[justify]
আজ মাসুদ রানার জন্মদিন।
আমাদের বয়স বাড়ছে। ফুটবল মাঠ ছাড়া হাফপ্যান্ট পড়লে লোকে বাঁকা চোখে তাকায়। নাইন্টি ফোরের সেই মনে গেঁথে যাওয়া সেলিব্রেশনের বেবেতো আর রোমারিও- তাদের দুইজনের ছেলেরাও নাম লিখিয়েছে পেশাদার ফুটবলে। রানা হারামজাদা এখনো সমানে লাম্পট্য চালিয়ে যাচ্ছে।
মাসুদ রানার সাথে পরিচয়ের সময় মনে নেই আমার। মনে আছে, পরিচয় হয়েছিলো ‘বিপর্যয়’এ। জার্মান ধনকুবের ম্যাক্স মরলকের হাতে নিখোঁজ বিসিয়াই এজেন্ট বাবুল আহমেদ নিয়ে তদন্ত করতে রানা এসেছিলো, সুইজারল্যান্ডে বোধহয়।
সত্যি বলতে, রানার আসল দৌড় জানার আগেই চিনেছিলাম তাকে। সময়টা কিশোর-মুসা-রবিনে’র। কাকাতুয়া নিয়ে সান্তা মনিকায় তোলপাড়। মোম্বাসায় ধরছি পোচার। ভিনদেশী রাজকুমারে ঝামেলার ভাস্তে বিদ্ঘুটে জব বলছে ‘অগোলোম- বগোলোম’ । লাইফ ওয়াজ গুড ম্যান !! বাভারিয়ান বরিস আর রোভারের ভাষায়- ‘হোকে’ ।
এরা বাদ দিলে রবিন হুড, এথোস-পর্থোস-আরামিস আর টম সয়ারের যুগ। এদের মাঝে রানা খোঁজার সময় কই ভাই। পিশাচ দ্বীপের অনুকরণে ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ নাটকটাও তো যুইতের লাগলো না।
তারপর নাইন টেন। পোলাপানের হাতে হাতে বেঞ্চের তলায় ঘুরতো সংকেত। হেঁটে হেঁটে স্কুল থেকে আসার সময় নিউমার্কেটের সামনের বুকস্টল থেকে নতুন জাপানী ফ্যানাটিক, আর নাইলে নীলক্ষেতের সেকেন্ডহ্যান্ড আই লাভ ইউ ম্যান।
কাঁচাপাকা ভুরুর রাহাত খানের সামনে আসলেই ক্যামন যেন চুপসে যায় এমআরনাইন। এইটুকু বাদ দিলে আগাগোড়া দুর্ধর্ষ। হাতকাটা সোহেল, মায়াময়ী সোহানা, ধারালো রুপা, সেক্রেটারি ইলোরা, আর গিলটি মিয়াঁ।
ভাগ্য হয়েছিলো একবার কাজী আনোয়ার হোসেন, অদ্বিতীয় কাজীদার সাথে দেখা করবার। সে এক অভিজ্ঞতা। কোটি কোটি প্রশ্ন ঠিক হয়ে আছে মনে মনে, তাঁর অমায়িকতায় বেমালুম ভুলে গেছি সব। ঠিক এই সময় কে যেন জিজ্ঞাসা করলেন, কাজীদার নিজের সৃষ্ট প্রিয় চরিত্র কোনটি। ঘর আলো করা হাসি দিয়ে কাজীদা বললেন, গিলটি মিঁয়া !!
এই গিলটি মিঁয়ার মতো আমিও খাঁটি ঢাকার- নতুন ঢাকার- মানুষ ভাই। রমনা চিনি, সেগুণবাগিচা চিনি, বনশ্রী চিনি। কেবল হাজারীবাগের ওদিকটা গেলে একদমই কানা। মাসুদ রানা হাতে ধরে আমায় চিনিয়েছে প্যারিসের রাজপথ, পলিনেশিয়ান দ্বীপ বা মস্কোর অলিগলি।
কত বিচিত্র চরিত্র। রানার অসমবয়েসী বন্ধু লুবনা আভান্তি। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জার ক্যান্সারাক্রান্ত মেজর ফজল মাহমুদ। মুক্তবিহঙ্গের শত্রুর চেয়েও অসহ্য বন্ধু মাইকেল সেভার্স। মায়ানমারের উ-সেন।
সময়-অসময় জ্ঞান ছিলো না। নটরডেমের টেস্ট পরীক্ষার আগের রাতে। বাংলা ব্যাকরণ মাথায়। ডেনিশ ধর্মযাজকের ছদ্মবেশে থাকা রানার পেছনে তখন ধুরন্ধর গোয়েন্দা ক্লঁদ রাঁবো। সুবর্ণা এক্সপ্রেসের ঈদের বিনা টিকিটের দাঁড়িয়ে থাকা ভীড়। আমি তখন মিলান থেকে ছেড়ে আসা আটলান্টিক এক্সপ্রেসে, বাঁচাতেই হবে জেনারেল তুর্গেনিভকে। কারেন্টহীন শুক্রবারের আজিমপুরের দুপুর। বিকালে খেলার আগেই শেষ দেখতে হবে হংকং এর মাফিয়াদের।
