গাড়ি চলে না (৩) - ফিনিক্স থেকে বসুন্ধরার বাব্‌ল

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: সোম, ০৭/০১/২০০৮ - ৭:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
আমরা সব মিলিয়ে ৬ ভাই ১ বোন। এক মায়ের পেট থেকে যে কত বিভিন্ন কিসিমের সন্তান পয়দা হতে পারে, আমাদের পরিবার তার একটা বড় উদাহরণ। আমার ঠিক পরে যেই দুই ভাই, তাদের কথা ধরি। মাহফুজ হচ্ছে জন্মের আলসে, কুম্ভকর্ণের থেকেও বেশী ঘুমাতে পারে ও। পড়াশোনা ঠিকমত শেষ করেনি, কাজ-কামের খবর নাই, সারাদিন বাসায়ই পড়ে থাকে। যদি না ঘুমায়, তাহলে খবরের কাগজ পড়ে সারাদিন, একদম প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। বাপ-মা'র ওকে নিয়ে টেনশনের অন্ত নেই। ভবিষ্যতে এই ছেলের কি হবে, সেই চিন্তায় তারা কাবু।

ওর পরেরটার নাম ছোটন। মাহফুজের একদম উলটা। ভীষণ চটপটে, ভীষণ উদ্যোগী। কম্পিউটার সাইন্সে পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে, সিডনি থেকে মাস্টার্স করেছে, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের কাগজপত্রও করে ফেলেছে সে খুব তাড়াতাড়ি। এখন ছোটন সিডনিতে ফ্রি-ল্যান্স প্রোগ্রামিং করে, ওয়েবসাইট ডিজাইন করে, আর একটা কলেজে আইটি পড়ানোর ধান্দা করছে। ৮ বছর আগে ওর একটা হার্টের অপারেশান হয়েছিল ভারতে, কিন্তু সেটাও ওকে আটকাতে পারেনি। ওকে নিয়ে আমরা কোন টেনশন করি না, কারন জানি যে ওকে দিয়ে হবে।

ধরেন এই দুই ভাই আমার কাছে আসলো একটা আবদার নিয়ে। দুইজনই আমার কাছে বড় অংকের টাকা ধার চাইলো। (যদিও তা দেয়ার বিন্দুমাত্র সামর্থ্য আমার নেই, কিন্তু যুক্তির খাতিরে ধরি চাইলো!) আমি হয়তো বড় ভাই হিসাবে কাউকে কম বেশী ফেভার করবো না। কিন্তু মাহফুজকে টাকা দেয়ার সময় আমি সেই টাকাটা মোটামুটি খরচের খাতায় ফেলে দেবো, ধরে নেবো যে এই টাকা আর ফেরত পাচ্ছি না। কিন্তু ছোটন যদি চায়, তাহলে আমি ওকে বেশ নিশ্চিন্তেই টাকাটা ধার দিয়ে দেবো। কারন আমি জানি যে এই টাকার দ্বিগুণ ফেরত দেয়ার তাকত ওর আছে।

কিন্তু আমি তো আপন বড় ভাই। এখন ধরেন আমার কাছে না এসে ওরা আমাদের কাজিন শিবলির কাছে গেলো টাকার জন্যে। সে তো প্রথমেই মাহফুজকে হেসে উড়িয়ে দেবে। বলবে, গেলি! কিন্তু ছোটনকে সে হয়তো টাকা ধার দিলেও দিতে পারে, তবে আগে ও জেনে নেবে ছোটন কিভাবে টাকাটা ফেরত দেয়ার প্ল্যান করছে, কদ্দিনের মধ্যে, ইত্যাদি।

আমার কাজিন যে কাজটা করছে, সেটা হলো মাহফুজ আর ছোটনের creditworthiness (ঋণগ্রাহ্যতা) যাচাই করে দেখছে। ছোটন ওর বিচারে অনেক বেশী creditworthy তাই ছোটন ধারটা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু মাহফুজের ঋণগ্রাহ্যতা খুবই কম। ওকে ধার দিয়ে আমার কাজিন টাকাটা খোয়াতে চাবে না।

পরিভাষায় ছোটন হলো prime risk - উৎকৃষ্ট ঝুঁকি, তুলনামুলক বিচারে নিরাপদ ঋণগ্রহীতা। আর মাহফুজ? ও হলো sub-prime risk - নিকৃষ্ট মানের রিস্ক, যাকে ঋণ দেওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে। আমার কাজিন যেই কাজটা করলো, বিশ্বের সব ব্যাংকই প্রতিদিন এই কাজটা করে - যারা ঋণ চাইছে বাড়ি কিনতে বা শিল্প গড়তে, তাদের সেই ঋণ ফেরত দেবার সম্ভাবনা মাপ-জোক করে।

কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবপ্রাইম ঋণগ্রহীতাদের কারনে বিশ্ব অর্থনীতিতে এমন তোলপাড় উঠেছে, সেটা উদঘাটন করাই আজকের পোস্টের উদ্দেশ্য।

Quick ঝালাই

তার আগে একটু পেছনে চোখ বুলিয়ে নেই। গত দুই পোস্টে (এখানেএখানে) আমরা ১৯৯৫-২০০৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতির চড়াই-উতরাইয়ের একটা মোটামুটি আন্দাজ পেয়েছি। বিশেষ করে বিখ্যাত ডটকম ক্র্যাশের ব্যাপারে। তার থেকেও বেশী যেটা ধরতে চেষ্টা করেছি তা হলো সুদের হার, asset bubble ইত্যাদি নানা ভ্যারিয়েবেল কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। আগের পোস্টের মন্তব্য পড়ে চিন্তা করলাম এই অংশটা আরেকটু তরল করার অবকাশ আছে। তাই চলুক আরেকবার -

সুদের হার যখন কম --> তখন অনেক ঋণ দেয়া নেয়া হয়
--> বাজারে liquidity তৈরী হয় --> লিকুইডিটি খুঁজে বেড়ায় সম্পদ যেমন স্টক, শেয়ার, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট --> ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে asset কেনার জন্যে --> অ্যাসেট'এর দাম ক্রমে বাড়তে থাকে --> মূল্যবৃদ্ধি হতে হতে এক পর্যায়ে speculation বা হুজুগ শুরু হয়ে যায় --> তখন পুরো ব্যাপারটা একটা asset price bubble'এ পরিণত হয় --> উত্তরোত্তর সমস্ত অ্যাসেট'এর দাম দৌড়াতে থাকে --> ক্রেতাদের পাগলামোর কারনে তখন exotic asset'এর দামও বেড়ে যায় (পেইন্টিং, অ্যান্টিক ইত্যাদি) --> bubble চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় - তখন হঠাৎ এক সময় জুয়াড়ীদের টনক নড়ে, বাজারের সেন্টিমেন্ট ঘুরে যায়** --> তখন সশব্দে বুদবুদ ফাটে --> অনেক সময় এর ফসল হিসাবে অর্থনীতিতে মন্দা চলে আসে।

তবে সেন্ট্রাল ব্যাংক যদি এই প্রক্রিয়ার যে কোন এক পর্যায়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে বাজারে বেশী liquidity হয়ে গেছে, এই লিকুইডিটি কমানো দরকার, তখন তাদের মারণাস্ত্র হলো সুদের হার বা interest rate বাড়িয়ে দেয়া। সুদের হার তরতর করে বাড়িয়ে দিলে --> ঋণগ্রহীতা আর ঋণের সংখ্যা কমে যাবে --> বাজারের লিকুইডিটি কমে আসবে --> অ্যাসেট কেনার হিড়িক কমে যাবে। সময়মতো সুদের হার না বাড়ালে তার কুফল কি হতে পারে, ফেড চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রীনস্প্যানের শাসনামল তার বড় নজির।

