এদেশে কিছু দৈনিক পত্রিকা আছে যেগুলো সকালে বেরোয় না, বরং বেরোয় বিকালে। ডাকা হয় ঈভ্নিং পেপার নামে, অফিসফেরত মানুষের দল ট্রেনে-বাসে পড়বে বলে - একঘেয়ে যাত্রার সময়টা কেটে যায়, আর দিনের বেলা কোথায় কি ঘটলো সেটাও জেনে নেওয়া হলো। কিছুদিন আগে পর্যন্ত একটাই বড় মাপের সান্ধ্য পেপার ছিল, নাম ঈভ্নিং স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু যুগটা প্রতিযোগিতার - তাই ঈভ্নিং স্ট্যান্ডার্ড-এরও প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেছে। নাম তার দ্যলন্ডনপেপার (সব একটানে, কোন স্পেস ছাড়াই!) এবং দ্যলন্ডনপেপার যখন প্রথম বেরোয়, তার মূল আকর্ষণ ছিল এই যে পত্রিকাটা সম্পূর্ণই ফ্রি। পুরাপুরি মাগনা বিতরন করে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাতাল রেলের স্টেশনের সামনে, অফিস পাড়ার ফুটপাথে, রাস্তা ঘাটে। পত্রিকার যা রেভিনিউ দরকার, তা আসবে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে। এখন লন্ডনের রাস্তায় একটা না, বরং দুইটা ফ্রি সান্ধ্য পেপার পাওয়া যাচ্ছে। লাভটা আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের।
কিন্তু লাভটা আরেক দলেরও। বিকাল বেলা যখন অফিসে দম কিছুটা হলেও বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে, তখন লিফটে চেপে নিচে চলে যাই, দোকান থেকে একটা ঠান্ডা কোক কিনতে, একটু সূর্যের আলো আর আকাশ দেখবো বলে, যদিও লন্ডনের আকাশ দেখা এই গ্রীষ্মের গরমেও পরম ভাগ্যের ব্যাপার, কারন শালার ২৪-ঘন্টা বিটকেলে মেঘলা আবহাওয়া। যাক গিয়ে, বিল্ডিং থেকে বের হলেই দেখি ঐ সময়, বিকাল সাড়ে তিনটা বা চারটার কথা বলছি, পেপারের ভ্যান পার্ক করা ফুটপাথের পাশে। ভ্যানের সামনে কটকটা বেগুনী রঙের জ্যাকেট পরা এক ঝাক ছেলেমেয়ে বাংলায় কিচির মিচির করছে, আড্ডা দিচ্ছে, বিড়ি ফুঁকছে। একটু পরেই পেপার বিলি শুরু হয়ে যাবে। প্রতি ঘন্টায় কম করে হলেও ৩০০-৪০০ পেপার বিলি করতে হবে, খুব সম্ভবত আরো বেশি। ঠিক পাঁচটায় যখন হাজার হাজার লোক অফিস-দালান-কোঠা থেকে বেরিয়ে পড়ে, তখন তাদের দেখি স্রোতের বিপরীতে যেমন মাছ সাঁতরায়, ঠিক তেমন মানবস্রোতের দিকে ঘুরে বাঁ হাতের কনুইয়ে এক গাদা পেপার নিয়ে দাঁড়িয়ে অনর্গল অন্য হাতে পেপার দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকেই সাধে, অনেকেই নেয়, আবার অনেকে নেয় না। একের পর এক পেপার হাত বদল হয়ে যায়, তড়িৎ গতিতে।
যে এলাকাটায় কাজ করি, লন্ডনের ঠিক মাঝখানে, সেই সেন্ট্রাল লন্ডনে এই পেপার বিলির কাজটা মোটামুটি পুরোটাই বাংলাদেশীরা দখল করে নিয়েছে। বেশীর ভাগই এখানে স্টুডেন্ট ভিসায় আছে, উপার্জনের আরেকটা পথ এটা তাদের জন্যে, কলেজের টাকা মেটানোর আর প্রতি মাসের খরচ তোলার আরেকটা ব্যবস্থা। বেশীর ভাগ ছাত্রদেরই কিছু না কিছু করে চলতে হচ্ছে, সেটা পেপার বিলি হোক, বা নানা রকম দোকানে কাজ করে হোক। বেতন বোধ করি আইনত যেটা মিনিমাম ওয়েজ সেটাই, ঘন্টায় ৫-৬ পাউন্ড। এদের অনেকে শুধু নামেই ছাত্র এখন, পড়াশোনার থেকে মনোযোগ উঠে গিয়ে টাকাপয়সা রুজি-রোজগারের দিকেই বেশি চলে গেছে। অবশ্য দেশে কার সংসারের কি প্রয়োজন সেটা তো তারাই সবচেয়ে ভালো জানে। আলালের ঘরের দুলালও আছে কিছু এ শহরে, গুলশান-বনানীর বড়লোকের ছাওয়াল তারা, কোন কাজ-বাজ করার প্রয়োজন তাদের পড়ে না। দেশ থেকে আসে টাকা, অনেকে সুন্দর গাড়ী হাঁকায়, দামী ফ্ল্যাটে থাকে। এখানেও বিভেদ!
