বেশ কয়েক বছর ধরে বিলেতে আছি - দরজার ওপাশেই ইউরোপ, কিন্তু সেই তুলনায় কন্টিনেন্ট একেবারেই ঘুরে দেখা হয়নি। শুরুতে কিছুদিন ছাত্র ছিলাম, তাই শূন্য পকেটে বিদেশ ঘোরা খুব একটা বাস্তবসম্মত ছিল না। কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পরেও নানান এই-সেই করে ইউরোপে আর তেমন যাওয়া পড়েনি - একবার শুধু দুর্দান্তর ওখানে হল্যান্ডে গিয়েছিলাম।
এই বছরের শুরুতে তাই ঘোর সংকল্প করেছিলাম যে এই অবহেলার অবসান ঘটাতেই হবে। ছয় মাস অন্তর অন্তর বাপ-মার আবদার 'ঢাকায় আসো, ঢাকায় আসো'। আমি জানুয়ারী মাসেই বলে দিলাম, বছর শেষের আগে আর আসছি না। শুনলাম তাদের ঘ্যান-ঘ্যান - কিন্তু ব্যাপার না। আমার চিন্তা হলো কোথা থেকে যাত্রা শুরু করা যায়। পূর্ব ইউরোপ নিয়ে ভীষণ ফ্যাসিনেশান ছিল - কাজের ক্ষেত্রে একটা বড় সময় আমি ব্যয় করি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে - পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, ইত্যাদি। আমার দুইজন সহকর্মী আছে, পোল্যান্ড থেকে আগত, তারাও বললো - যাও দেখে আসো, সুন্দর লাগবে। আর মনের পেছনে ছোটবেলার একটা ট্রিগারও কাজ করছিলো, কিছুটা নিজের অজান্তেই।
যখন ছোট ছিলাম...
বাসায় আব্বার একটা বই ছিল - শিরোনাম 'আইখম্যান'। হিটলারের জল্লাদ, ষাট লক্ষ ইহুদি হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধাণ চালিকাশক্তি এডোলফ আইখম্যানের জীবনী, বাংলায় অনুবাদ করা। ছোটবেলায় সেই বইয়ের পাতা উল্টাতাম - দেশের সর্বাত্মক ইহুদি-বিদ্বেষী পরিবেশে আমার তখন এতটুকু বোঝারও ক্ষমতা ছিল না যে সেই হত্যাযজ্ঞ ভূল না ঠিক। (বুঝেছি আরো পরে, বড় হয়ে, একটু বিবেক যখন এসেছে।) তো সেই বইয়ের পাতায় দেখতাম কিছু নাম ঘুরে ফিরে আসে, ইউরোপের ইতিহাসে যেগুলো চিরস্থায়ী কালিমা - আউশউইৎস, ত্রেব্লিংকা, মাইদানেক, সোবিবোর। নাৎসীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল এগুলো - বেশীর ভাগই পোল্যান্ডে। জীবনের কোন এক সময়ে এই স্থানগুলো স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা ছিল, মনের গহীন কোনে। যদিও ঢাকায় সেই দশ বছর বয়সের ছেলে - বইয়ের পাতায় চোখ তার আটকানো - তার পক্ষে আদৌ জানা সম্ভব ছিল না যে সেই সুযোগ একদিন আসবে কি না।
সব কিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। টিকেট কিনলাম রায়ানএয়ার (Ryanair) থেকে, 'কুখ্যাত' ডিস্কাউন্ট এয়ারলাইন্স, ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চলে যাওয়া যায় এতে করে মাত্র ৪০-৫০ পাউন্ডে। ছুটি নিলাম সেই মাফিক। এর পরের ঝক্কি ভিসা নেওয়া। লন্ডনের পোলিশ এম্ব্যাসীতে সব মিলিয়ে তিন দিন গেলাম, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়ালাম। কনকনে শীতের হাওয়া সহ্য করে ঠায় দাঁড়িয়েছি, এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক দুই ঘন্টায় গিয়ে ঠেকেছে, তবুও ধৈর্য, আশা।
