এলোমেলো কোঁকড়া চুলে চিরুনি চালানো শেষ করে নূর হোসেন এবার তার গায়ের চাদরটা খানিক আলগা করে,‘এরশাদরে এইবার যাইতেই হইবো!’
পাশে থাকা সুমন মিয়াঁও খুব উত্তেজিত। ‘লাখে লাখে লোক আইতাছে! পল্টন তো পুরা ভইর্যা গ্যাছে! মিনিমাম এক-দুই লাখ তো হইবোই, না ওস্তাদ?’
সুমনের প্রাক্কলন নিয়ে নূর হোসেনের এখন আগ্রহ নাই। লোকজনকে ঠেলে বা কনুই মেরে সে আরো সামনে আগায়। মিছিলের একদম সামনে যাওয়া দরকার। আউজকা মিছিল লিড দিতে হইবো।
রাস্তার দুপাশে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন কিছু সমাবেশ। সেখানে বক্তৃতা দিচ্ছে মাঝারি সারির রাজনীতিক বা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রনেতারা। পরিস্থিতির ওপর বক্তারা নানা দিক থেকে আলো ফেলে। ‘…ভাইসব, আমাদের আজকের কর্মসূচী আপনারা জানেন। সবাই জানে। আমরা, দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধির মানুষেরা, আমরা এক হয়েছি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতন চাই বলে। আজ আমাদের অবরোধ। অবরোধ মানে কী? মানে সরকারকে অচল করে দেওয়া!’
অবরোধের সঠিক অর্থ বাতলানোর কৃতিত্বে বক্তার গলার স্বর উঁচু হলে পরে সেই উত্তেজনার সাথে তাল মেলাতে হ্যান্ডমাইকটারও কষ্ট হয়। কিন্তু, পরিস্থিতির ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক হালচাল না জানানো পর্যন্ত বক্তার থামার কোনো ইচ্ছা নাই। সবাই জানে যে সরকার বিরোধী এসব আন্দোলন বন্ধ করতে এরশাদ জরুরী অবস্থা জারি করেছে। কিন্তু অ্যাতো করেও সে মানুষকে থামাতে পারলো কই? সকাল থেকেই তো সমস্ত দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল করে পল্টনে আসছে। একের পর এক মিছিলে রাজপথ টালমাটাল। অন্যদিকে দুই পক্ষকে একেবারে মুখোমুখি করে দিয়ে সরকার রাস্তায় পুলিশ, বিডিআর আর আনসার বাহিনী নামিয়ে দিয়েছে। সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের উপস্থিতি আজকে বাধ্যতামূলক। বক্তা নিজে দেখেছে, অনেক লোকজন চাকরি বাঁচাতে কাল রাতেই সচিবালয়ে চলে এসেছে, সেখানে তারা টেবিলের ওপর মশারি টানিয়ে মাথায় ফাইল দিয়ে ঘুমিয়েছে পর্যন্ত।
পড়াশোনা করা বিদ্বান মানুষজনের এসব বক্তব্য নূর হোসেন অন্য দিন মনোযোগ দিয়ে শোনে। তবে আজকে ফাইল মাথায় দিয়ে সরকারি অফিসারদের ঘুমানোর ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই, আজ সে খুব উত্তেজিত। খালি এসব বড় বড় বক্তৃতাতেই কি এরশাদ নেমে যাবে? গায়ের চাদর খুলে ফেলে নূর হোসেন তাই মিছিলের সামনে এগোয়, তার পিঠে গণতন্ত্রের মুক্তির বাসনা, বুকের স্লোগান উঠে আসে গলাতেও।‘স্বৈরাচার, স্বৈরাচার- নিপাত যাক, নিপাত যাক!’
