মানবজাতির রক্ষক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন সুহান রিজওয়ান (তারিখ: সোম, ১৫/০৩/২০১০ - ১১:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[ প্রাসঙ্গিকঃ সাইন্স ফিকশন গল্পের সম্রাট আইজ্যাক আসিমভ কিছু চমৎকার মজলিসী ঘরানার গল্প লিখেছিলেন। সবগুলো গল্পই একটুখানি সাইন্স, আর অনেকটুকু ফিকশন। এই গল্পগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো 'এজাজেল' নামের একটি দুই সেন্টিমিটার লম্বা ভিনগ্রহী। বাংলায় গল্পগুলো আগেই অনুবাদ হয়েছে, হাসান খুরশীদ রুমী করেছেন সে অনুবাদ।
[i]
আমার এ লেখা অনুবাদ বলা ঠিক হবে না। গল্পটির যথাসম্ভব স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক জটিলতা যুক্ত শব্দ প্রায় বর্জন করেছি। পটভূমি পরিবর্তন করে চরিত্রগুলো করা হয়েছে দেশীয়। দুর্বল ভাবানুবাদ বলতে পারেন।

নীচের গল্পটি আইজ্যাক আসিমভের 'সেইভিং হিউম্যানিটি' গল্প অবলম্বনে লেখা।]
[/i]

বন্ধু কেরামত আলী একটা বড়সড় শ্বাস ফেলে বললো, " আমার এক দোস্তের মহাজাগতিক শক্তি ছিলো।"

আমি বললাম, " তুমি কি তোমার পিচ্চি ভূতবন্ধু ফাযাযিলের কথা বলছো ??"

কেরামত আলী আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে বললো, " তুমি কী করে জানলে ফাযাযিলের কথা ?? তোমাকে তো এই বিষয়ে কিছু বলেছি বলে মনে পড়ে না হে..."

এই ফাযাযিল হচ্ছে একটা দুই সেন্টিমিটার লম্বা ভূত, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে একটা ভিনগ্রহবাসী। আমার বন্ধু কেরামত আলী প্রায়ই এই ভূতের নানা কিচ্ছা আমায় শোনায় ঠিক চারপেগ পেটে পড়বার পর। মজার বিষয় হলো, সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ অবস্থায় এই ভূতের নাম পর্যন্ত কেরামত মুখে নেয় না। অথচ কাঁটায় কাঁটায় চারপেগ গিললেই তার মুখ থেকে এই ফাযাযিলের নানাবিধ কর্মকান্ড আপনি শুনতে পাবেন। যেমনটা এখন শোনা যাচ্ছে...

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, " না না- তুমি বল নি। মানে, একদিন তুমি আপনমনে ঐ নামটা বিড়বিড় করে বলছিলে কি না..."

কেরামত আলী আমায় পাত্তা না দিয়ে তার আজকের গল্প শুরু করলো...

" মহাজাগতিক শক্তির কথা আমায় প্রথম বলে আমার বন্ধু রুস্তমগীর। সে ভার্সিটি পাশ দেয়া বিদ্বান লোক। কাজেই তোমার মত হাবিজাবি লোকেরা তাকে চিনবে না। তদুপরি সে ওজন বুঝে চলে। সস্তাদরের লোকজনদের সে সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে।

এহেন রুস্তমগীর আমায় বললো- "বুঝলে কেরামত, আমার মাঝে কিছু অদ্ভুত অভাবনীয় মহাজাগতিক শক্তি আছে। ... কি, বুঝলে না, তাই না ?? বেশ- খোলাসা করে বলছি। এই আমাকেই দেখো। আমি একজন উচ্ছ্বল, গতিশীল যুবক। অথচ আমার কেবলি মনে হয় - কেমন এক জড়তা স্থবির করে রেখেছে আমার চারপাশকে। পুরো মহাবিশ্বই যেন আমার পাশে এসে মুহুর্তের জন্যে থমকে যায়।"

আমি বললাম, "এই অবস্থা কতদিনের বন্ধু রুস্তম ??"

