(১)
শিরোনাম থেকেই হয়ত অনেকে আন্দাজ করে ফেলেছেন, লেখাটার বিষয়বস্তু স্পর্শকাতর। অবশ্য সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, বিষয়বস্তু নয় বরং এই বিষয়ের সত্যপাঠ নিতে গেলে অনেক সময় পাঠকই স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেন। এই কাতরতা আর অনুভূতিপ্রবণতার কথা মাথায় রেখেই লেখাটা আমাকে শুরু করতে হচ্ছে বেশ কিছু কৈফিয়ত দিয়ে। প্রথম কৈফিয়ত হিসেবে, এই কথা শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে, লেখাটার উদ্দেশ্য আর যাই হোক, সেটা স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ মানুষকে কাতর করা বা আহত করা নয়।
বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার শিকার বেশ কিছুদিন ধরেই ব্লগার, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট, সংস্কৃতিকর্মী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পুরোহিত, এরকম ‘কিছু বিশেষ ধরনেরর’ মানুষ হয়ে আসলেও, গুলশানের ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে যাবার আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ শুধু নয় বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সরকার প্রধাণ পর্যন্ত মূলত মেতে ছিলেন সমস্যা অস্বীকার করার নানা কৌশল উদ্ভাবন করতে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ এর নানা উপায় আর উপদেশমালা খুঁজে বের করতে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যদিও বিভিন্ন সময় এবং উক্ত হত্যাগুলোর আগে পরে কম বেশি গ্রেফতার করেছে, কিন্তু কেন যেন আমার কাছে মনে হয়েছে এই ধরনের ঘটনাগুলোর পরে সরকার থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গা-ছাড়া ভাব ছিল। সেই হিসেবে চিন্তা করলে গুলশানে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ট্র্যাজিক ঘটনাটিকে জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে একটি প্যারাডাইম শিফট হিসেবে দেখা যেতে পারে। অন্ততপক্ষে এখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।
অন্যদিকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এইসব বিষয়ে সবসময়েই ‘আই হেইট পলিটিক্স’ বা ‘আই হেইট জঙ্গিবাদ’, বা ‘ইহা প্রকৃত ইসলাম নয়’ ধরনের গা-বাঁচানো মতবাদ ব্যবহার করে দায় এড়িয়ে চলে এসেছেন। নিজের আশে পাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার চেয়ে বেশিরভাগ মানুষকে বরং অনেক অনেক দূরবর্তী গাজা বা ইরাকে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক অনুভূতিপ্রবণতায় কাতর হতে দেখেছি।
সম্ভবত সরকারের উচ্চপর্যায়ের মানুষজন থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অনেকেরই ধারণা ছিল এই বিশেষ ধরনের আক্রমণ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আসবে না। নিকট অতীত এবং ঘটমান বর্তমানে উপরে উল্লিখিত আক্রান্ত মানুষদের অনেকেই ঠিক সাধারণ জনগনের কাতারে ফেলেন না। আইনপ্রণেতাদের অধিকাংশ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ কেউই নিজেদের এই বিশেষ ধরনের আক্রান্ত গোষ্ঠীর একজন হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেন নি। ফলে এই বিশেষ ধরনের টার্গেটেড কিলিং সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত অনেককেই বরং অনেক সময়েই আস্বস্ত করেছে। হয়ত এই হত্যার ভয়েই চিন্তাশীল লেখা কেউ আর লিখবে না, বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে অনুমোদিত নয় এমন কাজ (পূজা, গান বাজনা, অন্য ধর্ম প্রকাশ্যে পালন) ধীরে ধীরে কমে যাবে - এইসব ভেবে হয়ত অনেকেই পুলকিত হয়েছেন। আমরা দেখেছি, এরকম প্রায় প্রত্যেকটা হামলার পর সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অপরাধীদের ব্যপারে তেমন কিছু না বলে বরং যারা এই হামলার শিকার তাঁদেরই কল্পিত অপরাধের খতিয়ান দেয়া হয়েছে। আর কেউ যাতে ভবিষ্যতে এরকম জঘণ্য কাজ (যেমন চিন্তাশীল লেখালেখি, গান-বাজনা, পূজা করা) না করেন বা করলেও ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে করেন, এরকম উপদেশ দেয়া হয়েছে।
গুলশানে জঙ্গি হামলা এই পরিস্থিতিকে সামান্য হলেও পালটে দিয়েছে। বামমোর্চা, জামাত-বিএনপি, ফরহাদ মঝহার, আনু মোহাম্মদ বা জোনায়েদ সাকির মতো কিছু বিশিষ্টজন ছাড়া অনেকেই সম্ভবত স্বীকার করেছেন বা অন্তত বুঝতে পেরেছেন যে, এই জঙ্গি ব্যপারটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে গৎবাঁধা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বেকারত্ব, ভালোবাসা আর গণতন্ত্রের ত্বত্ত্ব দিয়ে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না।
আজকের লেখার বিষয়বস্তুকে আরেকটু ওজনদার করার জন্য অতীতের বিভিন্ন সময় আমার করা কিছু সিলি, আনসফিস্টিকেটেড সোশাল এক্সপেরিমেন্টের কথা উল্লেখ করব। এই এক্সপেরিমেন্টগুলো অনেকগুলোই অতীতে করা। তাই কেউ চাইলেই আমি তার দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারব না। এটা আমার দ্বিতীয় কৈফিয়ত। অবশ্য এক্সপেরিমেন্টগুলোর ফলাফল এতটাই প্রত্যাশিত (অন্তত আমার কাছে) যে, এক্সপেরিমেন্টগুলো ছাড়াও আমি যে দাবীগুলো করছি সেগুলো আরেকটু নরম স্বরে দাবী করে ফেলা যেত।
আমার তৃতীয় কৈফিয়ত হলো আমি সমাজবিজ্ঞানি নই। আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখব বা উল্লেখ করব এই বিষয়গুলো নিয়ে সিরিয়াস সমাজবৈজ্ঞানিক গবেষণা হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। আমি এখানে যা লিখব তার উৎস মূলত আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, পড়াশোনা এবং বোঝাপড়ার নির্যাস। যেহেতু এইসব বোঝাপড়ার পেছনে কোনো বিশেষ প্রক্রিয়াধীন গবেষণাপ্রসূত তথ্য নেই, আমি আমার পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তির বিপরীতে পাঠকদের যুক্তি শুনতে আগ্রহী হবো এবং আমার আমার পর্যবেক্ষণ এবং বোঝাপড়াকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হবো।
(২)
আমরা কোনো সমস্যা আর তার সমাধান নিয়ে আলাপ করতে গেলে অনেক সময়েই খুব সাধারণ একটা ভুল করে ফেলি। সেটা হলো সমস্যার কারণ হিসেবে ‘কেবল একটি’ বিশেষ কারণকে নির্দেশ করা বা ‘কেবল একটি’ কারণ আছে এমনটি ধরে নেয়া। কোনো সমস্যার পেছনে কেবলমাত্র একটি কারণই থাকতে পারে, এটি ধরে নিয়ে যুক্তি তর্কের অবতারণা করতে গেলে অনেক সময়েই একটি বহুল চর্চিত লজিক্যাল ফ্যালাসির শিকার হতে হয়। জঙ্গিবাদ নিয়ে আমরা যদি বিভিন্ন গোষ্ঠীর আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনাগুলো একটু খতিয়ে দেখি, তাহলে লক্ষ্য করব এই আলোচনাগুলোর অধিকাংশই এই বিশেষ লজিক্যাল ফ্যালাসির দোষে দুষ্ট। জঙ্গিবাদের মতো একটি জটিল সমস্যাকে কেবলমাত্র ‘একটি’ কারণের ফলাফল হিসেবে দেখাতে চাওয়া বা জঙ্গিবাদকে নিজেদের রাজনৈতিক বা সংগঠনের প্রচলিত ডিস্কোর্সের আলোকে ব্যাখ্যা করার সাম্প্রতিক প্রয়াসগুলোকে তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার কাছে অত্যন্ত আত্মবিধ্বংসী মনে হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদকে অন্যান্য রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যার সাথে মিলিয়ে ফেলে এক কাতারে বিবেচনার করার সাম্প্রতিক চর্চা জঙ্গিবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত লালন পালনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ধণাত্মক ভূমিকা রাখছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
