ছবি দেখার চেষ্টার গল্পঃ
থিয়েটার কর্মী, পরিচালক, অভিনেতা ফিরোজ আব্বাস খানের প্রথম ফিল্ম গান্ধী, মাই ফাদার। গত এক সপ্তাহ ধরে দেখার চেষ্টা করছিলাম ছবিটা। বাজে আবহাওয়া, আর বাসরুট বন্ধ থাকায় এক দিন বাসা থেকে বের হয়েও আমি, সেলিম ও মারুফ মাঝপথে বাদ দিলাম আমাদের অভিযান। ক্যামেরা-প্রিন্টের ডিভিডি এনে বাসায় মিনিট ত্রিশেক দেখার পর সিদ্ধান্ত নিলাম হলেই দেখতে যেতে হবে।
বাসার কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কি-তে সিনেওয়ার্ল্ড গ্রুপের হল আছে তাতে গান্ধী, মাই ফাদার ছবি দেখায় না। বাধ্য হয়ে হানা দিলাম দেশিপাড়ার ছোটো সিনেমা হল 'বুলিয়ানে"। খুব একটা বাণিজ্যিক ছবি না গা-মা-ফা। বুলিয়ান ওটা দেখায় শুধু দুপুর দেড়টায়। আমরা গেছি সন্ধ্যা সাতটায়। সুতরাং অন্য কোনো ছবি না দেখে পাশের রেস্টুরেন্টে দোসা, দইবড়া, ইডলি খেয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।
আয়োজন করে আরেকদিন গেলাম ইলফোর্ড। সেখানেই বুঝলাম সচলায়তন বড় হচ্ছে। ৬০-৭০ জন দর্শকের মধ্যে আরো দু'জন সচল-কে পেয়ে গেলাম। অলৌকিক হাসান আর থার্ড আই (তানভীর)।
ছবি নিয়ে কথাঃ
ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভাবতে বসলাম ছবি নিয়ে। কী দেখলাম, কেমন দেখলাম।
বিখ্যাত বাবার ছায়ার নীচে বড় হওয়া সন্তানের আত্ম-পরিচয় তৈরির দুর্ভাগ্য গাঁথা হচ্ছে ছবিটি।
মহাত্মা গান্ধীর বড় ছেলে হরিলাল গান্ধীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি।
ছবির শুরু হয় মৃতবৎ হরিলালকে হাসপাতালে ভর্তি করার দৃশ্য দিয়ে। এক দঙ্গল দাঁড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে হরিলালরূপী অক্ষয় খান্না জানায় যে তার বাবার নাম গান্ধী, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সেখান থেকে ফ্ল্যাশব্যাকে ছবির টুকরো টুকরো কাহিনী। ব্যারিস্টার থেকে মহাত্মা হয়ে যাওয়া বাবার তিনবার মেট্রিক ফেল ব্যর্থ সন্তান। তার জীবনের একমাত্র ধ্বনাত্মক দিক হচ্ছে (বাবার নির্দেশে) সত্যাগ্রহ আন্দোলন করে জেলে যাওয়া প্রথম ভারতীয়।
হরিলালের ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় না। অনেকটা বাবার কারণে। নিজে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড গেলেও ছেলেকে তিনি হাতছাড়া করতে চান না। তার রাজনৈতিক আদর্শের প্রথম সৈনিক বানাতে চান তাকে। আর বাবার ছায়ায় থেকে থেকে বিবাহিত ও সন্তানের পিতা হরিলাল পুড়তে থাকে আত্মদহনে যে সে কতটা অকর্মা, বাবার উপর নির্ভরশীল।
গান্ধী, মাই ফাদার ছবিটাও একইরকম ছায়ায় থাকে আমাদের কাছে। রিচার্ড এ্যাটনবারার বিশাল বাজেটের গান্ধী ছবিটা আমাদের মাথায় থাকে, হয়তো আরো দর্শকদের মাথায়ও থাকে, আর অতি অবশ্যই রয়েছে সমালোচকদের কলমের ডগায়। কিন্তু তার তুলনায় কম বাজেটের এই ছবিটির দৈন্যতা ছবির কিছুটা হলেও অঙ্গহানি ঘটায়, হয়তো অনেক সম্ভাবনাকেও নষ্ট করে দেয়। পরিচালক বা প্রযোজককে সে দায় দিতে চাই না, তারা তথাকথিত আর্ট ফিল্ম ও বাণিজ্যিক ফিল্মের সীমারেখা ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। তারা ধন্যবাদার্হ।
ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো, স্থানগুলো বাজেটের স্বল্পতায় শিল্পিত হয়ে উঠতে পারে না। যদিও কাহিনীটি বাপ ও ছেলের। কিন্তু গান্ধী বলেই অনিবার্য ভাবে অনেক দৃশ্য এসে যায় যেগুলো বড় বাজেট দাবী করে। যার অভাবে, গল্পের প্রেক্ষাপটে পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে দর্শকের কাছে ভারতের যেকোনো জায়গা মনে হয়, কোলকাতাকে ভারতের যেকোনো বাজারের গলি মনে হয়। জনসভায় বোমা মারার দৃশ্যের পর লাশের দিকে গান্ধীর ছুটে যাওয়াটা কেমন সাজানো সাজানো মনে হয়। তবে এগুলো ছবির মূল বিষয় ছিল না।