** সেন্টিমেন্ট-এর ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং, তাই এর আরেকটু ভেতরে যাওয়া যায়। সেন্টিমেন্ট কি কারনে এক সময় পড়ে যায়? সত্যি কথা বলতে অর্থনীতিবিদরা এখনো এর কারন হলফ করে বলতে পারেন না। এখানে mass psychology বা herd behaviour'এর মত সমষ্টির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িত আছে। তবে কিছু কিছু কারন চিহ্নিত করা যায়। হঠাৎ একটা বড়-সড় external shock এসে বাজারকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। সাম্প্রতিককালে এই রকম শকের সবচেয়ে বড় নজির অবশ্যই ৯/১১'র হামলা। এর ফলে সমগ্র উন্নত বিশ্বের বাজার-সেন্টিমেন্টে বড় আঘাত লেগেছিল - মার্কিন বাজারের উপর এই হামলার প্রভাব নীচের গ্রাফে দেখতে পাচ্ছেন। সেন্টিমেন্ট ঘুরে যাওয়ার আরেকটা কারন হতে পারে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে সুদের হার বাড়ানো শুরু করেছে - সস্তা টাকার দিন শেষ এটা বুঝতে পেরে অনেক সময় জুয়াড়ীরা মনে বড় দাগা খান। এতেও বাজারের পতন শুরু হতে পারে।

ফেডের সুদের ঢেউ খেলানো চিত্র

১% কেন ও কিভাবে?

উপরের গ্রাফটা একটা ওয়েবসাইটে খুঁজে পেলাম - চমৎকার একটা ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই দাগের প্রতিটি মোচড়ে! আজকের মতন মনোনিবেশ করি সেকশন ৩-এর উপর। ডটকম বাব্‌ল ততোদিনে ভেঙ্গে পড়া শুরু করেছে, সবাই বাজার নিয়ে বেশ শংকিত। এমন সময় এলো ৯/১১'র আক্রমণ। শেয়ার বাজারের জন্যে এটা ছিল একেবারেই মরার উপর খাড়ার ঘা। এমনিতেই নিউ ইয়র্ক হলো মার্কিন তথা বিশ্ব অর্থনীতির প্রধাণ প্রাণকেন্দ্র, এবং ওয়াল স্ট্রীট হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের আস্তানা। গোল্ডম্যান স্যাক্স, মেরিল লিঞ্চ থেকে শুরু করে সিটিগ্রুপ, আমেরিকান এক্সপ্রেস, জ়ে পি মরগান, এদের সবার প্রধাণ কার্যালয় নিউ ইয়র্কে। এমন একটা ভয়ানক আক্রমণের পরে দুনিয়ার অর্থনীতির কি হবে, আবার কি হামলা হবে কি না, এই সকল ভয়ভীতি টেনশন বাজারকে একেবারে মানসিক ভাবে পর্যুদস্ত করে দিল। শেয়ারের দাম প্রবল বেগে নিম্নমুখী হতে লাগলো।

এহেন দুর্যোগের সময় সুপারম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন মিস্টার গ্রীনস্প্যান। ৯/১১'র ঠিক পরে পরেই ফেডারেল রিজার্ভের জরুরী মিটিং বসে ১৭ সেপ্টেম্বরে। বাজারকে আশ্বস্ত করার লক্ষ্যে গ্রীনস্প্যান সেদিন সুদের হার ৩.৫০% থেকে ৩.০০%'এ নামিয়ে দেন। তার মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই অক্টোবরের শুরুতে আবার সুদের হার কমানো হয় ২.৫০% পর্যন্ত। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হলেন না গ্রীনস্প্যান - এর পরের মাসে সুদের হার নামলো ২.০০%-এ। আর ডিসেম্বরে এসে আরো ০.২৫% কমানো হলো -- ১.৭৫%।

শুরু হয়েছিল সাড়ে তিন শতাংশ দিয়ে, সেটা এসে ঠেকলো পৌনে দুইয়ে - মানে ঠিক অর্ধেক হয়ে গেল সুদের হার, মাত্র তিন মাসের মধ্যে। শেয়ার বাজারকে বাঁচাতে গ্রীন্সপ্যানের তখনকার সমস্ত পদক্ষেপ লিপিবদ্ধ আছে এখানে

গ্রীনস্প্যান নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন যে ৯/১১'র পরে শেয়ার বাজার ছাড়াও সমগ্র আমেরিকা জুড়ে যে ভয়ংকর নৈরাশ্য, ভীতি ও অনিশ্চয়তা কাজ করছিলো, তা মোকাবেলার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপগুলা তখন জরুরী ছিল। এমনিতেই অর্থনীতি তখন মন্দার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তার উপর যখন এত বড় একটা অঘটন ঘটে গেলো, তখন ফেড'এর গুরুদায়িত্ব ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণকে আশ্বস্ত করা যে এই দুঃসময়ে ফেড তাদের পাশে আছে। সুদের হার ধুপধাপ করে কমিয়ে দিলে তারা যদি আবার ব্যবসা-বাণিজ্য কেনাকাটা করতে ভরসা পান, তাহলে ফেডের সেটাই করতে হবে।

২০০১ পেরিয়ে ২০০২ সালও অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত খারাপ গেলো। টেকনোলজি কম্পানীগুলা লক্ষ লক্ষ লোক ছাটাই করলো। বেকারত্বের হার অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলো। সব কিছু মিলিয়ে বিচ্ছিরি এক অবস্থা। জবাবে গ্রীনস্প্যান সুদের হার কমাতে কমাতে ১.০০% নিয়ে আসলেন। সেই ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ২৫ জুন ২০০৩ - এর আগের ৪৫ বছরে সুদের হার কখনো এতটা নামেনি। ঋণের ক্ষীণ স্রোত একটা বন্যায় পরিণত হলো। ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজন, বাড়ি বা গাড়ী কিনতে ইচ্ছুক যারা, আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই ঢালাও হারে ১% সুদে ঋণ নিতে আগ্রহী হয়ে পড়লো।

সুদের হার মাটিতে নামিয়ে দিয়ে গ্রীনস্প্যান আরেকটা কাজ করলেন। তিনি এই ১% হার ধরে রাখলেন পুরো একটা বছর। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত নীচুতে সুদের হার আটকে রাখাটা গ্রীনস্প্যানের আমলের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে এখন সনাক্ত করা হয়। এর ফলে লিকুইডিটির যে প্রবল জোয়ার আসলো অর্থনীতিতে, তা সহজেই অনুমেয়। ১% সুদের যুগে আমেরিকাতে যেই বিশাল পরিমান ঋণ তৈরী হয়েছিল, তার প্রভাবেই পুনরায় বড়সড় asset price bubble সৃষ্টি হয়। (যেটা আজ ২০০৬-০৭'এ এসে সাবপ্রাইম ক্রাইসিসে রূপান্তরিত হয়েছে।)

মামু কেন বড়লোক (হতে পারতো!) চোখ টিপি

বিশেষ করে হাউজিং সেক্টরে সেই বাব্‌ল একটা প্রকান্ড আকার ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি শহরে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে এই হাউজিং উন্মাদনা জেঁকে বসে। আমাদের প্রিয় মডু মাহবুব মুর্শেদ থাকে যেই শহরে, অ্যারিজোনার ফিনিক্স, সেটা পরিণত হয় হাউজিং উন্মাদনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একেবারে Ground Zero. অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে ২০০৫ সালে মাত্র এক বছরে ফিনিক্স শহরে বাড়ির দাম গড়ে ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এবং শুধু ফিনিক্স না, পুরো দেশ জুড়ে বেপরোয়া বেগে বাড়ির দাম বাড়তে থাকে। লাস ভেগাস, ওয়াশিংটন, বস্টন, নিউ ইয়র্ক, প্রতিটি শহরে বিরাট বুদবুদের সৃষ্টি হয়। ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডার মত অঙ্গরাজ্যগুলাতেও এই হাউজিং বাব্‌ল বিশালাকৃতি ধারণ করে। ঋণের নেশায় বুদ হয়ে প্রপার্টি বাজারে মাতলামোর সময় ছিল সেটা। পুরো ব্যাপারটাকে speculative madness, স্রেফ হুজুগ ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব না।

