গত সপ্তাহে মারা গেলেন লেখক নর্ম্যান মেইলার। মার্কিন সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ। বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মার্কিন সাহিত্যের যে চার খলিফা ছিলেন - মেইলার তাদের অন্যতম। আধুনিক বাংলা কবিতার আলোচনা যেমন সম্ভব নয় পঞ্চপান্ডবকে বাদ দিয়ে, ঠিক তেমনই গত ৬০ বছরের মার্কিন সাহিত্য বিষয়ক কোন আলোচনাই সম্পূর্ণ হবে না যদি না বেলো, মেইলার, রথ, বা আপডাইকের উল্লেখ না থাকে। মেইলারের মৃত্যু সাহিত্যের জগতে কি বিশাল শূন্যতা রেখে গেল, তার প্রমাণ মেলে মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লেখা অগুণতি স্তুতিস্তবক থেকে।
সেই প্রজন্মের সবাই চলে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। বড় খলিফা সল বেলো মারা গেলেন দুই বছর আগে - তবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারটা জিতে তবেই তিনি গেছেন। বয়সের দিক থেকে তার পরেই ছিলেন মেইলার - নোবেল বিজয়ের আশা হয়তো তার কোনদিন ছিল না, কারন সাহিত্য বা অন্য কোন কিছুতে গতানুগতিকতার ধার ধারার মত লোক তিনি ছিলেন না। অপর দুইজন বয়সে আরেকটু ছোট - তারা এখনও বেঁচে আছেন। চোখ ধাঁধানো ছোটগল্প দিয়ে জন আপডাইক-এর যাত্রা শুরু, কিন্তু উপন্যাস, প্রবন্ধ, এমনকি শিল্প সমালোচনাতেও তার সগর্ব বিচরণ। এত কিছুর দরকার ছিল না যদিও, শুধু মাত্র 'র্যাবিট এংস্ট্রোম' চরিত্রকে নিয়ে লেখা তার চার খন্ডের উপন্যাসটি শেষ করেই তিনি যদি বসে যেতেন, তাহলেও আধুনিক ইংরেজী কথাসাহিত্যে তিনি অমর। আর শেষজন ফিলিপ রথ। ৪৮ বছর আগে গুডবাই, কলাম্বাস উপন্যাসটি দিয়ে তার আবির্ভাব। কিন্তু তার লেখনীশক্তি চরম পরাক্রমশালী। আজও মধ্যগগনে জ্বলজ্বল করছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে প্রৌঢ় বয়সে এসে কি যেন হলো রথের - একের পর এক বিস্ময়কর উপন্যাস লিখে তাক লাগিয়ে দিলেন সাহিত্যামোদীদের। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে একমাত্র অকাল মৃত্যুই বোধ হয় তার নোবেল বিজয় ঠেকাতে সক্ষম হবে।
আরো স্বনামধন্য লেখক আছেন - স্যালিঞ্জার বা ভনেগাট, টনি মরিসন, রিচার্ড ফোর্ড বা কর্ম্যাক ম্যাকার্থি। কিন্তু দ্বিতীয় মেইলার কি আরেকটা পাওয়া যাবে?