অবশেষে ভিসা মিললো গতকাল। আজ সকালে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম, বাসা থেকে সোজা স্ট্যান্সটেড এয়ারপোর্ট। রায়ানএয়ারের ফ্লাইট, দুপুর ১টার সময়। গন্তব্য - দক্ষিণ পোল্যান্ডে অবস্থিত ক্রাকোভ (Krakow) শহর।
ক্রাকোভের পথে
ঠিক ক্রাকোভ কেন? শুনেছিলাম যে পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর যে তিনটি শহর, ক্রাকোভ তাদের অন্যতম। অপর দুটো ভিয়েনা এবং প্রাগ (চেকের রাজধানী)। ক্রাকোভের কেন্দ্রের স্থাপত্য শৈলী ইতালীয় রেনেঁসার ধাঁচে তৈরী, কমিউনিজমের ৫০ বছরের শাসনামলেও সেটার তেমন ক্ষতি সাধন হয়নি। ফলশ্রুতিতে কমিউনিজমের পতনের পরে ক্রাকোভের আর্কিটেকচারের সুখ্যাতি সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। উইকেন্ড কাটানোর জন্যে ক্রাকোভ এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল পর্যটকদের কাছে। শুক্রবারের কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলায় অনেকে ফ্লাইট নিয়ে এখানে চলে আসেন, দুইদিন থেকে রোববার রাতে ফিরে যান। ফ্লাইটের সময়ও বেশী না - দুই ঘন্টা লাগলো লন্ডন থেকে আসতে। সাংস্কৃতিক জাতীয় আকর্ষণগুলো তো আছেই - তা ছাড়াও ইয়াং পোলাপানের কাছে ক্লাবিং করার জন্যেও ক্রাকোভ একটা হট-স্পট আজকাল।
দুপুরের ফ্লাইট ছিল। এক ইয়া-মোটা পোলিশ মেয়ের পাশে সীট পড়লো। এদিতা ক্রাকোভেরই মেয়ে, এক বছর ধরে লন্ডনে আছে। গ্রেট অরমন্ড হাসপাতালে ক্লিনারের চাকরি করে - কিন্তু নিজের দেশের তুলনায় অনেক ভালো মাইনে পায়, তাই কোন আক্ষেপ নেই। ক্রাকোভ থেকে প্লেন যখনও এক ঘন্টা দূরে, তখনই সে খুশীর চোটে মাতোয়ারা। এক বছর যাবত দেশে যায়নি, এয়ারপোর্টে তার পুরো ফ্যামিলি আসবে তাকে নিতে। আমরা ক্রাকোভের অদূরে বালিৎসে (Balice) বিমানবন্দরে এসে নামলাম স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায়। এদিতার পরিবার দেখলাম তার মতোই বিশালাকৃতির।
বিকালটা সুন্দর ছিল - এই সময়ে যতটা ঠান্ডা হওয়া উচিৎ, হয়তো গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কল্যাণে ততটা আর হচ্ছে না। লন্ডনের মতো ঠেকলো তাপমাত্রা। বালিৎসে থেকে বেরিয়েই পোল্যান্ডকে ভালো লেগে গেল। শীতের দিন, ন্যাড়া পাইন গাছগুলো সব নীলচে আকাশের দিকে আঙ্গুল তাক করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। মোরগের ডাক ভেসে এলো দূর কোথাও থেকে। গত ১৫ বছরে সমাজ ও অর্থনীতির সংস্কার আর আধুনিকায়ন চলেছে ঝড়ের বেগে, তারপরেও পোল্যান্ড এখনো অনেকদিক থেকেই ট্র্যাডিশনাল একটা দেশ রয়ে গেছে। কৃষি এখনো অর্থনীতির একটা বড় স্তম্ভ, গ্রামাঞ্চলের সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ এখনো নিবিড়। বালিৎসের বাইরে রাস্তাঘাট দেখলাম, কেমন যেন মনে হলো ঢাকার অদূরে গাজীপুর বা টাঙ্গাইলের মতো কোথাও চলে এসেছি - আরো পরিস্কার, আরো ঠান্ডা কিন্তু আমেজটা অনেকটা ঐ রকমই।