বুদবুদ বাংলাদেশী স্টাইল

বাংলাদেশের সাথে হয়তো কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছেন কোন কোন পাঠক। বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক লিকুইডিটি আসছে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স-এর আকারে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বিদেশে অভিবাসী বাংলাদেশীরা ২০০৭ সালে প্রায় সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার (৪৫,৫০০ কোটি টাকা) বাড়িতে পাঠিয়েছেন। এই সংখ্যা অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে চুরমার করে দিয়েছে। তার আগের বছর ২০০৬-এ রেমিট্যান্স এসেছিল 'মাত্র' সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

রেমিট্যান্স জিনিসটা ভালো। এতে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স মূলত যাচ্ছে জমিজমা আর ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনার মত অনুৎপাদনশীল খাতে। এই কথাটা নতুন কিছু না, এই পোস্টের আগেও লাখো মানুষ একই কথা বলেছেন। বিদেশ থেকে আসা এই লিকুইডিটির পাহাড়, সেটাকে একটা উৎপাদনশীল খাতে পরিচালিত করতে আমরা নির্মমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। যেহেতু liquidity chases assets, প্রবাসে এত পরিশ্রম করে যে মানুষটা এত টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, তিনি অবশ্যই চাইবেন একটা নিরাপদ অ্যাসেট কিনতে। সেটাই যুক্তিযুক্ত এবং সেটা তার অধিকারও বটে।

কিন্তু তার ফলাফলটা আমরা বিচার করি? দেশটা আর কতই বড়? বিশাল টাকার পাহাড় ছুটছে জমির পিছনে, যেটা পরিমানে একেবারেই সীমিত। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের নিজস্ব বাবেলের। জমির দাম আর ফ্ল্যাটের দাম কিভাবে উড়াল দিয়েছে তা সবারই জানা। প্রবাসীদের টাকা এই বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধির পিছনে প্রধাণ চালিকাশক্তি। কিন্তু এই বাবেল কিভাবে ফাটবে জানা নেই, আদৌ ফাটার কোন কারনও দেখছি না। অন্য কোন অ্যাসেট কি আছে যেটার দিকে আমাদের প্রবাসীরা ঝুঁকতে আগ্রহী হবেন? ভেবে দেখুন এই বিশাল পরিমান টাকা আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের তুলনায়ও অনেক বেশী। কোনভাবে যদি এই টাকার বন্যাকে নতুন শিল্প-কারখানা তৈরীর খাতে প্রবাহিত করা যেতো, যদি বিশ্বমানের ফ্যাক্টরি নির্মানে এতগুলা টাকা ব্যবহার করা যেতো, তাহলে দেশ অনেক বেশী উপকৃত হতো। কিন্তু সেটা না হয়ে সবাই বসুন্ধরায় পাঁচ কাঠা কিনতে ব্যস্ত।

তাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। প্রবাসীদের জন্যে দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগের নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরী করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। প্রবাসীদের দেশপ্রেমের অভাব নেই, কিন্তু তারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা থেকে একটা ভালো রিটার্ন চান। দেখা যাচ্ছে প্রপার্টি বাব্‌লই তাদের সবচেয়ে ভালো লাভের গ্যারান্টি দিচ্ছে। ৫ লাখ টাকা যদি হয় এক কাঠা জমির দাম, সেটা কয়েক বছরের মাথায় ১০ লাখ, ১৫ লাখ হয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটের দামও একই ভাবে আগাচ্ছে। এত চমৎকার লাভ তারা আর কোন সেক্টর থেকে আশা করতে পারেন?

সঠিক জানা নেই প্রবাসীদের টাকা দেশের শিল্পায়ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে বর্তমান বা পূর্বের কোন সরকার কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা। ঢাকার শেয়ার বাজারে নতুন কম্পানীর IPO বা শেয়ার ছাড়া হলে প্রবাসীদের IPO লটারিতে দাঁড়াতে হয় না এতটুকু জানি। তাদের গ্যারান্টি দেয়া হয় যে নতুন শেয়ার তাদের জন্যে বরাদ্দ থাকবে। এইভাবে তারা নতুন ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রসারে সাহায্য করছেন, এটা অবশ্যই একটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এই পদক্ষেপ ক্ষুদ্র। সরকারের আরো অনেক কিছু করার আছে, শেখার আছে।

ফিলিপিন বা ভারত বা মেক্সিকো বা শ্রীলংকার মত দেশের উদাহরণ আছে, যারা প্রবাসীদের পাঠানো টাকার চমৎকার প্রয়োগ করতে সফল হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি খাতে। শিল্পায়ন আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেও সেই টাকাটা খাটানো গেছে। এই সব দেশে আমাদের পেটমোটা আমলাদের পাঠিয়ে দিয়ে তাদের সরেজমিনে শিখে আসা উচিৎ কিভাবে পলিসিগুলা তৈরী করা হয়েছে, প্রয়োগ করা হয়েছে।

হায় সে কি আর হবে কখনো? তাও আশা হয়, একদিন, কোন এক দিন...

যাক, ভেবেছিলাম লিখবো সাবপ্রাইম নিয়ে, কিন্তু আজকেও দেখছি হলো না! কত কথাই না মাঝখানে চলে আসে। আজ যা দেখলাম তা হলো অতিরিক্ত লিকুইডিটির ফলে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ সবখানেই কিভাবে প্রপাটি বাব্‌লের সৃষ্টি হয়েছে। নেক্সট পর্বে আশা করছি বাড়ি মর্টগেজ ব্যবসার খুঁটিনাটি আর নানা রকম দুই নম্বরী জালিয়াতির কিছু বিবরণ দিতে পারবো। সকলকে ধন্যবাদ।

টাইমলাইন
১৯৯৫-২০০০ - টেলিকম ও ডটকম প্রসূত শেয়ার বাবেল
২০০১-২০০৩ - ডটকম ধ্বস, শেয়ার বাজারের পতন
২০০৪-২০০৬ - সাবপ্রাইম বাবেল, পুনরায় শেয়ার বাজারের উত্থান
২০০৭ - আজতক - সাবপ্রাইম ক্রাইসিস

অর্থনীতি সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্ট
- ১০০ ডলারের তেল, আর আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যত
- গাড়ি চলে না - বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘোর ঘনঘটা
- গাড়ি চলে না (২) - পিকাসো, টিউলিপ, ডটকম ও সাবপ্রাইম


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লিকুইডিটি নিয়ে জলবৎ তরলং বিশ্লেষণ! হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

সুবিনয় মুস্তফী লিখেছেন:
আমাদের প্রিয় মডু মাহবুব মুর্শেদ থাকে যেই শহরে, অ্যারিজোনার ফিনিক্স, সেটা পরিণত হয় হাউজিং উন্মাদনার জিরো পয়েন্টে

একদম ১০০% সত্য কথা। আমি যখন ২০০৫ এ অ্যারিজোনাতে আসি তখন থেকেই দেখছি বাঙ্গালীরা (এবং অবাঙ্গালীরা) পাগলের মতো ছুটছে বাড়ি কিনতে। সবার মন্তব্য, "অ্যারিজোনা বাড়ছে তাই বাড়ির দামও বাড়ছে। এই সময় যদি বাড়ি কেনা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে দাম এতো বেশী হবে যে সেটা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাবে।"

কাউকে দেখলাম আজকে $২০০হাজারে বাড়ি কিনলো, ১৫দিন পরে আরকজনকে দেখলাম সেটা $২৫০হাজারে কিনল। এই দেখে আরেকজন পাগল হয়ে উঠল এবং শেষমেষ কিছুদিনের মধ্যে $৩০০ হাজারে কিনল। কেউ কেউ একাধিক বাড়ি কিনে ফেলল। ফ্ল্যাট মরুভুমি বাড়িতে বাড়িতে সয়লাব হয়ে গেল।

এখন শুরু হয়েছে কম দামে বাড়ি বেচার ধুম। এর ছোঁয়া বোধহয় চাকুরীতে এসেও লাগছে। কমপক্ষে ১০ জন বাঙ্গালীর চাকরী চলে গেছে গত কয়েকমাসে। এর মাঝে এই ভাবে বাড়ি ঘর বিক্রী। একমাস আগে রাজা, একমাস পর ঘরবাড়ি ছাড়া। পুরোপুরি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ওনারা কি সচলের পাঠক?
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমার পাঠানো লিংক ধরে এসে একটা দুইটা পোস্ট পড়ে। বেশীরভাগ নিয়মিত নন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

এই লিংক ওদের কাছে পাঠিয়ে দেখতে পারো, ক্ষ্যাপে কিনা! চোখ টিপি
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

দিগন্ত এর ছবি

তাসের ঘর তৈরীর খেলা। আর কি বলি - সবই মায়া ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

চামে চামে অর্থনীতি শিখে ফেলছি ।

সবজান্তা এর ছবি

সচলায়তনে যত দিন যাচ্ছে আমি ততোই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এমনিতেই আলসে বলে আমার বেশ খ্যাতি আছে। একটু দুর্বোধ্য বিষয় এবং তার উপর কঠিণ ভাষায় লেখা যে কোন ধরণের আর্টিকেলই আমি সযত্নে পরিহার করি। যেই কারনে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমি আমার পাঠ্য বিষয়ের বাইরে অনেক কিছু নিয়েই জানতে পারিনি।

কিন্তু সচলে এসে অভিজিৎদার বিবর্তন-ধর্ম এবং বর্তমানে সুবিনয় মুস্তফীর অর্থনীতির উপর এমন সহজ এবং সুখ পাঠ্য লেখা পড়ে, আমার মত মানুষেরও দিব্য চক্ষুর উন্মীলন ঘটছে। সেই জন্য একটা বিশাল ধন্যবাদ সচল এর সব লেখককেই দিতে চাই।

এই লেখাটা অসাধারণ হয়েছে। এর চেয়ে বেশি আশা করি, কিছু বলার দরকার নেই ।

আমি এমনিতে বেশ গর্দভ জাতীয় ছাত্র। একসাথে এত বেশি লেখা পড়লে আমার মাথায় প্যাঁচ লেগে যায়। তাই আমি কিছু ব্যাপার একটু বলছি, আপনি অনুগ্রহ করে একটু দেখুন, আমার জানাতে ভুল আছে কিনা --

সাবপ্রাইম ক্রাইসিস -- ঋণ পরিশোধের অযোগ্য লোক যখন ঋণ পেয়ে যায় ( নিম্ন সুদের হারের কারনে , সেই সাথে সরকার এর অর্থনীতি চাঙ্গাকরন প্রোজেক্টের অংশ হিসেবে ), তা থেকে সৃষ্ট ক্রাইসিস ????

স্পেকুলেটিভ বাবলঃ কোম্পানির অতীত, ভবিষ্যত চিন্তা না করেই, শুধু মাত্র হুজুগের বশে, দাম দেখেই শেয়ার কিনে ফেলা, অতঃপর শুভ বুদ্ধির উদয়, মার্কেট প্যানিক তৈরী হওয়া এবং সশব্দে বাবলের বিস্ফোরণ ??

Asset Price bubble : যখন সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হয় তখন তারল্য বৃদ্ধি পায়, এর ফলে অনেকেই নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসেবে স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করে, ফলশ্রুতিতে স্থাবর সম্পত্তির দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্টিক সামগ্রীর দাম ও বাড়তে থাকে। এক সময় পাবলিক সেন্টিমেণ্ট পরিবর্তন ঘটে, এই বাবলেরও সশব্দে বিস্ফোরণ ঘটে ???
--------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

পারফেক্ট। তিনটাই একদম ঠিক ঠিক ধরেছেন। তবে সাবপ্রাইম গ্রাহকদের কাছে কিভাবে জোচ্চুরি করে ঋণ গছানো হয়েছিল, এবং সেটা কতভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করেছে, এমন কি বিশ্বের অর্থনীতিকে বসিয়ে দিচ্ছে, সেগুলাও বর্তমানে বড় থিম। ওবামা ও এডওয়ার্ডস-এর মতো populist ক্যান্ডিডেটের উত্থানের এইটা একটা বড় কারন। বেপরোয়া unregulated পুঁজিবাদের বাড়াবাড়িতে খোদ আমেরিকার মানুষই আজ নিপীড়িত বোধ করছে, হয়রান হয়ে গেছে। সেগুলা নিয়ে সামনে লিখতে চাই।

আপনার সুমন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। হাসি
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

খেকশিয়াল এর ছবি

আরিফ জেবতিক লিখেছেন:
চামে চামে অর্থনীতি শিখে ফেলছি ।

হিহি আমিও, অর্থনীতি নিয়া অনেক পাঙ্খা একটা পোস্ট দেঁতো হাসি

দিগন্ত এর ছবি

"বেপরোয়া unregulated পুঁজিবাদের বাড়াবাড়িতে "

- এটাই চিন্তার বিষয়।

সুদের হার (prime lending rate)বাড়িয়ে রিয়েল এস্টেটের বুদবুদ চুপ্সানোর কৌশল ভারতেও নেওয়া হয়েছিল। রাতারাতি সুদের হার বাড়িয়ে ৮ থেকে ১২% এ উঠে গেল। তাও রিয়েল এস্টেটার দাম ধাক্কা খায় না। তবে বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে। আমার মনে হয় এর ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হারও কিছুটা কমবে, কিন্তু আখেরে ভালই হবে।

চিনে দেখেছি এসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই, লোকজনে বিশেষ একটা খোঁজও রাখে না এসব নিয়ে। ওদের সবই সরকারি কন্ট্রোলে, সকার যা করে সবাই তা মাথা পেতে নেয়। আমি থাকতে থাকতে শুনলাম ওখানে পর্কের দাম ১০০% বেড়েছে গত ১ বছরে। ভেবে দেখুন, পর্ক হল মাংসের মধ্যে ওদের সবথেকে বড় ভক্ষ্য। আমাদের এখানে হলে সরকার পড়ে যাবার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

চীনে শুকরের মাংসের মূল্যস্ফীতি নিয়ে গল্পটা আমিও পড়ে ভিমরি খেয়েছিলাম - কত রকম কলকব্জাই না নড়ে! পুরো ব্যাপারটাই খুব ইন্টারেস্টিং। সাবপ্রাইমের মত বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ে একটা সিরিজ করা যায়... হুমম...!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

সুমন এর ছবি

এত সহজে কিভাবে চিন্তা করেন উপরেওয়ালা জানেন।
অনেক কিছু জানা হল।
আমিন!!

