ফিরিয়ে দাও অরণ্য?

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: রবি, ২২/০৬/২০০৮ - ৩:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিবিসির ফ্রন্ট পেজে দুটো খবর আজকে চমকে দিলো। দুটোই পড়শী দেশ ভারতকে নিয়ে। আগেই বলে রাখি - এই খবর দুটো তুলে ধরছি, তাই বলে এই ভাবার কোন কারন নেই যে আমি প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তির খারাপ খবরে খুশী হয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছি। বরং ভারতের ট্রেন্ড আমাদের দেশের ভেতর কিভাবে প্রতিফলিত হতে পারে, সেটাই ভাববার বিষয়।

প্রথম খবরটি ভারতীয় বৃদ্ধদের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা নিয়ে। যত 'উন্নতি' হচ্ছে ততই বৃদ্ধদের প্রতি অবহেলা-অত্যাচার বেড়ে যাচ্ছে। 'আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের' এই কি অবধারিত পরিণতি? যত সমৃদ্ধি বাড়ে, যত সমাজ আধুনিকতর হয়, তত জীবনযাত্রার গতি দ্রুত হয়, ইঁদুর-দৌড়ে টিকে থাকার জন্যে বা এগিয়ে যাবার জন্যে মানুষ আরো প্রাণে-পণে দৌঁড়ায়। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পেছনে ফেলে যায় পুরনো জীবন আর সেকেলে আদর্শ। সমাজ ও পরিবারের পুরনো কাঠামো, বয়স্কদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-দায়িত্ব-ভালবাসা।

এমনকি তাদের যত্ন নেওয়াটাও ঠেকে এক দুর্বিষহ বোঝা হিসাবে। বৃদ্ধদের ভরণ-পোষনে পিছিয়ে যায় সন্তানাদি, এগিয়ে আসতে হয় সমাজ আর রাষ্ট্রকে। ভারতে যেটা হচ্ছে সেটা আমাদের দেশেও প্রতীয়মান। ওল্ড পিপলস হোম, যেটা ছিল কিনা কিম্ভুত এক পশ্চিমা বস্তু, যেটার দিকে আঙুল তুলে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও নৈতিকতার তুলনামূলক মহত্ত্ব খুঁজে পেতাম পশ্চিমাদের থেকে - সেই বৃদ্ধাশ্রমও চলে এসেছে বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন আগে।

বিবিসির রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি -

There has been a steady rise recently in reports of cases of elderly being abused, harassed and abandoned in India. Traditionally older people has been revered in India, signified by the touching of their feet by the younger generation. Prime ministers and presidents have almost always been senior citizens. Joint family systems - where three or more generations lived under one roof - were a strong support network for the elderly. But more children are now leaving their parental homes to set up their own. Sociologists say the pressures of modern life and the more individualistic aspirations of the young are among reasons why the elderly are being abandoned or, in some cases, abused.

ডেমোগ্রাফিক অদল-বদল বাংলাদেশেও হচ্ছে। চার-পাঁচটি সন্তানের বদলে অনেক পরিবারের এখন দুটি বড়জোর তিনটি সন্তান। সেই যে এককালে বাবা-মাদের ইন্সুরেন্স পলিসি ছিল - কোন না কোন একটা বাচ্চা আমাদের বুড়ো বয়সে দেখাশোনা করবে - সেই নিশ্চয়তা ধীরে ধীরে অকেজোর দিকে চলে যাচ্ছে। বুড়োদের এখন দেখে রাখবে কে?

*

অন্য খবরটা আরো বেশী দুঃখজনক, আশংকাজনক। ভারতে কন্যা সন্তান হত্যার মাত্রা বেড়েই চলেছে। ৯-১০% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেও, দুরন্ত 'আধুনিকতার' পিছনে ছুটেও যে মধ্যযুগের সবচেয়ে নীচু প্রবৃত্তি জ্বলজ্বল করতে পারে - তাই এই খবর পড়ে মনে হলো। উদ্ধৃতি - In one site in the Punjab state, there are just 300 girls to every 1,000 boys among higher caste families.

