সাইয়িদ কুতুবের যৌন অবদমন

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: বুধ, ০৭/১১/২০০৭ - ৯:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

small

৯/১১ যেদিন ঘটে, সেদিনই নিউ ইয়র্কার পত্রিকার সাংবাদিক লরেন্স রাইট (Lawrence Wright) তার সম্পাদককে জানিয়ে দেন যে তিনি এই ঘটনার পিছনের ঘটনা অনুসন্ধান করতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নামকরা সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে গত ৮০ বছর ধরে নিউ ইয়র্কার সুপ্রতিষ্ঠিত। নবোকভ, রথ আর আপডাইক থেকে শুরু করে মার্কিন সাহিত্যের তাবৎ রথী-মহারথীরা এর পাতায় লিখেছেন এবং আজও লিখছেন। সাহিত্যের পাশাপাশি পত্রিকার প্রামাণ্য রিপোর্টিং-এর ঐতিহ্যও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা বা সামাজিক ট্রেন্ড নিয়ে সুদীর্ঘ (এবং সুপাঠ্য) ইনভেস্টিগেটিভ প্রতিবেদন পত্রিকাটির একটি বিশেষ আকর্ষণ। যেই সম্পাদকের কাছে লরেন্স রাইট তার আরজি পেশ করেন, সেই সম্পাদক ডেভিড রেমনিক-ও নানাবিধ বিষয় নিয়ে বই-প্রবন্ধ লিখে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন - যেমন মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলির জীবনী অথবা বার্লিন ওয়াল পতনের পরে রুশ দেশের আনাচ-কানাচ ঘুরে সে দেশের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে লেখা রেমনিক-এর পুলিৎসার পুরস্কার বিজয়ী প্রামাণ্য গ্রন্থ লেনিনের সমাধি

রেমনিক তার রিপোর্টারের কথায় রাজী হয়ে যান, এবং পরবর্তী পাঁচ বছর লরেন্স রাইট আল কায়দার উৎসের সন্ধানে দুনিয়া চষে বেড়ান। মিশর, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নিজ দেশের সিআইএ-এফবিআই - সব জায়গায়ই গেছেন এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে। সময়ে সময়ে তার প্রবন্ধ বেরুতো পত্রিকার পাতায় - যেমন ওসামা'র ডান হাত মিশরীয় ডাক্তার আয়মান আল জাওয়াহিরির কাহিনী অথবা এফবিআই-এর জন ও'নীল-এর গল্প (যাকে এখন বলা হয় দ্য ম্যান হু নিউ - যে মানুষ জানতেন।)

পাঁচ বছরের সাধনা শেষে লরেন্স রাইট-এর গ্রন্থটি অবশেষে বেরিয়েছে - বইয়ের নাম দ্য লুমিং টাওয়ার (The Looming Tower: Al Qaeda's Road to 9/11)। এবং এক যুগ আগে যেমন রেমনিক তার রাশিয়া নিয়ে বইটি লিখে পুলিৎসার পেয়েছিলেন, তার শিষ্য রাইট-ও এই বছর দ্য লুমিং টাওয়ার-এর জন্যে একই পুরস্কার পেয়েছেন, নন-ফিকশন ক্যাটেগরিতে। এ ছাড়াও আরো সাতটি পুরস্কার পেয়েছে বইটি ইতিমধ্যে। চমৎকার লিখেন রাইট এবং কাহিনীটাও পড়ার মতো।

*

বইটি গতকাল কিনে প্রথম শ'খানেক পাতার মত পড়া হয়েছে। বইয়ের প্রথম দিকের অনেকাংশ জুড়ে আছে সাইয়িদ কুতুবের জীবন নিয়ে আলোচনা। মিশরীয় এই ভদ্রলোক সরকারী চাকরি করতেন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে, পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন বৃটিশ চামচা রাজা ফারুকের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখার কারনে সাইয়িদ কুতুব দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, এবং বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় আমেরিকা চলে যান দুই বছরের জন্যে। উদ্দেশ্য ফারুক সরকারের কোপানল থেকে দূরে থাকা আর একই সময় এডুকেশন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ - আমেরিকাতে কুতুবের এই দুই বছর তাকে পাশ্চাত্য আর আধুনিক সভ্যতার প্রতি প্রচন্ডভাবে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। নিজ দেশে ফিরে তিনি এই বিষয়ে প্রচুর বই-প্রবন্ধ লিখেন, এবং মিশরে ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলনের একজন পুরোধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার মৌলবাদী আন্দোলনের গতিরোধ করতে গিয়ে নতুন সামরিক শাসক জামাল আব্দেল নাসের-এর সাথে তার বারংবার টক্কর লাগে। ফলশ্রুতিতে কুতুব কারাগারে ছিলেন টানা এক দশক, এবং সেই সময়টায় তিনি আরো বই লেখেন - বিশেষত কোরানের তাফসীর ইত্যাদি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথে তিনি আবার নাসেরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, এবং এইবার উপায়ান্তর না দেখে নাসের তাকে ফাঁসি দেন।