প্রায়দিনই পেপারটা হাত বাড়িয়ে নেই। কিন্তু আমিও বাড়িমুখী, তারাও প্রচন্ড ব্যস্ত, তাই একটু দাঁড়িয়ে আড্ডা মারবো সেটা সম্ভব হয় না। তার পরেও দু'দিন আগে একজনের সাথে সুযোগ হয়ে গিয়েছিল, যখন বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়েছিলাম। সে দিয়ে যাচ্ছে পেপার দেদারসে, আর আমার সাথে টুকিটাকি আলাপ চালাচ্ছে। এখানে কোন এক ছোটখাটো কলেজে এম্বিএ করছে। বল্লো সামনের মাসে তার বাড়ি যাওয়ার প্ল্যান - তার মা নাকি দেশে তার জন্যে মেয়ে ঠিক করে রেখেছে, বিয়ে দেবে বলে। ছেলেটা আমাকে বল্লো, মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছে। বিদেশ নিয়ে রঙ্গীন ফানুস স্বপ্ন যদি থেকে থাকে, ছেলেটা সেই স্বপ্ন আগে-ভাগেই গুড়িয়ে দিতে চায়, বলে দিয়েছে তার তেমন টাকা পয়সা নেই, সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেপার বিলি করে। তা জেনে শুনে যদি বিয়ে করতে রাজি থাকে, তাইলেই পোষাবে।
আমার বাস চলে এলো। বাড়ি চল্লাম আমি। সাত বছরের প্রবাসী জীবনে ছোট বড় অনেক রকম কাজই করার সুযোগ অথবা ভাগ্য হয়েছিলো। কঠিন সেই সময়ের কথা ভাবি যখন এইসব ছেলে-মেয়েদের দেখি। তারা বেশির ভাগই আমার থেকে কয়েক বছরের ছোটই হবে। হয়তোবা এদেরও ভাগ্যের শিকে একদিন ছিড়ে যাবে, যেমন আমারটা দৈবাত ছিড়ে গিয়েছিলো পাঁচটি শহর, তিনটি দেশ, আর দুটো মহাদেশে থাকবার পরে। কিন্তু সে আরেক কাহিনী।
মন্তব্য
বেড়াল নই, বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরও নই, আর এ-ও কোন রসিকতা নয়
কিন্তু সুবিনয় মুস্তফী, এই লেখাটার মাঝে একটা কিছু আছে নিশ্চয়!
ভালো লাগলো। এমন ঝরঝরে লেখা চাই আরো।
হাঁটুপানির জলদস্যু
লেখা পড়ে ভালো লাগলো।
বেশ ভাল লাগলো পড়ে।
ভাল লাগল। আরো লেখা চাই।
.................
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা
প্রকৃতিপ্রেমিকের দেয়া উদ্ধৃতিটুকু আমারো দিতে ইচ্ছে করছে।
খুব ভাল্লাগলো। কাছ দিয়ে ছুঁয়ে গেল সব শব্দ, রেখে গেলো অন্যরকম আবেশ।
গল্পেরা সব এইরকম। পট আর চরিত্রগুলো আলাদা।
আপনার কাছে আরো লেখা আশা করি।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
আমার বাড়িতে আছে একজন প্রতিদিন পেপার দেয়। উইকডেগুলোতে লন্ডন লাইট, উইকেন্ডে স্পোর্ট আর লুট, এভাবেই টিকে আছে
আচ্ছা?? কোথায় শিফ্ট? সেন্ট্রালে?
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
শুনতে চাই
সবাইকে মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। গল্প এত জমেছে, যে জীবনটাই মস্ত এক গল্প হয়ে গিয়েছে! সচলে আরো লেখার আশা রইলো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
খুব ভাল লাগলো, আবার খারাপও
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন। জীবন থেকে নেওয়া এ রকম সত্যি গল্প আরো চাই।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
এখানেও সব পত্রিকাই ফ্রি দেয় কিন্তু পড়ার কোন জো নেই। লেখা খুব ভালো লেগেছে।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
ভালো লাগলো বর্ণনা।
পেপার বিলির চেয়ে ভিজ্যুয়ালি ক্লাসিক হলো পিঠে বড় প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে পোস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। (যেমন গলফ সেল)।
কোনো কাজকেই ছোট মনে হয় না এখন আর। তা ছাড়া টেম্প জবগুলো যদি মাথা না খাটানোর হয় তবে আরাম লাগে।
অবশ্য আমাকে যদি এ কাজ করতে বলা হয়, তাহলে আমি কখনোই করবো না। শরীরের শ্রম বেচার চেয়ে সহজ উপায়েই আয়ের পথ চিনি বলে।
কেউ চিরকাল এসব পেশায় থাকে না। সিঁড়ি পেয়ে যায়।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
পড়লাম দেরিতে, মন্তব্য যা করার সবাই করে দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন, পরের লেখাটি কবে আসছে?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন