা হলো না নতুবা তাও হয়তো কাজে লাগতো। সময়ের মাপটা কখনই আজাদ ভালো বুঝে না সেকারণে হতে পারে অথবা অনেক দীর্ঘ সময় সে নিচ্ছে এ কারণে তার রেস্টরুমের দরোজায় টোকা দেয় কেউ এবং আজাদ কিছু বুঝার আগে নার্সের কণ্ঠ শুনতে পায় সে, `আর ইউ ওকে, মি: হাসান`?“ প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ এরকমই মনে হয় আজাদের কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার হাতের শূন্য টেস্টটিউবের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা ঠিক করতে পারে না আজাদ ফলে নার্সের পরবর্তী টোকায় অধৈর্য ভাব ধরা পড়ে। নার্সটার গলা অবশ্য আরেকটু নরোম ও আন্তরিক মনে হয়, `ইজ এভরিথিং অলরাইট ডিয়ার`। সবকিছু কি করে ঠিকঠাক থাকে এমন মন্ত্র আজাদ জানে না এবং জানা থাকলে আজ এখানে তাকে বসে থাকতে হয় না কিন্তু এই মুহুর্তে প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা জরুরি মনে হয় তার কাছে নতুবা তার সন্দেহ হতে থাকে নার্সটা চেঁচামেচি করে লোক ডেকে একটা কান্ড ঘটাবে অথবা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। সে সম্ভাবনার কথা কল্পনা করে বিব্রতই হয় আজাদ তবে তা যতটা তার স্বল্পবসন অবস্থার জন্য তার চেয়ে বেশি তার এখনও শূন্য টেস্টটিউবটার বাস্তবতায়। দরোজায় এবারে নার্সটা আর টোকা দেয় না বরং ধাক্কাই বলা যায় তার প্রতিক্রিয়াকে এবং এই পাশে ভাষাহীন মানুষের মত মনের ভেতর উত্তর গোছাতে গোছাতে দরোজার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় আজাদ ।
ছবিঃ আর্ল জোনস্।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন