[justify]
‘ওয়াচম্যান’ সিনেমাটার শুরুতেই বব ডিলানের একটা চমৎকার গান আছে। দ্যা টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং। সব কিছু বদলায়, সব কিছুই বদলে যাচ্ছে, সব কিছুই বদলে যাবে। পৃথিবী ঘুরবেই।
সুনীলের কোন লেখাটা প্রথম পড়েছিলাম, সেটা আমার নিজেরও মনে নেই ঠিক। কেবল মনে আছে সে বইতে খোঁড়া একজন মানুষ- যার মনের জোর সাংঘাতিক- সেই রাজা রায় চৌধুরী নামের একটা মানুষ ছিলো। খুব সম্ভব ভূপাল রহস্য ছিলো প্রথম বইটার নাম। এরপর পড়লাম ভয়ংকর সুন্দর।
এবং এই বইটা পড়ে আমি কাকাবাবুর বিরাট ভক্ত হয়ে গেলাম। কালিকট বন্দরে এক শেকলে বাঁধা বন্দী ক্রমাগত চ্যাঁচিয়ে যাচ্ছে – সম্রাট কনিষ্কের মুণ্ডু হাতে করে আমার বন্ধু বসে আছে আমার জন্যে অপেক্ষা করে, আমায় যেতে দাও। ইতিহাসের ছোট্ট একটা মিথকে আশ্রয় করে সুনীল ভয়ংকর সুন্দর ভাবে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এরপর সবুজ দ্বীপের রাজা আর বিজয়নগরের হীরে- রাজা রায় চৌধুরী, নরেন্দ্রভার্মার ভাষায় বলতে গেলে - আনডন্টেড।
ক্লাস সিক্স, শীতের ছুটি, গ্রামের নানুবাড়ি বিশাল বড়। আমি সেই ছুটিতে ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছি গ্রামে থাকা অন্যান্য খালাতো ভাইদের সাথে। সেবারই জানলাম গ্রামের ক্রিকেট খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস- পেপসির কেস ধরে বাজি খেলা হয়- টেপ টেনিস না শুধু টেনিস বল। বাড়িতে রাশভারি নানা ভাই আর আদর দিয়ে মাথায় তোলা নানু। আর ছিলো আইনপড়ুয়া খালামণি। সেই ক্রিকেট মহোৎসবের দিনগুলি কাটানোর সময় এক কুয়াশার ভোরে দেখি খালামণি বই পড়ছে। সেই সময়। সন্ধ্যায় কিছু করার না পেয়ে আমিও টেনে নিলাম সেটা। ইতিহাস অমন করেও লেখা যায় !
সুনীল গাঙ্গুলি জড়িয়ে আছেন অনেক কিছুর সাথে। স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বইপড়া কর্মসূচির মাঝেও প্রিয় বইয়ের একটা আবার যক্ষের ধন- আর অন্যটা ছিলো আঁধার রাতের অতিথি। বিশুঠাকুর চরিত্রটাকে দারুণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো আমার।
সব সমীকরণ উলটে দিলেন আপনি সুনীল, ক্লাস এইটে। ছবির দেশেতে, কবিতার দেশেতে। মার্গারিট। কিছু বলার নেই, কিচ্ছুটি বলার খুঁজে পেলাম না বইটা পড়ে। কী স্বছ গদ্য, কী মনকাড়া বর্ণনা, কী অনায়াস সহজে বলা যায় নিজের গল্প। সেই প্রথম পড়া বইটাই এখনো আছে আমার বুকশেলফের ছট একটা জায়গা জুড়ে, আমি জানি এরচাইতে বহুগুণ জায়গা জুড়ে আছে সেটা প্রতিটি বইপড়ুয়ার মনেই।
কবিতার জন্যে অমরত্বকে আপনি তুচ্ছ করেছিলেন না সুনীল ?? কেউ কথা রাখেনি তাই- আপনিও অমর হয়ে গেলেন কবি। যে হাতে ছুঁয়েছিলেন সুনীল নীরার মুখ, সে হাতেই অনূদিত হয়েছিলো ব্যোঁদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল। বিনয় বাদল দীনেশের মতন জল লাফিয়ে ওঠে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের বারান্দায় আর ‘লোরকা স্মরণে’ পড়তে গিয়ে বারবার আবিষ্কার করি বিস্ময়ে -কবিরা কখনো সত্যবাদী হয় না।
কোথায় যেন পড়েছিলাম সুনীল গাঙ্গুলি কবিতা ছাড়া আর কিছুই লিখতে চাননি কখনো। সাহিত্যের আরেকটা নির্মমতা হলো ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কবিকে তাই লিখতে হয় অনেক কিছুই। ভাগ্যিস সুনীল লিখেছিলেন। বার্লিন প্রাচীরের ভাঙ্গা টুকরো হাতে নিয়ে তার সাথে আমরাও দেখি ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ, জাদুকর সত্যজিৎ এর হাত ধরে অরণ্যের দিনরাত্রি দেখি। আমি একা, আমাদের আরো কয়েকজন।
আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকীর কাকাবাবুর জন্যে অপেক্ষা ফুরিয়েছে কয়েক বছর হলো। কবিতার ছায়া মাড়াই না, সেই সময় আর পূর্ব-পশ্চিম আবার পড়লাম বছরখানেক আগে। এই তো, সুনীলের সাথে আমার সম্পর্ক চায়ের আড্ডা বাদে এইটুকুই। তারপরেও আজ সকালে আপনার প্রয়াণে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলাম সুনীল। কারণটা কি বুঝতে পারি না।
ফাহিম ভাই দেখলাম ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলে দিয়েছেন কারণটা।
... এটাই মনে হয় সবচেয়ে সত্য কথা। সুনীল চলে গেছেন, সাথে করে নিয়ে গেছেন আমাদের স্মৃতির শহরের একটা বড় অংশ। সুনীল- তার নবীনকুমারের মতোই- আমাদের সেই সময়ের প্রতীক। সেই সময়ের লোকগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। স্টিভ ওয়াহ অবসরে, পাওলো মালদিনি আর লুইস ডি নাজারিও রোনালদো খবরের কাগজে নেই। মাসুদ রানা ধুঁকতে ধুঁকতে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে পূর্ব আর পশ্চিমে- না ফেরার দেশে মতি নন্দী, মাইকেল জ্যাকসন আর হুমায়ূন আহমেদ। আজ এই মিছিলে যোগ দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
আপনি নেই এই সত্য মেনে নিয়েও চোখ মুছে সেই সময়ের প্রতীক রুপে আপনাকে বিদায় জানাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সবকিছু বদলে যাচ্ছে, দ্যা টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং।
আপনি নেই তাই সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায় জানা হবে না আর। আপনি নেই তাই সন্তু হারিয়ে গেছে।
আপনি নেই তাই হারিয়ে গেছে এক টুকরো চাঁদ।
[/justify]
মন্তব্য
নেট এ বসে এ খবরটা দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম !! সন্তু-কাকাবাবু আর কখনো আসবেনা আমাদের সামনে। ওরা হারিয়ে গেছে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
সকালের ঘুম ভেঙ্গেছে এই খবরের ফোনে
facebook
সকালে নেটে বসেই খবরটা চোখে পড়লো। খুব খারাপ লাগছে। এভাবে প্রিয় লেখকরা সবাই এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে !
উনি ভালো থাকুন। যেখানেই থাকুক না কেন।
অমি_বন্যা
এখন আমি ইতিহাস জানবো কোথা থেকে। আর কাকা বাবুরই বা কি হবে?
শূণ্য লাগছে খুব
এখন আমি ইতিহাস জানবো কার কাছে। কাকাবাবুরই বা কি হবে এখন। তাকে চালিয়ে নিবে কে?
মুশফিকুর রহমান
অসংখ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি!
"সেই সময়", "পূর্ব-পশ্চিম", "প্রথম আলো" এই উপন্যাস গুলো পড়ার সময় মনে হত এর যেকোন একটা সৃষ্টির জন্যই তো লেখক শত বছর বেঁচে থাকবেন পাঠকের মনে !!
এভাবে প্রিয় লেখকরা সবাই এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছেন ! খুব খারাপ লাগছে
ভীষণ একটা ধাক্কা খেলাম! আমার বিছানার পাশের ছোট টেবিলটাতে এখনো পড়ে আছে 'প্রথম আলো'। পরের পর্বটা শুরু করেছি মাত্র। অলস দুপুরে ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিয়ে যাদের বইগুলো টেনে নিয়ে অদেখা ভুবনে হারিয়ে যাই সে মানুষগুলো এক এক করে সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এই বছরটা যেন শুধু হারানোর বছর। কিছুদিন আগে আমার অবসরের নিত্য খোরাক যোগানো হুমায়ূন আহমেদ। সে ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, এবার কালের গল্প বলে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়! অতীতকে তার মত এতো নিখুঁত, প্রাণ ঢেলে, সহজবোধ্য করে তুলে ধরার ক্ষমতার আর বুঝি কেউ থাকলো না। এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়! যার বর্ণনায় বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, স্বামী বিবেকানন্দ, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, গিরিশ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথসহ আরো অনেক মহাঋষী হয়ে উঠেছে আমার কাছে রক্তমাংসের মানুষ। মানুষটির প্রতি আমি চিরঋনী!
.........
রংতুলি
ভালো বলছেন। আমাদের নায়করা হারিয়ে যাচ্ছে... ২০১২ সালটা আসলেই অপয়া।
সুনীল আমার সবচেয়ে প্রিয় ঔপন্যাসিক। তাঁর চলে যাওয়াতে কতটুকু মন খারাপ লাগছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। লেখককে ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য।
তামান্না ঝুমু
ধন্যবাদ সুহান রিজওান, বিষাদটাকে বিষাদময় করে দেবার জন্য। অনুভবটা প্রখর হলো।
সুনীল, আমার কৈশোরের সঙ্গী, যার বই পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতাম বাংলার ইতিহাসে, নিজেকে খোঁজে বেড়াতাম প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি সিমেন্ট-চুন খসে পড়া দেয়ালে।
দিবাকর
আসমা খান
নতুন কোন কাকাবাবু ও সন্তু আর পড়ব না ভাবতেই মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছে
শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল মহান এই লেখকের প্রতি
সুনীল আসবে ফিরে বারে বারে
তাঁর লেখার তরে।
তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
তুহিন সরকার
টুহিন_পরেেটি@য়াহোো।চোম
গতকাল খবরটা শোনার পর থেকেই মনে মেঘ জমে আছে। আপনার লেখাটা পড়ে আর অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না। সত্যি কীভাবে সব প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে একে একে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আমি প্রথম খবরটা শুনি আহসান হাবীব ভাইয়ের মুখে। উনি সকালে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন খবর সত্যি কিনা। সাথে সাথে নেটে ঢুকে দেখি যে সত্যিই তিনি আর নেই। সেইদিনটা যে কী গুমোট আর মন খারাপ করা গিয়েছে আমার।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
নতুন মন্তব্য করুন