জোহরা তাজউদ্দীন যখন পহেলা নভেম্বরের সন্ধ্যায় অশুভ কোনো ইঙ্গিত তাড়িত হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন এদিক ওদিক, সেই একই দিনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কজন সিনিয়র আর্মি অফিসার স্থির করেছেন উল্টোরথে চেপে বসা দেশ আর সেই রথরুপী বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে আবারো নিয়মতান্ত্রিক করে তোলার জন্যে একটি প্রতি-অভ্যুত্থান করতে হবে তাদের। চীফ অফ জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ, ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিলেরা একমত হয়েছেন, দোসরা নভেম্বরের মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেই তারা শুরু করবেন একটি নীরব অভ্যুত্থান। যার মূল লক্ষ্য, সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
সেই দোসরা নভেম্বরে, শীতার্ত এক রাত নেমেছে ঢাকার বুকে। বঙ্গভবন থেকে খানিক আগে বিদায় নিয়েছেন জেনারেল ওসমানী। খন্দকার মোশতাক আর সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কর্নেল রশিদের সাথে এতোক্ষণ নানা বিষয়ে আলোচনা করছিলেন ওসমানী, জেনারেল খলিলও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আশেপাশেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে ফারুক।
জেনারেল ওসমানী আলোচনায় প্রস্তাব রেখে গেছেন, জেনারেল জিয়াকে অবসরে পাঠানো হোক। জিয়া আর ওসমানীর পারষ্পরিক অপ্রসন্নতা সম্পর্কে সকলেই কমবেশি জানেন, আর খন্দকার মোশতাক নিজেও ঠিক আস্থা রাখতে পারছেন না জিয়ার প্রতি। কিন্তু রশিদের ধারণা, খালেদ মোশাররফই জিয়ার চাইতে বড় হুমকি। ওসমানী চলে যাবার পরেও রশিদ আর মোশতাক আলোচনা করছিলো এসব নিয়েই। কাকে চীফ অফ স্টাফ করা যায়, কাকে কোথায় বদলি করা গেলে পরিস্থিতি আরেকটু বেশি নিয়ন্ত্রণে আসে- এসব নিয়েই দুজনের কথাবার্তার ফাঁকতালেই মধ্যরাত পেরিয়ে যায় সময়ের কাঁটা।
রশিদ যখন আলোচনা শেষ করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো নীচতলায় শুতে যাবার, পাহারায় থাকা এক ত্রস্তব্যস্ত পুলিশ অফিসার ছুটে আসে তখন তার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘স্যার, আর্মির যত লোক বঙ্গভবন পাহারায় ছিলো, সবটি সইরা গেছে ! বইলে গেছে, আমাদেরও সইরা যাওয়া উচিৎ।’
অপ্রস্তুত রশিদ বাইরে ছুটে এসে দেখে, সত্যিই তাই। মেজর ইকবালের অধীন যে সেনাদলটি পাহারায় ছিলো, পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মধ্যরাতের খানিক পরেই তারা বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখে চলে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। শুরু হয়ে গেছে পালটা অভ্যুত্থান। কারা শুরু করেছে এই প্রতিবিপ্লব, রশিদ এখনো তা জানে না। তবে সে অনুধাবন করে, ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লার হেলান বঙ্গভবন থেকে হয়তো সরে যাচ্ছে সেনানিবাসের দিকে।
ঘুমন্ত ফারুককে ডেকে তোলে রশিদ। শেখ মুজিব হত্যার পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া দুই লেফট্যানেন্ট কর্নেল চটজলদি আলোচনায় বসে যায় খন্দকার মোশতাককে নিয়ে। কী করণীয় তাদের, ঠিক করতে চেষ্টা করে সবাই বসে।
ফারুকের অধীনস্থ ট্যাঙ্কগুলো তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বঙ্গভবন, ক্যান্টনমেন্ট আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেগুলোকে প্রস্তুত করে ফেলে ফারুক। রশিদও নিজের অধীন কামানগুলোকে আক্রমণাত্বক ভঙ্গিতে প্রস্তুত করে রাখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর ক্যান্টনমেন্টে। একই সাথে, মোশতাক আর রশিদ ফোন ঘোরাতে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। হদিস পেতে চায় বিপরীত অভ্যুথানটির ব্যপ্তি আর উদ্দেশ্য সম্পর্কে, প্রস্তুত করতে চায় হাতের সকল তাসকে, পেতে চায় সাহায্য।
তাদের মনে ভাবনা আসে, এ অভ্যুত্থান কি আওয়ামী লীগের স্বপক্ষের কারো? সেনাবাহিনীর কারো সাথে আঁতাত করে কি পুনরায় ক্ষমতায় চলে আসতে চাইছে শেখ মুজিবের কোনো অনুসারী ? মুজিবের মৃত্যুর পর কাদের সিদ্দিকী চেয়েছিলেন হত্যাকারীদের বিপক্ষে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতে, কিন্তু সেনাবাহিনী দিয়ে বল প্রয়োগ করে তাকে তো ইতোমধ্যেই দমন করা হয়েছে !