জঙ্গিবাদ ব্যপারটা কী? এই প্রশ্নটি করা হলেই আমাদের দেশের মানুষ নানা দল আর উপদলে ভাগ হয়ে যাবেন। সবাই নিজের মতো করে নিজের কম্ফোর্ট জোনে বসে সমস্যাটিকে ব্যাখা করার চেষ্টা করবেন। কারও কাছে জঙ্গিবাদ হলো, কিছু বেকার যুবকের চাকরি না পাওয়ায় অবদমিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, কারও কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাবহেতু চাপা ক্ষোভের উদগীরণ, কারও কাছে কিছু ভালোবাসাহীন যুবকের ভালোবাসার দাবীতে প্রতীকি হাহাকারের প্রতিধ্বনি, কারও কাছে ভারত আর ইসরাইলের ষড়যন্ত্র, কারও কাছে কিছু নিষ্পাপ আলাভোলা মানুষ ব্রেনওয়াশ হবার ফলাফল, কারও কাছে এটা ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র, কারও কাছে এটা প্রকৃত ইসলাম থেকে বিচ্যুতি আবার কারও কাছে এটাই প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ বা কিতাল, যার জন্য জীবন দেয়া যায়, জীবন নেয়া যায়।
এই জঙ্গিবাদের পেছনের কারণ হিসেবেও এক এক ধরনের মানুষ এক এক রকম কারণ দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না বা চান না, যে একটা জটিল সমস্যার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। এইসব একাধিক কারণের মিথিস্ক্রিয়াতে শেষ পর্যন্ত একটা এন্ড প্রোডাক্ট বেরিয়ে আসে।
জঙ্গিবাদের এইসব কারণ আর সংজ্ঞার মধ্যে অনেকগুলোই পরস্পরবিরোধী। আবার অনেকগুলোই একে অন্যের পরিপূরক। আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো, এই কারণগুলোর মধ্যে দুই একটা কারণ একেবারেই উড়িয়ে দেবার মতো হলেও বাকি অনেকগুলো কারণই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া চলে না। জঙ্গিবাদ প্রচার এবং প্রসারের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতির ময়দানের সাম্প্রতিক হালচালের ব্যপক প্রভাব থাকলেও আজকের লেখাটির ফোকাস মূলত জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট।
(৩)
জঙ্গিবাদ, বিশেষ করে সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলা থেকে শুরু করে বিশ্বের অত্যন্ত শক্তিশালি এবং প্রগতিশীল দেশ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দেশে আমরা ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় শত শত নিরীহ মানুষকে নিহত আর আহত হতে দেখেছি। সেই প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে জঙ্গিবাদ নিয়ে বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে সচেতন হবার প্রয়োজন আছে কিনা, জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনায় এই প্রশ্নটিকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করি।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলাগুলোতে আমরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংস্থা আল-কায়দা আর সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা আইসিসের নাম বিভিন্ন সময় উঠে আসতে দেখেছি। বাংলাদেশেও ব্লগার হত্যা, পুরোহিত হত্যা, শিয়া, বা খ্রিস্টান পাদ্রি হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক হলি আর্টিজানের হামলায় বিভিন্ন সময় আইসিস আর আল-কায়দার দেশীয় ফ্র্যাঞ্চাইজ নেয়া গোষ্ঠীগুলোর নাম উঠে এসেছে। আল-কায়দা আইসিস বা তাদের দেশীয় ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম আদর্শিক দ্বন্দ্ব বা কর্মপন্থায় কমবেশি পার্থক্য থাকলেও মূল আদর্শিক জায়গায় তাদের বিরোধ সামান্যই। বিশেষ করে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে তাদের আদর্শিক বিভাজনের জায়গার চেয়ে আদর্শিক মিলের জায়গাটুকুই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অধিক আলোচনার দাবী রাখে বলে আমার মনে হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ থেকে উদ্ভুত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে অন্যান্য সাধারণ প্রচলিত অপরাধমূলক কাজের (হত্যা, হুমকি, অরাজকতা সৃষ্টি) সাদৃশ্য থাকলেও এই দুই ধারার অপরাধের মধ্যে পার্থক্যকে বুঝতে পারা জঙ্গিবাদকে বুঝতে পারা এবং মোকাবেলার জন্য অতন্ত্য জরুরি। জঙ্গি সমস্যার সাথে অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মূল ফারাক হলো জঙ্গিবাদে জড়িত অধিকাংশ মানুষই এই কাজগুলোকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে না বরং চরম পূন্যের কাজ বলে বিবেচনা করে। জঙ্গিবাদ দমনের এই মিশনে তাই ‘কেবলমাত্র’ আইনশৃঙ্খলার ব্যপারটি বিবেচনায় আনলে মূল সমস্যাটিকে পাশ কাটানো হবে।
(৪)
একটু আগেই উল্লেখ করেছি, অনেকেই জঙ্গিবাদের পেছনের কারণ হিসেবে প্রচলিত ডিস্কোর্স বা নিজেদের সংগঠনের প্রচারিত ডিস্কোর্সের পক্ষে যায় এমন সব ডিস্কোর্স প্রচারেই অধিক উৎসাহী থাকেন। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদকে কেবলমাত্র আমেরিকার ইরাক বা আফগানিস্থান আক্রমনের উৎপাদ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা এমনই একটি ডিস্কোর্স। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে বিশ্বরাজনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর কোনো প্রভাব নেই এটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আমি বুঝতে চাইছি, ভৌগলিক ভাবে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত হয়েও এইসব ভূরাজনৈতিক ঘটনা কীভাবে এবং কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে।
আমেরিকা বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নানান ছুতোয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আক্রমণের ইতিহাস একেবারে নতুন নয়। মুসলমান ছাড়াও পৃথিবীতে নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আমেরিকা থেকে শুরু করে অন্য অনেক শক্তিশালি জাতি বা রাষ্ট্রের দ্বারা অত্যাচার এবং গণহত্যার শিকার হয়ে এসেছে এবং আসছে। কিন্তু ঠিক ‘কোন বিশেষ কারণ বা কারণসমূহ’ হাজার হাজার মাইল দূরে ঘটে যাওয়া ‘কিছু বিশেষ ঘটনা’র প্রভাবে আমাদের দেশের একজন তরুণকে জঙ্গি হয়ে ওঠার পথে উদ্বুদ্ধ করে? কেন মুসলিম ছাড়া অন্য অনেক সম্প্রদায় বা জাতি যখন গণহত্যার শিকার হচ্ছে বা শক্তিশালি রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীনদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে সেইসব ক্ষেত্রে কেন একজন মানুষ নিজেকে মানবজাতির একজন ভেবে সেই যুদ্ধে শামিল হচ্ছে না? বা নিপীড়নের শিকার হলেই যদি মানুষ সহিংস কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ত তাহলে আমাদের দেশের নিপীড়িত সংখ্যালঘুরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে না জড়িয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলে মেয়েরা কেন জড়িয়ে পড়ছে?