হাইয়ার কাস্ট ফ্যামিলিজ! এ কি করে সম্ভব? তারাই না ভারতের উন্নতির সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি? ইন্ডিয়া শাইনিং-এর যুগে তো উঁচু বর্ণেরই সবচেয়ে বেশী লাভ হয়েছে বলে জানি। পড়াশোনা থেকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল আর আইটির হাই-ফাই চাকরিতে তারাই সবচেয়ে বেশী ভাগ পেয়েছে। তাহলে এই অবস্থা কিভাবে হলো? একটা মেয়ে পালতে এতো কষ্ট কেন?

অবশ্য আমাদের দেশেও কি বৈষম্য কম? সেটাই বা কি করে বলি। হয়তো আমাদের কপাল ভালো যে আমাদের সমাজে আল্ট্রা-সনোগ্রাম প্রযুক্তি এতোটা ছেয়ে যায়নি। ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত সবার হাতে তা পৌঁছায়নি। পৌঁছালে কি হতো বলা যায় না।

তবে ভবিষ্যতের দিকে একটু তাকানো যাক। বাংলাদেশের জন্যে এখানে দুটো বড় রিস্ক আছে বলে মনে হয়।

১) ভারতের এই জেনারেশানের ছেলেরা যখন বেড়ে উঠবে, বয়োসন্ধি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন বিরাট সামাজিক দুর্যোগের আগাম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যৌন-প্রবৃত্তি থেকে শুরু করে স্ত্রী-পরিবার - এসবই মানুষের সহজাত স্বাভাবিক চাহিদা। আজকে যেই কন্যা সন্তানের অভাব, তার লজিকাল পরিণতি হলো ২৫ বছর পরে গিয়ে বিয়ের বয়সী যুবকদের জন্যে পাত্রীর প্রকট সংকট। সেই সময়ে সামাজিক অনাচার, পতিতাবৃত্তি, নানা রকম যৌন অপরাধ - এগুলো বাড়ার বদলে কমার কোন কারন দেখি না।

অনেকদিন আগে বিবিসির একটা প্রতিবেদনে এই বিষয়ে একজন পাঠক মন্তব্য করেছিলেন যে প্রায় অবধারিত ভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নারী হাইজ্যাক কিডন্যাপিং পাচারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেই মন্তব্য তখন বেশ যুক্তিসঙ্গত লেগেছিল। (চীনে ইতিমধ্যে wife-trafficking network তৈরী হয়ে গেছে। ওয়ান চাইল্ড পলিসির পরে তিন দশক গত হয়েছে, তাই এর 'প্রয়োজনীয়তা' চলে এসেছে। বিস্তারিত নীচে।) এই থেকে অনুমান করা যায় যে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানকে ঘিরেও এই রকম নারী পাচার নেটওয়ার্ক তৈরী হবে, এবং জোরদার হবে। আজ না হোক, তা আর ২০-২৫ বছরের মধ্যেই।

২) লক্ষ কোটি এক্সট্রা যুবক থাকার আরেকটা পরিণতি থাকতে পারে। ভারতের মতোই চীনেও কন্যা সন্তান মেরে ফেলা হচ্ছে অঢেল। একটা বড় কারন চীনের এক-সন্তান পলিসি (one-child policy) যা প্রায় ৩০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। চীনা সরকারের নিজের হিসাবেই ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় ৩ কোটি ব্যাচেলার বৌ-হীন অবস্থায় ঘুরে বেরাবে।