মূলে যে গল্প তা হলে যাওয়ার আগে মিডিয়ার কল্যাণে যতটুকু জেনে যাই তার সাথে ছবিটা আর কিছু যোগ করতে পারে না। ছবির বা পরিচালকের মূল ব্যর্থতাকে আমি এভাবেই দেখতে চাই।
পরিচালক বড় বা ছোট কোনো গান্ধীর উপরই দোষ বা দায় চাপাতে চাননি, সে ঠিক আছে। কিন্তু ছোটো গান্ধীর বিবর্তনগুলোর কার্যকারণ দর্শক হিসেবে আমার কাছে স্পষ্ট হয় না।
হরিলাল গান্ধী হিন্দু থেকে মুসলমান হচ্ছেন সে দৃশ্য ছবিতে আছে। আব্দুল্লাহ নাম ধারণ করার পর আবার হিন্দু হচ্ছেন সে ঐতিহাসিক দৃশ্যও ছবিতে আছে। কিন্তু এই রপ-পরিবর্তনের নেপথ্যে হরিলালের মনোভাবনা, আত্ম-সংকট কিংবা গান্ধীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কোনো ভিজ্যুয়াল কাহিনী পরিচালক আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন না। তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন পাতার স্ন্যাপশট দিয়ে যান, এতে গল্পটার ধারাবাহিকতা ধরা যায় কিন্তু গভীরে যাওয়া যায় না।
পরিচালক ফিরোজ আব্বাস খান হয়তো গণমানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া মহাত্মা গান্ধীর বড়পুত্রের কাহিনীটা সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আনতে পেরেছেন। কিন্তু পিতা-পুত্রের দ্বন্ধ ও দেশের সব সন্তানের পিতা হতে গিয়ে নিজ পুত্রের কাছে হারিয়ে যাওয়া যে বাবার কাহিনী আমাদের শোনানোর ইঙ্গিত করেছিলেন তা আমার শোনা-দেখা হয় না। একটা আধা-ইতিহাস ভিত্তিক গল্প আমরা পাই, কিন্তু যেখানে সৃজনশীলতায় ডকুমেন্টারি পেরিয়ে শিল্প হয়ে উঠবে ছবিটা সে জায়গায় পরিচালক যান না। পরিচালকের বিশ্লেষণটা পাওয়া যায় না।
খুব কঠিন শোনাচ্ছে সমালোচনাটা। কিন্তু ছবিটা দেখার জন্য আমার আগ্রহ আর দুর্ভোগের একটা বর্ণনা শুরুতেই দিয়েছি। সুতরাং পরিচালকের কাছে বাড়তি কিছু চাওয়া থাকতেই পারে।
তবে হরিলাল চরিত্রের জন্য অক্ষয় খান্নার নির্বাচনটা ঠিক হয়নি। হরিলালের মত চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা অক্ষয় দেখাতে পারেন নি। নিজেকে প্রস্তুত করার পরিশ্রম টুকুও তিনি করেননি। অতি-অভিনয় দেখা গেছে অনেক অংশেই। অথচ বেন কিংসলে'র গান্ধী চরিত্রটিকে মুখোমুখি রেখেও দর্শন জরিওয়ালা গান্ধী চরিত্রে অপূর্ব অভিনয় করে গেছেন। ভূমিকা চাওলাও ভালো অভিনয় করেছেন। আর গান্ধীর স্ত্রীর চরিত্রে শেফালি শাহ ছিলেন অত্যন্ত ন্যাচারাল। যদিও বয়স বেড়ে যাওয়া অংশে মেকাপ-ওম্যান তার মুখে কালি-ঝুলি মাখানো ছাড়া আর কিছু করেন নি। বিগ ক্লোজআপে তাই কুঁচকানো চামড়ার বদলে দেখা যায় উঁচু হয়ে থাকা প্লাস্টিক।
ক্যামেরার কাজে জনৈক ডেভিড ম্যাকডোনাল্ডের নাম দেখতে পাই আমরা। তিনি সযত্নে ছবি তুলেছেন কিন্তু ক্যামেরার কোনো বিশেষ ভাষা বা অনন্য কোনো ফ্রেম বা মগজে গেঁথে যাওয়ার মত কোনো দৃশ্য আমি পাইনি।
এত কিছুর পরও পরিচালক ফিরোজ আব্বাসকে বা অনিল কাপুরকে আমি সাধুবাদ জানাতে চাই। বাণিজ্যের ফর্মুলা থেকে বের হয়ে এসে ছবি বানানোর সাহস দেখানোর জন্য। সেইসাথে এই আশাও করি যে নবীন পরিচালক তার এখান থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতায় আমাদেরকে আরো সৃজনশীল ছবি উপহার দেবেন অচিরেই।
মন্তব্য
ছবি এবং গান্ধীপুত্র নিয়ে আগ্রহ ছিল। আগে জানিয়ে ভাল করলেন। ভাল লাগলো।
দেখে ফেলেন তাড়াতাড়ি। হলে গিয়ে।
ডিভিডি দেখলে পুরা মজা না পাওয়ার আশংকা আছে।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
দেখতে হবে
বলার মত সব কথাগুলোও আমি লিখতে পারিনি।
অনেক কিছু বলার ছিল।
কিন্তু লিখতে গেলে মনে হয়, আরেকবার না দেখে একবারের দেখায় অনেক মন্তব্য করা ঠিক না। কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণও।
(মঙ্গলবার কয়টায়?)
