'স্বপ্নের দেশ' হিসাবে মার্কিন মুলুক একদা সুপরিচিত ছিল। হয়তোবা অদ্যাবধি সেই সুনাম বলবৎ রহিয়াছে -- সঠিক জানা নাই। তবে অত্র দেশে যৌবনের তিনটি মূল্যবান বৎসর অতিক্রম করিবার পরে এই স্বপ্নের প্রকৃত রূপ আমার নিকট প্রতীয়মান হইয়াছিল। সত্য বলিতে খানিকটা দুঃস্বপ্নের ন্যায়ই ঠেকিয়াছিল।
স্বীয় লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম বিধায় বাঙ্গালি অভিবাসী বন্ধুমহল আমেরিকার ইতিবাচক দিকই কেবল দেখিতে পাইতো। অথচ কোন এক বিকৃত রুচির বশবর্তী হইয়া কি কারনে আমি নেতিবাচক বিষয়গুলাই অধিক লক্ষ্য করিতাম। সমাজের প্রতি স্তরে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞতা ছিল একখানা বড় উদাহরণ। যেই রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি অনেকাংশেই নির্ভর করিতেছে বিভিন্ন জাতিদিগকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ভাবে শোষণের উপর, সেই রাষ্ট্রের জনগণের অন্ততঃ বহির্বিশ্ব সম্পর্কে স্বচ্ছতর ধারণা থাকা আবশ্যক বলিয়া মনে হইতো। ইহা বাদেও কারন ছিলো। দৈনন্দিন জীবনে অপচয়, চারিদিকে অহেতুক বাহুল্য, নগ্ন বস্তুবাদী প্রবৃত্তির একচ্ছত্র আধিপত্য, ইত্যাদি চোখে লাগিতো। তদুপরি মার্কিনীদের ঈশ্বর-ঈশ্বর করিতে করিতে বিগলিত হইয়া যাওয়ার প্রবৃত্তিকেও চরম ভন্ডামি বলিয়া মনে হইতো। কোন এক বইয়ের পৃষ্ঠায় একদা পড়িয়াছিলাম - 'ঈশ্বর এবং অর্থকে একই সঙ্গে উপাসনা করা সম্ভব নহে'। কেবলি মনে হইতো যে মার্কিনীরা এই অসাধ্য সাধন করিতেই সচেষ্ট রহিয়াছে।
মার্কিন দেশে যত অস্বাভাবিক স্ফীতকায় মানুষ দেখিয়াছি, তাহা বিশ্বের আর অন্য কোথাও দেখি নাই। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের ফলাফল -- বিকটাকৃতির মানব-পর্বতমালা। প্রচার মাধ্যমে দিবা-নিশি তরল বিনোদন পরিবেশন করিয়া একটি দেশের জনগণকে কি রূপে উজবুক বানাইয়া রাখা যায়, মার্কিন মুল্লুক ছিল তাহারও প্রকৃষ্ট উদাহরন। দার্শনিক মার্ক্স বলিয়াছিলেন - ধর্ম হইলো জনতার আফিম। আমার নিকট মনে হইতো যে প্রয়াত দার্শনিকের উক্তির ঈষৎ পরিমার্জনা করা প্রয়োজন। বলিতে পারা যায় -- বোকা বাক্সের বিনোদনই আধুনিক বিশ্বের জনগণের প্রকৃত আফিম।
যাহা হোক, এই রচনা লেখিতে বসিবার কারন ব্যাখ্যা করি। স্বপ্নের দেশেও অনাচার, বৈষম্য ব্যাপক আকারে বিদ্যমান - কাট্রিনা ঘূর্ণিঝড়ের সুবাদে এই সত্য অনেকেই অবলোকন করিয়াছিলেন। অতিরিক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার একখানা কুফল হইলো ব্যাপক প্রাচুর্য্যের মাঝেও হতদরিদ্রের নীরব উপস্থিতি। সম্পদের আধিক্যের কারনে এই অভাব সচরাচর চক্ষুগোচর হয় না। তথাপিও সমাজের নিম্নবর্ণের মাঝে - বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে - দারিদ্র্য এবং অন্যান্য সামাজিক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটিয়া থাকে।
বিগত ছয় মাস ধরিয়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করিতেছে। উন্নত বিশ্ব হউক অথবা অনুন্নত, দৈনিক আহার্য খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অত্যাধিক বৃদ্ধি পাইয়াছে। বাংলাদেশে চাউলের দামের উর্ধ্বগতি সম্পর্কে সুধী মহল অবগত আছেন। পত্রিকা ঘাটিয়া আজিকে বুঝিতে পারিলাম যে এই মূল্যবৃদ্ধি মার্কিন মুলুকেও বড় আঘাত হানিয়াছে। পত্রিকার শিরোনাম - অগুণতি মার্কিনদিগকে অনাহার তাড়িয়া বেড়াইতেছে।