সকাল থেকে স্লোগান দেয়া মিছিলগুলো কিছুটা ঝিমিয়ে গেছিলো, নূর হোসেনের অভিনব প্রতিবাদে তা নতুন করে প্রাণ পায়। সমবেত সমস্ত মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে এই ঘোরগ্রস্ত যুবকটিকে দেখে। হালকা গোঁফ-দাড়ির মুখের সাথে মাতাল চোখজোড়া, পায়ে কেডস, জিন্সের প্যান্ট, গায়ের চাদর কোমরে প্যাঁচ দিয়ে বাধা। ছেলেটি জোরে জোরে স্লোগান দেয়, কখনো ঘুরে ঘুরে মাথার ওপরে দু হাত তুলে তালি বাজায়, তার অনিয়মিত নাচের মুদ্রায় এলোমেলো হয়ে যায় রাজপথ। নানা ধরনের প্রশংসাসূচক বাক্য উচ্চারণ করতে করতে তাই পথ ছেড়ে দেয় সকলে। শ্রমজীবী মানুষ, সচেতন ছাত্র বা দেশদরদী রাজনীতিক, সবার চোখেই খেলা করে আশা, অবিশ্বাস আর ঈর্ষা । নূর হোসেনের ওইটুকু বুক হঠাৎ করেই হয়ে দাঁড়ায় সকলের ইশতেহার। ওস্তাদের প্রতি সবার সমীহ মেশানো এসব চাউনি লক্ষ করে সুমন মিয়াঁর আত্মবিশ্বাস এবং উত্তেজনা বাড়ে।‘সাইড দ্যান, সাইড দ্যান! দেখি, ওস্তাদরে যাইতে দ্যান। আরে ভাই সরেন না ক্যালা!’
বুক-পিঠে স্লোগান নিয়ে মানুষ থেকে পোস্টার হয়ে নূর হোসেন তখন গলা ফাটায়,‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি?’
মিছিল ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে আবদুল গণি রোডে, কারণ জায়গা করে দিতে হয় পল্টনের দিক থেকে ফিরে আসা আরো একটি জনস্রোতকে। তোপখানা মোড়ে নাকি পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়েছে, ওদিক দিয়ে বেরোনো যাচ্ছে না। অস্ত্র হাতে টহল দেয়া পুলিশ বাহিনী ওদিকে কী করে মিছিলের সদস্যদের উস্কানি দিচ্ছে, পল্টন ফেরতা এক পরিচিত বাস চালক সুমন মিঁয়াকে তার একনিষ্ঠ বর্ণনা দিতে গিয়ে জানায়,‘খানকির পোলারা ইটা মারতাছে!’
নূর হোসেনের রাগটা এবার আর শুধু স্বৈরাচারে কেন্দ্রীভূত থাকে না, গত সপ্তাহে দেয়া দেড়শো টাকা চান্দার শোকে পুলিশের ওপর ক্ষোভটা বেশ সহজেই জমে। ঘটনাটা মনে পড়ায় রাগের চোটে তার উচ্চকিত স্লোগান পর্যন্ত থেমে যায়। ঠোলার বাচ্চাগুলান বেশি বাইড়া গ্যাছে!
তা ঘটনাটা কী? নাহ, বাপের হালায় সেদিন শরীরটা বেশ খারাপ, নূর হোসেনেরও কোনো খ্যাপ নাই। তো বাপ মজিবুর রহমানের পরামর্শে নূর হোসেন গেলো মহাজনের কাছে। টাকার ব্যাপারে মহাজন আস্ত ছোটোলোক হলেও এমনিতে মানুষ সে খারাপ নয়, মজিবুর রহমান তার বেবিট্যাক্সি চালায় আজ বিশ বচ্ছরের ঊপরে, নূর হোসেনকে বেবিট্যাক্সি দিতে তার তাই আটকায় না। তা মহাজনের কাছে গিয়ে নগদ একশো পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে নূর হোসেন একটা বেবিট্যাক্সি নিলো। ইচ্ছা ছিলো এক বেলা চালিয়েই সন্ধ্যায় ফিল্ম দেখবে। চিত্রায় নাকি ইলিয়াস কাঞ্চন আর সুচরিতার খুব অ্যাকশান একটা ছবি চলছে, সাথে চার্লি হিসাবে দিলদার। কিন্তু শালার কপালটাই খারাপ, পাঁচটা ট্রিপ মারার পরেই শান্তিনগরের সামনে এক ঠোলা নূর হোসেনের সমস্ত ফুরফুরে মেজাজটা ঝন ঝন করে ভেঙে ফেললো। বাপের নামে করা লাইসেন্স দেখিয়েও সার্জেন্টটাকে বোঝানো যায় না। নূর হোসেন তাই ছাড়া পায় গুণে গুণে দেড়শো টাকা দেয়ার পরেই। সেই থেকে শালার রাস্তাঘাটে নীল উর্দি দেখলেই তার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। স্টেডিয়ামে গিয়ে আবাহনীর তিন পয়েন্ট পাওয়া দেখেও মাথাটা তার ঠাণ্ডা হয়নি, ডাইলপট্টির কাছে ভি দুইটা গোল খাইলো- এই খেলা দিয়া মোহামেডানরে হারায় ক্যামতে!