রুস্তমগীর বলে, " এ তো আমার শৈশব থেকেই বন্ধু। আমি আমার এই বিশেষত্ব অবশ্য বুঝতে পারি বড় হয়ে ওঠার পর। তার আগ পর্যন্ত আমারো মনে হতো এই বিশেষত্ব খুবই স্বাভাবিক।... বুঝতে পারছি তুমি কি ভাবছো। ভাবছো, আমি উন্মাদ। এতোদিনেও কেন কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাইনি।... কারণ আমার এই গোপন কথা আমি কাউকে বলতে ইচ্ছুক নই। "

- "কিন্তু এসব কথা তবে তুমি আমায় বলছো কেনো, ভাই রুস্তম ??"

- "কারণ, পুরো পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র লোক, যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। বাদবাকি সকলে জোচ্চোর।"

বুঝতেই পারছো, আমি এতে অবাক হইনি। এ তো প্রায় ঐশ্বরিক সত্য যে আমার বন্ধুদের মাঝে আমার জনপ্রিয়তা প্রবাদতুল্য। তারা যে মনের কথা আমার কাছে খুলে বলে একটু ভার লাঘব করতে চাইবে, এ আর আশ্চর্য কী ?? এর মূল কারণ হচ্ছে আমার চারিত্রিক কাঠিন্য। পেটে বোমা মারলেও তো আমি আমার কোন দোস্তের গোপন কথা অন্য কাউকে বলবো না। ... হ্যাঁ, তোমার ক্ষেত্রে অবশ্য আমি এ নিয়মের কিছুটা ছাড় দিয়েছি। এর কারণ হলো তোমার দুর্বল স্মরণশক্তি। তোমায় বলে তো ক্ষতি নেই কিছু, তুমি সব কিছুই মিনিট দশকের মাঝে ভুলে যাবে।... যা হোক, রুস্তমগীরের গল্পে ফিরে যাই।

-" আচ্ছা ভাই রুস্তম, তোমার এই মহাজাগতিক শক্তি, ঐ জিনিসটা -প্রকাশ পেলো ঠিক কীভাবে ??"

- " একেবারেই সাদামাটা বিষয় ওটা। ... সবসময়ই ওটা প্রকাশ পায় আমি বাইরে বেরুলেই। ঘরের বাইরে আমি গেলেই দেখেছি- ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। আবহাওয়া অধিদপ্তর যাই বলুক না কেনো, এটা একেবারে নিখাদ সত্য যে আমি আবহাওয়ার একটা বড় নিয়ামক।

এই যেমন ধরো সেবার আমি গেলাম দক্ষিণের একটা ছোট পাহাড়ী শহরে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে বৃষ্টিটা নামলো ওখানে- ... ওহ !! সে যদি দেখতে !! সেখানে ছুটিটা মাটি হয়ে যাওয়ায় আমি ভাবলাম একটু সুন্দরবনের দিকটাই তবে ঘুরে আসি। ... কি আর বলবো তোমায়, তিনদিন পরে সেখান থেকেও যখন আমি ফেরত আসছি তখন শুনতে পাচ্ছিলাম বরফ দেখে স্থানীয় দু'য়েকটা লোক বলছে যে তারা আইসক্রীমের ব্যবসা শুরু করবে। ..."

-"এতো সাংঘাতিক ব্যাপার ভাই রুস্তম !! তা তুমি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবসা শুরু করলেই পারো ??" আমি সদুপদেশ দিলাম।

- "বিষয়টা এতো সহজ নয় বন্ধু। আমি ওরকম বৃষ্টি চাইলে দেশে জলোচ্ছাস দেখা দিতে পারে। ... আর বিষয়টা তো কেবল আবহাওয়া দিয়ে নয়, অন্যান্য ভাবেও বোঝা যায়। এই যেমন ধরো সেদিন যে আগুন লেগে ঐ বিশাল পাটকলটা পুড়ে গেলো, হাজার লোক বেকার হয়ে পড়লো আর নিঃস্ব হলো বহু কর্মী।... পত্রিকায় দেখেছো তো ঐ 'রহস্যময়' অগ্নিকান্ডের কোন কিনারা হয়নি ?? এর কারণ আর কিছু নয়- অগ্নিকান্ডের খানিক আগে আমি রিকশা নিয়ে ঐ পাটকলটার পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম।

তারপর ধরো পত্রিকায় ওটাও নিশ্চয় দেখেছিলে, সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙ্গেছে শিল্পপতি আক্কাস কুরেশির মা ?? আমি আবিষ্কার করেছি- এর কারণও আর কিছু নয়, আমি স্বয়ং। কারণ ঠিক ঐ সময়েই আক্কাস কুরেশি আমার সাথে একটা জরুরী ব্যবসায়িক আলাপে ব্যস্ত ছিলো।"

শরীরটা ভয়ে কেঁপে উঠলো আমার। সর্বনাশ !!! কার পাশে বসে আলাপ করছি আমি ??

সখেদে বললাম- " তুমি তো রুস্তমগীর দেখছি একটা কুফা !! "

রুস্তমগীর আঘাত পেলো এ কথায়। " আহা ! ও কথা বলো না... এ এক মহাজাগতিক বিস্ময় ... সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাপারস্যাপার... "

-"কুছ পরোয়া নেই দোস্ত।" বললাম আমি। "তোমার এ সমস্যা আমি ঠিক করে দেবো। আমি তা পারবো।"

- "বটে ?? সত্যিই পারবে তুমি ?? ... কিন্তু কেন ?? এর বিনিময়ে লাভটা কি তোমার ?? আদৌ কোন লাভ আছে কি ??"

-"একজন বন্ধুর মানসিক শান্তি।" দাঁত বের করে বললাম আমি।

-" কিন্তু না, এটা ঠিক শোভন নয়..." আপন মনেই বিড়বিড় করে বললো রুস্তমগীর।

-"তা তো বটেই। তা - তুমি যদি মনে করো ধন্যবাদে ঠিক পোষাচ্ছে না- এবং তারপর আমায় কিছু টাকাপয়সা দিতে চাও; সেক্ষেত্রে আমি অবশ্য আপত্তি..."

-"ছি ছি কেরামত !! এটা তুমি কি বললে ?? টাকাপয়সা দিয়ে তোমার মত বন্ধুকে অপমান করবো ?? ছি ছি... কখনো না !!!

... বিষয়টা আসলে তা নয়। এই যে আমি সারাটা জীবন ধরে কেবল অঘটনই ঘটিয়ে এসেছি, এর একটা প্রায়শ্চিত্তের কথা মাথায় এলো। মানে; আমারো তো কিছু করা উচিৎ, তাই না ?? কাজেই কেবল আমার কুফা কাটানোই যথেষ্ট নয়- তোমায় এমন ব্যবস্থাও করতে হবে যাতে আমি কোন সংকটকালে মানবজাতির রক্ষকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে পারি।"

-"কাজটা একটু কঠিন হয়ে গেলো না ?? " আমার একটু ধাঁধাঁ লাগতে থাকে।

-"ভাই কেরামত, আমার মুখের দিকে চেয়ে এই কাজটা করো- দোহাই লাগে। তুমি না আমার বন্ধু ?? যাও ভাই- দ্রুত যাও। ব্যস্ত হয়ে পড় আমার যন্ত্রণা লাঘবের কাজে, যত তাড়াতাড়ি পারো।"

মতিঝিলের হোটেলটা থেকে খাবারের বিল না দিয়ে বেরিয়ে যাবার এই চমৎকার সুযোগটা আমি হাতছাড়া করলাম না। রুস্তমগীর আমার বিল না দেবার বিষয়টি স্মরণ করবার আগেই তাকে আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা রাস্তা করে দিয়ে সরে পড়লাম।...