এসব ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। সেটি হলো, এর পেছনে ধর্মের ভূমিকা কতটুকু? বা এইসব ঘটনার কারণ হিসেবে ধর্ম ইসলামের আলাদা কোনো দায় নেবার দরকার আছে কিনা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন লেখায় এই বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে আমি অনেককে এই জায়গাটাতে পাশ কাটাতে দেখেছি। এই পাশ কাটিয়ে যাওয়া লেখক-বিশ্লেষকদের আমি মোটাদাগে চারটি ভাগে ভাগ করব।
একটি ভাগে আছেন যারা মূলত সমস্যাকে পাশ কাটাতেই চান। এঁদের মূল উদ্দেশ্য সমস্যা যাই হোক না কেন, ধর্মকে কেউ যেন দোষারোপ করতে না পারে। বস্তুত এঁদের এই জঙ্গিবাদ সমস্যা নিয়ে বিশেষ কোনো মাথাব্যাথা নেই বরং অনেক ক্ষেত্রে এরা খুশি এবং জঙ্গিবাদের পেছনে অন্য বিভিন্ন কারণ খুঁজে বের করে জঙ্গিবাদকে নানা কথার প্যাঁচে জাস্টিফাই করাই এঁদের বৈশিষ্ট্য।
আরেকটা গোষ্ঠী আছেন যারা নিজের ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। এঁদের ধর্ম শিক্ষা মূলত হয়েছে সামাজিক এবং পারিবারিক ধর্মাচারণ পালনের মধ্যে দিয়ে। ধর্মকে ভালোভাবে না জানার কারণে এঁদের অধিকাংশই ধর্মকে সর্বতভাবে একটি শুভশক্তি বলে মনে করে থাকেন। ধর্মের ভেতরে খারাপ কোনো কিছু থাকতে পারে এঁরা এটা ভাবতেই পারেন না। আমার ধারণা, আমাদের সমাজে এরকম লোকের সংখ্যাই বেশি। আমরা বিভিন্ন জঙ্গি হামলার পরে, বিশেষ করে ব্লগার হত্যার পর সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন জায়গার মানুষের লেখা, বক্তব্য এবং মন্তব্য লক্ষ্য করলেই বিষয়টা বুঝতে পারব। এই ধরনের বয়ানগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এসব ক্ষেত্রে একই বাক্যে খুনি জঙ্গি এবং হত্যার শিকার ব্লগারকে তিরস্কার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই তিরস্কার এবং উপদেশের মাত্রা হত্যার শিকার ব্লগার এবং হত্যার অপেক্ষায় থাকা তাঁদের সহব্লগারদের প্রতি অপরাধি জঙ্গিদের চেয়েও বেশি। এসব ক্ষেত্রে বক্তা বা লেখক যেহেতু আগেই ধরে নিচ্ছেন যেহেতু ধর্মের খারাপ কোনো দিক থাকতে পারে না বা এর খারাপ কোনো ইন্টারপ্রিটেশান হতেই পারে না, সুতরাং তাঁদের চোখে এই অভিযুক্ত ব্লগাররা শুরুতেই একটা বিরাট দোষী হয়ে যান। আর এটা মানুষের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট যে যাদেরকে আমরা অপরাধী ভাবি তাদেরকে অনেক সময় নিয়মের বাইরে অনুপাতের অধিক শাস্তি পেতে দেখলেও আমরা খুশি হয়ে উঠি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাস্তায় ধরা পড়া চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারি বা ইভটিজার যখন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যায় তখন সেটা অনেক সময়েই তাঁর অপরাধের তুলনায় অতিরিক্ত শাস্তি হয়ে গেলেও আমরা সেটা নিয়ে অনেকেই মনে মনে খুশি হই বা জাস্টিফিকেশানের চেষ্টা করি।
আরেকটি গোষ্ঠী আছে যারা মূলত আরেকটু জ্ঞানী গোষ্ঠী। এঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত গবেষক এবং বিশ্লেষক। এঁরা এই জঙ্গিবাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক সময়েই একাডেমিক পেপারের মতো তথাকথিত নিরপেক্ষ (disinterested) লেখা লিখতে গিয়ে আসল সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্ব দেন না। এঁরা বর্তমানের আলোচ্য ইসলামিক র্যাডিকালাইজেশান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে থাকা সকল ধরনের র্যাডিকালাইজেশানকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে মূলত সমস্যাটিকে ছোট করে দেখান। পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ধারনার ওপর ভিত্তি করে চরম পর্যায়ের র্যাডিকালাইজেশান এবং তার ওপর ভিত্তি করে বিশাল আকারের গণহত্যা পর্যন্ত ঘটে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক জঙ্গি সমস্যাকে সেইসব সমস্যারই আরেকটি নতুন রূপ হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে বা তথাকথিত নিরপেক্ষ থাকতে গিয়ে এঁরাও সমস্যার মূলে হাত দিতে পারছেন না।
চতুর্থ গোষ্ঠীর মূলত কোনো সমাজ বাস্তবতার কথা চিন্তা না করেই সব সমস্যার জন্য একেবারে কোনো ভূমিকা উপসংহার ছাড়া ধর্মকে দায়ী করে বসেন। কিন্তু একটা দেশের চোদ্দ পনের কোটি মানুষ যদি এই বিশেষ ধর্মের অনুসারি হন এবং সাম্প্রতিক জঙ্গি সমস্যা যদি সত্যিই সেই ধর্মের কোনো বিশেষ রূপ থেকে উদ্ভুত হয় তাহলেও যে একেবারে গড়পড়তা এই চোদ্দ পনের কোটি লোককে জঙ্গি সমস্যার দায়ী করে ফেললে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না, এই জায়গাটা অনেক ক্ষেত্রেই এই চতুর্থ গোষ্ঠীর লোকজন বোঝেন না।
আমরা যদি কোনো একটা সমস্যা সমাধান করতে চাই তাহলে সেটা নিয়ে স্পষ্ট ভাবে আলাপ করাটাই বেশি প্রয়োজন। এই বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠীর অনেকেই জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনায় ধর্ম হিসেবে ইসলাম যখনই প্রাসঙ্গিক হচ্ছে তখনই তাঁরা অন্য ধর্মের টেক্সটে ফিরে গিয়ে দেখাচ্ছেন একই ধরনের সহিংসতার কথা অন্য ধর্মের টেক্সটেও আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষ্য করার বিষয় সেটা হলো এটা ঠিক তুলনামূলক ধর্মত্বত্ত্ব আলোচনা করার সময় নয়। আমরা বাইবেল এবং চার্চভিত্তিক ক্রুসেডের ইতিহাসের কথা অনেকেই জানি। কিন্তু আজকে ইসলামি জঙ্গিবাদের সমস্যা এবং সমাধানের কথা আসলেই সেই ইতিহাসের কথা তুলে আজকের সমস্যাকে ছোট করে দেখার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টাকে অত্যন্ত অদূরদর্শী বলে মনে হয়।
(৫)
আমরা একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারব, এই ঘটনাগুলোকে এতদূর আসতে দেবার পেছনে আমাদের উপরে উল্লিখিত এই প্রত্যেকটি অলস এবং অসৎ বিশ্লেষণের দায় রয়েছে। একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা দিয়ে যদি শুরু করি, তাহলে শুরুতেই বলতে হবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া ব্লগার রাজিব হায়দারের হত্যার কথা। রাজিব হায়দারের হত্যার সময় থেকেই আমাদের এই ব্লগার হত্যাগুলোর পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নানা রকম একমুখি ডিস্কোর্স তৈরি হওয়া শুরু হয়।
রাজীব হায়দার হত্যার সময়কালের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট হয় যে, শাহবাগ আন্দোলনের একেবারে উত্তাল মুহূর্তে শাহবাগ আন্দোলনকে ধর্মের নামে বিভাজনের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দেয়া এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ব্লগার হত্যাকে শুধুমাত্র শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেখলে এর বহুমুখী বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।
শাহবাগ আন্দোলন শুরু হবার আগে থেকেই বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে সেকুলার এবং উগ্র ধর্মীয় ব্লগারদের মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছিল একথা অনেকেই হয়ত জানেন। এই ধর্মীয় উগ্র ব্লগারদের একটা বিশাল অংশ সরাসরি জামাত-শিবিরের সাথে জড়িত থাকলেও নিঃসন্দেহে এদের অনেকেই অন্যান্য উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠির সাথে জড়িত ছিল বা তাদের মতবাদে বিশ্বাসি ছিল। জামাত-শিবিরের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, যে কোনো উপায়ে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা অন্যদিকে অন্যান্য উগ্র ধর্মী গোষ্ঠির সেটি হয়ত প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না। এই গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই ইসলামি খেলাফত বা ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। জামাত-শিবির বর্তমানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলেও তাদের দলেরও একটা বড় অংশও মূলত ইসলামি আইন বা শাসন বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে। তাই প্রাথমিক উদ্দেশ্য সামান্য ভিন্ন হলেও তাদের মূল শত্রু ছিল একই। বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশে যারা সেকুলার আন্দোলন এবং লেখালেখির সাথে জড়িত তাদেরকে ডিমোরালাইজড করতে পারলে মূলত এই দুই দলেরই লাভ হবার কথা।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রাজিব হায়দারের হত্যার জন্য যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা প্রাথমিকভাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য, শিবিরের নয়। এদের গ্রেফতার করার পর এরা জবানবন্দীতে বলেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুটি মসজিদে জুমার খুতবায় ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে এমন ব্লগারদের হত্যার ফতোয়া দিত। সুতরাং রাজিব হায়দার হত্যা কেবলমাত্র শাহবাগ আন্দোলনের ফলাফল এটা বলে ফেলাটা সম্ভবত একটা বড় সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পরবর্তীতে ব্লগার হত্যা বা অন্যান্য জঙ্গি হামলায় জড়িত বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের যখন গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অনেকেই জামাত শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল।
রাজীব হায়দার হত্যার সাথে শাহবাগ আন্দোলনের সময়কাল এত দারুণভাবে মিলে যাবার কারণ এই হামলা থেকে দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে বা দুই পক্ষেরই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাই এই প্রত্যেকটা গোষ্ঠীকে আলাদা করে দেখলে বা তাদের বিরোধের জায়গাকে বড় করে দেখলে মূল সমস্যাকে পাশ কাটানো হবে। ব্লগার হত্যার ঘটনাগুলোতে যেমন আল কায়দার দেশীয় সহযোগিদের দায় স্বীকার করতে দেখেছি তেমনি আবার পুরোহিত হত্যা বা গুলশান হামলায় আইসিসের দেশীয় সহযোগিদের দায় স্বীকার করতে দেখেছি। আবার এদের যখন গ্রেফতার করা হয়েছে তখন আমরা লক্ষ্য করেছি অনেকেই প্রাক্তন জামাত-শিবিরের কর্মী, অনেকেই হিজবুত তাহরীতের কর্মী, অনেকেই দরিদ্র মাদ্রাসার ছাত্র, অনেকেই আবার নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্র।
এতসব নানামুখি আলামত থাকার পরেও আমি লক্ষ্য করেছি অনেকেই নিজের পুরাতন বিশ্লেষণের সাথে মিলে যায় এমন তথ্যগুলোকেই কেবল গ্রহণ করেন বা করতে আগ্রহী। গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এইসব জঙ্গিদের সার্বজনীন একটা প্রোফাইল করের ফেলা খুবই কঠিন। শাহরিয়ার কবিরের মতো শ্রদ্ধ্বেয় মানুষও যখন এরকম একটি সমস্যাকে ‘কেবল জামাত-শিবিরের দায়’ বলে চিহ্নিত করতে চান তখন আমাদের শঙ্কিত হতে হয়। আবার যখন জঙ্গি হিসেবে প্রাইভের ভার্সিটির উচ্চবিত্তের সন্তান আবিষ্কৃত হয় ফরহাদ মজহারীয় প্রো-মাদ্রাসা বিশ্লেষকগণ খুশি হয়ে ওঠেন। ভণ্ড বামেরা যখন জঙ্গিদের জঙ্গি বলেই স্বীকার করতে চান না, তখনই আবার জঙ্গিদের ভেতর আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান পাওয়া গেলে হই হই করে ওঠেন। আমাদের এই নানা রকম বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠীর ভণ্ডামি আর আলস্যে তাই এরা ফুলে ফেঁপে বাড়তে থাকে।
ব্লগার হত্যা শুরু হবার পর সরকারের উচ্চপদস্থ অনেকের মধ্যেই দেখেছি জঙ্গিদের সুরেই কথা বলতে। তারা কেন ভেবেছিলেন যে কেবলমাত্র ব্লগার হত্যার পরেই এই হত্যার উৎসব থেমে যাবে? এক একটা সুসংগঠিত গ্রুপ যখন নিয়মিতভাবে এবং সফলভাবে একের পর এক এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই যায় তখন কি মনে এতটুকু প্রশ্নও আসা উচিৎ নয় যে, শুধুমাত্র কয়েকজন ব্লগারকে হত্যার উদ্দেশ্যেই কি তারা এত সুসংগঠিত সংগঠন তৈরি করেছে? ধর্মবিরোধী বা নাস্তিকদের প্রতি ঘৃণা তো বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আজকে নতুন করে শুরু হয় নি। কিন্তু ঠিক কী কারণে একে একে তাঁদের হত্যা করা শুরু হলো?
(৬)
জঙ্গি হত্যাকাণ্ড এবং হামলাগুলোতে জড়িত জঙ্গিদের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করতে গিয়ে আমাকে খুব অজনপ্রিয় একটি জায়গায় পৌছুতে হয়েছে। এক সময় মানুষের ধারণা ছিল, সুবিধাবঞ্চিত এবং ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত মাদ্রাসাগামী যুবকদের জঙ্গি হবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত জঙ্গিদের অনেকেই দেখা গেল বেশ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। অভাব অভিযোগ তো দূরের কথা তাদের অনেকেই দেশ বিদেশের এমন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে যেগুলোর ব্যয়ভার মেটানো বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্ত এতেও খুশি হবার কারণ নেই। কারণ জঙ্গিদের মধ্যে উচ্চবিত্ত থাকলেও কেবল উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানই জঙ্গি হয়েছে এমন নয়, সাধারণ এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরও জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হতে দেখা গেছে। তাহলে সমস্যা হলো কেবল বিত্তের পরিমাণ দিয়ে জঙ্গিপনার কারণকে বেঁধে রাখা গেল না।
এরপর অনেকেই বললেন, এইসব সন্তানদের পারিবারিক বন্ধন ভালো না। এদের ভালোবাসার অভাব রয়েছে। এই কথাটা সত্য হলেও আমার আসলে ভালো লাগত। কারণ সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সমস্যার কারণ চিনতে পারা। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এইসব জঙ্গিদের কেউ কেউ বাবা মার একমাত্র সন্তান। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অনেক পরিবারই এদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছে। তাছাড়া এটাও মনে হল কোটি কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশ। বাবা-মার ভালোবাসা পায়নি, পরিবারে অশান্তি এরকম মানুষ নিশ্চয়ই খুঁজলে কোটি না হলেও কয়েক লাখ পাওয়া যাবেই। ভালোবাসা পায় নি বা পারিবারিক অশান্তির মধ্যে বড় হয়েছে এগুলো তো মানব সভ্যতার ইতিহাসের দুর্লভ কোনো ঘটনা নয়! কেবলমাত্র ভালোবাসার অভাবে বা পারিবারিক বন্ধন দুর্বল থাকার কারণে কেউ জঙ্গিদলে যোগ দিচ্ছেন এই যুক্তিকে ঠিক সৎ সুচিন্তিত যুক্তি বলে মনে হয় না আমার কাছে। পারিবারিক বন্ধনই যদি মূল কথা হবে তাহলে সপরিবারে জিহাদ করতে আর যৌনদাসী হতে মানুষ কেন পারি জমাচ্ছে দূরদেশে?