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
যেমনই হোক, আমি ছবিটা দেখবই। গান্ধী চরিত্রের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে ... কিছু করার নেই।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
গান্ধীর চরিত্রে জরিওয়ালা দারুণ অভিনয় করেছেন।
ছবিটা ভালোই হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে গিয়েছিলাম মিডিয়াতে একটা প্রচারণা দেখে যে এটা অস্কারে যাবে।
কিন্তু ছবি দেখে মনে হলো অস্কার পাবার মতো ততো গোছানো ছবি হয়নি। তবে ভারত দেখে যদি না দেয়া হয়।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
দেখাতেই মুক্তি।
সেইজন্যইতো পুরা গল্প বল্লাম না। দেখার বিকল্প দেখা। দেখে ফেলতে হবে। তবে ডিভিডি ভালো না হলে দেখে লাভ নেই।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
দেখতে হবে। (টরেন্টে আসলে)
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
অনেকে ছবিটা দেখেনি।
আগে ছবিটার একটা গল্পসংক্ষেপ দেয়া উচিত ছিল। তাতে হয়তো অনেক পাঠক আগ্রহ বোধ করতেন ছবিটা দেখতে।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
যতবার গান্ধী দেখি ততবার ভাবি নিজেকে বদলাবো,ছোটখাটো লোভ সামলাবো। হয়ে উঠেনা।
হরিলাল হয়ে যাই....
----------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
দেখতে হবে ছবির লিস্টটা আরেকটু বড় হলো
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
ছবিটাতে একটা জরুরি বিষয় এসেছে। তা হচ্ছে বিরাট বাবার ছায়ায় বড় হওয়া সন্তানের সংকট।
এরকম সন্তানদের উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে। তাদের কেউ কেউ বেশ সমস্যাও তৈরি করে।
কিশোরকুমারের ছেলে অমিতকুমার বা সত্যজিতের ছেলে বা ফজলুল হকের ছেলে ফায়জুল হক এদের কথা ভাবা যায়। এরা হয়তো স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছে। অনেকে চাপ নিতে না পেরে ভেঙে যায়। হরিলাল গান্ধি সেরকমই ছিল। ছবিটা দেখবার মতই।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
শোহেইল ভাই
কয় দিন ধইরা ভাবতেছিলাম একটা বিষয় নিয়া লিখতে, আপনের এই কমেন্টের পর মনে হইলো লিখন যায়...বিষয়টা হইলো বাবাদের ছেলেরা...
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...
ভাস্কর, বিখ্যাত বাবাদের সাধারণ মেধার সন্তানের আত্মপ্রকাশের সংকট বিষয়টা অনেক আগে থেকেই মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। একটু খোঁজ করলে তত্ত্বীয় বিষয়টাও পেয়ে যাবেন।
দিয়ে দেন একটা ঝকমারি লেখা ।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
মেঘ
দেখতে হবে।
মেঘ
দেখতে হয় ছবিটা। তবে এই আলোচনা বা সমালোচনার একটা সমস্যা হচ্ছে ব্যাপারগুলো মাথায় গেঁথে যায়, আর ছবি দেখার সময় সেগুলো দাঁত কেলাতে থাকে। তা বলে ভাববেন না, আমি ফিল্ম রিভিউ করতে মানা করছি। কারণ রিভিউ না পড়লে যে দেখাই হতো না অনেক ছবি।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
নতুন মন্তব্য করুন