পোল্যান্ডে চলাচলের জন্যে ট্রাম এবং ট্রেন সবচেয়ে বহুলপ্রচলিত যানবাহন। বিরাটাকৃতির এক ট্রেনে চড়ে বিমানবন্দর থেকে ক্রাকোভ শহরে এসে পৌঁছলাম। সেন্ট্রাল স্টেশন, ১৫ মিনিটের ট্রিপ। শহরের যেই হোস্টেলে থাকবো, সেটায় পৌঁছাবার ডিরেকশন নেট থেকে প্রিন্ট করে এনেছিলাম। রেল স্টেশন থেকে বেরুলাম তাই হোস্টেল খুঁজে বের করতে। টাকা ভাঙ্গিয়ে নিয়েছিলাম আগেই। পাউন্ড প্রতি সাড়ে চার য্লোতি (zloty) পাওয়া গেলো।
স্বপ্ন যখন সত্যি
স্টেশন থেকে বেরিয়েই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। অবশেষে ছোটবেলার স্বপ্ন সফল - চলে এসেছি মিটেলইউরোপায়। শৈশবের আরেকটা প্রিয় বই, প্রিয় স্মৃতির কথা মনে পড়লো - এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী। বার্লিন শহরে এমিল আর তার বন্ধুদের মারাত্মক একদিনের এডভেঞ্চার। মনে হচ্ছিল তেমনই একটা গল্প বা মুভির মধ্যে চলে এসেছি - এই তো রাস্তার মধ্যে খাঁজ কাটা ট্রাম লাইন ধরে ধীরগতিতে চলে আসছে ট্রাম, সন্ধ্যা হয় হয়, শীতের বাতাসে কিছু মানুষ অপেক্ষা করছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ধোঁয়া বেরুচ্ছে ঠান্ডায়, পুরু জ্যাকেট কোট আর হ্যাটে মোড়া সবাই।
বুড়িমা বাবুশকাদের দেখলাম এখানে ওখানে, বাজারের থলে হাতে ধীর পায়ে এগোচ্ছে। মনে হলো প্রগতি প্রকাশনের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে - কত পরিচিত। এরাই দেখেছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, নাৎসীদের হত্যার প্রলয়, হিটলার আর স্টালিনের পেশীর লড়াই। অতঃপর কমিউনিজম, বার্লিন ওয়াল, স্নায়ুযুদ্ধ, চার্চিলের আয়রন কার্টেইন। কত ইতিহাস, বিংশ শতাব্দীর কত কিছুই না দেখতে হয়েছে এই অঞ্চল, এই শহরের মানুষকে। রাশিয়ার লোহার বুট, শীতল যুদ্ধের ৫০ বছর। ক্যাথলিক চার্চের প্রতিরোধের ঘাঁটি ছিলো ক্রাকোভ শহর - পোপ জন পল রোমের পোপ হিসেবে নির্বাচিত হবার আগে ক্রাকোভ শহরেরই আর্চবিশপ ছিলেন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালো ১৯৯০-এ, পুরো অঞ্চল ধীরে ধীরে ফিরে এলো আবার ইউরোপের বুকে। ২০০৪ সালে পোল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করেছে। ভৌগোলিক দিক থেকে পোল্যান্ড বরাবরই ইউরোপের একেবারে মধ্যেখানে, এখন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দিক থেকেও সেই স্থান সে আবার দাবী করার সাহস ফিরে পাচ্ছে।
ব্লিং ব্লিং-এর গোলক-ধাঁধা
ম্যাপ দেখে দেখে যাচ্ছিলাম আর এই সব কথা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। স্টেশন থেকে হোস্টেল পর্যন্ত পথটুকু বেশ মলিন ঠেকলো - শহরের এই পাড়াটা সাধারণ গোছের। সেন্টারের সেই মোহনীয় আর্কিটেকচার এখান থেকে আরো ১৫-২০ মিনিট দূরে। কিন্তু প্রথম কাজ হোস্টেল খুঁজে পাওয়া। অন্ধকার হয়ে আসছে। খুঁজতে খুঁজতে পেদিচোভ স্ট্রীটের ৭ নম্বরে এসে পৌঁছলাম, ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। বেল দিলাম, দরজাও খুললো, কিন্তু ভেতরে একেবারে নিকষ ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা সিঁড়ির ছায়া দেখা যাচ্ছে। আমি একটু ভ্যাবা-চ্যাকা খেয়ে গেলাম। আবার ফুটপাথে বেরুলাম, দরজায় নাম-ধাম দেখে ফের ঢুকলাম