সেটা ১৯৬৬ সালের কথা। পরবর্তীতে সাইয়িদ কুতুবের বিশ্বগ্রাসী মৌলবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ওসামা আর আয়মান জাওয়াহিরি থেকে শুরু করে হাজারে হাজার আরব যুবক নব্য খেলাফতের স্বপ্ন দেখে। আধুনিকতার যে ভিত্তি - যুক্তি ও অনুসন্ধান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, নারীস্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা, বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা - মোটামুটি সব কিছুকেই তারা উপড়ে ফেলতে চায়, কুতুবের ভাষায় পাশ্চাত্যের আরোপিত 'জাহেলিয়াত' ধ্বংস করে উম্মাহ'র জয়গান গাওয়ার বাসনা তারা পোষন করে।

*

কিন্তু সাইয়িদ কুতুবের মাথা কেন বিগড়ে গিয়েছিল? ৯/১১-র পরে তাকে নিয়ে কিছু লেখালেখি হয়েছিল, এর মধ্যে আল কায়দার ইন্টেলেকচুয়াল গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে নিয়ে রবার্ট আরউইনের প্রবন্ধটি স্মরণযোগ্য। কুতুব যে আমেরিকায় গিয়ে সে দেশের যৌনস্খলন দেখে ভড়কে গিয়েছিলেন, তার কিছুটা আরউইনের প্রতিবেদনে ছিল, কিন্তু রাইটের বই থেকে জানা গেলো যে কুতবের যৌন অবদমন তাকে মানসিকভাবে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল। সাইয়িদ কুতুব জীবনে বিয়ে করেননি। প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন যৌবনকালে দুয়েকবার। সাধারণ ভাষায় যাকে হ্যান্ডসাম বলে সেটা যে তিনি ছিলেন না, তার ছবি দেখলেই বোঝা যায়। আমেরিকাতে গিয়ে সেই দেশে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বিশেষ করে কলোরাডোতে যেই কলেজে তিনি পড়তে গিয়েছিলেন, সেই কলেজের ছাত্রীদের সনাতনী লজ্জাবোধের অভাব এবং তাদের নিঃসংকোচ উদ্দাম জীবনযাত্রা তাকে প্রচুর পীড়া দেয়। রাইট তার বইতে কুতুবের একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়েছেন - "A girl looks at you, appearing as if she were an enchanting nymph or an escaped mermaid, but as she approaches, you sense only the screaming instinct inside her, and you can smell her, and you can smell her burning body, not the scent of perfume but flesh, only flesh. Tasty flesh, truly, but flesh nonetheless."

বিস্ময়কর এক উক্তি। কামতাড়নায় কুতুব কিভাবে জ্বলছিলেন, এই কয়েক লাইন থেকে তা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তার পরিবারের দেওয়া সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, তিনি সারা জীবনে নারীসঙ্গ উপভোগ করেননি, তার মৃত্যু পর্যন্ত একবারও সেক্স করেননি। আর সেই অবদমন থেকেই তার মাথায় যে বিভ্রাট আর বিকৃতি, সেসব তার পাশ্চাত্য-বিরোধী মৌলবাদী চিন্তাচেতনায় বিরাট ভূমিকা পালন করে।

*

বাংলাদেশ থেকে বা পৃথিবীর অন্য যে কোন রক্ষণশীল সমাজ থেকে যেই ছেলেরা পাশ্চাত্যে এসেছে - বিশেষ করে অবিবাহিত - তাদেরই কুতুবের উপরের উক্তির মত কিছু চিন্তা-ভাবনা মাথায় এসেছে - এতটুকু বললে কি অত্যুক্তি হবে? ফ্লেশ, ওনলি ফ্লেশ। তবে শুধু বাইরে কেন, দেশের ভিতরেও যে অবদমিত কাম ও যৌন ঈর্ষা কি আকারে কাজ করে, তা রেপ স্ট্যাটিস্টিক্স দেখলে বা দেশের পত্রিকার পাতা খুললে টের পাওয়া যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে। মৌলবাদ প্রসারে যৌন অবদমন বা ঈর্ষার ভূমিকা কতখানি? রাস্তায় মেয়ে দেখে খেলনা পুতুলের মত মাদ্রাসার ছাত্রদের মাথা ঘুরে যাওয়া (অবশ্য এটা অন্য পুরুষদের বেলায়ও খাটে), কিংবা তাদের হুজুরদের দেওয়া খুতবা বা ওয়াজে বেপর্দা মেয়েদের অবাধ চলাচল নিয়ে অনবরত বিষোদগারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় যখন পাড়ার ওয়াজে যেতাম, হুজুরদের বেপর্দা মেয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা একটা অবসেশন-এর মত ঠেকতো।