রহমতগঞ্জের কাছে দুই গোল খাওয়ার শোকে এবং পুলিশ সার্জেন্টের প্রতি জিঘাংসায় নূর হোসেন এখন ছটফট করে। এই ছটফটানি অনূদিত হয় তার হাতের আঙুলে, মিনিবাস আর বেবিট্যাক্সি চালনায় পোক্ত সেই হাতজোড়া দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে দেশের রাজাকে খ্যাপায়,‘এরশাদ, তুই কবে যাবি?’
সমবেত অজস্র মানুষের মাঝে এই জিজ্ঞাসার উত্তর কে জানে? কেউ না। ফলে তাদের আক্রোশ আর দ্রোহ সদর্পে ঘুরে বেড়ায় আবদুল গণি রোডের সারাটা শরীর জুড়ে। এই সড়কটিকে গ্রাস করা হয়ে গেলেও মিছিলের ক্ষুধা মেটে না, মসৃণ একটা অজগরের মতো পিচ্ছিল সরীসৃপ হয়ে সে বেঁকে যায় তোপখানা রোড বরাবর, সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে বেরিয়ে আসে প্রেসক্লাবের সামনে।
তোপখানা রোডে ঢুকতেই অবশ্য পরিচিত একটা মুখ দেখা যায়। ছাই রঙের একটি পিঠ খোলা জিপ চলছে ধীর গতিতে, তাতে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর জিপগাড়ির সামনে-পেছনে-চতুর্পাশে তো বটেই, এমন কী বডি ধরেও দোল খাচ্ছে পার্টির প্রচুর ছেলেপেলে। শেখ হাসিনা নিজেও স্লোগান দেয়ায় কারো চাইতে পিছিয়ে নেই। মাঝে মাঝে স্লোগান থামিয়ে দুয়েকটা নির্দেশ বা বক্তব্য যা-ই দিন না কেনো, চতুর্পাশের মিছিল সেটিকে বিবর্ধিত করে দিচ্ছে আরো কয়েকগুণ।
এসব দৃশ্য দেখে নূর হোসেন নিজেই বেশ উজ্জীবিত হয়ে পড়ে এবং শেখ হাসিনার দিকে এগোতে চায়। কিন্তু আপার কাছে যাওয়াটা খুব মুশকিল, চলন্ত জিপের ওপর শেখ হাসিনার স্লোগানদীপ্ত ভঙ্গিমা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে প্রতিবাদী কর্মীদের দারুণ অ্যাকশন ছবি তুলতে একগাদা সাংবাদিক দারুণ ব্যস্ত। এদের ঠেলে নূর হোসেন এখন কী করে সামনে যায়? উত্তেজনায় নগর আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক ছটফট করতে থাকে।
কিন্তু বিচিত্র এই মানুষ পোস্টার কী করে শেখের বেটির চোখ এড়াবে? একটি আদুল গায়ের যুবক, কখনো হরিণের লাফে কখনো জাগুয়ারের ক্ষিপ্রতায় সে একটি বিশাল মিছিলকে মাতাচ্ছে স্লোগানে স্লোগানে, পুলিশ-আনসারে ভরপুর ঢাকার রাজপথে আজকের দিনে এই দৃশ্য অবিশ্বাস্য না লেগে পারে না। শেখ হাসিনা তাই হাত তুলে নূর হোসেনকে কাছে ডেকে নিজের শঙ্কা প্রকাশ করেন,‘কী পাগলামি করতোছো? শিগগির জামা গায়ে দাও। … আরে গায়ে এইসব লেখা দেখলে পুলিশ তো গুলি করবে!’
নেত্রীর পায়ে ধরে সালাম করার সুযোগ পেয়েই নূর হোসেন ধন্য, উপরি হিসেবে স্নেহ মেশানো এই উদ্বেগের স্পর্শে সে একেবারে নুয়ে পড়ে।’আপা, দোয়া কইরা দ্যান। গণতন্ত্র আনতে আজকে জান দিয়া দিমু!’
জীবন উৎসর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নূর হোসেন বেশ হালকা বোধ করে। কিন্তু এই নিয়ে দীর্ঘসময় আলোচনা করার সময় শেখ হাসিনার নাই, ছাই রঙা জিপ ধীরগতিতে সামনে আগায়। চতুর্দিকে কর্মী পরিবেষ্টিত সেই গাড়িটির অপসারণ দেখতে দেখতে নূর হোসেন আবেগে এলোমেলো হয়ে পড়ে। সত্যিই তাহলে সে আপার পায়ে ধরে সালাম করলো, অ্যাঁ? নাহ- আজকে আর ছাড়াছাড়ি নাই, আন্দোলন সফল করে স্বৈরাচারকে এবার সরিয়ে ফেলতেই হবে। আবেগ বাদ দিয়ে কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত হবার জন্য নূর হোসেন এখন প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। ‘এরশাদের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে!’