অন্ধকারে, হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়িটা বেয়ে উঠলাম, কিন্তু দেখি প্রাইভেট ফ্ল্যাট। কি মুশকিল। আবার নামলাম, এবার একটা দরজা খুঁজ়ে পেলাম, খুলে দেখি বাড়ির পেছনের কংক্রীট-মোড়া একটা খোলা জায়গায় চলে এসেছি! এতো আচ্ছা বিপদে পড়লাম। হোস্টেলই খুঁজে পাচ্ছি না, পড়েছি উল্টা গোলক ধাঁধায়! এবার ফোন বের করে ফোন দিলাম - মোবাইলে কত বিল উঠবে কে জানে, কিন্তু হোস্টেলে ঢোকা দিয়ে কথা। ঘরে-বাইরে এখন পুরো অন্ধকার।
একটা মেয়ে ফোন ধরলো - হঠাৎ একটা দরজা খুলে গেলো, তারপর আঁধারে পথ দেখিয়ে সে আমাকে নিয়ে এলো 'ব্লিং ব্লিং' (Bling Bling) হোস্টেলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। হোস্টেলটা বেশ সুন্দর, ছোট-খাটো কিন্তু ছিমছাম, আর দরকারী ফ্যাসিলিটিজ সবই আছে। কিচেন, বাথরুম, শাওয়ার, ইন্টারনেট, এমন কি ওয়্যারলেস কানেকশনও! রুমের চাবি নিলাম, লকারে জিনিস ফেলে একটু জিরোলাম। কাজ আছে কিছু - ফোন কার্ড কিনতে হবে, একটা তিন দিনের বাসের টিকেট করতে হবে, ঠান্ডা এখন ঠেসে নামছে - বেকুবের মতো উলের টুপি বা মাফলার আনতে ভূলে গেছি, দুটোর অন্তত একটা কিনতে হবে। রাতের বেলা নতুন জায়গায় ঘোরাঘুরি কতখানি নিরাপদ তাও ঠিক জানি না, তবে আর সব কিছুর আগে দরকার খাওয়া-দাওয়া। তাই ব্যাগ-ট্যাগ রেখে হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নিয়ে হোস্টেলের বাইরে চলে এলাম।
কারোলিনার কথা
কাছেই একটা স্যান্ডউইচের দোকান দেখেছিলাম। সেখানে ঢুকে স্যান্ডউইচের অর্ডার দিতে দিতে দোকানী কারোলিনার সাথে কথা হলো। পোল্যান্ডের নবীন প্রজন্মের প্রায় সবাই দেখি কোন না কোন প্রকার ইংরেজী বলে। কারোলিনার ইংরেজী বেশ ভালো। সে আশ্বাস দিলো যে স্যান্ডউইচে শুকরের মাংস নেই, পুরোটাই বিফ। জিজ্ঞেস করলো কোত্থেকে এসেছি - বাংলাদেশ শুনে বললো, এই শহরে বেরাতে ইউরোপীয় লোকই আসে বেশীর ভাগ, মাঝে মাঝে কিছু চীনা বা জাপানী। কালো বা বাদামী অত আসে না। স্যান্ডউইচ বানাচ্ছে আর কথা বলছে। জিজ্ঞেস করলাম, উলের টুপি কই পাবো। সে বললো হেঁটে গালেরিয়া'তে চলে যাও। বিরাট একটা নতুন শপিং মল, ১০-১৫ মিনিট লাগবে এখান থেকে। কিন্তু চিন্তার কারন নেই, রাত ১০-১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে সেটা।
টুকিটাকি আলাপ - সে ইউনিভার্সিটিতে মার্কেটিং পড়ে, আরো লাখো অল্পবয়সী পোলিশদের মতো তারও অনেক আশা-আকাংখা, এক সময়ে লন্ডনে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার। সে বললো যে এই দেশে যতোই কাজ করুক না কেন, খুব বেশী ভালো বেতন সে কখনোই পাওয়ার আশা করে না। ক্রাকোভের অফিসে কাজ-টাজ করলে যা বেতন পাবে তা লন্ডনী টাকায় মাসে ৪০০ পাউন্ডের বেশী হবে না। ওদিকে লন্ডনের দোকানে বা কাফেতে কাজ করলেও মাসে কম সে কম হাজার পাউন্ড। লন্ডনে জিনিসপত্রের চড়া দাম ধরার পরেও লাভ থাকে। এ কারনেই সবাই যাচ্ছে সেখানে।
স্যান্ডউইচ বানানো শেষ। সাথে একটা পেস্ট্রি আর একটা কোক কিনে হোস্টেলে ফিরে এলাম। খেয়ে-দেয়ে একটু সুস্থির লাগলো। বাইরে রাত, কনকনে ঠান্ডা, বেরুতে ইচ্ছা করছে না। সারাদিনের অবসাদ গায়ে। ঘুম চলে এলো।