ফাযাযিলের কাছে যখন সমস্যাটা খুলে বললাম- তখন তাকে বেশ ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছিলো। তার দুই সেন্টিমিটার লম্বা দেহটা থেকে সুবাস ভেসে আসছিলো। সব মিলিয়ে বেশ প্রসন্ন দেখাচ্ছিলো তাকে।

-"তাড়াতাড়ি তোমার সমস্যাটা খুলে বলো হে। আমার আজ বলরুম অনুষ্ঠান আছে। দ্রুত যেতে হবে সেখানে... " ফাযাযিল বললো।

অতএব আমি তার কাছে পেশ করলাম রুস্তমগীরের সমস্যাটা।

-"বাহ !! এদ্দিনে তুমি একটা বেশ মজার সমস্যা নিয়ে এলে আমার কাছে। ... মানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেই পরিষ্কার করে বলা আছে- একজন পর্যবেক্ষকের কারণে প্রভাবিত হতে পারে পুরো ব্যবস্থা। তোমার বন্ধুর পর্যায়টা এখন ঠিক সেরকম। ঠিক আছে, ব্যাপার না। ইউনিভার্সের এনাট্রপিতে পরিবর্তন আনতে হবে কিছু। ... তোমার কাজটা তবে তাড়াতাড়ি করেই ফেলি। আমার জন্যে আবার বলরুমে দুই সুন্দরী সামরিন পথ চেয়ে আছে। "

-"দাঁড়াও, দাঁড়াও।" ফাযাযিলের দ্রুততা দেখে আমি চ্যাঁচালাম। "এটাই যথেষ্ট নয়..."

-"ফালতু বকো না। দুই সামরিন অবশ্যি যথেষ্ট। কেবল লুচ্চা হলেই তিনটে সামরিন চাইবে..."

-"না না- ওকথা নয়। আসলে, বিষয়টা ঠিক এটুকুতেই সীমাবদ্ধ না। মানে রুস্তমগীরের কুফা কাটালেই তোমার চলবে না। সে যেন ভবিষ্যতে মানবজাতির ত্রানকর্তা হতে পারে- তোমায় ও ব্যবস্থাও করতে হবে। "

... আমার কথা বুঝতে ফাযাযিলের বেশ ক্কিছু সময় লাগলো। এবং তারপরের কিছুক্ষণ সে ব্যস্ত থাকলো অকথ্য সব গালিগালাজে। ...

তার মুখ একটু বিশ্রামে গেলে আমি বললাম, " ইয়ে, মানে ... কাজটা কি তুমি করতে পারবে ??"

-"করবো আমি। মানবজাতির রক্ষক... হুহ!! আরে, যেভাবে নিজেদের তোমরা নিজেরাই শেষ করে দিচ্ছো, তাতে এইসব কথাবার্তা ফাঁকা বুলি বলে ঠেকে...। যা হোক, কাজটা আমি করছি।"

আধঘন্টা ধরে কাজটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলো ফাযাযিল। এবং পুরো সময়টা আক্ষেপ করলো সুন্দরী দুই সামরিনের কথা ভেবে।...

তবে একসময় সে জানালো যে কাজটা শেষ হয়েছে। অতঃপর আমি অপেক্ষায় থাকলাম রুস্তমগীরের সাথে পরবর্তী সাক্ষাতের...।

... কাজেই পরদিন অফিসে আমি পাকড়াও করলাম রুস্তমগীরকে। আমায় দেখে তার চোখ কুঁচকে ঊঠলো। "কি ব্যাপার, খাবারের বিল না দিয়ে কাল হোটেল থেকে ভেগে পড়লে যে ?? জানো - আমায় কীরকম অপ্রস্তুত হয়েছে কাল ??"

-" ছেড়ে দাও ওটা, দোস্ত। তোমার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। মানে, এখন থেকে তুমি আর কুফা নও..."