রেজওয়ান এর ছবি

পছন্দের পোস্টে যুক্ত করলাম। জলবৎ তরলং হচ্ছে অনেক কিছুই। হাসি

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

রানা মেহের এর ছবি

বাংলাদেশ নিয়ে আরো একটু বেশী লেখা যায় না?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ফারুক হাসান এর ছবি

প্রিয় পোস্টে যুক্ত করলাম।
অর্থনীতি সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টগুলির লিংক এই পোস্টের নীচে না দিয়ে শুরুতেই দিয়ে দিতে পারেন।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

জুবায়ের ভাই, ফারুক হাসান, রেজওয়ান ভাই, আরিফ জেবতিক এবং অন্য সকল মন্তব্যকারীকে আন্তরিক ধন্যবাদ। অনেকে এই লেখার সরলতার কথা বলেছেন। আমি নিজের জীবনে হাড়ে হাড়ে এর অভাব টের পেয়েছিলাম বলেই লেখার সময় সরলতার আশ্রয় নিয়েছি। যখন অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম, আর পরবর্তীতে যখন এই ফিল্ডে কাজ করা শুরু করি, তখন আসলেই ভীষণ কষ্ট হয়েছে বিভিন্ন কনসেপ্ট বুঝতে গিয়ে। একই জিনিস হাজার বার পড়তে হয়েছে, না বুঝে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়েছি, সহপাঠী বা সহকর্মীকে একই প্রশ্ন করে হাজারবার জ্বালিয়েছি। কিন্তু পরে এসে বুঝেছি যে আসলে কনসেপ্টগুলা বোঝা সহজ, যদি একটু তরল ভাষায় বিভিন্ন বাস্তব উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করা যায়। নন-স্পেশালিস্ট পাঠকের কাছে যদি বোধগম্য হয়, তাহলেই এই লেখাগুলোর সাফল্য।

রানা মেহের জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশ নিয়ে আরেকটু লেখা যায় কি না। স্বীকার করছি যে এই লেখাগুলা একটু পশ্চিমা-কেন্দ্রিক ঠেকতে পারে কোন পাঠকের কাছে। এই প্রসঙ্গে দুটো পয়েন্ট আছে - গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের ফলে আজকের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বড় বড় অর্থনৈতিক ট্রেন্ডগুলা শুধু একটা দেশকে প্রভাবিত করেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং সমগ্র বিশ্বই তা টের পায়। চীনের উন্নয়নের জয়যাত্রা আমাদের দেশের খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিতে সক্ষম, আবার আমেরিকার সাবপ্রাইম ঋণগ্রহীতাদের দুঃখ-কষ্ট সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকেই আঘাত করে। দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো যে অর্থনীতির রীতিনীতি সবখানেই কিন্তু এক। আমেরিকার প্রপার্টি বুদবুদ বা শেয়ার উন্মাদনার সাথে বাংলাদেশের প্রপার্টি বুদবুদ বা শেয়ার উন্মাদনার কিছু কিছু অমিল আছে, কিন্তু উভয়েরই ফান্ডামেন্টাল কারন কিন্তু একই - লিকুইডিটি কিম্বা হুজুগ। এই কারনেই এই পোস্টে আমি দেশে জমির দাম বাড়া নিয়ে একটু বলেছি, আর আগের পোস্টে ৯৬-এ মতিঝিলের শেয়ার কেলেংকারি নিয়ে আলাপ ছিল।

তারপরেও চেষ্টা করবো দেশের অর্থনীতি নিয়ে আরো লেখার। সমস্যা হলো যে ডেইলি স্টার সহ দুয়েকটা ওয়েবসাইট ছাড়া এই বিষয়ে সঠিক, নির্ভরযোগ্য সংবাদ তেমন পাওয়া যায় না। কেউ যদি দেশীয় অর্থনীতি বিষয়ে ভালো ওয়েবসাইটের ঠিকানা জানেন, তাহলে জানাবেন। এইদিকে পুরো সপ্তাহই পশ্চিমা আর দূরপ্রাচ্যের অর্থনীতি নিয়ে পড়তে হয় বা লিখতে হয় বলে এদের ব্যাপারে ধ্যান-ধারণা আমার আরেকটু স্বচ্ছতর। সকলকে আবারও ধন্যবাদ।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ছালার, অর্থনীতির মতো খাইস্টা একটা ব্যাপারও আমি এতো সহজে গলাধঃকরণ করলাম ক্যামনে?
জয়তু বুড়া মিয়া!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

পুরুজিত এর ছবি

দারূণ লাগছে।
একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো। বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে যে টাকাটা আসে তা শুরুতে প্রোপার্টি কেনাতে খরচ হলেও শেষ পর্যন্ত তো টাকাটা দেশের অর্থ প্রবাহে যুক্ত হবে। অর্থাৎ জমি বিক্রি করলো যে লোকটা সে বিক্রিলব্ধ টাকাটা হয় বিনিয়োগ করবে অথবা ব্যাংকে রাখবে। সেক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে এ কথাটা কি ঠিক?

হিমু এর ছবি

আমি একটু চিপা দিয়ে মাথা ঢুকাই। জমি বিক্রি করছে যে ল্যান্ড ডেভেলপার, সে সাধারণত হয় পরবর্তী প্রজেক্টে টাকাটা বিনিয়োগ করে, অথবা ব্যাঙ্কে ফেলে রাখে। আবারও জমিতেই যদি বিনিযুক্ত হয়, তাহলে অনুৎপাদনশীল খাতেই চলে গেলো টাকা। ব্যাঙ্কে ফেলে রাখলে অলস টাকার পরিমাণ বাড়লো।

নাকি?


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

"ব্যাঙ্কে ফেলে রাখলে অলস টাকার পরিমাণ বাড়লো।"

- ব্যাঙ্কের টাকা কোনোভাবেই অলস টাকা নয়। ব্যাঙ্ক সেই টাকা আবার বাজারে খাটিয়ে সুদ দেয় - এটা নিশ্চয় আপনার জানা আছে। তাই ব্যাঙ্কে বেশী টাকা যাওয়া মানে দেশীয় বাজারে শিল্প স্থাপনের জন্য সহজ শর্তে লোন পাওয়া - দুটো খুব কাছাকাছি।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দুর্ধর্ষ সিরিজ। চলুক। কলেজে থাকতে শখের বশে কিছু পড়েছিলাম। মরচে খসছে এখন। এতটা সহজ-সরল ভাষায় এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখার জন্য অভিনন্দন।

রেমিট্যান্সের টাকা অপচয় নিয়ে আমার নিজেরও দুঃখের শেষ নাই। কিছু করা দরকার। সরকারের হাতে ছেড়ে দিলে কিছুই হবে না।

পুরুজিত এর ছবি

না হিমু ভাই, ব্যাংকে গেলে টাকাটা অন্য উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারবেন ঋণ নিয়ে, কারণ টাকা বসিয়ে রাখলে তো ব্যাংক সুদ দিতে পারবে না জমাকারীদের। পরবর্তী প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে সে টাকাটাও শেষ পর্যন্ত স্পেন্ডিং স্ট্রিমেই আসবে। একমাত্র অনুৎপাদনশীল খাত হল কেউ যদি টাকা বালিশে জমিয়ে রাখে। শুধু কন্সাম্পশানে খরচ করাটাও খারাপ হতে পারে অবশ্য।
আমি বলতে চাচ্ছি যে প্রবাসীদের নিজেদেরই যে কলকারখানা করতে হবে এমনটা মনে হয় না। দেশে বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ থাকলে তারা যেভাবেই টাকা পাঠান না কেন তাতেই দেশের উপকার হবে।

হিমু এর ছবি

তারল্য সংকটে তো ব্যাঙ্কগুলি ভোগেই। অলস হাজার হাজার কোটি টাকা পড়ে থাকে ব্যাঙ্কে, একরকম বালিশের নিচেই। কোন প্রকল্পে ঋণ দেয় ব্যাঙ্কগুলি? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ ঋণের ইতিহাস যদি দেখি, তাহলে কী কী আসে খাতায়? হাউজিং, গাড়ি, বিবাহ, এমনকি কম্পিউটার ক্রয় ...। কিছুটা যে মূল অর্থপ্রবাহে ঢোকে না, তা নয়, তবে কত অংশ? বাংলাদেশের ব্যাঙ্কগুলি থেকে ঋণ নিয়ে ওয়ারিদ টেলিকম ব্যবসা শুরু করে দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন বড়স্কেলের উদ্যোগ গড়ে ওঠে না সহজে। ব্যাঙ্ক দেদারসে অগ্রিম ঋণ দেয় আমদানিকারকদের, আর তাতে করে উল্টো সাইফন চলতে থাকে।