অনেকে এটাও বলেছেন বর্তমান সময়ের সরকারের দুঃশাসন, নিপীড়ন আর বাক-স্বাধীনতার অভাবের কারণেই মানুষ নাকি জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে। তখন আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে মানুষ তো স্বৈরাচারী আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়া আর এরশাদের আমলও পার করে এসেছে। অত্যাচার, নিপীড়ন আর বাক-স্বাধীনতাই যদি আসল কারণ হবে তাহলে আজকের মতো গণ্ডায় গন্ডায় না হলেও অন্তত কিছু জঙ্গি তো তখন থাকতেই পারত। আনু মোহাম্মদের কথা অনুযায়ী, বেকার সমস্যার কারণেই যদি মানুষ জঙ্গি হবে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে পড়া ছাত্ররা কেন জঙ্গি হয়? কার্নেগি মেলনের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ বেতনে চাকরি করা একজন মানুষ কোন বেকরত্বের কারণে জঙ্গি হয়?
জঙ্গিবাদ নিয়ে এই আলোচনা অনেক সময়েই আবার চলে যাচ্ছে 'অল্প বয়সের অপরিণত বুদ্ধি' বা কম বয়সের 'অতিরিক্ত আবেগের' দিকে। অনেক আলোচনার মূল ফোকাসটা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে কম বয়সের 'অপরিণত বুদ্ধি'র কারণে লোকজন জঙ্গিপনায় জড়াচ্ছে। ষোল কোটি লোকের একটা দেশে কোটি কোটি তরুণ তরুণীর মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত আবেগি কেউ অপরিণত বুদ্ধির হবে এটাও নিশ্চয়ই অসম্ভব বা অভূতপূর্ব কোনো ঘটনা নয়। যে কোনো যুদ্ধে একেবারে সামনে যুদ্ধ করে সৈনিকদের সবচেয়ে কম মূল্যবান অংশ আর বড় পদধারী সেনাপতি, জেনারেল বা রাজারা থাকেন নিরাপদে ড্রয়িংরুমে টিভিসেটের সামনে অথবা পালিয়ে যাওয়া যাবে এমন সুরঙ্গসমৃদ্ধ সুরক্ষিত দুর্গের ভেতরে। সেখানে বসে সম্মুখ যোদ্ধাদের মোটিভেট করা হয়। পৃথিবীর প্রায় সব যুদ্ধেই হাজার হাজার সম্মুখ সমরের সৈনিক মারা যায়। রাজা বা সেনাপতি মারা যায় এমন ঘটনা পুরো ইতিহাসেই বিরল। বেশিরভাগ জঙ্গি হামলায় জড়িতদের বিশ্লেষণ করলে খালিচোখে দেখা যাবে এইসব হামলায় জড়িত প্রায় সবাই কম বয়সী তরুণ। এই কম বয়সী তরুণরা আসলে সম্মুখ যোদ্ধা, যাদের যুদ্ধের নীতিনির্ধারণি বা গতিপথ পরিবর্তনের শক্তি খুব সামান্য। এরা শুধুমাত্র শত্রুপক্ষের হাতে মারা যেতে প্রস্তুত এমন কিছু ডেডিকেটেড গুটিমাত্র। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই জঙ্গিবাদের যারা গুরু, সেটা আলকায়দার প্রধাণ হোক, বা আইসিসের প্রধাণ, সেটা জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করা জসিমুল্লাহ রাহমানি হোক, আব্দুর রাজ্জাক হোক বা জাকির নায়েকই হোক, সবাই কিন্তু পরিণত বয়সের। এই পরিণত মস্তিষ্কের লোকদের মাথা থেকেই কিন্তু উদ্ভব হয়েছে এইসব পরিকল্পনার। এবং যেহেতু তারা অনেকেই সরাসরি সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে মাঠে নামছে না সুতরাং ধরেই নেয়া হচ্ছে জঙ্গিবাদের মূল কারণ এই 'বাচ্চা বাচ্চা' 'ভালোবাসাহীন' ছেলেমেয়েরা।
এইসব ভাবতে ভাবতে চারপাশের বড় বড় মানুষদের এই ধরনের অলস যুক্তি আর অসততায় কষ্ট পাই উদ্বিগ্ন হই। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। ঠিক কোন জায়গাটায় মিল আছে এই প্রত্যেকটা মানুষের? আবার পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট পড়ার চেষ্টা করি। খেয়াল করে দেখি এই জঙ্গিদের বেশিরভাগই সাম্প্রতিককালে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল অথবা আগে থেকেই ধার্মিক ছিল। এদের একজনও ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী নয়। একজন হিন্দু ধর্মালম্বী বেকার জঙ্গি হয় নি। একজন ভালোবাসাহীন দরিদ্র খ্রিস্টান জঙ্গি হয় নি। একজন দুর্বল পারিবারিক বন্ধনের নাস্তিক জঙ্গি হয় নি। একজন কম বয়েসি আবেগি বৌদ্ধ বা আদিবাসী জঙ্গি হয়নি।
কিন্তু এখানে এসেও একটা খটকা লাগে। ধর্ম হিসেবে ইসলাম যদি এই জঙ্গিবাদের পেছনে দায়ী হয় তাহলে এদেশের প্রায় চোদ্দ পনের কোটি মানুষকে সম্ভাব্য জঙ্গি হিসেবে ধরে নিতে হয়। আর তাছাড়া এই কোটি কোটি মানুষগুলো তো কেউ নতুন করে মুসলমান হয় নি। তাহলে আমার উপরের দেয়া যুক্তি তর্কের সূত্র ধরেই কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এতদিন ধরে এরা কেউ জঙ্গি হলো না কেন? হঠাৎ কী এমন হলো যে এইসব মুসলমানদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ জঙ্গি হয়ে উঠতে শুরু করল?
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
মন্তব্য
ইন্টারেসটিং!
ফাঁকিবাজি মন্তব্য!