এই অবস্থার একটা খুব এক্সটীম সম্ভাব্য পরিণতির কথা পড়েছিলাম এক বিদেশী পত্রিকায়। এটা বাস্তবে কতখানি সত্য হবে জানি না, তবে আন্দাজ বা ভবিষ্যদবানী হিসাবে মন্দ না। চিন্তাটা হলো যে - এই ফ্রাস্ট্রেটেড যুবকদেরকে সমাজের কন্ট্রোলে রাখার তাগিদে সেনাবাহিনীর মত প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে। এই ছেলেদেরকে তো কোন না কোনভাবে সমাজে absorb করে নিতে হবে। সেনাবাহিনী সেই রকম একটা 'নারীহীন', macho বা masculine প্রতিষ্ঠান। কম বয়সী যুবকদের সমস্ত তেজ এবং জোশ সামরিক জীবনযাপনে প্রবাহিত হবে। এবং এই একই কারনে চীনের বহির্বিশ্ব-নীতিও আগের তুলনায় আরো যুদ্ধংদেহী (militaristic) এবং আগ্রাসী পথে এগুবে।

চীনের বেলায় যেটা লেখা হয়েছিল, সেটা ভারতের বেলায়ও খাটতে পারে। তবে আবারও বলা উচিৎ যে এটা স্পেকুলেশান, এবং প্রথম সত্যটা ফলে গেলেও, দ্বিতীয়টা ফলবে কিনা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না।

*

তবে বিশেষ করে চীনে বুড়োদের ডিপেন্ডেন্সির যে করুণ চেহারা হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার বলেছে যে অন্তত আরো দশ বছর তারা ওয়ান-চাইল্ড পলিসি ধরে রাখতে চায়। সেখানে ছোটকালে একটা শিশুর পেছনে ৬ জন মানুষ (দাদা দাদী নানা নানী বাবা মা) তাদের সমস্ত আদর সোহাগ টাকা পয়সা ঢেলে দেন। সেখান থেকে বাচ্চাদের হয়েছে little emperor বা খুদে সম্রাট সিন্ড্রোম। (পক্ষান্তরে আমার নানা নানীর যেমন দুই ডজন নাতী নাতকুর। তাই এম্পেররগিরি করতে পারিনি, ভাই বোন বা কাজিনদের সাথে সব ভাগাভাগি করতে হয়েছে।)

কিন্তু পরে গিয়ে এই সমস্যা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যদি দাদা-দাদী নানা-নানী এবং বাবা-মার জেনারেশানও দীর্ঘায়ু হয়, তাহলে শেষে গিয়ে কেবল একজন মানুষের ওপর তাদের সবার দেখ-ভাল, খোঁজ খবর, যত্ন-আত্তির দায়িত্ব এসে বর্তাচ্ছে। তখন কয়টা সন্তানের পক্ষে এতখানি দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হবে? কয়জন স্বেচ্ছায় কনফুশিয়ান সমাজের এই স্তম্ভটাকে (বড়দের প্রতি সম্মান) মেনে চলবে? এই সমস্যাকে নাম দেয়া হচ্ছে '৪-২-১ সমস্যা'।

এর বিপরীতে প্রয়োজন হবে বর্ধিত রাষ্ট্রীয় পেনশনের। সেটা শুধু সরকারী চাকুরেদের জন্যে না, বরং সমাজের সব বুড়োবুড়িদের জন্যেই দরকার হবে। শেষ বয়সে বাচ্চাদের উপর নির্ভর করার চিন্তা বাদ দিতে হবে, পশ্চিমের মতই রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং-এর উপর ভীষণ জোর দিতে হবে। সন্তানের পরিবর্তে বিরাট বিরাট পেনশন ইন্ডাস্ট্রি, পেনশন ফান্ড গড়ে উঠবে, আর রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে নানা উপায়ে। পশ্চিমে এগুলো অনেকদিন থেকেই চালু ছিল, এখন সব দুধ-ভাত। মনে হচ্ছে উন্নয়নের নামে অদূরদর্শী সামাজিক নীতির ফলে প্রাচ্যেও এগুলো চলে এলো কেবল।

