একটা দল শান্ত। আগ্রাসী গোলক্ষুধা নেই, অনবরত আক্রমণ চালানো নেই, আচমকা দূরপাল্লার রোমাঞ্চকর শট নেই। তাদের ছকটা সরল, একটু বিরক্তিকর মাত্রাতেই সরল। বল পায়ে রাখো, বল পায়ে রাখো, বল ধরে রাখো। এই তরিকায় সাফল্য পেতে যা দরকার, ঠিক সেই ছাঁচের দুর্দান্ত বল প্লেয়ারের অভাব নেই তাদের।
অলস পায়ের যাদুর এই দলটা স্পেন।
পরপর দুই ইউরো আর এক বিশ্বকাপের মুকুট মাথায় তোলা ঐ পাসিং ফুটবল আকঁড়ে ধরেই। এমনই অবাক সে অবলম্বন, স্ট্রাইকারের দরকারই হয় না দলটার। ফলস নাইন নামের অদ্ভূত এক স্ট্রাটেজিতে বিশ্বকাপ আর ইউরো জেতা কোচ দেল বস্ক এই টুর্নামেন্টে অবশ্য দলকে খেলিয়েছেন চার-তিন-তিনেই। গোল করায় কখনোই খুব বেশি সপ্রতিভ না স্প্যানিয়ার্ডরা, তবে এইবার মাঝখান দিয়ে তাহিতিকে গ্রুপ পর্বে পেয়ে দশ গোল করে নিয়েছে তারা।
অন্য দলটা বেহিসাবী, উশৃঙ্খল, তারুণ্যের উদ্দামতায় মাতাল। ভুল করছে, ভুল করছে; কিন্তু পর মুহুর্তেই চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে অভাবনীয় স্কিলে- ডিফেন্স ভাঙ্গা থ্রু’তে- অকল্পনীয় ফিনিশিং এ। দলের খেলোয়াড়রাও তরুণ। খেলছে যেন খেলার আনন্দেই।
রোমাঞ্চকর ফুটবলের চিরকালের রোমান্টিসজমে মোড়া এই দলটা ব্রাজিল।
কনফেডারেশনস কাপের আগের অগোছালো ব্রাজিল বদলে গেছে খেলা শুরু হতেই। বাণিজ্যের এই যুগে ‘জোগো বনিতো’র দায় এখন ব্রাজিল বহন করে না- রবার্তো কার্লোসের বহুল আলোচিত সেই সংলাপটা যথার্থ হয় স্কোলারির ব্রাজিলের খেলা দেখলে। কিন্তু ওই যে, ফুটবলের চিরকালীন রোমান্টিসিজমের দায় !! নেইমারের যাদু, মার্সেলোর সৃষ্টিশীলতা আর অস্কারের হঠাৎ কারিকুরি যে ভবিষ্যতের ইতিহাস নতুন করে লিখবে না- সেটার বিপক্ষে বাজি ধরার লোক কিন্তু বেশি নেই।
চিরকালীন ফেভারিট সেলেসাওদের সাথে লা ফুরিয়া রোহাদের সোনালী প্রজন্মের লড়াইয়ের মঞ্চ তাই শুধু আরেকটা ফুটবল ম্যাচের জন্যে অপেক্ষা না। ফুটবল পূজারীদের কাছে রীতিমত উপাসনা করে পাবার মতো ফাইনাল। ‘পূজারী’ শব্দটা আরেকটু সার্থক হয়ে যাবে মঞ্চটাকে গোণায় নিলেই। ফুটবল যদি ধর্ম হয়ে থাকে, মারাকানাকে তার মন্দির না বলে উপায় আছে ??
