চ্যাপম্যান: জন লেননকে যে ভন্ড ভাবতো

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/১০/২০০৭ - ৪:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দ্য কিলিং অব জন লেননদ্য কিলিং অব জন লেনন
জন লেনন খুন হওয়ার ২৬-২৭ বছর পরও পৃথিবী জুড়ে তার অন্ধ অনুসারী কিন্তু অনেক। সুতরাং লেননের খুনিকে নিয়ে ছবি বানানোর ঝুঁকি ও ঝক্কি বিশাল বলেই অনুমান করা যায়। খুনির চরিত্রে কেউ ভয়েই অভিনয় করার কথা না। অন্যদিকে খুনকে আলাদা কোনো মাহাত্ম্য না দিয়ে খুনির দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা দেখা খুবই দুরুহ। তারপরও এ্যান্ড্রু পিডিংটনের ছবি 'দ্য কিলিং অব জন লেনন' সমালোচক ও বোদ্ধা দর্শকদের কাছে যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য হয়েছে পরিচালকের দক্ষতার কারণেই।

বিখ্যাত রটারডাম বা এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যালে তো বটেই ইউকে'র সবচে বড় 'ইন্ডিপিন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল' রেইনড্যান্সেও দেখানো হয়েছে ছবিটি। খুন বা মারদাঙ্গা মার্কা ছবিতে আমার আগ্রহ কম। কিন্তু রেইনড্যান্সের কর্ণধার এলিয়েট এতো বেশি কানপড়া দিচ্ছিল যে উঁকি দিতে আমিও ঢুকেছিলাম শাফ্টসব্যারি সিনেওয়ার্ল্ডের স্ক্রিন ৭-এ।

পত্রিকায় খবর
৮ ডিসেম্বর ১৯৮০-তে লেননের খুন হয়ে যাওয়াটা এখনও সংগীত-পিপাসুদের বুকে বেঁধে। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় তাকে যে খুন করলো সেই চ্যাপম্যানের ভেতরের ভাবনাগুলো পর্দায় আনতে চেয়েছেন পরিচালক। পুরো ছবিটার কাহিনীর ভিত্তি হচ্ছে চ্যাপম্যানের আদালতে দেয়া বক্তব্য আর তার ব্যক্তিগত ডাইরি।

ছবিটা ঠিক ডকুমেন্টারি নয়, সুতরাং পিডিংটন পরিচালক হিসেবেও অনেক কিছু এখানে যোগ করেন। তার মধ্যে শিল্পসম্মত দিক হলো ছবিটা ৮০ সালে নির্মিত ছবি বলে ভ্রম হয়। পরিচালক খুনির মানসজগত দেখাতে চেয়েছেন আবার তার প্রতি দর্শকের কোনো অনুরাগ বা বিরাগ না জন্মাক এতোটা নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বও রাখতে চেয়েছেন। এতে লেনন-ভক্তদের সমালোচনার সমস্যাটা হয়তো মোকাবেলা করা গেছে হয়তো। কিন্তু 'সেন্টিমেন্টাল' উপাদান কম থাকায় বা দর্শককে ইমোশনালি ইনভলভড্ না করায় বা মূল চরিত্রের প্রতি দর্শকের সিমপ্যাথি জাগানোর চেষ্টা না করায়, টাইটেলে লেননের নাম থাকা সত্ত্বেও ছবিটা জনপ্রিয় হবে না বলেই মনে হলো।

ছবিতে মৃত্যু-দৃশ্য ছাড়া লেনন একেবারেই অনুপস্থিত। চ্যাপম্যানকে আমরা ছবিতে পাই একধরনের মানসিক সমস্যায় থাকা গড় মানুষ হিসেবে। যার জীবন খুবই সাদামাটা ও বোরিং। স্ত্রী বা মায়ের সাথে তার খুব একটা কার্যকর সম্পর্ক নেই। তারপরও জীবনের গূঢ়তর মানে খুঁজে বেড়ায় চ্যাপম্যান। স্থানীয় লাইব্রেরিতে যায় বিভিন্ন রকম বই পড়তে। একদিন তার হাতে আসে জেডি সেলিংগারের লেখা 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই'।

দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই
বইটি পড়ে চ্যাপম্যান যেন নিজেকে পেয়ে যায় মূল চরিত্র হোল্ডেন কোলফিল্ডের মধ্যে। কোলফিল্ড চরিত্রটির ছিল ভন্ড মানুষজনের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা আর অশ্রদ্ধা। ফিকশনের চরিত্রের এই দিকটির সাথে নিজের মিল খুঁজে পায় চ্যাপম্যান। এখন দরকার ঘৃণা করবার মত সেলিব্রিটি ভন্ড। লাইব্রেরিতেই চ্যাপমান খুঁজে পায় জন লেননের ছবির বই। তাতে লেননের জীবনের বিভিন্ন সময়ের সাদা-কালো অনেক ছবি ছাপা আছে গ্লসি কাগজে। সেইসব ছবির পাতা উল্টায় চ্যাপম্যান; দেখে লেননের প্রাসাদের মত বাড়ি, দামী ফ্ল্যাট, বিলাসী ইয়াট, আর তার মাথায় ক্রোধ কাজ করতে থাকে।

ডাকোটার বিল্ডিংয়ের সামনে লেনন ও তার স্ত্রীডাকোটার বিল্ডিংয়ের সামনে লেনন ও তার স্ত্রী
চ্যাপম্যান ভাবে, এই সেই লেনন, যে বিখ্যাত হয়েছে মানুষকে সাম্যের কথা বলে, যে 'ইমাজিন' করতে বলেছে শোষণমুক্ত পৃথিবীর কথা। তার কেন এইসব বিত্ত-বৈভব থাকবে? চ্যাপমানের সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দেরি হয় না আসলে লেনন তার শ্রোতাদেরকে নিয়ে খেলা করেছে, লেনন একটা ভন্ড।

চ্যাপম্যান তার আইডল চরিত্র কোলফিল্ডের মত একটা জরুরি কাজ খুঁজে পায়। সে লেননকে হত্যা করার মিশন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাজার মাইন ভ্রমণ করে একবার নিউইয়র্ক এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরেও যায় চ্যাপম্যান। কিন্তু পরের বার চ্যাপমান তার ফ্যান্টাসিকে বাস্তবে রূপ দেয়। লেনন যখন গুলি খেয়ে পড়ে থাকেন তখনও চ্যাপম্যান পালায় না। সে ঘটনাস্থলের কাছেই পুলিশের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, ঠান্ডা মাথায় ধরা দেয়।

ছবির শেষে আমরা জানতে পারি চ্যাপম্যানের শাস্তির মেয়াদ শেষ কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তাকে এখনও জেলে রাখা হয়েছে। কিছুটা সত্য তথ্য ও কিছুটা নাটকীয়তা যোগ করে পিডিংটন লেননের মৃত্যুকাহিনী নিয়ে এরকম কালো একটা ছবি বানিয়ে ফেলেন। অনেকেই একে সাহস হিসেবেই দেখছেন। হয়তো তাই। এই ছবির সূত্র ধরেই আমরা হয়তো আরো কিছু বিখ্যাত লোকের খুনিদের মানসজগত নিযে এরকম শিল্পিত ছবি পাবো। যেখানে অন্ধকারে থাকা তথ্যগুলোয় নতুন করে আলো ফেলা হবে, খুন বা খুনির ওপর আলাদা কোনো মাহাত্ম্য আরোপ না করেই।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বহুদিন আগে বিটিভিতে প্যাকেজ অনুষ্ঠান শুরুর প্রথম দিকে একটা নাটক দেখেছিলাম । মুল চরিত্রে পাভেল আজাদ(আজাদ আবুল কালাম) ছিলেন । এক সদ্য তরুন যে একজন বিখ্যাত রহস্য গল্প লেখকের অন্ধ ভক্ত । সেই লেখকের সব রহস্য গল্পগুলো সে পড়ে,পড়তে পড়তে সে নিজেই গল্পের চরিত্র হয়ে উঠে । গল্পের চরিত্রের মতোই সে একদিন শখের বশে খুন করে বসে ।
নাট্যকার দর্শকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন-এই খুনের জন্য আসলে কে দায়ী? এই তরুন নাকি সেই লেখক?