(বলে রাখা দরকার ছিল আমি জনসংখ্যাবিদ জাতীয় কিছু নই। এইসবই amateur চিন্তাভাবনা। তবে demography is destiny বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সেটার সত্যতা পদে পদে মিলে দেখেই এই বিষয়ে আগ্রহ। পশ্চিমে ইমিগ্র্যান্ট নিয়ে যে নিত্য কচলাকচলি চলছে গত ৭-৮ বছর ধরে তার নিচেও রয়েছে তাদের সুগভীর ডেমোগ্রাফিক সমস্যা।)


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

দ্বিতীয় বিষয়টা বেশ আগে পড়েছিলাম কোথাও।
আরও একটা খবর দিই (হয়ত দেখেছেন)।
ইংল্যান্ডের এক পাঞ্জাবী কাপল (৬০+, ৫০+) বংশ ঠিক রাখার জন্য আইভিএফ করে। এত বয়সে ইংল্যান্ডে কোন ডাক্তার সেটা করতে রাজী হয়নি, তাই তারা ভারত গিয়ে কাজটা করায়। ইংল্যান্ডে একটা হাসপাতালে যখন মহিলা বাচ্চার জন্ম দেয়, তখন দেখা যায় সেটা কন্যা। ঠিক তখনই ভদ্রলোক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়, যে বাচ্চাটা তারা নিবে না। জানতে চায় মহিলাকে নিয়ে কত দ্রুত আবার ভারত যাওয়া যাবে, আরেকটা ট্রাই দেয়ার জন্য।

কীর্তিনাশা এর ছবি

দারুন লাগলো। এত তথ্য আগে জানা ছিল না। ভারত, চীনের পাশাপাশি আমাদের দেশের অবস্থাটা জানতে পারলে ভালো লাগতো।

-----------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ভাল লাগালো এবং ভাবালো। আপনার বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং ঝরঝরে আলোচনা লক্ষণীয়। ধন্যবাদ।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

হিমু এর ছবি

খুবই ইন্টারেস্টিং ইস্যু। কিন্তু চীন আর ভারতে যদি যুগপৎ এই পুরুষ-সংখ্যাগুরুত্ব দেখা দেয়, তার পরিণতি, অর্থাৎ সম্মিলিত প্রভাব কিন্তু আরো খারাপ হতে পারে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

আরো একটা ফলাফল - ভবিষ্যতে সমকামিতার হার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সম্পূর্ণ পোস্টের সাথেই সহমত। দরকারী আলোচনা। বিষয়-নির্বাচনে যথারীতি মুগ্ধ।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কতোদূর এগোলো মানুষ?'

সভ্যতা শুনি এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নে আমাদের মোক্ষলাভ ঘটবে। বয়স্কদের বিষয়ে অবহেলা-উপেক্ষা-অযত্ন সবই ক্রমবর্ধমান বস্তুতান্ত্রিক জীবনের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। কিন্তু মেয়ে শিশু-ভ্রুণ হত্যা কোন যুক্তিতে ফেলা যায়? সভ্যতা শব্দটাকে তখন শুধুই উৎকট রসিকতার মতো শোনায়। আদিমযুগে যখন সভ্যতার ধারণাও সৃষ্টি হয়নি, মানুষ শুধু জীবনধারণের জন্যেই বেঁচে থাকতো, তখনো মানুষ মেয়ে শিশুদের এভাবে হত্যা করেনি। ধর্মের নামে, সংস্কার বা প্রথার নামে এই হত্যাকাণ্ড কীভাবে এখনো চলতে পারে এবং কোন যুক্তিতে জেনেশুনে তা সহ্য করা হয়, জানি না। কীসে পরিত্রাণ? এতো হতাশ লাগে!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

বনবিবি এর ছবি

দারুন পোস্ট! সুবিনয় মুস্তফী, হাজার বছর ব্লগর ব্লগর কোরে যান!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।