গোর্কি বলতে বাঙ্গালী সচরাচর দুটো জিনিস বুঝে থাকে:
১) ১৯৭০-এর সেই ভয়াল সাইক্লোন যাতে অগুনতি মানুষ মারা যায়, এবং
২) মহান রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি, যার 'মা' নামক উপন্যাসটি বাংলাদেশের পাঠক সমাজের কাছে সুপরিচিত। রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের কারনে আমাদের লাভ-ক্ষতি আরা যাই হয়ে থাকুক না কেন, যারা বইয়ের পোকা তাদের বিশেষ লাভ হয়েছিল। রেভোল্যুশন রপ্তানীতে উদ্গ্রীব সোভিয়েতরা তৃতীয় বিশ্বকে ভাসিয়ে দিয়েছিলো তাদের মহৎ সাহিত্যকর্ম দিয়ে। এমন পাঠক কমই আছেন বাংলাদেশে, যিনি মস্কোর রাদুগা প্রকাশন বা প্রগতি প্রকাশন কর্তৃক মুদ্রিত একটা বা দুটো রাশিয়ান বই বাংলা তর্জমায় পড়েননি। এবং এ জাতীয় বইয়ের মধ্যে গোর্কির 'মা' উপন্যাসটি নিশ্চয়ই অল-টাইম গ্রেটেস্ট হিট্স-এর তালিকায় স্থান পাবে!
তবে পশ্চিমে গোর্কি বেশী পরিচিত তার তিন খন্ডের আত্মজীবনীর জন্যে। আট বছর বয়সে এতিম, ১১ বছর বয়সে ঘরছাড়া বালক আলেক্সি পেশ্কভ্ এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় যে সে তার বিশাল দেশটি ঘুরে বেড়াবে, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আধুনিকতা, শিল্পায়ন, নগরায়ন ইত্যাদির চাপে অনাদিকালের রুশ সমাজে যে আমূল পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন পেশ্কভ্। ২৫ বছর বয়সে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এক ছোট গল্পের মাধ্যমে, ছদ্মনাম বেছে নেন 'গোর্কি' - রুশ ভাষায় তার অর্থ 'তিক্ত'! ১৯১৭-র বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেন, এবং পরে কমিউনিস্টরা তার লেখাকে নিজেদের প্রচার-প্রপাগান্ডা কাজে ব্যবহার করলেও বস্তুত তাদের সাথে গোর্কির সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর।
*
সে যাই হোক, গোর্কির আরেকটা পরিচয় আছে সফল নাট্যকার হিসেবে, যে বিষয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলাম অজ্ঞ। কিন্তু লন্ডনে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে গোর্কির দুটো নাটক মঞ্চায়িত হলো এবং দুটিই দেখার সৌভাগ্য হলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের দুটি নাটক এবং দেখলামও সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিবেশে! প্রথম নাটক 'The Lower Depths' যা জারের আমলের রুশ সমাজের একদম নিম্নাতিনিম্ন স্তরের বাসিন্দাদের নিয়ে রচিত। পটভুমি কোন এক অজ্ঞাত নগরীর একটি মেস-কাম-লঙ্গরখানা, সেখানে থাকে এক বিচিত্র, বীভৎস, দীনহীন মানবসমাজ। পতিতা, মদ্যপ, ঠগবাজ, অসফল শিল্পী, এদের নিয়ে সেই কাহিনী দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে পশ্চিম লন্ডনের এক অতিক্ষুদ্র থিয়েটারে, নাম ফিনবারা (Finborough)। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। এক বিল্ডিং-এর দোতলায় বড় একটা রুম নিয়ে মঞ্চ। নিচেরতলায় পাব অথবা বার, দোতলায় নাটক! ঠাসাঠাসি করে বড়জোর ৪০ জন দর্শক বসানো হয়েছে। এতই অল্প জায়গা যে আমি বসেছিলাম সামনের সারিতে, এবং প্রায়ই অভিনেতাদের কোট বা গাউন আমার হাটুতে স্পর্শ করে যাচ্ছিলো। নাটকটা ভাল ছিল, কিন্তু একটু বেশি ডিপ্রেসিং।