তিনটা জিনিষ নাকি দুনিয়ার সবাই চেনে। কোক, যিশু আর পেলে। বাঙ্গালির ক্ষেত্রে মনে হয় যোগ করে দেয়া উচিৎ মাসুদ রানার। স্রষ্টা এখানে হোমসের ডয়েলের মতোই চলে গেছেন সৃষ্টির আড়ালে। মুদি দোকানীর হাতে পর্যন্ত রানার আড়ালে ঢেকে গেছে নমস্য কাজীদার নাম।
অগ্নিপুরুষ বইয়ের শেষ দু’টো বাক্য একেবারে মনে গেঁথে গেছে আমার।
‘গোজোর পাহাড়ে পাহাড়ে বাতাসের ফিসফিসানি। চাপা স্বরে কী সব জল্পনা-কল্পনা।‘
কল্পনার রঙ্গিন দিন শেষ। এখন মাসের শেষে, মাঝে মধ্যে কান্না পায়। অস্থির ফেসবুক, অস্থির রাজপথ, ভাঙ্গা মন্দির। মনে হয়, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টিলেজেন্সের খুব দরকার ছিলো। দরকার ছিলো দুঃসাহসী, দুর্ধর্ষ- হোক বহুগামী- কিছু মাসুদ রানার।
রোদ উঠে গেছে জীবনের নগরীতে, কৈশোর থেমে গেছে তোমাদের জানালায়।
তবুও মাঝে মাঝে রাতে ঘুমোবার আগে, বা চলন্ত বাসে ফুলফলপ্রকৃতি দেখার ফাঁকে, বা আজকের মতো এলোমেলো স্মৃতি সন্ধায় সে জানালায় উঁকি দিলেই দেখি- কর্সিকার বন্দরে গ্লাসের পর গ্লাস হুইস্কি খেয়ে যাচ্ছে এক লোক। রোদে পোড়া বাদামী রঙ, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। অলস হাতে পায়রাকে বাদাম ছুঁড়ে দিচ্ছে লোকটা। চোখজোড়া তার অদ্ভূত মায়াময়। টানে সবাইকে, বাঁধনে জড়ায় না।
মাসুদ রানা তার নাম।
আর আজ, সেই মাসুদ রানার জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন অগ্নিপুরুষ।
[/[justify]]
মন্তব্য
প্রথম প্যারাটা পড়ে হাসি থামাতে পারছি না।
দারুণ লাগল বাকি লেখাটাও।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
সত্যি বলতে কি এখন মাসুদ রানা ওভাবে পড়া হয় না, আগে যেমন স্কুলে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে পাঠ্যবইের ভেতরের সঙ্গী ছিল ঐ ছোট্ট কিন্তু মোটা বইটা। আপনার লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল, পড়ার বই বাদ দিয়ে মাসুদ রানা পড়ে মায়ের বই ছিঁড়ে ফেলার কথা !
চমৎকার লিখেছেন। ধন্যবাদ।
নাহিয়েন
আগেই লিখে ফেললেন , যাক। কিন্তু রানার লাম্পট্যে আপনের গাঁ জ্বলে কেন শুনি !
facebook
আগে লিখে ফেলার রাগে আপনি সুহানের 'গা' (দেহ) জ্বালানোর বদলে পুরো 'গাঁ ' (গ্রাম)-টাই জ্বালিয়ে দিলেন?!!! তাও ভাল, আপনার আসিতেছে আসিতেছে-র ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় শুনে অপেক্ষায় বসে থাকলে ২০১৩-র বদলে ২০২৩ হয়ে যেত, অপেক্ষাতেই বসে থাকতে হত আমাদের!
****************************************
-ঘ্যাচাং-
****************************************
যতদূর মনে পড়ে সোহানার রুপ মাধুর্য্যের বর্ণনা শুনেই রানা পড়া শুরু করসিলাম। তারেক অণু সাহেব, এরপরেও যদি লাম্পট্যে গা না জ্বলে তবে কেম্নে কি
লেখায়--
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
মাসুদ রানা পড়া হয়না অনেক বছর।
আসলেই।
সেটাই।
রহস্য পত্রিকায় রানার বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে, রানা এমই ক্রেজ তৈরি হয়েছি বুকের মধ্যে, একেবারে রানার প্রথম বেই ধ্বংসপাহাড় দিয়েই শুরু করেছিলাম। সঠিক জানি না, তার জন্মদিন কবে, তবে রানা কিন্তু একেবারে ছোট্টটি জন্মায়নি। জন্মদিনে সে রীতিমেতা ২৮ বছরের টববগে তরুণ! প্রায় অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও তার বয়স ত্রিশের কোঠায়!