মিছিল বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলে পল্টনের দিকে। পদযাত্রার ধ্বনির সাথে সমানে চলে নূর হোসেনের কানের পাশে সুমন মিয়াঁর ধারাভাষ্য, ‘ওস্তাদ, খালেদা জিয়া ভি আইছে! বাইতুল মাকারামের উত্তর দিকের গেইটে খাড়াইছে নাকি পুলাপান নিয়া।’ অথবা ‘সাম্বাদিকে আপনের ছবি তুলছে ওস্তাদ? তাইলে কাউলকা প্যাপারে আয়া পড়বো, না?’
তা, নূর হোসেনের এদিকে কান দেয়ার সময় কোথায়? সুমন মিয়াঁর জিজ্ঞাসা বা তথ্যপ্রদানের ব্যাকগ্রাউন্ডে সমানে চলছে ক্রমেই আকারে বড় হতে থাকা মিছিলের গুঞ্জন। ডানে থেকে মিছিল আসে, বাঁয়ে থেকে মিছিল আসে। নবাবপুরের ওয়েল্ডিং মেশিনে কাজ করা যুবক, বংশালের সাইকেল মেকানিক, নীলক্ষেতের দিক থেকে আসা চশমা পড়া শিক্ষিত ছাত্র, ধানমন্ডিতে অফিস করা সাদাটে রঙের পুরুষ - সবাই আজকে জুটেছে মিছিলে। সমন্বিতভাবে এরা নূর হোসেনের মিনিবাসের অ্যাক্সিলারেটরে একটি নিরেট লাথি দেয়। নূর হোসেন আজ কাউকে সাইড দেবে না, কোনো শালার সাধ্য নাই আজকে তাকে ওভারটেক করে। কিন্তু সামনে ওটা কি? আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়, জনস্রোতকে বাঁধ দিয়ে আটকাবে বলে নীল উর্দির দল ব্যারিকেড দিয়েছে। পুলিশ বাহিনী বন্দুক হাতে এদিকে-ওদিক পায়চারি করে। তাদের কারো হাতে চারকোণা ঢাল, কারো মাথায় হেলমেট। মিছিল থামিয়ে দেবার এই আয়োজন দেখে মহানগরীর মিনিবাস চালক সমিতির সক্রিয় সদস্য নূর হোসেনের রাগ হয়। ব্যাটারা কি কিছুতেই তার ছুটন্ত মিনিবাসকে গণতন্ত্রের লক্ষ্যে পৌঁছোতে দেবে না? নূর হোসেনের বাপ যে এই ঠোলার দলকে ‘রাক্ষস’ বলে ডাকে, তা কি কেবল ঘুষের টাকার শোক ঢাকতে?
ঘরের কথা মনে হতেই নূর হোসেন কুঁকড়ে যায়। বাপকে নিয়ে তার ঝামেলা নাই। সপ্তাহের সাতদিনই লোকটা ট্যাক্সি চালানোতে ব্যস্ত, ছেলেদের সাথে কথাবার্তা বলার সময়টা তার ঠিক হয়ে ওঠে না। আর উপার্জন করা ছেলে, সে পলিটিক্স নিয়ে লাফালাফি করলে বাপে আর বলবে কী? নুর হোসেন ডেইলি কমসে কম সত্তরটা টাকা মায়ের হাতে দেয়। নাহ, বেবিট্যাক্সি চালানো পিতা নূর হোসেনকে বেশি ডিস্টাপ দেয় না। তয় মায়েরে নিয়া হইছে মুশকিল, খুব দিগদারি করে। বনগ্রামের ওইটুকু ঘুপচি গলিতে থেকেও মহিলা কী করে মাতৃস্নেহতে টলটল করে, নূর হোসেন তা কিছুতেই বুঝে ওঠে না।
আজকের মিছিলের ব্যাপারটাই দ্যাখো। মরিয়ম বিবির কথা শুনবার হুজ্জত থেকে রক্ষা পেতে বুক-পিঠে এইসব লেখা নিয়ে নূর হোসেন কাল রাতে বাসাতেই গেলো না। ঘুমালো নির্মাণাধীন ডিআইটি মসজিদের দোতলায়। কিন্তু মায়ে যে কী করে! মহিলা ফজরের নামায পড়া শেষ করেই স্বামীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নূর হোসেনকে খুঁজতে লেগে গেলো। তারপর লোকের মুখে ছেলের সন্ধান পেয়ে ভোররাতে মসজিদের নিচে এসে নাম ধরে সে কী ডাকাডাকি! এদের যন্ত্রণায় আরামের ঘুমটা শেষ করে নূর হোসেন নিচে নামতে বাধ্য হলো। অবশ্য নামার আগে সে গায়ের লেখাগুলি চাদরে ঢেকে নিয়েছে, মায়ের চোখে পড়লে মহিলা তার মিছিলে যাওয়ায় গ্যাঞ্জাম লাগাতে পারে।