বড় বড় জমির ডেভেলপার যারা আছে, তাদের অনেকের টাকাপয়সা দেশে থাকে না, চলে যায় দেশের বাইরে (তাদের অনেকেও দেশে থাকতে পারে না কারণ তাদের নামে খুনের মামলা ঝুলছে)।

গৃহায়ন শিল্পে বিনিয়োগে উৎপাদন বাড়ে, তবে ইন্দোনেশিয়ার সিমেন্ট, থাই অ্যালুমিনিয়াম আর কোরিয়ান টরস্টীলের। আর আমাদের আশুলিয়ার ইঁটের ভাটায় ইঁটের। আমরা মুদির বাচ্চারা খালি কিনি আর বেচি আর খাই।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

শুধুমাত্র রিয়েল এস্টেট আর ক্ষণস্থায়ী কনসাম্পশনে টাকাটা গেলে সেটা এক প্রকার অপচয়ই হচ্ছে। এর পেছনে একটা কারণ হিমু বলেছেন - আমদানীকৃত জিনিস কিনে কিনে সেই টাকা আবার বিদেশেই পাঠিয়ে দিচ্ছি আমরা। সেটা স্নো-পাউডার হোক আর স্টীল-সিমেন্ট হোক।

অন্যদিকে বিনিয়োগ কত বিভিন্ন খাতে করা দরকার তার একটা উদাহরণ দিই। শিল্প বাদ থাকুক, অবকাঠামোর কথা ধরেন। দেশের ট্রাফিক জাম সম্পর্কে সবাই অবগত। এর পেছনে বড় একটা কারণ হলো গাড়ী বা মানুষের তুলনায় রাস্তা বাড়েনি। টাউন প্ল্যানিং-এর তত্ত্ব মোতাবেক একটা শহরের সমগ্র সার্ফেস এরিয়ার কম সে কম ২৫% শতাংশ রাস্তাঘাটের জন্যে বরাদ্দ থাকা উচিত। সেই তুলনায় ঢাকা শহরের রাস্তা মোট এরিয়ার ৭-৮% এর বেশী হবে না। ফলশ্রুতিতে ট্রাফিক জাম, ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। ঢাকার বাইরেও হাইওয়ে বা রেল পরিবহনে বিনিয়োগের অনেক প্রয়োজন আছে।

এই অপ্রতুল পরিবহণ অবকাঠামোর একটা সরাসরি ফলাফল হচ্ছে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি। একটা মাল বোঝাই ট্রাক যত বেশী জামে বসে থাকবে, সেই মালের final retail price সেই অনুযায়ী বাড়তে বাধ্য। মূল্যস্ফীতির সাথে বাজে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সম্পর্ক এখানে। (যদিও আরো অনেক কারণ আছে, মূল্যস্ফীতির পেছনে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারন।) এ ছাড়াও পচা ইনফ্রাস্ট্রাকচার অর্থনীতির উন্নয়নের সম্ভাবনা রুদ্ধ করে, রপ্তানীকারকদের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সরকারের পক্ষে সম্ভব বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় একটা national infrastructure development plan দাঁড় করানো। এবং সেটা বাস্তবায়ন করতে দাতাদের কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে কেন, যখন এত রেমিট্যান্স আসছে? সরকার একটা বন্ড ছাড়তে পারে, যেটা প্রবাসীরা কিনবেন। এমন একটা বন্ড স্কীম বড় আকারে মার্কেটিং করা যায় পত্রপত্রিকায় বা মিডিয়াতে। তবে শর্ত একটাই, প্রবাসীরা কোন অ্যাসেটই কিনবেন না যদি তাদের বা তাদের পরিবারের আর্থিক লাভ না হয়। শুধু দেশপ্রেমের আবেদন দিয়ে এই বন্ড কেনানো যাবে না।

আর অন্য শর্ত হচ্ছে অবশ্যই সরকারের প্ল্যান বাস্তবায়ন যোগ্য হতে হবে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ভারতের উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। ওদিকে চীনে যারাই গেছেন, তারাই বলেছেন যে উন্নত বিশ্বের থেকেও বেশী উন্নত ওদের অবকাঠামো! যেমন চওড়া হাইওয়ে, তেমন গতিশীল অর্থনীতি। তবে কথার পেছনেও কথা আছে। গণতন্ত্র না থাকার ফলেই চীনে এটা সম্ভব হয়েছে। হাজার হাজার কৃষকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ একর চাষাবাদযোগ্য জমি জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে, হাইওয়ে বানানোর জন্যে। ভারতে যেহেতু গণতন্ত্র বজায় আছে, এই লেভেলের জুলুম সম্ভব না। আর জোর জবরদস্তি করতে গেলেই আপনি পাচ্ছেন নন্দীগ্রাম আর শিঙ্গুরের মত ভয়াবহ পরিস্থিতি। বাংলাদেশের পরিত্রাণ কি?!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

দিগন্ত এর ছবি

"national infrastructure development plan " - এটা আমাদের দেশে খুব সফল, কিন্তু এর আওতায় দেশী অনাবাসি সবাই ছিল। যেমন এটা দেশে করমুক্ত বিনিয়োগ হিসাবে ধরা হত, বিদেশীদের ক্ষেত্রে সেটাই উচ্চসুদে বিনিয়োগ হিসাবে। দেশের সুবর্ণ চতুর্ভুজ প্রকল্প (চার মহানগরীকে ৬ লেন হাইওয়ে দিয়ে সংযুক্ত করার প্রকল্প) এই বন্ডের টাকাতেই চলেছে। উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে (বা বাংলাদেশেও) বিনিয়োগে সুদের হার উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশী। তাই শুধুমাত্র একটু পরিবেশ আর দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করলেই আরো লক্ষ লক্ষ ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসা সম্ভব।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

পুরুজিত এর ছবি

আমিও মনে করি এই ধরনের বিনিয়োগের আহবানে দেশপ্রেমের চেয়ে বাণিজ্যিক আবেদন মুখ্য করা উচিত। যতদিন না ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে অলস টাকা পড়েই থাকবে উদ্যোক্তার অভাবে। এখন এই সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে সেইটাই লাখটাকার প্রশ্ন।

ekojon_probashi এর ছবি

আমি অর্থনিতির কেউ নই
একজন সাধারন খেটে খাওয়া প্রবাসি
সুবিনয় মুস্তাফি র কাছে একটা প্রশ্ন

প্রথমেই বলে নেই প্রবাসি দের টাকা যে কোনো কাজে লাগছে না এবং সেটা যে আরো ভালো কোনো কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে আমি আপনার সাথে একমত ।

কিন্তু
বাংলাদেশে একজন সরকারি কর্মচারি ধরেন টেলিফনের লাইনম্যান তার বেতন আগে ছিলো ১৪০০টাকা স্কেলে মাসে পেত ২৭০০ টাকার মত এরিয়া ওভারটাইম মিলে অনেকে তিন ছুয়ে যেত ।(এখন কত জানি না)
আগে এই টাকায় হয়ে যেত
তারপর একসময় ঢাকা শহরে দুই রুমের বাসা ভাড়াই হয়ে গেলো ৩০০০টাকা লাইন ম্যান এর বেতন কিন্তু বাড়ল না ।
তার এই বাড়তি খরচ যোগাতে সে ঘুষ খাওয়া শুরু করলো এখন তার ঘুষ সহ ইনকাম দাড়াল ৭হাজার টাকা এই টাকা সে তুলছেই প্রতি মাসেই আর পাবলিকও এই টাকা দিয়ে যাচ্ছে ।
*লাইন ম্যান যদি নিজের বেতন সাত হাজার এ নিতে পারে সরকার কেন পারে না ?
অর্থাত্ বাকি ৪হাজার টাকার জব সে ক্রিয়েট করছে এবং সেখানে একটা লেনদেন হচ্ছে মানে আরেকটা বাজার হয়ে গেলো
এটা শুধু টেলিফনের লাইন ম্যান নয় বাংলাদেশে র প্রায় সব সেক্টরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।
পানি বিদ্যুত গ্যাস পুলিশ ব্যাংক বাদ দেওয়ার মত কিছু খুজে পাচ্ছি না ।