এক্ষেত্রে আমি মনে হয় আপনার চেয়ে একটু বেশিই ভাগ্যবান। দেখাতো হয়েছেই, তার অনেক আগে থেকেই তাঁর সাথে আমার সেলফোনে কথা হয়। অথচ তখন আমি মফস্বলের রাস্তায় ঘোরা নিতান্ত এক ছাত্র। এখনো তাঁকে ফোন করলে ব্যস্ততার কারণে ফোন রিসিভ যদি করতে নাও পারেন, সেদিন আমি তাঁর গলার স্বর শোনার জন্য চাতকের মতো ফোনের দিকে চেয়ে থাকি। এক সময় অপেক্ষার অবসান হয়। রিং বেজে ওঠে। ফোনের ওপার থেকে মাসুদ রানার কণ্ঠস্বর--‘রনি কেমন আছো? ফোন করেছিলে?’
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
রানাভক্ত বেশির ভাগ কিশোরের চেয়ে আমি বোধহয় বেশি ভাগ্যবান। রানা পড়তে গিয়ে অন্যদের পিতৃমাতৃদেবের হাতে কানমলা খাওয়া বা বই ছিড়ে টুকরো টুকরো করার কাহিনি শুনলে আমার নিজের কথা ভেবে হাসি পায়। আমার রানা পড়া শুরু হয়েছিল সেই উ সেন দিয়ে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে দুই খণ্ড কিনে এনে টিনের তোরঙ্গে ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিশেষ করে এর প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছদে বোধহয় ফরাসী সুন্দরী চরিত্র ব্যারনেস সিবা-র একটা ইষৎ ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি ছিল বলে। বই আনার দিন দুয়েক পরেই হঠাৎ লক্ষ্য করি তোরঙ্গে ১ম খণ্ডটি নেই। গেল কই গেল কই করে ভয়ে ভয়ে তোলপাড় করতে করতে লক্ষ্য করলাম আমার প্রচণ্ড রাশভারী কঠোর ব্যক্তিত্ববান পিতৃদেব বিছানায় শুয়ে লেপের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে একটা নিউজপেপারের কাগজে মলাট দেয়া বই পড়ছেন, আর মাঝে মাঝে চোরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। তারপর কিভাবে আবিষ্কার করলাম এখন আর মনে নেই, শুধু মনে পড়ে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমার ভয়ে (কেড়ে নিয়ে যাব বলে?) উনিই রানার বইটা মেরে দিয়ে কাগজ দিয়ে মুড়ে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছেন!!! অর্থাৎ বাপের ভয়ে ছেলের বদলে, ছেলের ভয়ে বাপই লুকিয়ে লুকিয়ে রানা পড়ছে! কী কাণ্ড! বাবা এখন আর নেই, কিন্তু মনে পড়লে এখনও ভীষণ হাসি পায়
****************************************
প্রথমে কুয়াশা, পরে মাসুদ রানা, ছয় রোমাঞ্চ, পরে অন্যান্য অনুবাদ। তখনকার জন্য ভালই ছিল।
জন্মদিনটা কিভাবে? প্রথম বই প্রকাশের তারিখ হিসেবে, নাকি চরিত্রটার লেখক-নির্ধারিত জন্মদিন ?
মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই পড়েছিলাম হামলা-২। সেইই শুরু। বান্ধবীদের বাসায় শুনতাম ‘এসব’ বই নাকি পড়তে দেয়া হয় না। আর আমার আম্মা থোড়াই কেয়ার করতেন। বড় ভাইর সাথে কাড়াকাড়ি করে পড়েছি।
দেশের এই দুঃসময়ে একজন মাসুদ রানার প্রয়োজন অনুভব করছি সুহান।
আমার বই পড়া শুরুই হয় মাসুদ রানা দিয়ে। সেই ক্লাস ফাইভে। জেনেবুঝে নাকি না জেনেবুঝেই, পিতাজি চারখানা বই কিনে এনেছিলেন উল্লাপাড়া রেল স্টেশনের বুকস্টল থেকে -- তিক্ত অবকাশ ১,২ এবং ব্ল্যাক ম্যাজিক ১,২। "তিক্ত অবকাশ" দিয়ে শুরু। এরপর তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, সেবা রোমান্টিক, কিশোর ক্ল্যাসিক, অনেক কিছু পড়লেও রানার প্রতি অন্যরকম এক ভালোবাসা ছিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় বই হলো "অগ্নিপুরুষ"। এটা আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠতম বইগুলার একটা। আরও অনেক ভালো-লাগা বইয়ের মধ্যে বেশি ভালো লেগেছিল "আই লাভ ইউ, ম্যান"। সোহানা, রূপা, রেবেকা সাউল, সোহেল, রাহাত খান... সবার প্রতিই ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল। কত কত চরিত্র যে মনে দাগ কেটে গেছে! কাজীদাকে ধন্যবাদ, একটা অসাধারণ ছেলেবেলা উপহার দেয়ার জন্য। উনি না থাকলে, উনার সৃষ্টি না থাকলে, জানি না... আজ আমি যা, যতটুকুই হই না কেন, তা কোনোদিনই হতে পারতাম না। এই কথাটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি।
নতুন মন্তব্য করুন