The revolution will not be televised
উঠে দেখি রাত ৯টা। বুঝলাম গালেরিয়াতে গিয়ে টুপিটা এখন কেনা দরকার। আজকে রাতে আর বেশী ঘোরাঘুরি করবো না, কিন্তু টুকিটাকিগুলো সেরে ফেলা উচিৎ। আবার বেরুলাম। অন্ধকার, নির্জন। অল্প কিছু মানুষ এদিক ওদিক, অল্প কিছু গাড়ি-ঘোড়া।
লক্ষ্য করলাম লোকাল মানুষজন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। সারাদিনে একটা বাদামী বা কালো চেহারা এখন পর্যন্ত দেখিনি। এরাও দেখে না সচরাচর, বুঝতে পারলাম। উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসতে আসতে তাদের চোখ আমার মুখের উপরে নিবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশে আগত বিদেশীদের কেমন লাগে, আজকে শেষমেষ বুঝলাম। আমরা তো সারাক্ষণই ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম - দ্যাখ ফরেনার, ফরেনার! খুব একটা ভালো অনুভূতি না আসলে। বাজে লাগে। তবে মোটামুটি নিরাপদই লাগলো হাঁটতে। যদিও আজাইরা ঝুঁকি নেওয়া উচিৎ না।
চলে এলাম গালেরিয়াতে। বিশালাকৃতির মল। বসুন্ধরাকে ১০ দিয়ে গুণ করলে এই মলের সাইজের আন্দাজ পাবেন। ভিতরের ডিজাইন আর চাকচমকও পুরোপুরি পাশ্চাত্য স্টাইলে, কোন দিক থেকে কমতি নেই। দোকানের কাঁচের ডিসপ্লে জানালায় ঝুলছে প্রকান্ড সব সাইন - জানুয়ারী মাসের বিরাট Sale! Sale! Sale! বাজারের ভাষা সব দেশে একই!
টুপি খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম জিনিসপত্রের দাম এখানেও বাড়ছে - লন্ডন থেকে একই দামে কিনতে পারতাম এই মাল। তাও নেহায়েত জরুরী জিনিস, নইলে কান খসে যাওয়ার সমূহ আশংকা আছে। খুঁজে-পেতে একটা রং-বেরংয়ের উলের টুপি কিনলাম। মলের ভেতর দিয়ে হাঁটছি, দোকানপাটের শো-শা দেখছি, আর মাথা দিয়ে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। একটা স্লোগান ছিল, কে বা কারা শুরুতে বলেছিলো ঠিক জানি না - The revolution will not be televised। আমি ক্রাকোভের গালেরিয়াতে ঘুরতে ঘুরতে ভাবলাম The revolution will be privatized instead। The revolution will be marketed।
মল থেকে বেরিয়ে গেলাম। শহরের এদিকে বিরাট কিছু কিছু বিল্ডিং আছে, এখন পর্যটকদের হোটেলে রূপান্তরিত। কে জানে, হয়তো আগের আমলে কোন সরকারী দপ্তর ছিল। পঞ্চাশ বছরের কমিউনিজমের রেশ কি এখনো লেগে আছে এই কুৎসিত বিল্ডিংটার গায়ে, কিম্বা ঐ বুড়োর চেহারার ভাজে ভাজে? নাকি আমারই কল্পনা? বাস টিকেট কাটলাম, ফোন কার্ড কিনলাম একটা। অতঃপর হোস্টেলে ফিরে এলাম। হোস্টেলের লাউঞ্জের এক কোনায় দাঁড়িয়ে একটা ছেলে প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে দেয়ালে রং করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি আঁকছো। সে বললো, ক্রাকোভের কিছু দর্শনীয় বিল্ডিং-এর দৃশ্য এগুলো। দুই পাশের দেয়ালে আঁকবো, সুন্দর লাগবে। একটু পরে সে রংয়ের ঘটি-বাটি বন্ধ করলো, পাশের সোফায় এসে বসলো। আড্ডায় মাতলাম।
পিওত্র আর মার্তা
