১৯৩০ সালে ভারতবর্ষের নৈনিতালে বেড়াতে এসেছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান টুরিস্ট। স্থানীয় এক ক্রিকেট দল তাকে আহবান জানালো প্রীতি এক ম্যাচে অংশ নেয়ার জন্যে আর টুরিস্ট ভদ্রলোক সে আহবান গ্রহণ করলেন সানন্দে। খেলতে নেমে কিন্তু প্রথম বলেই শুণ্য রানে আউট হয়ে গেলেন তিনি - স্থানীয়রাও তাকে আর মনে রাখলো না। তারা ধরেই নিলো, এই লোক ক্রিকেট খেলতে পারেন না।
১৯৭১-৭২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলতে এলো অবশিষ্ট বিশ্ব-একাদশ। টনি গ্রেগ আর হিলটন আকারম্যান এসে পৌছলেন এডিলেডের বিমানবন্দরে। রিসিভ করতে এলেন সেই টুরিস্ট, যিনি এতদিনে বুড়ো হয়ে পড়েছেন। ক্রিকেট নিয়ে তার এটা-ওটা প্রশ্ন শুনে টনি বা আকারম্যানের কেউ একজন (কে, তা অবশ্য আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেননি। ) প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি ক্রিকেট খেলতেন নাকি এককালে ??'।
-'তা, খেলতাম এককালে টুকটাক...'।
-'আপনার নাম ??'
-'ডন ব্রাডম্যান'!
ভদ্রলোক কিন্তু ক্রিকেটটা সত্যিই মন্দ খেলতেন না। ২৩৪ ফার্স্টক্লাস ম্যাচে ৯৫.১৪ গড়ে ২৮০৬৭ রান এবং ৫২ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ারে ৬৯৯৬ রান। গড় মাত্র (!!) ৯৯.৯৪। ব্রাডম্যান, ব্রাডম্যান, স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান- পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান; সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ ও কি তিনিই নন ??...
২৭ আগষ্ট,১৯০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের বাউরালে জন্মানো এই ব্রাডম্যানের শৈশব কেটেছে বাড়ির পেছনের বারান্দায় একটা স্টাম্প দিয়ে ছোট্ট একটা গলফ বলকে ক্রমাগত পিটিয়ে গিয়ে। ক্রিকেট রুপকথার অংশ হয়ে যাওয়া এই ঘটনা জানেন সবাই, আমরা কেবল জানিনা কোন দৈবশক্তির যোগে এই অমানবিক মনসংযোগের ক্ষমতা তিনি করায়ত্ত করেছিলেন। সেবার ৩৬-৩৭ মৌসুমে এশেজ সিরিজের সময় এডিলেডে এক রাত্রিতে বসে অধিনায়ক ডন কিংবদন্তী স্পিনার বিল ও'রিলি এবং নেভিল কার্ডাসের সাথে সারা সন্ধ্যা আলোচনা করে কাটালেন কি করে বেঁধে রাখবেন ওয়ালী হ্যামন্ডকে সেই পরিকল্পনায়। রাত এগারোটায় বাড়ি ফেরবার সময় নাকি 'সামান্য কাজ আছে' বলে গাড়ি থেকে নেমে খানিক ঘুরে এলেন হাসপাতাল। পরদিন ঘোষিত হলো ব্রাডম্যানের শিশুর মৃত্যুসংবাদ। "স্যার ডন খেলার চেয়ে বড়"- অস্ট্রেলিয়ান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেঞ্জিস এই উক্তি করে ভুল করেননি ; কি বলেন ??
১৯ বছর বয়েসে ফার্স্টক্লাস অভিষেকের পর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট হাতে ম্যাচের পর ম্যাচ পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন 'বাউরালের বিস্ময়-বালক', অবশেষে সুযোগ এলো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার। ডাক পেলেন ২৮-২৯ মৌসুমের সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের দলে। ব্রিসবেনের সে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া পরাজিত হলো ৬৭৫ রানে। ডন করলেন দু ইনিংসে ১৮ এবং ১। বাদ পড়লেন দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে- সেই প্রথম এবং সেই শেষ। তৃতীয় টেস্টের দলে ডাক পেয়ে করলেন ৭৯ এবং ১১২। শুরু হলো ব্রাডম্যান যুগ। ব্রাডম্যান মানে নিষ্ঠুর, ব্রাডম্যান মানে নির্দয়, ব্রাডম্যান ছিলেন- খুনী।
ডনের ক্লান্তি বলতে কিছু নেই, তিনি নিরাবেগ। অন্য 'ভালো' ব্যাটসম্যানেরা যেখানে ৫০ রান করলেই আত্নতুষ্টিতে ভোগে সেখানে স্যার ডন ১৫০ এর আগে নাকি ব্যাটই তুলতেন না। প্রতি ৩ ইনিংসে ১টি করে সেঞ্চুরি, ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি, ২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি - কেবল পরিসংখ্যানই যথেষ্ট স্যার ডনের গ্রেটনেস বোঝাতে। (ভালো কথা,এহেন স্যার ডনের টেস্ট ক্যারিয়ারে ছয়ের মার ক'টি বলুনতো ? মাত্র ৬ টি !!)। জ্যাক ফিংগল্টন অযথাই বলেননি,"যে কোনো বল,এমনকি ওয়াইড বল পর্যন্ত ফস্কালেই ডনকে আঊট দিতে হবে।"।
স্যার ডনের কথা বলতে হলে বলতেই হয় 'বডিলাইন সিরিজের' কথা। ১৯৩০ এর সিরিজে ৭ ইনিংসে স্যার ডন রান তুললেন ৯৭৪। এশেজ ফিরিয়ে আনতে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড হ্যারল্ড লারউডের গতির সাহায্যে আশ্রয় নিলো 'বডিলাইন' নামক অপকৌশলের। ক্রিকেট ইতিহাস এর তুল্য বিতর্কিত কিছু আর দেখেনি কখনো...। কল্পনা করুন, লারউডের রানআপের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে এমসিসি'র ৩৩ হাজার ক্ষুদ্ধ দর্শক চ্যাঁচাচ্ছে- "বাস্টার্ড ! বাস্টার্ড !"। স্যার ডনকে এই অপকৌশলে দমাতে পেরেছিলেন বটে জার্ডিন, এই সিরিজে তার রানের গড় ছিলো মাত্র ৫৬.১৪ !!