*
কেন এত নাম হয়েছিলো তার? Larger than life বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই ছিলেন তিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েন - প্ল্যান ছিল প্রকৌশলী হবেন। কিন্তু বিধি বাম। ভেসে গেলেন সাহিত্যের স্রোতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চলছে তখন। পাশ করতে না করতেই সেনাবাহিনী থেকে ডাক আসে - সৈনিক হয়ে চলে যান প্যাসিফিক রণাঙ্গনে। সেখানে জাপানীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। ফিরে এসে সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে তার প্রথম বই লিখতে বসেন।
১৯৪৮ সালে সেটি প্রকাশিত হয় - দ্য নেকেড এন্ড দ্য ডেড শিরোনামে। প্রকান্ড সাইজের উপন্যাস - সাহিত্যে এক বিকট বিস্ফোরণ। মেইলারের বয়স তখন মাত্র ২৫। সেই বইয়ের মাধ্যমেই জানিয়ে দিলেন সবাইকে তার মেধা আর তার উচ্চাভিলাষের কথা। এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
কি করেননি তারপরে। বেপরোয়া জীবন আর বেপরোয়া জবানের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন, নিয়মনীতি কিছুই মানতেন না। মদ, মাদকদ্রব্য, মেয়েমানুষ - কোনটা বাদ রাখেননি। দেদারসে সেবন ও সঙ্গম চালিয়েছেন। ছয়বার বিয়ে করেছিলেন - নয় সন্তানের জনক। সিনেমা বানাতেন, রাজনীতি করতেন, পত্রিকা ছাপাতেন, সাংবাদিকতা করতেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আর ছিল বক্সিং। মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলীর বন্ধু ছিলেন - এবং আলী ও ফোরম্যানের সেই কিংবদন্তীতুল্য যুদ্ধ - ১৯৭৪ সালে জাইরের রাজধানী কিনশাসায় অনুষ্ঠিত দ্য রাম্ব্ল ইন দ্য জাঙ্গ্ল - সেটিকে নিয়ে লিখেন দ্য ফাইট, তার সেরা বইগুলোর একটি।
দ্য নেকেড এন্ড দ্য ডেড ছাড়া তার আরো কয়েকটি উল্লেযোগ্য উপন্যাস:
- দ্য এক্সিকিউশনার্স সং - কুখ্যাত খুনী গ্যারি গিলমোরের জীবন অবলম্বনে রচিত;
- এন্শিয়েন্ট ঈভনিংস - প্রাচীন মিশরের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস;
- হার্লোট'স গোস্ট - মার্কিন গুপ্তচরদের নিয়ে লেখা তার অতিকায় গ্রন্থ।
লেখকের ব্যক্তিত্বের মতই তার বইগুলোও ছিল সব প্রমাণ সাইজের - ৭০০-৮০০ পৃষ্ঠার নীচে বোধ হয় বই লিখতে পারতেন না মেইলার।
উপন্যাসের বাইরে ছিলো তার নন-ফিকশন লেখা। দ্য ফাইট-এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ ও আন্দোলন নিয়ে লেখা ১৯৬৮ সালের বই দ্য আর্মিজ অফ দ্য নাইট। তার তিন বছর আগে ট্রুম্যান কাপোটি লিখেছিলেন তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ইন কোল্ড ব্লাড। কান্সাসের প্রান্তরে সংঘটিত এক বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বাস্তব বিবরণ, এই বইটি মার্কিন সাহিত্যে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। (হয়তো মনে আছে, গত বছর এই লেখকের জীবন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে কাপোটি'র ভূমিকায় নিপুণ অভিনয় করে 'শ্রেষ্ঠ অভিনেতা' অস্কার জিতেন ফিলিপ সীমুর হফম্যান।) মেইলার-এর দ্য আর্মিজ অফ দ্য নাইট সেই ধারাতেই রচিত। পুলিৎসার ও ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড - মার্কিন সাহিত্যের এই দুটি শীর্ষস্থানীয় পুরস্কার জিতে নেয় এই বইটি।
শেষ বয়সে এসে একটু শান্ত হয়েছিলেন। মেইলারের পাগলামি একটু কমেছিলো। তার গাদা গাদা সন্তান-সন্ততিদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। যদিও তার দ্বিতীয় বউ আডেলের গলায় ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে জেল খেটেছিলেন একবার! সেটা ১৯৬০ সালের ঘটনা। অবশ্য আডেল মরেননি তাতে।
মহান এই লেখকের প্রয়াণে জানাই শ্রদ্ধা।
*
P.S. দেখুন দ্য ফাইট!
মন্তব্য
মেইলার এর কোনো লেখা অনুবাদ করে দিন। পড়ি।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
কি যে বলেন - ৭০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস অনুবাদের তাকত আমার নাই! মেইলারের ছোট গল্প আছে কি না শিওর না, তবে উপরোক্ত বইগুলা রিকমেন্ড করতে পারি।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
সুবিনয় মুস্তফী, মেইলার এর ছোটগল্প আছে কিছু, আর একটা ভাল বই আছে, যেটার কিছু অংশ অনুবাদের জন্য ট্রাই করতে পারেন (আমিও রিকমেন্ড করতেছি... হা হা হা.... যেহেতু আপনি মেইলার এর অনুবাদযোগ্য ছোট লেখা পেলে অনুবাদে আগ্রহী) বইটার নাম The spooky art : some thoughts on writing এইটা মনে হয় আপনার তালিকায় দেখিনি। এইটাও একটা নন-ফিকশন, অন্য অথরদের ব্যাপারে মেইলারের ক্রিটিসিজম।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
নতুন মন্তব্য করুন