ছেলেটার নাম পিওত্র বা পিটার। ২৭ বছর বয়স। ক্রাকোভের প্রসিদ্ধ ইয়াগিয়েলোনিয়ান (Jagiellonian) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে ইন্টারন্যাশনাল কালচার-এর উপর পড়াশোনা করে এখন চাকরি পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই কারনে সে পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এসব জায়গায় থেকে এসেছে, কাজ করেছে। কিন্তু এখন আবার ক্রাকোভ-এ ফেরত। তার কাজ পেতে অসুবিধে হলেও সে আশাবাদী। বললো লেগে থাকলে পেয়ে যাবো আমি জানি। দিনকাল ভালো হচ্ছে তবে একটু ধীরে ধীরে। কিন্তু কমিউনিজমের কথা তার বেশ মনে আছে, বললো এই দেশে কেউ আর ঐ সময়ে ফিরে যেতে চায় না।
কিছুক্ষণ পরে হোস্টেলের রিসেপশনিস্ট মার্তা-ও একই কথা বললো। ২২ বছর বয়স, দেখতেও একেবারে ঝাক্কাস। মার্তা ইয়াগ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানী ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে, এক বছর জাপানে থেকেও এসেছে। পোল্যান্ডে বর্তমানে প্রচুর জাপানী কম্পানী এসে অফিস-কারখানা খুলছে। মার্তার ইচ্ছে টয়োটা-তে কাজ করা। কমিউনিজম যখন বিলুপ্ত হয় তখন মার্তার বয়স পাঁচ। বললো অত বেশী মনে নেই আমার, তবে সব কিছুরই অভাব ছিল তখন। আমেরিকার শিকাগো থেকে আমার নানীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা পুরনো কাপড় আর খেলনা পাঠাতো - সেটা পেলে যে কি খুশী হতাম আমরা, যেন ক্রিসমাস চলে এসেছে তাড়াতাড়ি! তবে মার্তা এও বললো, যে বর্তমানের রাজনীতিবিদদের নিয়ে নবীন প্রজন্ম অতিশয় বীতশ্রদ্ধ। তার উপরে আছে ক্যাথলিক-পন্থী সমাজের নানান বিধি-নিষেধ, বুড়োদের সেকেলে আমলের সেকেলে মূল্যবোধ। তাই কাজের সুযোগ থাকলেও অনেক ছেলে-পেলে স্বেচ্ছায় বিদেশে চলে যায়। শুধু টাকার খোঁজে না, মুক্তিরও খোঁজে।
কালকে থেকে শুরু হবে আসল ঘোরা-ফেরার পালা। দিন শেষে পোস্টানোর ইচ্ছা আছে, কতখানি পারবো দেখা যাক।
(This was written last night. This netcafe in the town centre has no Bangla font installed. - SM)
মন্তব্য
তিনদিনে প্রায় ৫০০ তুলছি। দেখি ভালোগুলা বেছে Picasaweb-এ এলবাম উঠাবো। কালকে ফেরত যাবো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
ইউরোপ নিয়ে আমার নিজেরও খুব আগ্রহ আছে। পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য বসে থাকলাম।
বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী এবং ক্রান্তিকালের মানুষ - শাহরিয়ার কবিরের লেখা "বলকান থেকে বাল্টিক" এর দু'টো পর্বেই চমতকার ধরা আছে এসব পূর্ব ইউরোপীয় মানুষদের কথা,বিশেষতঃ কমিউনিজমের পতনের সময় তাদের স্বপ্ন,আশা,আশাভঙ্গ ও বেদনার গল্প।
পোলিশদের মজ্জাগত রুশবিদ্বেষের ব্যাপারে পারলে একটু খোঁজখবর নিয়েন। আমি পোল্যান্ড গেছি বহুবার, আলাপও হয়েছে অনেক পোলিশের সঙ্গে। তাদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে যে ধারণাটি আমার হয়েছে, তার সাথে আপনারটা মিলিয়ে দেখতে চাই।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