... ভাবতে থাকেন মোশতাক, ভাবতে থাকে রশিদ। এবং তারা অনুধাবন করে, শেখ মুজিবের অনুসারী কেউ ক্ষমতায় পুনরায় আসীন হতে চাইলে প্রথমেই চাইবে জাতীয় চার নেতাকে জেল থেকে মুক্ত করতে। অতএব কারাগারের সেই চার রাজবন্দী অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন সে মুহুর্তে। রশিদ ফোন করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের আইজি নুরুজ্জামানকে।
আইজি প্রিজন গভীর রাতে ফোন পেয়ে রশিদের কন্ঠে শোনেন, ‘এই মুহূর্তে আপনার জেলে কোনো সমস্যা আছে নাকি ?’
‘না, স্যার ! মানে এই মুহুর্তের কোনো খবর স্যার আমার জানা নাই।’ হতচকিত নুরুজ্জামান বলেন।
‘আপনি এখুনি জেল গেটের গার্ডদের অ্যালার্ট করে দেন।’ আদেশ দেয় রশিদ। ‘আর্মির কিছু লোক জেল গেটে যাইতে পারে। আপনারা সতর্ক থাকেন।’
ওদিকে খন্দকার মোশতাক ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে গেছেন। তিনি ফোন করে বসেন ওসমানীকে, তাকে অনুরোধ করেন দ্রুত বঙ্গভবনে চলে আসতে। মোশতাকের ফোন পাবার পরে সচল হয়ে ওঠে জেনারেল ওসমানীর টেলিফোনের ডায়ালিং ডিস্কটিও। ওসমানী নিজেও নানা জায়গায় ফোন ঘোরান। জানতে পারেন, চীফ অফ জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের হাতেই রয়েছে চলমান ঘটনাবলীর নাটাই।
চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসারের দপ্তর ততোক্ষণে পরিণত হয়েছে খালেদ মোশাররফের প্রতি-বিপ্লবের হেডকোয়ার্টারে। শাফায়াত জামিল, নুরুজ্জামান সহ আরো কিছু অফিসার সাথে আছেন তার।
অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে ঘন্টা দুয়েক আগেই তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ একদল সেনাকে সাথে করে চলে গেছেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাড়ি। রাতের পোশাকে জিয়াকে দেখা যায় অপ্রস্তুত অবস্থায়, হাফিজউল্লাহ তাকে বলে, ‘স্যার, আপনি এখন গৃহবন্দী।’
কোনো আপত্তি না করে চুপচাপ এই আদেশ মেনে নেন জিয়াউর রহমান। ফারুক-রশিদ আর মোশতাকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্যে কেটে দেয়া হয় জিয়ার ফোনের লাইন। তবে, অক্ষত থেকে যায় জিয়ার বেডরুমের এক্সটেনশন লাইনটি। ভবিষ্যতের বহু নাটকের জন্ম হবে সেই এক্সটেনশন লাইন দিয়েই।
আপাতত সেনাপ্রধানকে অচল করে দেয়া হয়েছে নির্বিঘ্নে, খালেদ এবার প্রস্তুত হন বঙ্গভবনের বিদ্রোহীদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে। সোনারগাঁ হোটেলের ক্রসিং, সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পাঠানো হয় দুই কোম্পানি সেনা। বিমানবন্দরের রানওয়ে, টিভি আর রেডিও স্টেশনেও সেনা পাঠানো হয়।
বঙ্গভবনে অবস্থান করা খন্দকার মোশতাক আর রশিদেরা ততোক্ষণে জেনে গেছেন রাতের এই অভ্যুত্থানের পেছনে কারা আছেন। খালেদ মোশাররফ আপাতত মঞ্চের প্রধান নট, এটা জেনে স্বস্তিতে থাকতে পারেন না মোশতাক। আর যাই হোক, আওয়ামী লীগের পুনরুথান ঘটতে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের পথে হাঁটতে থাকা মোশতাক হিসেব কষে দেখেন, শেখ মুজিবের অনুসারী চার নেতাকে সরিয়ে দিলেই আওয়ামী লীগের মূল উৎপাটন হয়ে যায় অনেকটা।
চার নেতা যখন একটি নড়বড়ে মঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে ভিত গেড়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের, সেই মুহুর্তে তাদের সঙ্গী ছিলেন মোশতাক। শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনে ঐ চারজন আলোকিত মানুষ যখন আবেগমথিত হয়ে কাঁদছিলেন অঝোরে, সেখানেও তাদের সঙ্গী ছিলেন মোশতাক। সেই মোশতাক এই মুহুর্তে মেজর রশিদকে সাথে করে পুরোনো সাথীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন আরো একটি বার। এবং এইবার কোনো ক্ষমতাপ্রাপ্তি বা কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা নয়, পলিটিশিয়ান মোশতাকের লক্ষ্য থাকে ঐ চার নেতার প্রাণ।