লন্ডনের বৃষ্টি ঠেলে গতকাল দেখে এলাম আরেকটি নাটক, Philistines যেটির ভাবানুবাদ হতে পারে 'শিক্ষা-সংস্কৃতি বিবর্জিত বর্বরেরা'। এটি গোর্কির রচিত প্রথম নাটক, ১৯০২ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম মঞ্চায়িত। গল্পটা এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে। পরিবারের মাথা এক সফল কিন্তু অল্পশিক্ষিত ব্যবসায়ী ভাসিলি, সে প্রচন্ড লোভী ও কৃপণ, সারাজীবন শুধু টাকাই গুনে গেছে, এমনকি তার ঘরের দোতলায় পার্টিশান দিয়ে সে একগাদা রুম বানিয়ে ফেলেছে লজিং দেবার নিমিত্তে। প্রচন্ড বদমেজাজী এবং তার দুই সন্তানের প্রতি অত্যাচারী, স্বৈরাচারী। (পুরো নাটকটাই ভাসিলি চরিত্রে অভিনেতা বেচারাকে ঘেউ-ঘেউ অথবা চিৎকার করতে হলো।) তার ছেলে পিটার ক্যাম্পাসে জারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মিছিলে অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়ে বাড়িতে বসে ভেরেন্ডা ভাজছে, আর তার মেয়ে তানিয়া, স্কুল শিক্ষিকা, বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে না হওয়াতে ভয়ানক বিষন্নতা ও তিক্ততায় ভুগছে।
এদের বিপরীতে ভাসিলির পালক ছেলে নীল, সে নতুন দিনের কান্ডারী, সে কারখানায় মজুরে, লোহালক্কর নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে, তরতর করে কাজে সে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যত নিয়ে প্রচন্ড আশাবাদী, ভাসিলির বাড়িতেই কাজ করে যে পোলিয়া নামের মেয়েটি, তাকে ভালোবাসে আর ভালোবাসে জীবনকে। এই চরিত্রগুলোর সংঘাত-ভালোবাসা নিয়েই নাটকের কাহিনী। নাটকের কমিক চরিত্র এক মধ্যবয়স্ক মদ্যপায়ী লজার, সে পুরো নাটকটাই দর্শকদের হাসিয়ে মাতালো। সেই চরিত্রে অভিনয় করলেন আইরিশ অভিনেতা কন্লেথ্ হিল, এ দেশের থিয়েটারের শক্তিমান অভিনেতা। তার অভিনয় আগেও দেখেছি একবার, এক কথায় অসামান্য তার শৈলী। আর আগেরবার যেমন ছোট্ট ঘরে ৪০ জনের সাথে নাটক দেখেছিলাম, তারই বিপরীতে গতকালের নাটক দেখলাম হাজার লোকের সাথে, টেম্স্ নদীর পারে অবস্থিত বিশাল ন্যাশনাল থিয়েটার কম্পলেক্সে। একই বিল্ডিং-এর ভিতরেই সেখানে তিনটে বিরাট মঞ্চ। লন্ডনে যারা থাকেন বা বেড়াতে আসেন তাদের সব সময় রিকমেন্ড করি একবার যেন দেখে আসেন সেটা! বরাবরি খুব ধারালো, উচ্চমানের নাটক তারা পরিবেশন করে, সেখানের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেক সময় লিখবো।
মন্তব্য
পড়ে ভাল লাগলো।... সেই শৈশব থেকে গোর্কির লেখার গুনমুগ্ধ পাঠক। তার 'মা' উপন্যাস নিয়ে করা নাটকও দেখেছি। এই নাটকটি বাংলায় পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখতে হবে তো! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
পড়লাম। দেখতে হবে কোন সময়।
গোর্কির নাট্যকার পরিচয় আসলেই জানা ছিলো না। ধন্যবাদ চমৎকার লেখাটির জন্যে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
রাশিয়ান বইগুলো সত্যি খুব কাজের ছিল ...
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
নতুন মন্তব্য করুন