আরো কথা মাথায় আসছে। যত দূর জানি, ইসলামে বিয়েকে দ্বীনের অর্ধেক, ফরজ কাজ হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। বিশেষ করে পুরুষদের জন্যে বিবাহিত জীবনের গুরুত্ব (তাদের যৌন প্রবৃত্তি একটা লিগ্যাল খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে) আর তার পাশাপাশি বিবাহের মধ্যে যৌনসঙ্গমের মাধুর্য্যের কথা বলা হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে সাইয়িদ কুতুবের মত সেক্সুয়ালি রিপ্রেস্‌ড্‌ চিরকুমার এবং তার বিকার-প্রসূত চিন্তা-ভাবনা কিভাবে এত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হলো? বেসিক্যালি, এই পার্ভাটের কথা এত লোক কেন মানে? অবশ্য কুতুবের গুরুত্ব বাংলাদেশের মৌলবাদে (তথা জামাত-শিবির গং) কতখানি সে বিষয়ে জানা নেই - যা জানি, তারা পাকিস্তানী মোল্লা মাওদুদীর চিন্তা-চেতনা দ্বারাই বেশী উদবুদ্ধ। (সেই লোকও আরেক হিপোক্রিট - সারা জীবন ইসলামী শাসন ব্যবস্থা নিয়া লেখালেখি কইরা শেষ বয়সে চিকিৎসা করতে যায় আমেরিকাতে, এবং খোদ 'শয়তানের দেশেই' সে মারা যায়। মাওদুদীর জানাজাও হইছিলো নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরে। সৃষ্টিকর্তার ভালো সেন্স অফ হিউমার আছে বইলাই মনে হয়!)

P.S. মনে পড়লো যে ওসামার সৃষ্টিতে আমেরিকার ভূমিকাও ছিল বিরাট - রুশ-আফগান যুদ্ধের সময়ে। সেইটা নিয়া রাইটের কি বক্তব্য, ততদূর এখনো যাই নাই। বোনাস লিঙ্ক - দ্য ম্যান হু নিউ, জন ও'নীল-রে নিয়া একটা ভিডিও ডকুমেন্টারি, পিবিএস চ্যানেলের ফ্রন্টলাইন অনুষ্ঠানে প্রথম প্রচারিত।


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

যৌন অবদমন!
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক বন্ধু হঠাত মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পর রুমমেটরা ক্লিনিকে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে হস্তমৈথুন প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন। বন্ধুটি খুব নামাজি ও ভদ্র ছিল।

সাইয়িদ কুতুবরা ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসান বান্নার মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গিরূপের সৃষ্টি। আগে ব্লগে এ নিয়ে তর্ক হতো অনেক। একটা ধারাবাহিক লিখেছিলাম মৌলবাদ সৃষ্টি নিয়ে। সেখানে সাইয়িদ কুতুব প্রসঙ্গও ছিল। লিংক এখানে
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অমিত এর ছবি

অবশ্যপাঠ্য তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হল।

হিমু এর ছবি
সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

একদম শেষে ভিডিও লিংকটা দেইখো টাইম পাইলে, একটু পুরান কিন্তু হেব্বি ইন্টারেস্টিং।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

মাহবুবুল হক এর ছবি

মজা পাইলাম। আমার তো মনে হয় যৌনতা ইসলামের
একটা থার্মোমিটার । অনেক কিছুই এর পারদে ধরা পড়ে।
আরব জাতির বিকৃত যৌনক্ষুধাকে ধর্মীয় মোড়কে চাপা দেয়ার কত চেষ্টা যে এর মধ্যে আছে ! কিন্তু বইটা পাই কেমনে?

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ঢাকার ভাল বইয়ের দোকানে গিয়া হানা দেন - নিউ মার্কেট বা গুলশানের এটসেটেরা কিম্বা বনানী ১১ নম্বরে আরেকটা দোকান আছে - নামটা ভুইলা গেছি!। অনেক সময় নাম-ধাম দিয়া দিলে ওরা বই অর্ডার দিয়া আনাইতে পারে।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

আড্ডাবাজ এর ছবি

অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা। যারা জামাত শিবির করে তাদের একান্ত গুরু হচ্ছে এই কুতুব। আর কুতুবের চেহারা খুলে পরিস্কার করে দেয়ার জন্য জাঝা। ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।