দেখা গেলো তার ধারণা যথার্থ, কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম বিবি বলে,‘বাপ রে, বাড়িত চল! আইজকা নাকি গোলাগুলি হইবো, তুই আইজ মিছিলে যাইস না বাবা। আমগো লগে বাড়ি চল।’
নূর হোসেন অবশ্য মায়ের এই অনুরোধ মানতে নারাজ। ভয় পেয়ে কী লাভ? মিছিলে তাকে আজ যেতেই হবে। তবে সে যে মিছিলের পেছনের দিকেই থাকবে এবং কোনোভাবেই ঝামেলার মধ্যে যাবে না, বাপ-মাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে নূর হোসেনের কোনো আপত্তি নাই। তা, জবান নূর হোসেন যতই দিক, বাপ-মা কি আর অ্যাতো সহজে হার মানতে চায়? আস্ত দুইটা আপেল চিবিয়ে শেষ করে ফেলার পরেও এদের কান্নাভেজা অনুরোধ থামে না। শেষটায় নূর হোসেন দুজনকে একেবারে জোর করেই নিয়ে গেলো গুলিস্তানের কামান পর্যন্ত। জোর করে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে তবে ছাড়া পাওয়া গেলো।
মরিয়ম বিবি কি এখনো গুলিস্তানের কামানের ওপাশে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে? এই উজ্জ্বল রোদেও মাতৃপ্রেমে নূর হোসেনের সারাদেহ আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গুলিস্তান এখনো অনেক দূর। আবার সামনে কয়েকশো গজ দূরেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেয়া আনসার আর পুলিশের দল। খানিক আগে বিআরটিসির ট্রাকে চেপে বোধহয় এই শালারাই এসেছে। আসুক, নূর হোসেন এখন মরিয়া। তার এখন ম্যালা দায়িত্ব। ঢাকা তো ঢাকা, সারা দেশ থেকে মানুষ এসে আজকে যোগ দিয়েছে স্বৈরাচার-বিরোধী মিছিলে। তার মিনিবাস এসব লোকে ভর্তি হয়ে আছে কানায় কানায়- এদের গন্তব্যে নামিয়ে দেয়ার আগে নূর হোসেনের মুক্তি নাই। সামান্য গতি না কমিয়ে নূর হোসেন তাই ছোটে ব্যারিকেড বরাবর। গণতন্ত্রের স্টপেজে পৌঁছার আগে এই বাস আর থামবে না।
তবে হঠাৎ করে কোমরের কাছে পেটের ডানপাশে শক্ত একটা আঘাত লাগলে বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারায়।
নূর হোসেন প্রথমটায় কিছু বুঝতেই পারে না। রাস্তা তো পুরো ফাঁকা, অন্ততঃ আরো আধা মিনিট নিরুপদ্রবে টানা যেতো। এমন খালি রাস্তায় এক্সিডেন করার লোক তো নূর হোসেন নয়! শালার টাংকি ফুটা হয়ে গেলো নাকি? সেটাই হবে, গলগল করে ফুয়েল সব বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়, বডিটাও কেমন হালকা হালকা লাগছে! নাহ, অ্যাতো ঝামেলা করে গাড়ি চালানো যায়? আর এদিকে দ্যাখো, প্যাসেঞ্জারগুলাও ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করেছে বাসের মাঝে! নূর হোসেন চিৎকার করে, ‘আরে খাড়ান! দৌড়ায়া যান কই? বাসের কিছু হয় নাইক্যা। অহনি স্টার্ট মারুম আবার। … ওই সুমইন্যা! সুমইন্যা! আবে চোপাখান অফ কইর্যা দ্যাক ডাইনপাশে কী লাগলো!’