সংবাদখানি পড়িয়া যারপরনাই অবাক হইলাম। পৌনে তিন কোটি মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করিতে গিয়া মার্কিন সরকারের নিকট হাত পাতিতেছে। এবং মার্কিন দেশের শতকরা ১১ ভাগ জনগণ খাদ্যের নিশ্চয়তা অর্জনে ব্যর্থ হইতেছে। এক কোটিরও অধিক মার্কিনী অনাহারী অভুক্ত রহিয়াছে।
নিজ দেশেও আজি হাহাকার। তাই মার্কিন মুলুকের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্টে প্রীত হইবার কোন কারন নাই। তবে তথাকথিত স্বপ্নের দেশেও যে কোটি লোক ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাইতে যায়, তাহা জানিয়া পুনরায় নিশ্চিত হইলাম যে সেই স্বপ্ন সর্বদা সত্য নহে।
মন্তব্য
আমার জ্ঞান এত কম যে আপনার পোস্টগুলোতে মন্তব্য করতে ভয় লাগে।
তবে নিয়মিত পড়ছি... এবং অনেককিছু নতুন ভাবে জানতে পারছি আর নতুন ভাবে চিন্তা করতে পারছি। এটুকু জানিয়ে রাখি।
(বিপ্লব)
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন ভাবে চিন্তা করতে পারছি
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ব্লগার হিসাবে এইটা অনেক বড় প্রাপ্তি। অর্থনীতির নাড়ি-ভুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বরাবরি খুব ভালো লাগে, যদিও এই জিনিস আমি নিজেও এককালে কিছুই বুঝতাম না।
অরিজিনালি চাইসিলাম সাধু ভাষায় লেখা নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করি। খবরটা পড়ে লেখার ইচ্ছা চাড়া দিলো। তবে কষ্ট আছে লেখা!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
যেই রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি অনেকাংশেই নির্ভর করিতেছে বিভিন্ন জাতিদিগকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ভাবে শোষণের উপর
বাণিজ্যিক বারাজনৈতিক শোষণ ছাড়া কে কবে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে এবং ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পরও কে তার অপব্যবহার করে নি একটু বলতে পারবেন ? দীর্ঘদিন শোষিত হওয়ার পরও আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই কি পাহাড়িদের উপর চড়াও হইনি ?
তদুপরি মার্কিনীদের ঈশ্বর-ঈশ্বর করিতে করিতে বিগলিত হইয়া যাওয়ার প্রবৃত্তিকেও চরম ভন্ডামি বলিয়া মনে হইতো।
কেন ? আমার তো মনে হয় মার্কিনীদের ধর্মবোধ রোববার সকালের দুই ঘন্টায় সীমাবদ্ধ।
বোকা বাক্সের বিনোদনই আধুনিক বিশ্বের জনগণের প্রকৃত আফিম।
সহমত। wag the dogছবি দ্রষ্টব্য।
মানছি আপনার বক্তব্য----------যদিও পৃথিবীর সব দারিদ্র্যই সমানভাবে দুঃখের ------- সেই সব অনাহারীদের জন্যও দুঃখবোধ করছি -------- পাশাপাশি মনে হচ্ছে বাংলাদেশ-ও হয়তো সেদিকে যাচ্ছে ------- যদিও কিছুদিন আগেও আমরা প্রকাশ্যে নিজের দুর্দশা তুলে ধরতাম ------ এখন গণমাধ্যমে উন্নয়নের জোয়ার দেখাই ------আর এ-ও সত্য যে একসময় ঐ শোষকদের পূর্বসুরীদের বাণিজ্য করতে আসা স্বর্ণ এ ভূমিতেও মানুষ সমান অর্ধাহারীই ছিল
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