প্রথম দিনের পরে আর কারো সাথে আড্ডা মারাই হইলো না। তবে আউশউইৎস গেছিলাম - ক্যাম্পের মুক্তিপ্রাপ্তির ৬৩তম বার্ষিকীও ছিল। কি যে দেখলাম ভাই। আমার জীবন আজকে স্বার্থক হইলো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
"তাই কাজের সুযোগ থাকলেও অনেক ছেলে-পেলে স্বেচ্ছায় বিদেশে চলে যায়। শুধু টাকার খোঁজে না, মুক্তিরও খোঁজে। "
এর সাথে বিদেশে বা বড় শহরে থাকতে চাওয়ার আর এক কারন হচ্ছে মুক্ত যৌনতার খোঁজ। ইউরোপে নতুন প্রজন্মের কাছে যৌনতা হচ্ছে সকালের নাস্তা বা গোসলের মত একটি নিষ্পাপ নৈমিত্তিক চাহিদা। নিজ গ্রাম বা ছোট কমিউনিটিতে সেটির অবাধ পূরণ অসুবিধাজনক যেখানে সবাই সবাইকে চেনে।
- অপ্রিয়
লেকাটি পড়ে ভাল লাগলো। I wish i will be there....
রায়হান আবীর
কথামালায় চলুক পূর্ব ইউরোপ সফর...আমারও যেতে ইচ্ছে করছে!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আঃ, সেই প্রগতি প্রকাশনের বই! আমাদের বাল্যকাল।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এই অংশটি পড়তে পড়তে আমিও হঠাৎচলে গিয়েছিলাম শৈশবের প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশনীর নানান বইয়ের ভেতর। এমন কি মনে পড়লো এই সেদিন বার বার দেখা দি পিয়নিস্ট ছবিটিরও কথা।...
দারুন বলেছেন তো! লেখাটি পড়তে খুবই ভাল লাগছে। পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায়।...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
হ্যা! তা তো নিশ্চয়ই! জলজ্যান্ত উদাহরণ দেখি আমরা পথে ঘাটে আব, যাব, গাব থেকে শুরু করে হালের পপ কালচার, ইংলিশ মিডিয়াম পোলাপাইনদের গায়ে চে'র টি-শার্ট। এদের দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে।
হাহা ইংলিশ মিডিয়াম গাইলাইয়ো না মিয়া, গায়ে লাগে...
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
I am going there in the coming Easter holidays...if possible put some tips in your writing about traveling over there...
Anything specific you want to know? Let me know and I'll try to answer. But make sure you do some research beforehand and have a good guidebook with you. I bought the Rough Guide to Poland before I came - it's terrific.
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
আপনার লেখাগুলো ঈর্ষনীয়।
মূর্খদের বিশ্বঅর্থনীতিশিক্ষার মতো ভ্রমণেরও একটা সিরিজ করে ফেলুন।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
হাহা দেখি, দোয়া রাইখেন, এই বছর আমি রাখছি ইউরোপ ভ্রমণের বছর। মইরা যাওয়ার আগে যা পারি দেইখা নেই, না কি কন?!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
বুড়িমা বাবুশকাদের দেখলাম এখানে ওখানে, বাজারের থলে হাতে ধীর পায়ে এগোচ্ছে। মনে হলো প্রগতি প্রকাশনের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে - কত পরিচিত
ঠিক এই লাইনটার জন্যই একবার পোল্যান্ড যাব একবার।
নতুন মন্তব্য করুন