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অদ্ভুত সুন্দর বিশ্লেষন, পরবর্তী পর্বের জন্য অধীর আগ্রহ তৈরী হলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ আপনাকে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। আপনার বিশ্লেষণ অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে, এবং আপনার টানা উপসংহারগুলির সাথে আমি প্রায় একশো ভাগ সহমত। একটা কথা আছে "ডেথ বাই এ থাউজ্যান্ড কাটস" অর্থৎ কিনা কিছু অপঘাতে মৃত্যু আছে যেটা একটা বা দুটো বড় আঘাত থেকে ঘটেনি, বরং অসংখ্য আঘাতের মিলিত ফলাফলে ঘটে। সাম্প্রতিক টেরর ঘটনাগুলোর পিছনে কিছু দৃশ্যমান কারণের সাথে আরো ছোট বড় অনেক অনুঘটক যোগ হয়েছে, সেগুলো বোঝাটাও জরুরী।
একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যোগ করতে চাই---টেররিজমের বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার সময় শুধু জামাত-শিবির নিয়ে আলোচনা করলে সেটা অসম্পূর্ণ হবে, এর সাথে বাংলেদেশের নিকট অতীতের অন্যান্য চরমপন্থী রাজনীতি, যেমন উত্তর/দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে সর্বহারা রাজনীতি, সেই রাজনীতি দমনের ইতিহাস, ইত্যাদির কোনো যোগ আছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা অতি জরুরী। সাম্প্রতিক সময়ের বেশীরভাগ জঙ্গী-ঘটনা এসব অঞ্চলেই ঘটছে, সেটা কাকতালীয় না-ও হতে পারে। তার উপর বাংলাদেশে আহলে হাদীস রাজনীতিও আলোচনার দাবী রাখে, যেখান থেকে বেশ কিছু জঙ্গীর উদ্ভব হয়েছে। আহলে হাদীস নিয়ে আমার ধারণা অত্যন্ত কম, আমি মাত্র সেদিন জানলাম যে এটা সম্ভবত সৌদী ওয়াহাবী মতবাদের বাংলাদেশী সংস্করণ।
---কৌতুহলী
জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে সব বিষয়ে হয়ত আমার লেখা স্পর্শ করবে না। লেখার যুক্তিতে কোনো ভুল পেলে বা আপনি নতুন কোনো পার্স্পেক্টিভ যোগ করতে চাইলে মন্তব্যে যোগ করতে পারেন। আপনাকে ধন্যবাদ।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
"এর সাথে বাংলেদেশের নিকট অতীতের অন্যান্য চরমপন্থী রাজনীতি, যেমন উত্তর/দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে সর্বহারা রাজনীতি, সেই রাজনীতি দমনের ইতিহাস, ইত্যাদির কোনো যোগ আছে কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা অতি জরুরী। সাম্প্রতিক সময়ের বেশীরভাগ জঙ্গী-ঘটনা এসব অঞ্চলেই ঘটছে, সেটা কাকতালীয় না-ও হতে পারে।"
সহমত। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছরগুলি অনেক কথা বলে, চরমপন্থী বাম রাজনীতি খুব বেশি চিকনে খেলে গেল এই দেশে, খুব বেশি চিকনে।
তানিম ভাই কি এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে চান বা পারেন?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
"এদের একজনও ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী নয়। একজন হিন্দু ধর্মালম্বী বেকার জঙ্গি হয় নি। একজন ভালোবাসাহীন দরিদ্র খ্রিস্টান জঙ্গি হয় নি। একজন দুর্বল পারিবারিক বন্ধনের নাস্তিক জঙ্গি হয় নি। একজন কম বয়েসি আবেগি বৌদ্ধ বা আদিবাসী জঙ্গি হয়নি।"
যথার্থ পর্যবেক্ষণ - এর বিপরীতে তেমন কোন লেখা/চিন্তা চোখে পড়েনি।
পর্ব যেহেতু - আরো কিছু ছোট সেগমেন্ট করা যায়, ফেসবুক বড় লেখা পড়ার অভ্যাস কমিয়েছে অনেকাংশে।
ষষ্টপান্ডবকে এই আলোচনায় মিস করি।
পাণ্ডবদাকে সত্যিই মিস করি। শুধু এই আলোচনায় না অধিকাংশ পোস্টেই মিস করি।
প্রথমে ভেবেছিলাম পুরা লেখাটাই এক পর্বে দিয়ে দেব। পরে দেখলাম মোটামুটি তিমি সাইজের লেখা হয়ে যাচ্ছে এইজন্য দুই পর্বে ভাগ করলাম। আবার বেশি ভাগ ভাগ করে দিলেও পড়ার সময়ে পাঠক হিসেবে লেখার ইউনিফাইড থিমটা বুঝে উঠতে কষ্ট হয়। দেখা যাক আগামী পর্ব বেশি বড় হয়ে গেলে না হয় আরেক পর্ব বাড়িয়ে দেব।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
এরকম একটি গুছানো লেখা ও যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ এর জন্য লেখককে ধন্যবাদ। লেখকের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছি। জঙ্গিবাদ বা ধর্মের অন্ধকার দিক নিয়ে লেখাগুলোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় লেখক একটি নির্দিষ্ট অভিলক্ষ্য স্থির করে তার লক্ষ্যের পক্ষে যায় এমন কিছু যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকে। সেই দিক বিবেচনায় লেখকের নির্মোহ যুক্তি উপস্থাপন দেখে মনে হচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে না গিয়ে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ সমস্যার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যই এখানে লেখকের মূল উদ্দেশ্য।
এই জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি নিয়ে একটা বিষয় না বলে পারছি না। জঙ্গিবাদের কার্যকারণ নিয়ে যারা লেখা-লেখি করেন তাদের অধিকাংশের মতামত-ই বিশ্লেষণ ধর্মী কয়েক পর্বের প্রবন্ধ ধাঁচের হয়ে থাকে। এধরণের লেখা পড়ে মর্ম অনুধাবণ করার জন্য পাঠককে একটু উঁচু মানের হতে হয়- উদারমনা, সহনশীল এবং যুক্তিবোধ সম্পন্ন হতে হয়। এই গোষ্ঠীটা হয়ত নিজ উদ্যোগেই এই বিষয়ে সচেতন। এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরের মানুষ হয় এধরণের লেখা এড়িয়ে যায় অথবা মূল বক্তব্য ধরতে না পেরে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া দেখায়। দেশে পরবর্তী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না, বরং তাদের সংখ্যাটাই বেশি। অনেক সময়-ই স্ব-জ্ঞানে অথবা অবচেতন মনে এদের মধ্যে জঙ্গিদের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের প্রবণতা দেখা যায়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রবন্ধ ধর্মী লেখার বাইরে গিয়ে তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন (তা হতে পারে মিম/গল্প/কবিতা/গান) সহজ কিন্তু কার্যকরী কোন উপায় বের করা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কয়েকজন সেই পথে কাজ করলেও তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুব-ই অপ্রতুল।
সাধারণ মানুষের সাথে এই আলোচনাগুলো কীভাবে করা যায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কনসার্ন হওয়া উচিত। কারণ এই বিষয়গুলো নিয়ে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ মতামত (যদিও এই লেখাটা কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত নয়) দিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। কারণ এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি সমাধানের দিকটাও ভাবা জরুরী। সামাজিক মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে শুধু বিচ্ছিন্ন গবেষণা এই সমস্যা সমাধানে বিশেষ কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ইন্টারেস্টিং আলোচনা।
গুলশানের ঘটনাটা আসলেই একটা প্যারাডাইম শিফট। ব্লগার হত্যাকান্ডের পরেও অর্থনৈতিক দিক থেকে উচ্চবিত্ত কিংবা ব্যাপক অর্থে মধ্যবিত্ত যে মানুষটা তর্ক করেছে, জাস্টিফাই করেছে, – তার মধ্যে একটা অংশ হঠাৎ উপলব্ধি করছে তার ইংরেজি-মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলে বড় হচ্ছে এবং পুরো ঘটনাকে কোন প্যাটার্নে ফেলা যাচ্ছে না । গুলশান-কান্ডের পর সরকার ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা সমস্যাটার বিস্তৃতি বুঝতে পারছে...।
পরের পর্বে অপেক্ষায়।
ধন্যবাদ আপনাকে। এই পর্বটা নীড়পাতা থেকে সরে গেলেই দ্বিতীয় পর্ব দেব।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আপনার পরের পর্বের পর হয়তো মন্তব্য করা ঠিক হতো, তারপরও কয়েকটি পারস্পের্কটিভ (মূলত বৈশ্বিক) শূধু উল্লেখ করছি-
১। সবসময়ই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে একটি অংশ তুলনামূলক হিংসাত্মক পন্থা বেছে নিয়ে থাকে। বাম আন্দোলনেও এর চিহ্ন দেখা যায়। আদর্শবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে (বাম আন্দোলনের ইতিহাসেও) এটা দেখা যায়।
২। আগামী দিনের রাজনীতিতে পৃথিবীর রাষ্ট্রের সীমানা দূর্বল হয়ে যাবে। এমন ভবিষ্যতবাণী অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী করেন। গোটা বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি অভিন্ন সমস্যা হিসেবে জঙ্গি সমস্যা-
সেই আগামী রাজনীতির প্রেক্ষাপট তৈরির ঐতিহাসিক অংশ কি না।।
৩। মানুষ নিজেকে অস্ত্র বানিয়ে ফেলছে। এটা সভ্যতার বিবর্তনে বিদ্যমান শাসন কাঠামো পরিবর্তনের নিয়অমক কি না? উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার বিরুদ্ধে সাদা পুলিশ হত্যার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে-
৪। বিশ্বজুড়ে প্রচলিত কর্পেরেট পুঁজিবাদের একচেটিয়া আধিপত্য মূল্যবোধের যে ভারসাম্য নষ্ট করেছে তাকে বিন্যস্ত করার টানাপোড়েন কি না?