আমার প্রশ্ন
এতে করে কি বাংলাদেশ এ কি একটা দৈত্ব অর্থনিতি গড়ে উঠছে না?
একটা সাদা যেটা কাগজে কলমে বেতন পায় ।
আরেকটা কালো যার কোনো হিসাব নেই।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ekojon_probashi ,

প্রবাসীদের টাকা যে কোন কাজে আসছে সেটা আমি বলি না। অনেক কাজেই আসছে। বাবা-মাকে ভালো বাসা ঠিক করে দেয়া, ভাইবোনদের স্কুল কলেজে পড়ানো, এসব অবশ্যই ভালো কাজ। তবে আরো ভালো কাজ করা যায় - শিল্প ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ তার মাত্র দুটা উদাহরণ।

আপনি যেই দ্বৈত অর্থনীতির কথা বলছেন, তার সাথে একমত। সরকারী অফিসে বর্তমানে যে বেতন স্কেল তাতে দুর্নীতি ঠেকানোর কোন উপায় নেই। দুর্নীতি দমনের একটা বড় পদক্ষেপ হওয়া চাই public sector pay-scale reform। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে একটা রিয়েলিস্টিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এটা ফরজ কাজ। এই কাজ না করলে সরকারী চাকুরেদের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির হারের সাথে তাল মিলিয়ে বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা থাকা উচিত। উদাহরণ দেই। যদি চালের দাম ৩০ টাকা কেজি থেকে ৪০ টাকা কেজি হয়ে যায়, সেটা ৩৩% মূল্যবৃদ্ধি হলো। এমতাবস্থায় আপনি একজন পিয়নের ১০০০ টাকার বেতন বাড়িয়ে ১১০০ টাকা করে দিলে (১০% বৃদ্ধি) সেই লোকটাকে ঠকানোই হলো। তার real income আপনি কমিয়ে দিলেন। তাই মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার বেতন হওয়া উচিত তখন ১০০০ + ৩৩৩ = ১৩৩৩, প্রায় সাড়ে তেরশো টাকা। ন্যায্য হিসাবে তাই বলে। এর থেকে কম দিলে তার দুর্নীতি করার incentive সৃষ্টি হচ্ছে। তার নিজের আর পরিবারের কথা চিন্তা করেই সে ঐ হারিয়ে যাওয়া ২৩৩ টাকা উদ্ধারে সচেষ্ট হবে - এবং সেটা ঘুষ খাওয়ার মাধ্যমে। আর একবার চুরির মজা পেয়ে গেলে সেটা থামানো কষ্ট। এজন্যেই দুর্নীতি শুধু আমাদের উন্নয়ন নয়, আমাদের জাতীয় চরিত্রের জন্যেও একটা বিষাক্ত সাপের মতই ক্ষতিকর ।

এর পাশাপাশি চলে আসে public sector reform এর কথা। দুইজন পিয়নকে ১০০০ টাকা করে বেতন দেন আপনি - তাতে আপনি পাবেন দুইজন কর্মবিমুখ, ফাঁকিবাজ এবং দুর্নীতিপরায়ন পিয়ন। কিন্তু আপনি বেতন স্কেল বাড়িয়ে একজন পিয়নকে ২০০০ টাকা বেতন দেন। দেখবেন আপনার কাজও বেশী আদায় হচ্ছে, এবং সেই লোক চুরি করারও বেশী আগ্রহ পাবে না, কারন যেই বেতন তাকে দেওয়া হচ্ছে, তাতে তার ঘুষ খাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। যখনই public sector reform এর কথা বলা হয়, তখনই বিশ্ব ব্যাংক আই এম এফ-এর দালাল এই জাতীয় গালি খাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু তাই বলে উপরের হিসাবটা একেবারে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না। বর্তমান ব্যবস্থায় আমাদের সরকারী সেক্টর একাধারে underpaid, overstaffed, unproductive এবং corrupt। বছর কে বছর এই ব্যবস্থা জিইয়ে রাখা হচ্ছে, কিন্তু কার স্বার্থে?

ধরতে যদি হয় তাহলে ধরতে হবে অন্য জায়গায়। সরকারের খরচ মেটাতে প্রয়োজন হয় রাজস্বের। সরকারী কর্মচারীদের যদি অপর্যাপ্ত রাজস্বের দোহাই দেখিয়ে বেতন কম দেওয়া হয়, অবকাঠামোর উন্নয়ন যদি অপ্রতুল রাজস্বের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ থাকে, তাহলে খোঁজ নিতে হবে, রাজস্ব কম হলো কেন?

রাজস্ব কম হলো কারন আমাদের দেশের বড়লোক ব্যবসায়ী শুয়োরের বাচ্চাগুলা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে দিতে এই ব্যাপারে ওস্তাদ হয়ে গেছে। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া আমাদের জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমি ব্লগে পারতপক্ষে গালিগালাজ এড়িয়ে চলি, কিন্তু গুলশান বনানীর তেলতেলে বড়লোকদের জন্যে ঘৃণা আর গালি ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না। শুয়োরের বাচ্চারা দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে বড়লোক হচ্ছে, বিএমডব্লিউ আর মার্সিডিজ গাড়ি হাঁকাচ্ছে, তাদের সন্তানেরা ১৫০ টাকা দিয়ে কফি খাচ্ছে আর ৩০০ টাকা দিয়ে মুরগির রান চিবোচ্ছে। কিন্তু ন্যায্য ট্যাক্সটুকু দিতে পর্যন্ত তারা অপারগ।

বিদেশে যারাই গেছেন তারাই দেখেছেন, এইখানের রাস্তাঘাট পরিষ্কার, ট্রাফিক লাইট চলে ঠিকমতো, হাসপাতালে ডাক্তার আছে, স্কুল কলেজ়ে শিক্ষক আসে টাইম মতো। এগুলা এমনে এমনে হয়নি। এইখানে প্রতিটা মানুষ তার ন্যায্য ট্যাক্স দেয় এবং পুরো জাতি সেই ট্যাক্সের সুফল ভোগ করে। Taxes pay for public services. আমাদের দেশে ট্যাক্সই আদায় হচ্ছে না, আপনি কোন পাবলিক সার্ভিস আশা করবেন? ডাক্তার কেন হাসপাতালে বসবে? সে তো ব্যস্ত নিজের ক্লিনিক নিয়ে। শিক্ষক কেন আসবে পড়াতে? সে তো ব্যস্ত বাসায় ছাত্র পড়াতে কিম্বা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ক্ষ্যাপ মারতে। পুলিশ কেন ঘুষ নেবে না?পাবলিক সার্ভেন্ট মানে এই না যে সে বৈরাগী হয়ে গেছে। তারও বাসায় বৌ বাচ্চা আছে, তাদের খাওয়াতে পড়াতে হয়।

তাই প্রতি পয়সার রাজস্ব গুনে গুনে আদায় করতে হবে, আর ফাঁকি দিতে চাইলে হারামজাদাদের ধরে ধরে জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। এই সব কথা বললে CTG'র দালাল এই জাতীয় গালি খাওয়ার আশংকা থাকে, কিন্তু আমি বলবো যে যেই সরকার এমন পদক্ষেপ নেবার সাহস রাখে, তাদেরই বাহবা প্রাপ্য।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ধ্রুব হাসান এর ছবি