এই মন্দিরে দুই দলের খেলা একমাত্র ম্যাচটা ১৯৫০ সালে। ৬-১ ব্যবধানে সেই ম্যাচটা জিতেছিলো ব্রাজিল। ইতিহাসটা হোস্টদের পক্ষে থাকলেও গেস্টরা এগিয়ে যাচ্ছে ইদানীংকার ফর্ম বিবেচনায়। টানা ২৯ ম্যাচ ধরে হারেনি স্পেন। উ-ন-ত্রি-শ ম্যাচ !! আফ্রিকা বিশ্বকাপে সুইজারল্যান্ডের কাছে সেই যে এক ঠোকর খেয়েছিলো, এরপর থেকে হারতে আর ইচ্ছা করেনি মনে হয়।
স্কোলারির ব্রাজিলের পক্ষে থাকছে আরো একটা ফ্যাকটর। ফুটবলের অন্য অনেক অঘটনের ম্যাচের মতোই সঙ্গে তারা পাচ্ছে হোম গ্রাউন্ডের দর্শকদের। স্পেনকে ব্রাজিলের হারানোটা ‘অঘটনের’ বললে নেইমাররা রাগ করতে পারেন। তাদের খুশি করার জন্যে নীল-হলুদ স্কোয়াডের সাম্প্রতিক অর্জনগুলোর কথা বলে ব্যালেন্স একটু করতেই হয়।
গ্রুপ এ’তে তাহিতির মতো কোন প্রতিপক্ষকেই পায়নি ব্রাজিল। তারপরেও গটগটিয়ে সেমিতে উঠতে কোন সমস্যাই হয়নি তাদের। জাপানের গতি, মেক্সিকানদের জায়ান্ট হান্টিং রোগ কিংবা ইতালির ট্যাকটিক্স কোন কিছুই আটকাতে পারেনি তাদের। তার ওপর দশ নম্বর জার্সির ভারেই কি না কে জানে, প্রতিভাবান বিস্ময় বালক থেকে হঠাৎ করেই ব্রাজিলের ভরসায় রুপান্তর ঘটেছে নেইমার ডস সান্তোস জুনিয়রের। আগামী দিনের বার্সেলোনায় মেসি-নেইমার জুটি, ইউরোপের বড় দলগুলোকে ভোগাবে বলেই মনে হচ্ছে।
কাগজে কলমে ব্রাজিলের ডিফেন্স এগিয়ে। দান্তে, লুইজ গুস্তাভো, থিয়াগো সিলভা কিংবা ডেভিড লুইজ। ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর রক্ষণে প্রতিটা নামই ভরসার। তবে কাগজে না হলেও কাজে পিছিয়ে থাকছে না স্পেনও। স্প্যানিশ আর্মাডা ক্রমাগত বল নিয়ে ওপারের সীমানায় গেরিলা আক্রমণ করে বলেই কী না, টুর্নামেন্টে মাত্র একবার বল ঢুঁকেছে নিজ জালে। পুরাণের নায়ক হয়ে সেখানে আবার গোলপোস্ট আগলে আছেন ‘সেইন্ট’ ইকার ক্যাসিয়াস।
সব মিলিয়ে পাল্লাটা তাই ব্রাজিলের পক্ষেই ভারী। তবে শুধুই হিসাব নিকাশ করে স্পেনকে বাদ দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আজ পর্যন্ত ইউরোপের বাইরে থেকে ইউরোপে বিশ্বসেরার মুকুট এনেছে এই স্পেনই। টানা দুই বড়দের ইউরোর সাথে অনেকটা চুপিসারেই অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোর টাইটেলটাও দুইবার পকেটে ঢুকিয়েছে লা রোহারা। পিচ্চিরা আশ্বাস দিচ্ছে সামনের দিনগুলো উজ্জ্বল। কিন্তু জাভিদের সোনালী প্রজন্ম নিশ্চয়ই টানা দুইবার বিশ্বকাপটা জিতেই টিকে থাকতে চাইবে ইতিহাসে। ব্রাজিলের মাটিতে সেটার প্রাকটিস করে নিতে আজকের ম্যাচের বিকল্প নেই তাদের।
কনফেডারেশনস কাপ ফাইনালের মঞ্চটাকে আরেকটু অর্থবহ করে তুলছে ব্রাজিলের সাম্প্রতিক অবস্থা। ‘ব্রাজিল বিপ্লবে’র সূচনা বলে সেটাকে অভিহিত করা একটু কষ্ট কল্পনাই হয়ে যাবে, তবে ফুটবল পাগল ব্রাজিলিয়ানেরা যে নড়েচড়ে বসেছে এই ফুটবল উৎসবের সময়ে -সেটাই কিন্তু বুঝিয়ে দিয়ে সরকারের প্রতি জমে ওঠা ক্ষোভটাকে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আরো অনেক রকম হিসাব মেটানোর ছিলো আয়োজকদের। স্টেডিয়ামগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় ছিলো; বিশ্বকাপ আয়োজনের হোমওয়ার্ক এই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল পাশমার্ক পাবে কি না, সেটা নিয়েও ছিলো রটনা। তবে সমস্ত প্রচার উড়িয়ে দিয়ে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার জানিয়ে দিয়েছেন, এই টুর্নামেন্ট এখনো পর্যন্ত আয়োজিত সেরা কনফেডারেশনস কাপ। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে একশো মিলিয়ন ডলারের মতো আয় হয়েছিলো ফিফার, ব্লাটারের ধারণা ফুটবল পাগল সাম্বার দেশের বিশ্বকাপ থেকে আয় করা যাবে আরো বেশি।
কাজেই বুফনকে বোকা বানিয়ে দেয়া নেইমারের গোল কিংবা তোরেসকে বানিয়ে দেয়া ইনিয়েস্তার রেশমি থ্রু পাস ছাড়াও ফাঁকতালে আজ ভোররাতে নায়ক হয়ে যেতে পারেন আরেকজন।
নীরব ভাষায় তিনি বলতে পারেন- ‘চেয়ে দেখো, আমার নাম ফুটবল। আমি, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। আমি, মানুষের সবচাইতে সর্বগ্রাসী আবেগ।’
মারাকানার মন্দিরে আজ, এই শেষের নায়কটিকে দেখতে চাওয়া পূজারীর সংখ্যাই বেশি।
মন্তব্য
খেলার ফল হোক ৩-১
উনত্রিশ ম্যাচ পরে হারার রেকর্ড করুক আজ স্পেন
খেলাধুলা নিয়ে তোমার লেখা বরাবরই খুব ছিমছাম হয়। এটাও তাই। ভালো লাগল।
আজকের খেলা কয়টায়? কোন চ্যানেলে দেখাবে? কোনোকিছুই ইদানীং ফলো করা হয় না।
রাত চারটায়। মাছরাঙ্গা, টেন স্পোর্টস/ স্টার স্পোর্টস
‘চেয়ে দেখো, আমার নাম ফুটবল। আমি, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। আমি, মানুষের সবচাইতে সর্বগ্রাসী আবেগ।’
ব্রাজিল ব্রাজিল
facebook
কোনো কথা নাই। ব্রাজিল...