৫। সাধারন মানুষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ হলেও রাষ্ট্রিক নীতির সঙ্গে তাকে মেলানো হয় না। এজন্য যুদ্ধে সাধারন মানুষকে (বেসামরিক) যুদ্ধের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু আসলে কী সাধারন মানুষ তার রাষ্ট্রনীতির বাইরে? একজন আমেরিকান কী আমেরিকান নীতির বাইরে থাকবে?
৬।। আমাদের দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং অসক্ষমতা স্বত্তেও জঙ্গী হামলার পরিমাণ এই অঞ্চলের মানুষের ইসলাম ভাবনার প্রকৃতি নিয়ে কোন কিছু তুলে ধরে কী?
এগুলো শুধুই দৃষ্টিকোণ মাত্র। ।।।।।
(১) অনেক আদর্শিক (আদর্শের গুরুত্ব আমলে না নিয়ে বা আদর্শের প্রতি জাজমেন্টাল না হয়েই বলছি) আন্দোলনেই মানুষ সহিংস পন্থা বেঁছে নিয়েছে এ কথা সত্যি, সেটা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হোক বা অন্য কোনো আদর্শিক আন্দোলনই হোক। এই আদর্শিক সংগ্রামের জন্য মানুষের সহিংস হয়ে ওঠার প্রবণতার মধ্যে যেমন অনেক মিল পাওয়া যাবে তেমনি বিরোধও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সেই মিলের জায়গাগুলো আলোচনার সাথে সাথে বিরোধের জায়গা নিয়ে আলোচনাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। একটা মানুষ যে ভাবে বা যে কারণে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য সহিংস হয়ে ওঠে আর ধর্মতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য সহিংস হয়ে ওঠে এদের মধ্যে ফারাক থাকার সম্ভাবনা আছে। এই ফারাকটা বুঝতে পারা এই সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন। যেহেতু সাম্প্রতিক সমস্যা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ, সুতরাং সেটা নিয়ে আলোচনায় ফোকাসডা থাকাটাও জরুরি। অনেক সময়েই বামপন্থীরাও সহিংস হয়েছে বা নাজিরাও ন্যাশনাল সোশালিজমের নাম করে সহিংস হয়েছে এইসব উদাহরণ বর্তমান সহিংসতার গুরুত্বকে খাটো করে। কারণ সমাধানের জন্য বর্তমান সমস্যার গুরুত্ব এবং স্বরূপ অনুধাবন করা বেশি জরুরি মনে হয়।
(২) এই বিষয়ে আমার ভাবনা খুব বেশি সুসংহত নয় বলে মনে করি।
(৩) এটা বলা খুব কঠিন। বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে হয়ত নিজেকে অস্ত্র বানানোর প্রয়োজনীয়তাও কমে আসতে পারে। ড্রোন বা মিনিয়েচার রোবট এই ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে হামলার সংখ্যা আমরা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশের আগ্রাসনগুলোতে ব্যবহৃত হতে দেখছি। হয়ত এগুলো আরও সহজলোভ্য হলে অন্যান্যরাও এই ধরণের প্রযুক্তি আরও বেশি করে ব্যবহার করবে। এখনও এটাকে ঠিক নিয়ামক বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে।
(৪) খুব কঠিন প্রশ্ন। জবাব দেবার মতো জানাশোনা নেই।
(৫) প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ব্যাপারটা সম্ভবত চলে আসে এখানে। যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বাইরে রাখার কথা নীতিগতভাবে বলা হলেও আধুনিক যুদ্ধগুলোতে সাধারণ মানুষ ঠিক যুদ্ধ থেকে বাইরে থাকার সুযোগ পায় বলে মনে হয় না। আগে যেখানে পদাতিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হতো সেখানে হয়ত কিছুটা সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন তো এমন কোনো যুদ্ধ দেখি না যেখানে সাধারণ মানুষ এর বাইরে থাকতে পারে।
(৬) আমার মনে হয় আমাদের দেশে জঙ্গি হামলার পরিমাণের কথা চিন্তা করলে আমাদের সরকার বেশ খানিকটাই সফল (টার্গেটেড কিলিং গুলোর কথা বাদ দিয়ে বলছি)। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে যাদের নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে আমরা অনেক বেশি শক্তিশালি মনে করি সেখানেও বেশ বড় বড় হামলা হয়েছে। অবশ্য সে রকম হামলা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো আমাদের দেশে পরিচালিত করতে চায় কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। এইসবের জঙ্গি হামলার সাথে আমাদের ইসলাম ভাবনার প্রকৃতি নিয়ে আমার ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করব পরের পর্বে।
ধন্যবাদ জানবেন।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
'তাহলে এতদিন ধরে এরা কেউ জঙ্গি হলো না কেন? হঠাৎ কী এমন হলো যে এইসব মুসলমানদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ জঙ্গি হয়ে উঠতে শুরু করল?'