-"মাথাটা বিগড়ে গেলো নাকি তোমার ?? বলি আমার দূর্বলতা নিয়ে রসিকতা করছো ??..." এইসব বলে টলে আমার উপর একটা লম্বা বক্তৃতা যখন সে শুরু করতে যাচ্ছিলো- তখন উপায়ান্তর না দেখে তাকে টেনে নিয়ে এলাম বাইরে। এবং তার গাড়িতে তাকে নিয়ে চড়ে বসলাম। প্রায় ঘন্টা দু'য়েক ইতস্ততঃ ঘোরাফেরার পর বিষয়টা রুস্তমগীরের মাথায় ঢুকলো। কোন পথচারী আজ তার গাড়ির সামনে পেছনে আছাড় খেয়ে পড়েনি, সবুজ বাতি হঠাৎ করেই লাল হয়ে যায়নি, অথবা মেঘমুক্ত আকাশ হতে বজ্রসহ বৃষ্টি ঝড়ে পড়েনি।

পরের কয়েকদিন ধরে টেলিফোনে আমার কাছে অবিরত উচ্ছাস করলো রুস্তমগীর। " জানো বন্ধু এ কয়দিন কী সব চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে ?? নাচের সময় আমার বান্ধবীর পা হঠাৎ করে মচকে যায়নি। হোটেলের ওয়েটারগুলো নুডলসের বাটি উলটে ফেলেনি আমার পাশের টেবিলের উপর, এমন কী নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে আমি হেঁটে যাবার পরেও ছাদের উপর থেকে ইট খসে পড়ে আহত হয়নি কেউ !!! "

মাঝে মাঝে অবশ্য বেশ সংশয় নিয়ে সে বলতো, " দোস্ত, তুমি কি নিশ্চিত , মানবজাতিকে রক্ষার একটা সুযোগ আমি পাবো ?? "

-"অবশ্যই !!" বলতাম আমি। "এতো নিয্যেস সত্যি কথা। সময় হলেই পাবে। একটু সবুর করো কেবল..."

কিন্তু একদিন মনে হলো ঘটনা বাঁক নিয়েছে। আমার সামনে এসে রাগত গলায় রুস্তমগীর বললো, " শোনো। আজ ব্যাংকে গিয়েছিলাম আমার ব্যালেন্স কদ্দুর আছে জানতে। আমার মনে হয় ব্যালেন্স কমেছে কিছুটা।... তা তো কমবেই। ঐদিন বিল না দিয়েই তুমি চলে গিয়েছিলে না ??... যা হোক। ব্যাংকে ঢোকা মাত্র যেই ব্যালেন্স জানতে চাইবো- দুম করে সবগুলো কম্পিউটার গেলো নষ্ট হয়ে। আমার মনে হয় ঐ মহাজাগতিক শক্তির ব্যাপারটা ফিরে এসেছে আবার। "

-"না না, কী যে বলো তুমি।" আমি তাকে ভরসা দিলাম। " এ ঘটনা নিশ্চয়ই একটা বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা। তোমার ঐ কুফা, মানে মহাজাগতিক শক্তি আর কি, বহু আগেই বিদায় নিয়েছে।..."

কিন্তু ব্যাপারটা একটা বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা গেলো না। একই ঘটনা ঘটতে লাগলো সর্বত্র। মানে রুস্তমগীরকে দেখলেই কেনো জানি বিগড়ে যায় ঐ যন্ত্রগুলো। শেষে বিপত্তি ঘটলো রুস্তমগীরের অফিসেই। সে বেচারা যে ঘরেই যায়, সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যায় সে ঘরের কম্পিউটার।

-"আমি আর সইতে পারছি না এসব, ভাই।" আমার হাত ধরে কেঁদে ফেললো সে। " ঐ কুফা শক্তি আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু আমি যে এখন স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ... মারা পড়বো আমি !!!"