নির্দেশ পেয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে রওয়ানা হয়ে যায় ক্যাপ্টেন রিসালদার মোসলেমউদ্দীন, তার সাথে থাকে সশস্ত্র একদল সৈন্য।
শীতের মধ্যরাতের ঢাকা প্রত্যক্ষ করতে থাকে আরো একটি নাটক। রক্তপাতহীন এক প্রতি-অভ্যুত্থান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ খালেদ মোশাররফ যে আখ্যান শুরু করেছেন, নীচতম কূটবুদ্ধিতে সে আখ্যানের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় রক্তের দাগের আয়োজন করেন মোশতাক। বাংলাদেশ প্রস্তুত হতে থাকে কালো আচকানের একটি মানুষের ঢেলে দেয়া লাল কালির স্রোতে চারটি শুদ্ধতম নাম মুছে দেবার জন্যে।
মন্তব্য
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছিলাম দীর্ঘদিন। সম্প্রতি শেষ হয়েছে সেই লেখাটি, ইচ্ছে আছে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় দুই মলাটের মাঝে এটাকে প্রকাশ করার।
সচলের পাঠকদের লেখার কিছু অংশ তুলে দিলাম। অসংলগ্ন মনে হলে দুঃখিত।
দারুণ, অপেক্ষায় থাকলাম! সুহান ভাই।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অসাধারণ টিজার হয়েছে সুহান। বইটার অপেক্ষায় থাকলাম।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অপেক্ষায় আছি
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
অপেক্ষায় --
facebook
দারুণ সুহান ! এইবার বইমেলার সময় দেশে যাবার আশা রাখি -- বইমেলা থেকে বই কিনে তাতে তোমার অটোগ্রাফ নেয়ার অপেক্ষায় রইলাম। এবং আমি জানি এটি একটি মাস্টারপিস হতে যাচ্ছে! অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে অনেক ধন্যবাদ এ কাজটি করার জন্য।
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
অপেক্ষায় রইলাম
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আরেকটু বড় হলে ক্ষতি কি ছিল?
বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
অপেক্ষায় থাকছি, সুহান। অনেক শুভকামনা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
শুভকামনা সুহান ভাই, বইয়ের অপেক্ষায় থাকলাম :)।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
অসাধারন । বই এর পথ চেয়ে থাকলাম ।
অফ টপিক ঃ মোস্তাকের কবরটা কোথায় জানা আছে কি ? থুতু দিয়ে আসতাম ।
==========
দস্যু ঘচাং ফু
অসাধারন। বইটির অপেক্ষায় থাকবো। শুভ কামনা রইল।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
শুভকামনা রইল।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
অপেক্ষায় থাকলাম। অনেক শুভকামনা।
----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন
বিষয়বস্তু অসাধারণ! শুভকামনা ।
শুভকামনা রইলো তোর জন্যে। ৭৫ এর ঐ ধূসর সময়টাকে আলো দিয়ে দেখলেও ঝাপসা ই থাকে। তোর লেখা সেই ঝাপসাভাব কমাবে বলে আশা রাখি। এও আশা থাকল যে তোর বই য়ের চরিত্রেরা মেরিট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
অভিনন্দন!
গত কয়েকবছর ধরেই তোমার এই বইটির অপেক্ষায় আছি। শেষ হয়েছ জেনে খুব ভালো লাগলো।
কোন প্রকাশণী থেকে বেরুচ্ছে? পৃষ্ঠা সংখ্যা কত?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ট্রেইলার মারাত্মক!!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
সবাইকে শুভকামনার জন্যে, মন্তব্যের জন্যে- অনেক অনেক ধন্যবাদ। যেখানে থাকি, সেখানে মোবাইল ছাড়া ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়মিত না। উত্তর দিতে তাই দেরী হলো।
স্পর্শ ভাই, কিছুই ঠিক হয় নি। হলে আপনাদের অবশ্যই জানাবো
নতুন মন্তব্য করুন