ডনের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে ছায়া ফেলতে এলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ। প্রলয়ঙ্করী এই যুদ্ধ কি আরো অনেক কিছুর সাথে নিয়ে গেছে ডনের যাদু ?? সবার মতই এই সংশয় নিয়ে ৪৬-৪৭ এর সিরিজে ব্যাট করতে নামলেন ডন। ২৮ রানে ভোসের বলে স্লিপে আইকিন যা নিলেন , ডন বলেন তা ছিলো বাম্প ক্যাচ- যদি ও ইংরেজদের দাবি আম্পায়ার বোরউইকের এই ভুল সিদ্ধান্তেই ডন করেছিলেন ১৮৭- যা তার আত্ববিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে ইংরেজদের পোড়ালো ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে ও । অন্য অনেক কিছুর মতই টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শুণ্যটিও স্যার ডনের। ৪৮ এর ওভালে শেষ টেস্টে নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার সময় ব্যাটিং গড় ১০০ করতে স্যার ডনের প্রয়োজন ছিলো মাত্র ৪ রানের, এরিক হলিস নামের অখ্যাত এক লেগ স্পিনার তাকে পোড়ালেন হতাশায়। জীবনে একবার মাত্র হিট আউট হয়েছিলেন স্যার ডন,যা হয়েছিলেন লালা অমরনাথের বলে (যার পুত্র মহিন্দর অমরনাথ ছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রথম বিদেশী কোচ।)। ডন জীবনে একবার-ই স্টাম্পড হয়েছিলেন; মজার ব্যাপার হচ্ছে উইকেট ভেঙ্গেছিলেন এক বাঙ্গালী-প্রবীর মিত্র।
৯২ বছর বয়সে জীবনের সেঞ্চুরি পুরোবার আগেই ব্রাডম্যান মারা গেলেন ২৫ ফেব্রুয়ারী,২০০১। তার আগে ১৯৪৯ সালে অর্জন করলেন সম্মানসুচক 'নাইটহুড'। ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে যদি ২য় বিশ্বযুদ্ধটা না হতো; কোন সীমায় পৌছতেন তবে স্যার ডন ?? জানা নেই, কেবল এটুকু জানি - ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়কার who's whoতে স্যার ডন সম্বন্ধে লেখা হয়েছিলো ২১ লাইন, যা হিটলারের চেয়ে মাত্র ৮ লাইন কম এবং স্টালিনের চেয়ে ১৭ লাইন বেশী !!!
মন্তব্য
আপনার লেখার ভঙ্গিটা বেশ উপভোগ্য।
ব্রাডম্যানের খেলা টেস্টের সংখ্যা ৫২।
===================
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
দুঃখিত, ৫২ কীভাবে যে ৫৬ হয়ে গেলো...!!!
বেশ সাবলীল লেখা, হিংসা করার মত।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
খেলাধুলো নিয়ে খুব একটা পোষ্ট আসে না সচলে, আশা করবো আপনি নিয়মিত পোষ্ট দেবেন।
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
কে ছিল তা জান্তে মঞ্চায় ..........
........................................
শাহেনশাহ সিমন
আহা ব্র্যাডম্যা্ন। ছোটবেলার হিরো। গত বছর তাঁকে নিয়ে লিখসিলাম।
আপনার লেখাটা ভাল্লাগলো। আরো লেখা চাই।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
দারুন!
- তাঁর জন্ম বোরাল-এ (এভাবেই উচ্চারণ করা হয় জায়গাটার নাম, বৌরাল-->বোরাল-->Bowral) হয়নি। তিনি যখন খুব ছোট তখন তাঁর বাবা-মা বোরালে মুভ করেছিলেন শুনেছি।
লেখাটা অনেক উপাদেয় হয়েছে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
খেলাধুলা নিয়ে তোর যে কোন লেখা পড়লেই হিংসা হয়।
বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে দারুণ কিছু আশা করতেই পারি তোর কাছ থেকে।
---আশফাক আহমেদ
অসাধারণ এক ক্রিকেট ব্যাক্তিত্ব যার অগণিত ভক্তকূল যারা কখনও তার খেলা দেখেনি। শতাব্দি ধরে তার নাম ক্রিকেটের সাথে থেকে যাবে।
এই সুযোগে একটুখানি শ্রদ্ধা জানাই মার্ক টেলরকে যে ব্র্যাডমানের জীবদ্দশায় তার ৩৩৪ রানের রেকর্ড না ভাঙার সিদ্ধান্তকে রক্ষা করে ৩৩৪ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিয়েছিলো।
======================================
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো, সেইতো তোমার আলো।
সকল দ্বন্ধ বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেইতো তোমার ভালো।।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নতুন মন্তব্য করুন