আপনার লেখার শেষে এসে আপনি উপরের এই প্রশ্ন দুটি করেছেন। আশা করি পরের পর্বে উত্তর দেবেন।
তবে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন সেই প্রশ্ন যেহেতু আপনার মনের মাপে তৈরি সেহেতু আপনি উত্তরও খুঁজে পাবেন আপনার মনের মাপে। কারণ সমস্যাকে ঠিকভাবে চিহ্নিত না করে আমরা যদি আমাদের সমাধানের ক্ষমতা অনুযায়ী সমস্যাকে সংজ্ঞা দেই তবে আসল সমস্যা বাদ দিয়ে এটা হবে আমাদের কল্পিত সমস্যার সমাধান প্রচেষ্টা।
যেমন, আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলেন জঙ্গিরা হচ্ছে বিএনপি-জামাতের তৈরি। এতে সমাধানের উদ্দেশ্য আগে ঠিক করে নিয়ে সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপি-জামাতকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা, তাই জঙ্গি সমস্যার সংজ্ঞায় তাদেরকে ধরা হচ্ছে। সুতরাং আপনি প্রথমেই যদি এদেরকে জঙ্গি নামে চিহ্নিত করেন তবে আপনি একটা বিশেষ সমাধানের কথা মাথায় রেখে এগুচ্ছেন।
ফিরে আসি আপনার প্রশ্নে: 'তাহলে এতদিন ধরে এরা কেউ জঙ্গি হলো না কেন? হঠাৎ কী এমন হলো যে এইসব মুসলমানদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ জঙ্গি হয়ে উঠতে শুরু করল?' এর প্রশ্নের প্রথম উত্তর হচ্ছে: এরা কেউ জঙ্গি হয় না বা হতে যায় না। জঙ্গি এদেরকে বলছেন অপরপক্ষের লোক। যারা ধরা পড়েছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন তারা নিজেদের পরিচয় জঙ্গি বলে দেয় কী? সুতরাং আগেই একটা পক্ষে নাম না লিখিয়ে একজন সত্যানুসন্ধানী হিসেবে এ সমস্যার গোড়া আবিষ্কার করতে হলে লাইনের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হবে।
এরা যদি ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদে অংশ নিয়ে থাকে তবে সেই তথ্য আগে বিবেচনায় এনে আলোচনা শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে ব্যবহার করতে হবে জিহাদী বা খেলাফতের সৈনিক পরিচয়। জানার চেষ্টা করতে হবে ধর্মীয় টেকস্ট (এক্ষেত্রে মূলত: কোরান)-এর কীরকম ব্যাখ্যায় তারা আস্থা এনেছে এবং এই ব্যাখ্যাটা কত পুরনো, কে প্রথম দিয়েছে। এই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে অন্য কীসব ব্যাখ্যা আছে। অর্থাৎ ব্যাখ্যাগুলো আপনার চোখে বিভ্রান্তিকর নাকি মূল টেকস্টের ঘোলাটে বর্ণনাই স্বাভাবিকভাবে বিচিত্র ব্যাখ্যার উস্কানি দেয়।
সুতরাং চূড়ান্ত বিশ্লেষণ শেষে আপনার রায় যাবে হয় টেকস্টের বা টেকস্টের ত্রুটির বিরুদ্ধে। অথবা আপনি অনেকগুলো ব্যাখ্যার মধ্য থেকে কিছু ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে রায় দেবেন। বাকী ব্যাখ্যাগুলোকে আপনার কাল বা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করবেন।
তবে বৃহত্তর সমস্যা হচ্ছে আপনি যে জ্ঞান/যুক্তি/সত্য'র মাপকাঠিতে শেষ রায়ে পৌঁছাবেন তা ঐ পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা সাধারণত: সত্য মাপে না- তারা চালিত হয় বিশ্বাস দ্বারা। টেকস্ট ও টেকস্ট সম্পর্কে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যায় তাদের বিশ্বাস অনড়। এই বিশ্বাস টিল দ্যা ক্রসফায়ার (আইজিপি সাক্ষী)।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
মোটাদাগে একমত মন্তব্যের সাথে। দ্বিমতের জায়গাগুলা বলার চেষ্টা করি।
লেখার শেষে যে প্রশ্ন রেখেছি সেটাই শুধু আমার মনের মাপে তৈরি নয়, পুরো লেখাটাই তো আমার মন আর মগজের মাপে তৈরি। একেবারে ভারবাটিম কোট না করলে সেটা বোধহয় যে কোনো লেখার জন্যই সত্যি।
আপনি বাকি যে কথাগুলো বলেছেন তার খানিকটা জঙ্গিবাদের সংজ্ঞা নিয়ে। সেই জায়গাটা হয়ত লেখাটায় পরিষ্কার না। তবে আমি জঙ্গিবাদের প্রচলিত সংজ্ঞার কথা ভেবেই আলাদাভাবে আর সংজ্ঞা দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি। এ কথা সত্যি যে যাদেরকে আমরা জঙ্গি বলছি তারা হয়ত নিজেদের জঙ্গি বলে না। আমরা যেটাকে সমস্যা বলছি সেটাই হয়ত তাদের কাছে সমাধান। কিন্তু এই নামকরণের জায়গাটা নিয়ে বিরোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে।
এ কথা সত্যি যে আমি যে জ্ঞান বা যুক্তির স্ট্যান্ডার্ডে রায়ে পৌছুতে চেষ্টা করব সেটা আমরা যাদেরকে জঙ্গি বা তাদের সহযোগী বলছি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু এরা ছাড়া বা যারা এখনও তাদের পথে যায়নি বা যেতে চায় না তাদের সাথে একটা সংলাপ তৈরি করাটাই বরং আমার লেখাটার উদ্দেশ্য। একটু খেয়াল করলে দেখবেন গুলশান হামলার পরে এইরকম একটা বেশ বড় জনগোষ্ঠী এমনকি সরকারের অনেক অংশ এই ধরণের সংলাপে আগ্রহী হয়েছে। সেই জায়গাটাতে একটা সংলাপ সৃষ্টির চেষ্টা করাটাই আমার এই লেখাটার উদ্দেশ্য।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
গুলশানের ঘটনা পর সম্ভবতঃ সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে দেয়া একটা বার্তার একটা বাক্য মাথায় আটকে আছে। বার্তাটিতে আইএস বলেছিল 'ওরা ২০ জন ক্রুসেডারকে হত্যা করেছে গুলশানে'। অদ্ভুত লেগেছিল 'ক্রুসেডার' শব্দটি শুনে। তার মানে বিশ্বব্যাপী একটা ধর্মযুদ্ধ বিরাজ করছে যা আমরা জানি না? যদি ক্রুসেডই শুরু হয়ে থাকে তাহলে আর এসব আলোচনা করে কী হবে। হয় ক্রুসেডে যোগ দিতে হবে, নয়তো বেঘোরে প্রাণ দেবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ক্রুসেডে তো পার্টি থাকে দুইটা। হয় এই পক্ষ নয় ওই পক্ষ। মাঝামাঝি কোন রাস্তা নাই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চার পাঁচ বছর আগের ঘটনা। এক কট্টর হুজুর টাইপের বড় ভাই। এমনিতে তার সাথে তেমন খাতির ছিল না, কিন্তু দেখা হলে কথাবার্তা গল্পস্বল্প হয়। বিকালের দিকে ভার্সিটি থেকে বাসে করে বাসায় ফিরতেছি। পাশের সিটে সেই বড়ভাইও বসল। তার সাথে আলাপ হলেই সে ইহুদি নাসারাদের প্রসংগ নিয়ে আসত এমনিতেই (ইহুদি নাসারাদের দেশে স্কলারশিপসহ পড়াশোনায় আপত্তি নাই অবশ্য)। সেদিনও তার ব্যতিক্রম না। তাছাড়া ধর্ম সম্পর্কে আলাপে আমার নিজেরও আগ্রহ আছে, এইজন্য আমিও তাল দিতাম। তো সে হঠাৎ বলে উঠল যে, এই যে সাদা মেয়েরা এদের রেইপ করা দরকার। তারপর সে আমাকে শরীয়তের ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝাইল কেন এদের রেইপ করলে কোনো গুনা হবে না। সেদিন তার থেকে জানা হলো যে আমরা মুসলমানরা ইহুদি-নাসারাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় আছি, অতএব এইসবে কোনো সমস্যা নাই। এই রকম থিওরি যে আমি সেদিনই প্রথম শুনলাম এমন না। কিন্তু একেবারে নিজের কানে পাশে বসে থাকা কোনো পরিচিত লোকের কাছে শোনা সেই প্রথম। উল্লেখ্য সেই ভাই বুয়েট থেকে বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করা এবং বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষাধারী। এখন দেশে কোথাও চাকরি বাকরি করে। এইরকম লোকের মনে হয় না কোনো অভাব আমাদের দেশে আছে। অতএব সাধু সাবধান।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
সম্প্রতি প্রথম আলোতে আলী রিয়াজ এর ৪ পর্বের লেখাটা আলোচনায় এলে ভালো হতো.
প্রথম আলোতে প্রকাশিত অধ্যাপক আলী রীয়াজের লেখাগুলো পড়েছি। ওটা ছাড়াও আরও বেশ কিছু লেখার রেফারেন্স টানবো ভেবেছিলাম প্রথমে। পরে লেখাটা কোনো রেফারেন্স দিয়ে ভারাক্রান্ত না করেই লিখব বলে চিন্তা করলাম। যাতে পাঠকের লেখাটা বুঝতে হলে আরও লেখা পড়ে আসতে না হয়। আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
নতুন মন্তব্য করুন