-"ছি !! এসব বলে না ভাই আমার। " আমি বললাম। " ওসব তুচ্ছ কম্পিউটারদের নিয়ে কে মাথা ঘামায় বলো ??"... এইসব হাবিজাবি বলে সেদিনের মত শান্ত করলাম তাকে।

কিন্তু নিজেও বিচলিত হলাম এইসব ঘটনায়। কাজেই ফাযাযিলের কাছে জানতে চাইলাম এর ব্যাখ্যা। ফাযাযিল আমায় ব্যাখ্যা করলো সবকিছু। আর আমি সবকিছু ব্যাখ্যার জন্যে রুস্তমগীরকে নিয়ে গেলাম প্রকৃতির সান্নিধ্যে, একটা পার্কে।

-"ভাই রুস্তমগীর। তোমার ঐ কুফা জিনিসটা একদম চলে গেছে, সত্যি বলছি। কিন্তু কেবল কম্পিউটারের বেলায় ওটা যায়নি। ঐ ত্রুটি তোমায় মেনে নিতে হবে।"

-"আমার ঐ কুফাটাকেও সারিয়ে দাও ভাই কেরামত। "

-"কিন্তু, এ ত্রুটি যে সারানোর নয় ভাই। তুমিই না মানবজাতির রক্ষক হতে চেয়েছিলে ??"

-" মানে ?? " প্রচন্ড জোরে চ্যাঁচালো রুস্তমগীর। " মানবজাতির রক্ষার সাথে এর কী সম্পর্ক ??"

-" বলছি। ভেবে দেখো, যতদিন যাচ্ছে- মানুষ তত বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে যন্ত্রের উপর। খেয়াল করো- দিনদিন অকর্মন্য,অলস হয়ে উঠছে আমাদের লোকেরা। ভবিষ্যতের পৃথিবী নিশ্চিতভাবেই চালাবে কম্পিউটার। এবং এটা নিশ্চিত জেনে রাখো- এমন একটা কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বানাবেন- যেটা ছড়ি ঘোরাবে পুরো পৃথিবীর উপর। ওটাকে বন্ধও করা যাবে না। নিজেকে সে নিজেই রক্ষার ব্যবস্থা রাখবে। মানুষের উপর প্রতিষ্ঠা পাবে যন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব। মানবজাতির ঐ মহা সংকটকালে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে কে ?? একমাত্র তুমি রুস্তমগীর !! হ্যাঁ, একমাত্র তুমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই বিগড়ে যাবে ঐ যন্ত্র। তুমি গণ্য হবে মানবজাতির রক্ষক বলে ... "

-"ঐ দিন আসতে ঠিক কতদিন লাগবে ??" দাঁত কিড়মিড় করে জানতে চাইলো রুস্তমগীর।

-"তা, আমার বন্ধু ফাযাযিলের দেয়া তথ্যানুযায়ী- ... এই , ধরো না- প্রায় ষাট বছর ?? আহা !! রাগ করছো কেনো ?? বিষয়টাকে বরং এভাবে দেখো- যে, তুমি আরো ষাট বছর বাঁচবে !!!"

-" আর এই ষাট বছরে, পৃথিবী প্রতিদিন আরো বেশি করে কম্পিউটারাইজড হবে- প্রযুক্তির বাণ আসবে, আর আমাকে সেই সময়টা কাটাতে হবে ঘরে বন্দী হয়ে ?? একা ?? মশকরা ??" গলার রগ ফুলিয়ে চীৎকার জুড়ে দিলো রুস্তমগীর।

-"আহা, খেপলে কেনো ?? ভেবে দেখ, বিনিময়ে তুমি কি পাবে... মানবজাতির রক্ষকের মর্যাদা..."

-"তোর মানবজাতির গুষ্ঠি মারি !!!" এই বলে ঐ পার্কের মাঝেই আমায় তাড়া করলো রুস্তমগীর।

... এখন শুনেছি বেচারা রুস্তমগীর নাকি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসাধীন। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে পড়েছে শুনতে পাই..."