চ্যাপমান নামের একজন ট্রাবল্ড মানুষ নিজের ভোতা যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে জন লেনন একজন ভন্ড, যেহেতু তার নিজের বিলাসী জীবন আছে সেহেতু শোষনমুক্ত সমাজের কথা বলা ভন্ডামী এই যুক্তিতে সে লেনন কে খুন করে-আর এই খুনে তাকে প্রনোদনা জোগায় একটা উপন্যাসের চরিত্র ।

একটা খুনের জন্য কে দায়ী তবে? খুন হওয়া ব্যক্তির সো কল্ড ভন্ডামী(খুনীর জাজমেন্ট), খুনের প্রনোদনাদায়ী উপন্যাসের চরিত্র তথা উপন্যাসিক নাকি স্রেফ খুনী লোকটা নিজেই?
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কে দায়ী তার বিচার মোটামুটি আদালত করেছে। চ্যাপম্যান এখনও কারাগারে।
উপন্যাসটা তাকে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে খুনে প্রণোদনা দেয়নি নিশ্চয়ই। খুনে ছুরি ব্যবহার করলে ছুরি তৈরির কামার নিশ্চয়ই অভিযুক্ত হয় না। কারণ ছুরির ব্যবহার তো অনেক আছে।
আর বই লেখার মূল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই খুনি তৈরি ছিল না।

এই ছবিটার নির্মাণকৌশল এতো ভালো ছিল এবং পরিচালক এতো সংবেদনশীল ছিলেন যে ছবিটি দেখে চ্যাপম্যানের প্রতি কোনো বাড়তি মমত্ব জন্মায় না বা লেননের প্রতি কোনো ঘৃণাও না।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নিঘাত তিথি এর ছবি

বর্ণনা খুবই চমৎকার লেগেছে। ছবিটা দেখার আগ্রহ জন্মালো খুবই।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

তিথি, ধন্যবাদ। ছবিটা হয়তো ডিভিডি-তে দেখতে হবে। অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাবে কিনা, তবে অফ-মেইনস্ট্রিম ফিল্ম যেখানে দেখায় সেখানে যেতে পারে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

দুপুরেই পড়ছিলাম। মন্তব্য করা হয় নাই।

আমি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনতে গিয়েছিলাম ইনডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে গিয়ে শুনি গাড়ি কিনতে পারেনি বলে আফসোস করছে। তখন আমারও ঠিক এরকম একটা অনুভুতি হয়েছিল। পরে তার জীবনমূখী গান শুনলে ভন্ড মনে হত তাকে। আস্তে কমে এসছিল পছন্দটা।

জন লেননের খুনীর ব্যপারটা এক্সট্রিম কিন্তু অসম্ভব নয়।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

যাদের অনুভূতি খুব তীব্র তাদের কাছে তাদের পছন্দের মানুষের ভিন্ন মাত্রা বিরাট ধাক্কা দেয়।
সুমন কবিরের গানের আদর্শ আর তার জীবনের আদর্শ অনেকের কাছেই ধাক্কার মত লাগবে। স্বাভাবিক।
এর সাথে যদি যোগ হয় মানুষটার অস্থির মন-মানসিকতা, হয়তো কিছুটা অসুস্থতা তবে এরকম একটা ঘটনা ঘটতেই পারে।
কথা হচ্ছে একে পর্দায় আনা।
আমাদের দেশে হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণ নিয়ে কোনো শর্টফিল্মও কি কখনও হবে না?
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ভাল লাগলো পড়ে। JD Salinger পড়ে যে চ্যাপম্যানের মাথা খারাপ হবে, সেটাই বা কে জানতো?
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

তাও বলতে পারছি না ।কারণ এই লেখকের কোনো লেখা কখনও পড়িনি।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।