সুহান, লেখাটা ভালো লেগেছে ভীষণ
ডাকঘর | ছবিঘর
ব্রাজিল ব্রাজিল
আমারতো ব্রাজিলের ডিফেন্সকে নিয়েই আশঙ্কা। দাঁতে, গুস্তাভো এরা দুজন ক্লাব ফুটবলেতো নিয়মিত নন। বরং সাইড লাইনেই বেশি দেখা যায়। আর ডেভিড লুইজতো এটাকিং ডিফেন্ডার। স্পেনের টিকিটাকি আটকানো এঁদের দ্বারা কতখানি সম্ভব, ভাবছি। হ্যাঁ, তবে ঐযে বললেন গোলপোস্টে শট করার ব্যাপারে এঁরা ততো আগ্রহী নন, যতটা নেইমার, ফ্রেড বা অস্কার, পোলিনহোরা। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত নেইমার যাদু কতখানি কার্যকর হয়। হ্যাঁ, বলে রাখি আমি কিন্তু ব্রাজিলের সমর্থক, সেই ন্যাংটাকাল থেকেই। তবে এও বলি, ইদানিং স্পেনও কিন্তু পছন্দের তালিকায় আছে। তবে এবারে স্পেন দলে স্ট্রইকারের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রাজিল দলেতো ফ্রেডকে স্ট্রাইকারই মনে করছিনা। খেলা সেই ভোর ৪ টায়। আগের খেলাটাও আজ একটু আগেভাগেই হয়ে গেল। সময়টাতো কাটাতে হবে, তাই কিছু মন্তব্য করলাম। আমি কিন্তু বিশেষজ্ঞ নই বরং বিশেষ অজ্ঞই বলতে পারেন।
লেখাটা ভাল হয়েছে।
নিতান্ত গোমূর্খ বলে কোন কোন উপমা, কোন কোন কথায় "ফুটবলীয় ভাষার' প্যাঁচ বুঝতে পারিনা। ওই শব্দ/শব্দবন্ধগুলো সরেস আইসক্রীমে দুয়েকটা অপরিচিত বাদামের মতো। কিন্তু সবমিলিয়েও তোমার চাইতে ভালো লেখিয়ে দেখবনা সম্ভবত আরো অনেক অনেক দিন।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
যে কোন লেখাই এতো সুন্দর করে লিখেন সুহান। লেখাটা ভীষণ ভালো লাগলো।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
ব্রাজিল গত দুইবারের কনফেডারেশনস কাপ চ্যাম্পিয়ন (২০০৫, ২০০৯); এবং গত দুই বিশ্বকাপেই (২০০৬, ২০১০) তারা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিসে। সুতরাং, দোয়া করেন যেন ব্রাজিল কনফেডারেশনস কাপ চ্যাম্পিয়ন হইতে না পারে!
চারিদিকে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়া আলোচনা হলে কেম্নেকী!!!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
চমৎকার লেখা আর চমৎকার ফল - ব্রাজিল ৩-০ বিজয়ী, স্পেন-এর উপর ভালো আধিপত্য রেখে - ফ্যনাটাস্টিক!
- একলহমা
এই লেখাটা খেলাটা হয়ে যাবার পর লিখলে আরও ভালো হতো, অথবা আরও একটা লেখা নামানো যেতে পারে ফাইনাল রেজাল্ট নিয়ে।
মারাকানার মন্দির কাল পূজারীদের হতাশ করে নি মনে হয়। এক পেশে খেলা হইসে যদিও
সবাইকে থাঙ্কস মন্তব্য করার জন্যে
যাব্ব্যাটা, ফাইনাল ম্যাচের উপর রিপোর্ট করে আরেকটা লেখা নামা।
ক্রীড়া সাহিত্যের লেখায় আপনার জুড়ি নেই।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছেন - ব্যাপারটা ভাল্লাগছে
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
নতুন মন্তব্য করুন