দারুন দাদা দারুন! চালিয়ে যান। অনেক কিছু বলবো ভেবেও সময়ের অভাবে বলা হলো না......আপাতত পড়ি শুধু। তবে আপনার অর্থনীতি বিষয়ক এই লেখার ধরন এতই মজা লেগেছে যে আমার পুরোনো প্রেমের কথা মনে পরে গেল! ১৯৯৪ সাল, চট্রগ্রাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি, অর্থনীতি আমার একাডেমিক বিষয় নয়, তবে আমার অনেক প্রিয় বন্ধুদের বিষয় ছিল অর্থনীতি, সেই সুত্রে সময় কাটাতে যেতাম ওদের সাথে অর্থনীতির ক্লাসে! কলেজের দ্বিতীয় কি চতুর্থদিন একজন মাঝবয়সী (৩৬-৪২) ম্যাডাম অর্থনীতির ক্লাসে আসলেন, আমি বন্ধুদের সাথে ফাজলামো বন্ধ করলাম যাতে ধরা না পড়ি! ওনি ক্লাস নেয়া আরম্ভ করলেন, ম্যালথাসের থিওরি দিয়ে শুরু করলেন (এখন আর পুরোপুরি মনে নেই), যত সময় যায় আমার মুগ্ধতা বেড়েই চলে; ক্লাস শেষ হতে না হতে আমি ওনার প্রেমে পড়ে গেলাম...হাহাহা......বিশ্বাস করেন আমার শুধু মনে হচ্ছিলো এই অসাধারন বিষয়টা কেন আমি নিলাম না! এই আফসোস থেকে ছুটে গেলাম কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে; কোন লাভ হলোনা। যাইহোক যা বলছিলাম, ঐ দিন থেকে কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত আমি ফাহিমা ম্যাডামের ক্লাস কখনো মিস করিনি......অর্থনীতির মতো জটিল বিষয়টাকে ওনি ভালবাসিয়ে ছাড়লেন আমাকে! আজ অনেক দিন পর আবারো সেই স্বাদ পেলাম আপনার লেখায়। Cheers man, go ahead....!

তানভীর এর ছবি

জানা হোল অনেক কিছুই। বছর শুরুর সেরা সিরিজ নিঃসন্দেহে। আরো চলুক।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

সবজান্তা এর ছবি

আপনার মন্তব্যটা লেখার মতই সুপাঠ্য হয়েছে।

আমার একটা খুব স্টুপিড প্রশ্ন আছে। আমি এখনো ছাত্র, কোন আয় রোজগার নেই, তাই আয়কর এর প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে ঘুর পাক খায়, সেটা হচ্ছে, আমরা ট্যাক্স কেন দিবো ?
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি দেখি, আমরা যাও ট্যাক্স দেই, তাও তো আমাদের সুবিধা হয় না। ধরেন, আমি যেই এলাকাতে থাকি, তার রাস্তাগুলো আগে এমনই ভাঙ্গা ছিলো অনেক বছর, যে হাটতেও কষ্ট হত। এখন যাও ঠিক হয়েছে, তাও জোড়াতালি দিয়ে। আবার ভাংগতে শুরু করেছে। এখন আমার এলাকার একজন করদাতা যদি ভাবেন যে, ট্যাক্স দেওয়াতো অর্থহীন, কারন যেই টাকা দেই, তা যায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর রাজনীতিবিদের পকেটে, তা হলে কি ভুল হবে ?

আমি গুলশান-বনানীর ছোটলোক চরিত্রের বড়লোকগুলিকে বাঁচানোর জন্য বলছি না। তাদের নিয়ে আমার বক্তব্য না। আমার কথা হচ্ছে, যেইসব মধ্যবিত্তরা কর দেন, তাদের নিয়ে।

সুশাসন নিশ্চিত না হলে কি আমরা জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত করদান আশা করতে পারি ?

এই ব্যাপারে বিশদ জানার আগ্রহ থাকলো।
-------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

সবজান্তা ভাই,

খুব ভালো পয়েন্ট ধরেছেন। সাধারণ মানুষ কিসের ভরসায় কর দিবে? আসলে একটা চক্করের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা। রাজস্বের অভাবে অবকাঠামোর উন্নতি করা যাচ্ছে না। কিন্তু আবার অবকাঠামোর উন্নতি হয় না দেখেই মানুষ কর দিতে রাজী না। ডিম আগে না মুরগী আগে? এই vicious cycle থেকে বেরুবার উপায় কি? কে এগিয়ে এসে এই অশুভ বৃত্ত ভেঙে দেবে?

আসলে এসব প্রশ্নের সদুত্তর জানা নেই। কিন্তু খেয়াল করবেন যে হয়তো আপনার লেখার মধ্যেই প্রশ্নের উত্তরের বীজ লুকিয়ে আছে। আপনি সুশাসনের কথা বলেছেন। তার মধ্যেই পরিত্রাণের পথ। এক পর্যায়ে এসে আমাদের কোন এক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে এই কাজটা করে দেখাতে হবে --

একটা পাড়ার রাস্তা পুনর্নিমানের পাবলিক টেন্ডার হবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই টেন্ডার যাবে সবচেয়ে যোগ্য কন্ট্রাকটরের কাছে। মন্ত্রী বা লোকাল সাংসদকে কোন ঘুষ দিতে হবে না এই টেন্ডার পেতে। সেই নির্মাতা ভালো পিচ-বালু-সুড়কি দিয়ে ভালো কিছু রাস্তা বানিয়ে দেবে। সেই রাস্তা ছয় মাসের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে না, বরং ছয় বছর পরেও সেই রাস্তা পাড়ার মানুষকে দিব্যি সার্ভিস দিয়ে যাবে।

এই পাড়ার উদাহরণ পাশের আরো পাঁচটা পাড়া দেখবে। তাদেরও এরকম প্রক্রিয়ায় রাস্তা নির্মান হবে। কোন এক সময় এসে এই পাড়ার মানুষগুলার হয়তো এই বোধ হবে যে ট্যাক্স দেওয়া জিনিসটা তো আসলে খারাপ না, এতে নিজেদেরই লাভ হয়...

স্বপ্ন হয়তো একটু বেশীই দেখে ফেলছি - যদিও কিছু খাইনি! কিন্তু দেখতে তো ইচ্ছা হয়। এরকম কোন না কোন একদিন তো হবে। ৫০ বছর আগে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের লোকেরা আমাদের থেকে অনেক গুণে পিছিয়ে ছিল। তারা অনেক বেশী বিশৃংখল ছিল, অনেক বেশী অনুন্নত ছিল, অনেক বেশী জংলি ছিল আমাদের তুলনায়। কিন্তু ৫০ বছরে ওদের জাতির মৌলিক ডিএনএ চেঞ্জ করা গেছে - তারাও এখন বোঝে শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা আর পরিশ্রমের মূল্য। আর সেই সুবাদে কোথায় চলে গেছে তারা।

আমাদেরও এমন একদিন হবে, সেই স্বপ্নই দেখি। কিন্তু কাউকে না কাউকে অল্প কয়েকদিনের জন্যে হলেও সুশাসন করে দেখিয়ে দিতে হবে, যে আমরাও পারি।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ekojon_probashi এর ছবি

ধন্যবাদ সুবিনয় মুস্তাফী ভাই
ট্যাক্সেশনের ব্যাপারটা নিয়ে আমি ও কিছু জানতে চাইছিলাম।
আপনার কি মনে হয় না
বাংলাদেশের ট্যাক্সেশন সিস্টেম অনেক পুরানো এর একটা রিফর্ম বা ব্যাপক রদবদল দরকার?
পাশাপাশি জনসচেতনতা দরকার
কারন দেখেন শুধু সচেতনতার অভাবে লোকে হাজার টাকা ঘুষ দেবে কিন্তু শ'খানেক টাকা কর দিতে গড়িমসি করে ।
আপনার মত সপ্ন আমরাও দেখি
আর কে এগিয়ে নেবে ?
বাংলাদেশের তরুন প্রজন্ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।