কিন্তু সুমন মিঁয়া ও যাত্রীদের প্রতি এই আহবান ঠিক স্পষ্ট হয় না। কেবল শব্দ বাড়তে থাকে। ফুয়েল ট্যাংক ফুটো হয়ে যাওয়া ইঞ্জিনের গোঙ্গানি ক্রমশ সিনেমায় দেখা গুলির আওয়াজে রুপ নেয়। সাথে অবশ্য বেশ ঠাণ্ডাও লাগে। কোমরের কাছে জড়ানো চাদরটাকেও এই কাজের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। ওটা আবার কোথায় গেলো? নাহ, আজ সকালে কিন্তু এই চাদরখানা না থাকলে মায়ের কাছে সব ফাঁস হয়ে পড়তো। মরিয়ম বিবি অবশ্য বুকে-পিঠে ঠিকই কীসব লেখার অস্তিত্ব টের পেয়েছে। কিন্তু নূর হোসেন কি বোকা? সে পষ্ট গলায় জানিয়ে দিয়েছে যে আগামীকাল বড় খেলা, এসব লেখা আবাহনীর প্রতি তার ভালোবাসার নিবেদন।
আবাহনীর পরের খেলার তারিখ মনে করতে গিয়ে নূর হোসেন এখন প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। তবে চারপাশের এলোমেলো শব্দে কিছুই মনে পড়ে না, বরং অপরাধবোধ হয়। শালার এতোগুলা প্যাসেঞ্জার ভরসা করে তার গাড়িতে উঠেছে, আর সে কি না আজই ফাঁকা রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে বসে গেলো? নিজের প্রতি বিরক্তিতে নূর হোসেনের মুখ কুঁচকায়। পেছনের উদ্ভ্রান্ত যাত্রীদের চিৎকার আর অসহিষ্ণুতায় সেই বিরক্তি রুপ নেয় রাগে। যাত্রীদল, ট্রাফিক সার্জেন্ট ও রাস্তাঘাটের ওপর রাগ তো হয়ই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে রাগ জমে পুলিশের প্রতি। তরা অ্যাতো ফাল পারোস ক্যা? রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়া তরা কি নূর হোসেনের বালটা ছিঁড়তে পারবি?
এরশাদের ভাতার পুলিশ বাহিনির প্রতি ক্ষোভে নূর হোসেনের সারা গা তড়পায়। জুরাইন গোরস্তানে রাত তিনটার সময় গোপনে কবর দেয়ার মুহুর্তটিতেও তার মুখ থেকে সেই ক্ষোভের চিহ্ন মুছে যায় নাই।
মন্তব্য
আহা!! ঝরঝরে!!
ঘুমানোর আগে পড়লাম; ঝরঝরে ভাল লাগা নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছি।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ পড়েছেন বলে।
নূর হোসেন এর জন্য শ্রদ্ধা। লেখা ভাল হয়েছে।
অনন্যা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
আনেক দিন পরে লিখলেন সুহান। ভালো লাগলো লেখা।
হাঁ, অনেক দিন পর ব্লগে লেখা হলো।
ধন্যবাদ
অন্য অনেকের তুলনায় ভালো লিখেছেন। তবে নিজের তুলনায় নয়। পাঠক হিসেবে এটা আমার মূল্যায়ন। আশা করি সম্পাদনার সুযোগ এখনো রয়েছে। "পুলিশি জুলুম- বন্ধ করো, বন্ধ করো" যেন ষাটের দশকের কোন চলচিত্র থেকে নেওয়া শোনালো। ৯০ এ অনেক স্লোগান দিয়েছিলাম, কিন্তু এইটি দিয়েছি বলে তো মনে পড়েনা সুহান রিজওয়ান!
বিষয়টা তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই !
ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভালো লাগলো
আরও ভালো হওয়ার অনেকগুলো মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল
ধন্যবাদ পড়ার জন্য ভাই।
অনেকদিন পরে সুহানের লেখা দেখে লগইন করলাম। ট্যাগে 'উপন্যাস' দেখলাম। এটা কি নতুন প্রকল্প?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
নাহ, এইটা চলমান প্রকল্প
পড়ছেন দেখে থাঙ্কিউ
ইতিহাসকে উপন্যাসে ধরে রাখার এই প্রকল্পটিও সফল হোক সুহান। শুভকামনা!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ ভাইয়া
নতুন মন্তব্য করুন