তাহলে বাউচার ব্যাটা যে বলল, বাংলাদেশের খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে, সেটা কেমনে হবে? এদিকে নিজের দেশে ১ কোটি মানুষ অনাহারী রেখে খাদ্য সংকটে পড়া দেশগুলোর জন্য ২০ কোটি ডলার সাহায্যের কথাও বলেছেন বুশ। এদের ব্যাপার-স্যাপার কেন জানি তেমন একটা বুঝি না।
................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
আমেরিকান গরীবের জন্য দুঃখ করার কিছু নাই। আমেরিকার গরীব আর বাংলাদেশের গরীবের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বাংলাদেশের গরীবের পেটে ভাত ক্যান, দানা-পানিও থাকে না। আর এদের পিছে আমেরিকান সরকারের ফুড স্ট্যাম্পের মতোও কোন সাহায্য-সহযোগিতা নাই। আম্রিকান গরীব হইল পত্রিকার ভাষাতেই – “struggle to put enough food on the table”। ওই “টেবিলে enough food” মানে কি বুইঝা লন। আমাদের মধ্যবিত্তের অবস্থা এখন আম্রিকার গরীবের চেয়েও অনেক করুণ। আর গরীবের কথা তো ইয়েতেই আসে না।
=============
"আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম"
খুবই অবাক হইছি Sam's Club-এর চাল কেনার ব্যাপারে বিধি নিষেধ আরোপ দেখে। নিয়ম করছে যে কেউ একবারে ৪ ব্যাগের বেশী চাল কিনতে পারবেনা। ঐ দেশে এইরকম পদক্ষেপ তাজ্জবই ঠেকে। আমার বধ্যমূল ধারণা আর কিছুদিন পরে একই রকম ভাবে তেলের শর্টেজ আসবে, গ্যাস স্টেশনে লম্বা লম্বা লাইন হবে, এবং পেট্রল রেশন করা শুরু হবে আবার - ঠিক সত্তুরের দশকের মত।
Jim Kunstler-এর লেখা পড়েন কখনো ? উনি peak oil theory এবং post-oil দুনিয়া নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন। Urban design, urban sprawl - এইসব নিয়েও তার ব্যাপক আগ্রহ। একটা ব্লগ আছে ওনার - Clusterfuck Nation. প্রতি সোমবার আপডেট করেন। পড়ে দেখতে পারেন - ফাটাফাটি রকম লং-টার্ম বিশ্লেষণ। অনেকে যদিও বলে কুন্সট্লার একটু বেশী ড্রামাটিক। কিন্তু আমার কাছে দারুণ লাগে ওর ভবিষ্যদবানীগুলা।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
আমার কিছুটা বদ্ধমূল ধারণা আম্রিকার গরিব হল শখের গরিব - নাইলে কোথাকার নেপাল, বাংলাদেশ থেকে লোকজন এসে কাড়ি কাড়ি টাকা কামায় (একটু বাড়িয়ে বলা, তবে খুব একটা খারাপ থাকে না ইমিগ্র্যান্টরা), আর আম্রিকার নাগরিক না খেয়ে গাছের তলায় থাকে!
আচ্ছা!
সংজ্ঞা আলাদা।
আমাদের হইলো চাল কেনার টাকা আছে কি নাই, সেইটা সমস্যা।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
হুমম!...কারো জুতো নেই, আর কারো পা-ই নেই!
মার্কিন পুঁজিবাদের এই সব অসঙ্গতি নিয়ে প্রায় একশ বছর আগে ম্যাক্সিম গোর্কি একটি কৃশকায় ছোটগল্পের বই লিখেছিলেন- 'পীত দানবের পুরী' (সিটি অব ইয়োলো ডেভিল)। স্পষ্টতই গোর্কি স্ট্যাচু অব লিবার্টির শহর নিউ ইয়র্ককেই বুঝিয়েছেন ওই পীত দানবের পুরী।
সুবিনয়দা, আপনার লেখা পড়তে পড়তে বহু বছর আগে পড়া ওই বইটির কথা মনে পড়ে গেলো। অনেক ধন্যবাদ।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
মার্কিন দেশে দুই দশকের অধিককাল অতিবাহিত করিয়া এই রচনার বিশ্লেষণের সহিত একমত না হইবার কারণ দেখি না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ভাষার এক্সপেরিমেন্ট মন্দ হয় নাই।
সাধু ভাষার মজা এটাই, লেখাটারে হাল্কা আর সিরিয়াসের মাঝামাঝি কোন একটা আরাফাতের ময়দানে এনে ছেড়ে দ্যায়!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নতুন মন্তব্য করুন