দীর্ঘ গল্প শেষ করে বিল দেয়ার দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ক্যাফে থেকে বের হবার আগে কেরামত আলী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শেষ যে বাক্যটি বললো, তা ছিলো, " বুঝলে হে,মানবজাতি বড় অকৃতজ্ঞ !!! "


মন্তব্য

কাকুল কায়েশ এর ছবি

ভাল হয়েছে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ভিন্ন টাইপের সাইন্স-ফিকশনের আমেজ পাওয়া গেছে।
এই লেখকের আরো কিছু গল্পের এরকম অনুবাদ আশা করছি।

ওহ, আরেকটা কথা......ফাযাযিল নামটা সুপার হইসে! চোখ টিপি

=====================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!

==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ভালু পাইলাম...এতদিন পরে পরে লেখা দিলে হয়?

-----------------------------------------------------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

স্পার্টাকাস এর ছবি

'এজাজেল' কে নিয়ে লেখা বইয়ের নাম বা ডাউনলোড লিঙ্ক চাচ্ছি।
আজিমভের ছোটগল্পের অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখেছি খুরশীদ রুমি কিছু গল্পের অনুবাদ ভাল করেছে, আবার কিছুর জঘন্য। একই লেখকের অনুবাদ বলে মনে হয়না।
দেশীয় পটভূমিতে পরিবর্তন প্রশংসনীয় এবং অনুবাদ ভাল হয়েছে। আরো কিছু আসুক।

----------------------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

কিছুদিন আগেই জি-এম-তানিম ভাই আমার কাছে একই প্রশ্ন করেছিলেন।... ডাউনলোড লিঙ্ক জানা নেই। এখানে 'এজাজেল'-এর গল্পগুলোর নাম দেয়া আছে কেবল।

ইংরেজী বইটার নাম 'এজাজেল'- নীলক্ষেতে খুঁজে পেতে পারেন। ঐতিহ্যের অনুবাদে 'আজিমভের ফ্যান্টাসী গল্প' নামে রূমী সাহেবের অনুবাদটি পাওয়া যায়।

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

দুই সামরিন অবশ্যি যথেষ্ট। কেবল লুচ্চা হলেই তিনটে সামরিন চাইবে...

তোর কয়টা লাগে???
ভাবানুবাদ ভালু হইসে।

---- মনজুর এলাহী ----

ওডিন এর ছবি

ফাযাযিল! গড়াগড়ি দিয়া হাসি

অনুবাদ খুব ভালো লেগেছে। আরো চাই। হাসি

______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

অনুবাদ খুব ভালো লেগেছে। আরো চাই।

আমারও কথা একই "

বইখাতা এর ছবি

আসিমভের নাম দেখেই খুব আগ্রহ নিয়ে ঢুকলাম। ভাবানুবাদ চমৎকার হয়েছে। এমন আরো ভাবানুবাদ আসুক।
[অফটপিক: ভাবানুবাদের কথা লিখতে গিয়ে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই মনে পড়ে গেল অতিথি সচল চশমাওয়ালি'র কথা। খুব চমৎকার একটা ভাবানুবাদ করেছিলেন।]

অতিথি লেখক এর ছবি

এই ধরণের অন্য রকম সায়েন্স ফিকস্ন পড়তে বড় ভাল লাগে রে সুহান। আমার ও অন্যদের মত একি কথা ,"আর ও চাই।"
-তার্কিক

আকাশ নীলিমা [অতিথি] এর ছবি

খুব ভাল । চালিয়ে যান

আকাশ নীলিমা [অতিথি] এর ছবি

খুব ভাল । চালিয়ে যান

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

সকলকে পড়বার জন্যে ধন্যবাদ।

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি পরীক্ষার পড়া পড়েন। পরীক্ষার মধ্যে পোস্টানোর জন্য আপ্নের আইপিসহ ব্যাঞ্চাই।(দেঁতোহাসি)

স্নিগ্ধা এর ছবি

খুব ভালো হইসে ভাবানুবাদ, মজার হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

জব্বর অনুবাদ করছোস তো!!!
পলাশ রঞ্জন সান্যাল

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

হো হো হো
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।